সমস্ত সন্ধ্যার শেষে



















                সমস্ত সন্ধ্যার শেষে

                তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়















Samastha Sandhyar Sheshe
A Collection of Bengali Poems
By Tamal Bandyopadhyay
Rs. 20/-

কপিরাইটঃ লেখক
প্রথম প্রকাশ: কলকাতা বইমেলা- ২০০৩ (ফসিল)
দ্বিতীয় প্রকাশ: কলকাতা বইমেলা/ জানুয়ারি, ২০১৫ (অচেনা যাত্রী)
প্রথম অনলাইন সংস্করণ: শ্রাবণ, ১৪২১ (আগস্ট,২০১৪)
দ্বিতীয় অনলাইন সংস্করণ: চৈত্র, ১৪২১ (মার্চ,২০১৫) 
প্রকাশকঃ ‘অচেনা যাত্রী’র পক্ষে সুমনা বৈরাগী বিশ্বাস, ‘অখিল-স্মৃতি’ গ্রন্থাগার, নিত্যানন্দ মনোরমা ভবন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সরণি, সুভাষনগর, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিনকোড-৭৪৩২৩৫
ইমেলঃ achenayatri@gmail.com
ওয়েবসাইটঃ www.achenayatri.blogspot.in
মুঠোফোনঃ +৯১  ৮১৫৯০৯৩৭১০
প্রচ্ছদঃ তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় ( দ্বিতীয় প্রকাশে)  
বর্ণস্থাপন: কুমারেশ পাত্র ও রুপাই পান্তি
মুদ্রণেঃ সীমান্ত বাংলা প্রেস, রবীন্দ্র পার্ক, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা (দ্বিতীয় প্রকাশে)  

মূল্যঃ কুড়ি টাকা 






















                                   উৎসর্গ


                                বাবা ও মা- কে












ছবিঃ পার্থপ্রতীম সেনগুপ্ত









ভঙ্গুর বিবাহ ফেলে সে এক হারানো অপরাধ
সতর্ক-প্রবণ দিনে রেখে গেল ইচ্ছে অপবাদ

আর এক অবনত দলছুট হাসি স্মৃতি মেঘে
আদর অগ্রাহ্য করে ধেয়ে এল নক্ষত্রের বেগে

আর এই কেঁপে ওঠা যোগিনীর পান্ডুরাঙা হাত
হাতে হাত চোখে চোখ...অস্ত্রময় বারুদের রাত
লিখেছে ফুলের ঠোঁটে হিজিবিজি অক্ষরের ক্রোধ
ছটফটে পতঙ্গ থেকে কু-সন্ধানী এই মৃত্যুবোধ

চাউনি বাড়িয়ে দেয়.....তৃণ থেকে  বাণ খসে পড়ে
লাঙল গৃহস্থ,তবু পরবাসী চাঁদ অস্ত্রাগারে

যায় সে জ্যোৎস্না ছুঁয়ে ...টুপটুপ লাভা নদী এবং বমন
মোহনা উপেক্ষা করে নীলকন্ঠ অনিচ্ছুক অস্ত্র সমর্পণ














এই নাও আমাদের হৃদয় -স্পন্দন শেষে তুলে রাখা
রঙিন চুড়ির মতো রক্তের চুম্বন আর লাঙলের স্পর্ধা

আমি পাখির দেহ থেকে প্রতিটি পালক হাতড়ে  হাতড়ে
দেহের  উত্তাপ সহ মৃতফুল,শাসনের একটি কিনারে
রেখে বেরিয়েছি আজ,আমৃত্যু সমুদ্র আর ডিঙির উজান
পিছনে সরিয়ে ফেলে দাঁড়িয়েছি স্নানেরই কারণে

অস্ত্রগৃহে বিষজ্বালা;স্রোতের সুঠাম শিশু খরজন্মে
গাছের প্রতিটি পাতা,ছাল,বাকল,শিকড়ে লিখে যাবে
লিখে যাবে আমাদের বুকের গভীর শুষে,কেড়ে নেওয়া
ফসলের রক্তমাংস,অক্ষিপটে ঐ অবাধ্য দৃশ্যের সম্ভ্রম

