![]() |
গুগল ইমেজেস |
অণুগল্প
শব্দে-নৈঃশব্দ্যে
শম্ভুনাথ পাল
মা কখনও শহর চায়নি। না হসপিটাল, না নার্সিংহোম। শিবব্রতও চায়নি।
ঢলে যাওয়া সূর্যরঙ টলটলে ইছামতীতে সন্ন্যাসী-গেরুয়া। কাঠের চিতা সাজাচ্ছে গাঁয়ের লোকেরা। শ্মশানে মায়ের কাছে বসে ভাবছিল শিবব্রত। পড়ন্ত আলোয় বটছায়া মেখেছে শ্মশান। নির্বিকার ঠান্ডা নিথর মা। একবার তাকাল মায়ের মুখের দিকে।
শিবব্রতদের গাঁ-এ নদী আছে। ধানের খেত আছে। আছে আম-জাম-বট। আছে পুরোনো রক্ষাকালীমন্দির। আর আছে দিনমজুর। বেশিরভাগ গরিব। প্রায় চালচুলোহীন। দিন আনে দিন খায় গোছের। আর জেলেমহল্লাতে সার সার নৌকো। শুটকি মাছের গন্ধ। দিন নেই রাত নেই চুল্লু খেয়ে হইহুল্লোড় করে জেলের দল। বউ ঠেঙায় মদো-মিনসেগুলো। পোয়াতি বউগুলো পর্যন্ত নদীজলে দাঁড়িয়ে বাগদার পিন ধরে। এই গাঁয়েই জন্ম বড় হওয়া শিবব্রতর। ডাক্তারবদ্যি নেই। নেই ভালো রাস্তাঘাট। নদী পেরিয়ে হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ। মায়ের হাই ব্লাড-প্রেশার। প্রায়শই ডাক্তারবদ্যি লাগে।
শম্ভুনাথ পাল
মা কখনও শহর চায়নি। না হসপিটাল, না নার্সিংহোম। শিবব্রতও চায়নি।
ঢলে যাওয়া সূর্যরঙ টলটলে ইছামতীতে সন্ন্যাসী-গেরুয়া। কাঠের চিতা সাজাচ্ছে গাঁয়ের লোকেরা। শ্মশানে মায়ের কাছে বসে ভাবছিল শিবব্রত। পড়ন্ত আলোয় বটছায়া মেখেছে শ্মশান। নির্বিকার ঠান্ডা নিথর মা। একবার তাকাল মায়ের মুখের দিকে।
শিবব্রতদের গাঁ-এ নদী আছে। ধানের খেত আছে। আছে আম-জাম-বট। আছে পুরোনো রক্ষাকালীমন্দির। আর আছে দিনমজুর। বেশিরভাগ গরিব। প্রায় চালচুলোহীন। দিন আনে দিন খায় গোছের। আর জেলেমহল্লাতে সার সার নৌকো। শুটকি মাছের গন্ধ। দিন নেই রাত নেই চুল্লু খেয়ে হইহুল্লোড় করে জেলের দল। বউ ঠেঙায় মদো-মিনসেগুলো। পোয়াতি বউগুলো পর্যন্ত নদীজলে দাঁড়িয়ে বাগদার পিন ধরে। এই গাঁয়েই জন্ম বড় হওয়া শিবব্রতর। ডাক্তারবদ্যি নেই। নেই ভালো রাস্তাঘাট। নদী পেরিয়ে হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ। মায়ের হাই ব্লাড-প্রেশার। প্রায়শই ডাক্তারবদ্যি লাগে।
শিবব্রতর বাবা চেয়েছিল নদীর অপর পারে শহুরে গন্ধলাগা জায়গায় আর
একটা ছোটো করে বাড়ি থাক। মায়ের সায় ছিল না। কী আছে এ
গাঁয়ে? কী যে চাইত
মা! জেলেবউরা দিব্যি মাছের ঝুড়ি নামিয়ে গল্প করে। কেউ জল খেয়ে পান চিবিয়ে বাড়ি
যায়।
কে মেরে বউয়ের হাতের শাঁখা ভেঙেছে দেখে বকাবকি করে মা। কে এসে সাতসকালে একটু ধার নিয়ে যায়, ফেরত দেবে বলে আর দেয় না। কেমন নীরবে এসবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মা। একদিন
বাবার কী
এক বিরক্তিতে মায়ের গলা পেয়েছিল
শিবব্রত, ‘মানুষ তার কথায় মরে। তুমি যে কথাগুলো বলছ তা মানুষের মতো নয়!
মানুষ মরলেও তার কথা তাকে বাঁচিয়ে রাখে।'
মা সিক্স
ক্লাস পর্যন্ত। কী করে যে এমন সব কথা বলে!
বাবার উত্তর শুনতে পাইনি সেদিন।
বাবার উত্তর শুনতে পাইনি সেদিন।
জেলা সদরে এখন দু-কামরার শৌখিন বাড়ি শিবব্রতর। সর্বত্র স্কোয়ার-ফুটের হিসেব। একচিলতে ঝুলবারান্দা। তৈরির সময় কি
তদারকি ছিল শিবব্রতর! পুবদিকমুখী। সামনে এক বড় আমগাছ নিয়ে পড়-থাকা কাঠা সাতেক জমি। সকালের রোদ কেমন হেসে
ব্যালকনিতে হাজির হয়।
বছর ঘুরতে সব শেষ। প্রমোটারের হাত পড়ল ফাঁকা জমিতে। পাