।। চাঁদপুকুর ।। মানিক সাহা ।। অণুগল্প ।।

ছবিঃ জয়নাল আবেদিন/ সৌজন্যেঃ গুগল ইমেজেস 

চাঁদপুকুর
মানিক সাহা

পুকুরের জলে একটা তুলতুলে চাঁদ ভাসে। কচি মেয়েদের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ে জলে। বর্ষা প্রায় শেষ ---পুকুরের বুক যুবতীর ভরাট শরীর হয়ে আছে। পাড়ে চোতরার ঘন বন। অনেক ভাঁট ফুল আর কয়েকটা ধুতুরা গাছ ফুল ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্না ভাঁটফুলের গন্ধে মাখামাখি। আর কিছু নাম না জানা গাছ নতুন জল পেয়ে তড়বড়িয়ে উঠেছে। পুকুরটা এইসব গাছের আড়ালে নিজের ভরা যৌবন নিয়ে মেতে আছে।
           শচীবালা পাড়ে এসে বসে। তার ভেতরেও এমন একটা টলটলে পুকুর আছে। তাতে চাঁদের আলোয় জলের গভীরে থাকা মাছগুলি মাঝে মাঝে ঘাঁই মারে। শচীবালা বসে বসে ভাবে --- তার মতো বাঁজা মেয়েতে  লোকের ভেতর মাছের উথাল পাথাল কেন হয়!
            আব্বাস চাঁদের আলো গায়ে মেখে আঙিনায় বসে গান ধরেছে, ‘ও কি একবার আসিয়া সোনার চান মোক যান দেখিয়া...
            শচীবালার কান্না পায়। কান্না এমন ভয়ানক প্রতারক --- কথা দিয়ে কথা রাখে না। স্বামী ফেলে চলে গেল যে দিন --- কাঁদতে-কাঁদতে মনে হয়েছিল কীভাবে নিজের ভেতর আস্ত একটা নদী এতদিন লুকিয়ে ছিল। তারপর জল জমতে-জমতে পাথর হয়ে গেছে। শচী নিজেকে কথা দিয়েছে ---ঐ মুখপোড়ার জন্য আর কখনো কাঁদবে না।
           মানুষ কত বদলে যায়। বিয়ার পরদিন থিকা শরীল একেরে ত্যানা ত্যানা কইরা ফ্যালচে। কাজ কামাই ফালাই থুয়া কেবল বউ সোহাগ। তুমি আমার চান-সূরজ...তুমি আমার পাখি...ইচ্ছা করে বুকের ভিতর তোমাক বাইন্ধা রাখি!’ শচীবালা লজ্জায় মরে যায়। খিল খিল হাসে---...কোনো লাজ-লইজ্জা নাই মানুষটার।’  
             এক বছর পার হয়। দু-বছর। স্বামীস্ত্রীর অন্তরের টান কেমন যেন কম কম মনে হয়। ছবছর পার করেও যখন সন্তান এল না, তখন শচীবালার চাঁদপণা মুখের উপর কালো মেঘ আরো ঘন হল। বর আর কথায়-কথায় গান বাঁধে না। বরং কথা হারিয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন হতে থাকে। তার ডালে পাখি এসে বসে না। গান গায় না। সোহাগ কমতে-কমতে চরণামৃতের মতো হয়ে যায়। হাতের তালুতে তাকে দেখা যায় কী যায় না--- এমন অবস্থা। শচীবালা ঈশ্বরকে দোষারোপ করে। একটা সন্তান দাও গো ঠাকুর! একটা সন্তান দাও! 
              ঠাকুর আর কী করেন! সন্তান দেবেন ঠিক করে ফেলেন। তাই তার সতীন জোটে কপালে। তার আগেই তার উপর এমন অত্যাচার চলতে থাকে, এমন গঞ্জনা চলতে থাকে --- মরণ রে তুই কালা হয়া আয়... বাঁশি বাজেয়া আয়! 