সে উলঙ্গ শিশু আজ শত শত মৃতদেহ বয়ে যাবে
স্মৃতির বারুদ গৃহে সসম্ভ্রমে লিখে নেবে আগুন চুম্বন

এই নাও ঐ শিশুটির  স্মৃতির বারুদে আর অস্ফুট অক্ষিপটে
লিখে দাও,লিখে দাও এই অস্ত্রের পালক এবং
দু'হাতের রোমকূপ,হৃদয় হাতড়ে,খুঁড়ে, এঁকে দাও
ওর লাঙলের স্পর্ধা,ফুসফুসে গেঁথে নেয়া ওরই ভাবীকাল

১২/৯/২০০০









পথসীমা মুছে  গেছে,নদীপথে ,মেঘপুঞ্জে জমেছে আগুন
আরোপিত স্নেহ থেকে শুষ্ক ডালে অপেক্ষায় যে পাখির চঞ্চু
ক্রমে লীন হয়ে আসে, ওর নীল পালকের ভাঁজে আজ
গুঁজে দেব মেঘপুঞ্জে রাতজাগা কম্পমান শাসনের ডাক

আমাদেরই সূর্যাস্তে , আজ ধ্বসে যাক  সব বিষের চাবুক
সুগন্ধী বারুদ ফুলে ,সঞ্চিত ঈর্ষার ডাক অচেনা পথের
সীমানা হাতড়ে আর লাঠি বন্দুকের ভারে মিলে যাক
আমরা চাই না এই রক্তময় বারুদের খেলা

এ খেলার শেষ কবে?শেষ কবে বন্দুকের ডানা ছেঁড়া গান?
পথসীমা মুছে নেয়া নদীপথে
আর কবে ডিঙি নৌকার উজান বইবে
আর সুগন্ধী রাতের কানে-কানে লিখে দেবে পাখির গুঞ্জন?

আরোপিত স্নেহ নিয়ে বসে আছি মেঘপুঞ্জ জমছে যেখানে,
পথসীমা মুছে গেছে খেলার আদেশ এবং শাসনে;আজ
সামাজিক ভয়,আর বারুদফুলের লোভ হেলায় সরিয়ে রেখে আমাদের
ফিরিয়ে দিতেই হবে অপেক্ষমান পাখির ফসলের অধিকার...

১৪/৯/২০০০











কতরাত কেটে গেছে মৃত ফসলের খোঁজে

আজ রক্তবৃষ্টি দিনআমাদের দুই চোখ ভরা
মাটি-মার রাঙাবুক,দেহময় ধমনীর শুদ্ধ-রক্তের
প্রতিটি বিন্দুতে মিশে ডুবে আছে ফসলের ,বেদনার গান
আমাদের করোটির সুগভীরে এই গান,বটের ঝুরির মতো
ডালপালা পত্রেপুষ্পে বিষময় ব্যথিত রয়েছে

অন্ধরাত সন্তর্পণে  জ্যোৎস্নার কোষে কোষে মিশিয়েছে
ঘৃণার বারুদ,আর মা-এর গভীর থেকে জল শুষে,
শিকড়ের শূন্য বুকে জাইলেম ও ফ্লোয়েম কলার দেহে
আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে  বৃষ্টিজল ধুয়েছে পরাগ

মৃত-ফসলের খোঁজে অস্ত্রসহ চেনা-মুখসব স্মৃতি বিষ্ফোরণে
ধুয়ে গেছে অকাতরে....আমাদের কালো এই কাপড়ের
প্রতিটি বুননে লেখা,লেখা আছে ফসলের নাম,
মৃত মা'র ধমনীর শুদ্ধরক্ত ভিজে যাওয়া বীজজন্ম এই...

১৮/৯/২০০০






আদিম সূর্যোদয়ের লোভে আমরা বসেছি এখানে,
হৃদয়ের সব ধ্বনি, হাতের সমস্থ চুড়ি স্তব্ধ করে বসে আছি
অস্ত্রাগার প্রহরায় সমুদ্রময় তুফান আর উজান হাতড়ে
আমরাই সামলেছি স্নানের আমৃত্যু ডাক...

আজ পিছু ডাকবো না,যদিও বুকের মধ্যে বেজে যাক
নীড় ভাঙা চঞ্চুহীন ত্রস্ত পাখির ক্ষুধিত আক্ষেপ...

জানি আজ ব্যর্থ রাত,শরীরের সব ক্ষুধা  হেলায় সরিয়ে
শাসনের সব বাঁধা, রক্তচক্ষু বনান্তরে বামপাশে ঠেলে
হারানো লাঙল কিংবা ফসলের প্রার্থনায় ভারি হবে,
পাখির কুজনে,গানে,প্রতি পালকের স্পর্শে মুছে দেবে ঘুম...
যে ঘুম করোটি ,নাভি,আর স্মৃতির বারুদে নেশাখোর
উন্মাদের মতো আঁকে,গেঁথে দেয় পরাজয়,গ্লানির চুম্বন...

সাজিয়েছি জয়টিকা, পিছু থেকে ডাকবো না আজ,

সযত্নে লালিত এই শিউলিরা ঝরে যেতে পারে ঝড়ের আঘাতে

আমাদের চাই শুধু আমৃত্যু  শান্তির ঘুম,ফসলের তপ্ত মাঠ,কেননা
এতদিন সামলেছি ঋতুময়-স্নানের আদিম লোভ...

২০/৯/২০০০











বারুদ বেধেছি আজ,তরবারী বুকের ভেতরে,
আগুনের ক্ষিপ্রজিভ, আচমকা তিরস্কৃত সকাল ডেকেছে...
আমাদের ক্ষুদ্ধ পথ, ছত্রাকের নীচজন্ম, বুকভরতি অভিমানে
পাঠ্যবই বহির্ভূত শিক্ষার অনন্যোপায় পৃষ্ঠায়
লেগেছে কাজল, আর,পেশী  ঈর্ষার উচ্ছ্বল সুর

শূন্যগ্রামে ক্লান্তিহীন মৃত্যুর পরাগ শুষে ক্ষুধিত চোখের
অন্ধকার কোণে বেজে চলে দিগ্বিজয়ী অস্ত্রের
অবিরাম ঝনঝন,দর্পিত অশ্বের ক্রুদ্ধ হাঁটা-চলা...

অন্ধগ্রামে ,দশদিকে, সন্ধ্যার প্রতিটি কোষে ,সূর্যের অযুত কোটি
অনু-রশ্মির নির্বাক, একত্রিত ফিরে চাওয়া বিম্বিত হয়,
পেশীর গভীর থেকে যত লোভ শুষে নিয়ে প্রতি ডালে অন্ধ-ত্যেজ
ঢেলে দেয় বিষজালা, অস্ত্রাগারে পক্ষির প্রহরা-

বারুদ জমেছে বুকে,আরোপিত সব ঈর্ষা অক্ষিপটে
হলকর্ষণে তুলেছে যুদ্ধের দামামা,আর অতর্কিতে একদিন
আমাদের স্তব্ধ পথে অস্ত্রের ঝংকার তুলে অস্ত্রাগারে পুড়িয়েছে
পাঠ্যবই অন্তর্গত অনন্যোপায় শিক্ষার দিনরাত

৯/১০/২০০০




কবি গৌতম বসু'র একটি চিঠির অংশকেই ব্যবহার করলাম ব্যাককভার হিসাবে। 




সমস্ত সন্ধ্যার শেষে কক্ষ্যচুত গ্রহদের মতো
স্রোতহীন নদীপ্রান্তে ভেসে আসছে নক্ষত্রের আলো
সহসা চলার আগে যে ভাবে ক্ষয়িষ্ণু পথ কার যেন
আদিম চোখের কোণে লেগে থাকা আগুনের স্তূপ দেখে বার বার
স্তব্ধ হতে থাকে,আজ মৃত্যু-মুখর গানের সঞ্চারী-সুর
স্মৃতির উন্মাদ কোণে সেই বেগে এঁকে দিচ্ছে আরোগ্যের ক্ষত