              কিন্তু মৃত্যু কি আর অত সহজে আসে? উলটে তার স্বামী তাকে একদিন ফেলে চলে যায়। শচীবালা পড়ে অকুলপাথারে। বাপ মরছে দু-বছর হল।  বাপের বাড়ির আর কাছে যাবে? তাকে দেখার মতো কেউ নেই! কোনোরকম ভাবে একটা মাস কাটাল। ভাবনায় ভাবনায় শচীবালার ঘুম হয় না। রুচি হয় না কিছুতে। কিছুদিন পর খবর পেল, স্বামী তার নতুন সংসার পেতেছে।  আহা কতো সুখ, কতো স্বপ্ন--- সব ভেসে গেল।
              মনে মনে গালি দিল শচীবালা। কিন্তু কাকে যে গালি দিল, সে নিজেও বুঝল না। নতুন বউয়ের শরীর পুরুষখাকী। শচীবালার তেমন নয়। তার উপর তার গর্ভের মাটি উর্বর নয়। ওখানে বীজ পুতলেও কোন চারা তৈরি হয় না। এই শরীর নিয়ে সে কী করবে? তার উপর মাঝে মাঝে কী এক মাছ উথাল পাথাল ঘাঁই মারে!  আর কান্না তাকে মাঝে মাঝে প্রতারণা করে। মাছ উথালপাথাল করে তার পুকুরে।  
লোকে যেমন ময়না পোষে পিঞ্জিরায় বান্ধিয়া
সেই মতো নারীর যৈবন  
                            রাখিছং বান্ধিয়া...
শচীবালা তার শরীর ডুবিয়ে দেয় পুকুরের ঠান্ডা জলে। পূর্ণিমার রাতে তার শরীরে জোয়ার আসে। তখন সে এই পুকুরে নামে। সে জলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। চাঁদের আলোয় আরো দুটো চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়ায়, যেন এইমাত্র আকাশের অদৃশ্য ডাল থেকে খসে পড়েছে। চাঁদের বৃন্ত দুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে  
            জঙ্গলে গন্ধভাদালের মিষ্টি কটূ গন্ধ ভেসে আসে। শচীবালা ডুবে যেতে থাকে। ভেতরের মাছ জলে তীব্র আঘাত করে। শচীবালা পুকুরের জল জড়িয়ে নেয়। তার সারা শরীরে চাঁদপুকুরের জল। তার রন্ধ্রে চাঁদপুকুর। স্নায়ু কেঁপে ওঠে।
           পল্লবগোসাইয়ের কথা মনে পড়ে হঠাৎ, শচী, আমার সাধনসঙ্গিনী হবি? 
আপনি গোসাই মানুষ অন্য কেউ এ-কথা কইলে তারে জুতা পিটা করতাম।’
শচীর অপরাধ বোধ হয়। গোসাইকে এ-কথা বলা ঠিক য়নি।
কাম দিয়াই কাম রে বশ করন লাগে --- বুঝলা শচীবালা। কাম জয় কইরবার পারলে, দেখবা, সব কতো সহজ --- কতো সিধা। তুমি যারে পাপ কও, হেই তোমারে পুন্নের দিকে নিয়া যাবে। হবা শচী? হবা আমার সাধনসঙ্গিনী?
           জলের গভীরে ডুবে যেতে যেতে সে ঈশ্বরের কথা ভাবে। পুলকিত হয়। জলের ভেতর পল্লবগোসাই হাসি হাসি মুখে শচীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার হলুদ রঙের চোখ। যাকে সে পাপ বলে ভেবেছিল তা আবার হাতছানি দেয়। গুবগুব শব্দ করে একটা মাছ চাঁদপুকুরের রূপালি জলের অতলে ডুবে যেতে থাকে।



( দ্বৈপায়ন অনলাইনে এই প্রথম প্রকাশিত )
 মানিক সাহা কথা বলেন ৮১১৬৫৫৯৬১৫ নম্বরে। ভালো লাগলে জানান। 

মন্তব্যসমূহ