আমাকে পালাতে দেখে রঙিন আলোর কাছে হাতে হাত
সহসা দাঁড়াল যারা,ওরাই তো আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে
কুমারী মায়ের বুকে এঁকে ছিল বিষভরা দাঁতের কোলাজ—
আমার মায়ের বুকে সেই ক্ষত আজও কেন শুকায়নি
নক্ষত্র আলোয় এসে,আমি সব পরিষ্কার বুঝি

ওদের কঠিন হাতে রক্তের দুর্গন্ধভরা ফসলের জমি-
ধারালো অস্ত্রের বাঁকে ক্রমচলমান নদী
সমস্ত স্রোত হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে আসে; এবং কক্ষচ্যুত
গ্রহের হাজার খন্ড আমাদের প্রহরার পাশে এসে পড়ে...
আর অস্ত্রাগার থেকে ওদের দর্পিত ছুটে আসা...
রঙিন আলোর পাশে হাতে হাত সশস্ত্র দাঁড়ানো
পঁচিশ বছর আগে  মায়ের গর্ভ থেকে আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই

২৫/১/২০০১





ছবিঃ সৌরদীপ্ত চৌধুরী, চিত্রপরিচালক




এই তো আঁধার হল,নিভে এল সব বিষ-ক্ষুধা....
করোটির বিষপাত্রে,অবাধ্য শরীর-কোষে বীজের জন্ম শেষে
কার যেন অতর্কিত আক্রান্ত স্পন্দন দেখে জমা হল
ঈর্ষার উন্মাদ ডাক-আমরা সহসা কোনও প্ররোচনা হেতু
পালক সম্বল হাতে ফসলের সোঁদা-গন্ধ মুছে
খেলার শাসন ভুলে দাঁড়ালাম অস্ত্রাগারে,
সুগন্ধী রাতের বুকে লিখলাম অবিশ্বাস্য বারুদের ক্ষুধা

একদা লাঙল কাঁধে পথ চলা কৃষকের পায়ে কোনও এক
রঙিন স্বপ্নের ঘোর প্রতিরাত্রে বাসা বাঁধে আজ--
লাঙল সরিয়ে রেখে স্মৃতি বিষ্ফোরণ হেতু রক্তাক্ত পথে
বারবার ফিরে আসে লাঠি-বন্দুকের ডাক এবং প্রত্যেক পাখি
নীড় হারাবার ভয়ে প্রখর নদীর স্রোতে ঝাঁপ দেয়
আর যত অন্ধরাত, নষ্ট ফসলের ডাকে ক্ষতময় পথ ধরে...
সব অস্পৃশ্যতা যেন অস্ত্রের অবাধ্য ডাকে ভুলে যায় নবান্নের ঘ্রাণ

২৭/১/২০০১







নিশুতি রাতের ঠোঁটে অবিশ্বাস্য বেজে উঠছে বারুদের গান
আমরা স্নানের শেষে প্রলম্বিত বেণী পার্শ্বে কড়ি ও কোমলের
সব তাপ ভুলে নেমেছি বিরুদ্ধ সংগ্রামে

পুতুল খেলার শেষে ইচ্ছার বিরুদ্ধ পাখি কার যেন
নিরুপায় রক্তচক্ষু মুছে রেখে সব নীল রাত্রি থেকে
ফুলের রেণুর মতো শুষে নেয় সসম্ভ্রম মাতাল প্রলাপ আর
যুদ্ধ প্রস্তুতির পথে অতর্কিত  স্নেহ-ভেজা ডাকে,
রক্তময় নীলকণ্ঠে ফিরে আসে ঘৃণা ভেজা উত্তপ্ত  পঞ্চম

তখন দীঘির কাছে নিখোঁজ যুবক দেহ আর দেহ টানাটানি খেলা
সীমাহীন বক্তৃতার অসহ্য আদেশে আর মতামত ভারে জেগে থাকে
তঞ্চিত রক্তের দাগ হলুদ বসন্ত ভুলে পুনর্বার যেন জেগে ওঠে-
হারানো অস্ত্রের কোনও স্বরহীন স্বরলিপি,
অন্য এক ভূমিষ্ঠ শিশুর নিরুদ্বেগ অক্ষিকোণে বলে দেয়
যুদ্ধের প্রস্তুতি রাত.....নিশুতি ফুলের ঠোঁটে ফুটে ওঠা  বারুদ প্রলাপ

৩০/১/২০০১







বনপ্রান্তে উচ্চারিত  বিবর্ণ নৌকার ক্রম  অবিমিশ্র  ঘুম আর
উন্মাদ প্রকাশ লোভ সযত্নে সরিয়ে রেখে
এই তো দাঁড়িয়ে আছি অস্ত্রের আবেগে

বিষময় রাত্রিশেষে ভোরাই আলোর ডাকে যেভাবে  বৃন্তহীন
গোলাপের দেহে আর রক্তাপ্লুত পতঙ্গের ঠোঁটে পুনর্বার বেজে ওঠে
সৃষ্টির আদিম সুর; হলকর্ষণের পর উপ্ত বীজের সহস্র-ক্ষত
অপার্থিব আলোকের নিরুচ্চার আবেগের মাঝে রেখে আজ
আমরাও উঠলাম দৃপ্ত এক হাসির স্পন্দনে

সে হাসি সহজলভ্য সে দর্পের রামধনু রঙ
উজান হারানো নদী ...সীমাহীন পথ ভুলে সামাজিক
সমস্থ ঈর্ষার শেষে  বারংবার ফিরে এল অচিন অপ্সরা গ্রামেআর
ছটফটে শিশুদের লুকোচুরি খেলা অবসন্ন উপত্যকা ধরে
মিশে গেল মাংসাশী-পশুদের মুখে- 

সে মুখ ভোলার আগে অন্ধকারে আরো এক রক্তচক্ষু,
দর্পিত ক্রুদ্ধ শাসন সম্মোহিত করে আর পালক-অধিক বেগে আগুনের
ক্ষিপ্র জিভে আচমকা নেমে আসে ফসলের গোপন সন্ত্রাস
আর সে ভোরাই সুর......সাতরঙা রামধনু হাসি গ্রাস করে উপত্যকা গ্রাম,
আমাদের ক্ষুদ্ধ পথে,অস্ত্রাগারে,অক্ষিপটে লিখে দেয়
প্রকাশের লুকোচুরি…বিবরণ নৌকার এক তৃপ্তিমান ঘুম

৪/২/২০০১






১০

অপেক্ষা রসিক এক দামাল প্লাবন তার রক্তচোখে
সীমান্ত সাধিত পথে প্রত্যেক আলোর কাছে বসিয়েছে তড়িৎ প্রহরা
আমরা  ঘুমের কাছে, নীড়-ভাঙা তৃষাতুর পাখির পালকে,
নদীপথে এঁকে রাখছি  ক্রুদ্ধ এক হায়নার বিষাক্ত ক্ষত

শতেক জন্মের আগে বিস্মৃত সমস্ত স্বর আজ
অথর্ব লাঙল মুখে তীর্থ-ভ্রমণের শেষে গেয়ে ওঠা পরাজয় গীতি হয়ে
জল-ওষ্ঠ মধ্যবর্তী দর্পণের রতিবিম্বে ফুটে ওঠে ...
পথের জটিল বাঁকে ভুলে যাওয়া প্রিয়জন,হারানো বোনের ঠোঁটে
জেগে ওঠা বিষ-নখ....সুঠাম উলঙ্গ শিশু...রঙিন আলোর পাশে
জ্বালাময়ী ভাষণের আর রাত্রি-পাগল সেই
ট্রাক্টরের চুপচাপ অভিনব হত্যা গোপন...
হৃদয় প্রকোষ্ঠ থেকে ডেকে দেয় প্লাবনের দীর্ঘ উপচ্ছায়া

সে প্লাবন  নির্বিকার নীড়-ভাঙা পাখিদের ঠোঁটে ডেকে দেয় বান...আর
অস্ত্রাগারে,মধ্যরাতে ট্রাক্টরের ক্রুদ্ধ ঠোঁটে মুছে দেয় সব হত্যার দাগ

২৬/২/২০০১





'ফসিল' থেকে প্রকাশের সময় বইটির প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদ শিল্পী- শংকর মণ্ডল। 




১১

স্বজন হারানো এক দাহ্য অনুভব আজও স্বপ্নের ঘোর-এ
নবান্ন ঘ্রাণের লোভে মেতে ওঠে করোটির বিষ গ্রন্থি থেকে
দশদিকে ইতস্তত লাঙল-বিহীন চাষী আর ভয়ানক শীত
মন্থর তরঙ্গ ছুঁয়ে নেমে আসছে উপত্যকা-গ্রামে

রঙিন পাখির ডাকে উড়তে,ভাসতে থাকা হলুদাভ পাতা
যে এক সনাক্তকারী যুবকের দেহ থেকে
সমস্ত রক্তের কণা গ্রাস করে নেয়...আর লৌকিক তদন্ত শেষে
সন্তান হারানো মা'র দুগ্ধহীন শুষ্ক বুকে এঁকে দেয়
লাঙলের ভুল চাষ; সে শুধু বসন্ত শেষে
পরিধি-কেন্দ্র ছিঁড়ে ভেসে আসা সুপ্ত অপবাদ

অপেক্ষা-প্রবণ এক দাহ্য অনুভব আর ফেলে আসা
ভুল জাতক-কথন....দর্পিত পদাঙ্ক থেকে আজ প্রতিটি
সবুজাভ  গাছে গাছে লেপে দিচ্ছে বিকালের আলোআর
শীতল শিশির ছুঁয়ে অনাগত নবান্নের বাঁকে,
জমে থাকা নীল ঠোঁটে, উপত্যকা গ্রামে
বেজে উঠছে মৃদু শিস...রক্ত-চুম্বনের ঢেউ...
স্বজন হারানো এক দাহ্য অপবাদ

৯/৩/২০০১






১২
স্বজন হারানো পাখি সহসা ভুলেছে তার চঞ্চুভরা ক্ষত
দশদিকে  ইতস্তত গোধূলি-অনীহা বশে সৈনিকের অস্ত্র সমর্পণ
উড়িয়েছে পারাবত--মঞ্জির গোপনে বেঁধে
মার্জনা, রটনা মতে ভুলিয়েছে স্রোত-বক্ষে সুঠাম শিশুর সব দূর-ব্যবধান

পক্ষি-প্রহরার পর আমাকে   নর্তকী ভেবে উত্থিত গরল হত্যা
গন্ডুসে পানের পর সে কোন শতাব্দীহারা নীলকন্ঠ, আজ জন্তুর
হৈ হৈ রব শুনে সব পাতার আড়ালে যেন লিখে গেল বিভাব-বারুদ

এই তো অপেক্ষা শেষে বিশল্যকরণী হাতে দাঁড়িয়েছি স্নানের কারণে
করটির সুপ্ত কোণে লাঙলের সব মৃদু মন্ত্রোচ্চার
ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সমস্ত বাতাসে আজ ছেয়ে আছে
রক্তচোষা কোনো এক বারুদের অবৈধ উল্লাস

থেমে যাক বারুদের...অস্ত্রের  এ সব সৌরভ, আমরা
হারানো ফসল লোভে লাঙল সরিয়ে  হাতে তুলে নেওয়া
অস্ত্রের  রক্তাক্ত ক্ষত বিশল্যকরণী মেখে ধুয়ে নেব ঠিক...
ভুলে যাব ফসলের....রাত্রির লাঙলহীন সব অজুহাত আর আত্মসমর্পণ
তুলে দেব সুপ্ত কোণে স্বপ্নের সব ছিটকিনি

স্মৃতির বারুদ গৃহে যে স্বপ্ন লিখে দেবে সব
অভিনব হত্যা-গোপন...ছিন্ন বসন ত্যাগের পর নিদারুণ ক্ষোভে
জ্বলে ওঠা ভলক্যানো এলোমেলো উড়ে যাবে ...আর অস্ত্রাগারে
বারবার লিখে দেবে  রৌদ্র-বারুদের শেষে নিরুপায় আত্মহত্যা লোভ

১৭/৩/২০০১





১৩

অস্থির, তবু বুঝেছি তোমার রাগ
ভেসে ভেসে যায় রক্তের  মান্দাসে
রক্ত? হোক না! চাষাভুষোদের, তাই
 শাসক, তোমার এতে কী বা যায় আসে?

কী বা যায় আসে যারা ফিরল না ঘরে
যাদের কখনও ফেরাই হল না আর...
তুমি মানলে না, এই আমাদের ঘুম,
অস্তিত্বের নশ্বর ব্যবহার  
১৬/৩/২০০৭





 ১৪

দেখেছ সে-সব অভিমান খুঁড়ে খুঁড়ে
মৃত মানুষের অস্নাত সব আলো?
লিখছে অতীত পাখি ওড়ানোর শেষে
ধানক্ষেতে কার রোদ্দুর চমকালো?

          চমকে উঠছে মিথের সীমারেখা
          ঝুঁকে পড়া গ্রামে বহিরাগতের হাসি
          চাপা পড়ে গেছে আধমরা যত ছেলে
          আমরা কবিতা সেখানেই রেখে আসি

কেননা যা কিছু চাপা পড়ে আছে... দূর...
কঙ্কালে লেখা ফসলের নীরবতা
আমি যা পারিনি... ওরা তো সঠিক জানে
জমি দখলের যেটুকু সত্যি কথা...


১৮/৩/২০০৭ 








১৫

সাজিয়ে রেখেছ ক্ষত।
মুখোশে লুকিয়ে তবু একদিন
চুরি করে নিলে
                বহিরাগতের মতো...

লুকিয়ে রেখেছ অস্ত্রের পরিপাটি।
ঠিক বেঠিকের
                মধ্যবর্তী বাঁকে...
আর, পায়ে পায়ে জড়ানো লাশের খোঁজে
যদিবা কখনও কোলাহল উঁকি দেয়,
কী আর বলবে, তবে হে শাসক,
আর কী বলার থাকে!


২৪/৩/২০০৭ 







 ১৬

পড়ে আছে সেই মাটি।
অতীত যা কিছু কলহাস্যের
অতিদূর মাখামাখি...

পড়ে আছে মন, চঞ্চল, তাই
পাখি ওড়ানোর ভোরে
তুমি কি ভাবোনি, হেরে যেতে যেতে
অপেক্ষা করে করে-

কীভাবে ভেসেছে এই আবাসিক
রক্তের মতো জল...
মাটি ভেসে গেছে, মাটি পুড়ে গেছে,
অস্থির কোলাহল...

২৬/৩/২০০৭





১৭

তুমি নির্দেশে শ্মশান করেছ
অশরীরী জ্যোৎস্নাকে।
তুমি নির্দেশে বের করে দিলে
ঘর থেকে, যাকে তাকে।

তুমি পেয়েছিলে ফেরত দেওয়ার
গুলি বন্দুক,রাগ।
এত বছরের প্রতিশ্রুতি
অস্ত্রাগারের দাগ...

তুমি নির্দেশে ঠিক করে দিলে
পথ ও পথের আলো...
বহিরাগত যে! শাসকের হাতে
আমাদের চিতা জ্বালো।

২৭/৩/২০০৭  






 ১৮

কিছুই বলিনি।
শুধু, দুটো হাত তুলে ধরি একবার।

কপালের ঘাম তখনও সজীব।
        শরীরে মাটির আলো।

পতাকা ছিল না।
         অস্ত্র ছিল না

তবু

প্রতিবাদ বলে

ক্ষমা করলে না
               তুমি মহারাজ...

বন্দুক চমকালো!

৩০/৬/২০০৭










তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচিতি: তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম অক্টোবর ৪, ১৯৮১ ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এই কবি পেশায় শিক্ষক শৈশব কেটেছে শহর থেকে দূরে গ্রামে যে-সব স্থানে এক সময় বিভূতিভূষণ হেঁটে বেড়িয়েছেন একা একা বনগাঁয় পরে আগমন তমাল শূন্য দশকের অন্যতম সেরা প্রতিভা না না,তমাল এ কথা বলতে যাবে কেন, এ কথা বলছি আমরা,  যাঁরা কবিতাভুক, যাঁরা কবিতার রাজ্যটাকে মোটামুটি চিনি বা জানি তমাল বরং প্রচারবিমুখ নিজেকে লুকিয়ে রেখে গুটিয়ে রেখে ক্রমশ নির্মাণ করে চলেছেন কাব্যের রেশম তাকে কিছু বলতে হয় না তাঁর জমিতে জো-এসেছে বহু যুগ আগে আর তিনি লাঙল নিয়ে আজো ফসল ফলিয়ে চলেছেন কখনও সে জমিতে বারুদের গন্ধ পেয়ে থমকেছেন, ভয় পেয়েছেন, এমনকি শিশুর  মতো কেঁদেও ফেলেছেন। সমস্ত  সন্ধ্যার শেষেতমালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ২০০৩ -এ কলকাতা বইমেলায় ফসিলথেকে বের হয় দাম পাঁচ টাকা মাত্র ১২ টি কবিতা ছিল বইটি ‘অচেনা যাত্রী’ থেকে পুনরায় ‘কলকাতা বইমেলা-২০১৫’- প্রকাশিত হয়। এবারে আরো ছ’টি কবি যুক্ত হল।  ২০১৫-এ 'আদম' থেকে প্রকাশিত হয়েছে তমালের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'অদেখা বিষুবরেখা' 






মন্তব্যসমূহ

sanghamitra halder বলেছেন…
তমাল'দা নিঃসন্দেহে খুব ভালো উদ্যোগ। বেশকিছু লেখা পড়ে ফেললাম। আবারও পড়ব সময় করে। কিন্তু এ লেখাগুলো প্রায় এক যুগেরও বেশি আগের। এখানকার লেখালিখি নিয়ে বই দেখতে চাই শিগগির!
Ashimes Roy বলেছেন…
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
Ashimes Roy বলেছেন…
অসাধারন কবিতার ভিড়ে আমার চোখ হেঁটে বেড়িয়ে, একটাই কথা বলা যায় কবি তমাল এক উজ্জল নক্ষত্র...। এ পথ চলুক অবিরাম
Unknown বলেছেন…
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় -এর সমস্ত সন্ধ্যার শেষে- কাব্যগ্রন্থের পাঠ-প্রতিক্রিয়া
=====================================
শঙ্কর দেবনাথ
-------------------------------------
গতকাল (২৪/৩/১৫) সমস্ত সন্ধ্যা ধরে পড়লাম তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় -এর 'সমস্ত সন্ধ্যার শেষে' কাব্যগ্রন্থের ওয়েভ সংস্করণ। কবির উত্থান পর্বের প্রথম উপস্থাপনা যেন সমস্ত সন্ধ্যার শেষে আকাশে জেগে ওঠা পূর্ণিমা চাঁদের মত স্নিগ্ধতায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমার মননকে।
তমালের কবিতার শরীরে যেমন লেগে থাকে মায়াবী পেলবতা, সমাহিত কমনীয় নন্দন-ইশারা, তেমনি তার কবিতার মননে মেখে থাকে এক বিমুগ্ধ বোধের রাত্রি-রোদের শান্ত উষ্ণতা। সচ্ছন্দ শব্দ আর বাক্যবিন্যাস, সুচারু রহস্যময় লুকোচুরির লুব্ধতা তমালের কবিতার একটা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্টে দুত্যিময়।
সুমিষ্ট মিতভাষিতার আড়ালে কবি যে জগতকে বেধে রাখেন, একটু মন বাড়ালেই সেই জগত পাঠকের নিজের হয়ে ওঠে।
'সমস্ত সন্ধ্যার শেষে'- এর ই-সংস্করণ পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য পাঠকের পক্ষ থেকে অচেনা যাত্রীকে সাধুবাদ জানাই।
Unknown বলেছেন…
ধন্যবাদ সংঘামিত্রা হালদার ও অসীমেষ রায়। সঙ্গে থাকুন। অচেনা যাত্রী'র পাশে থাকুন।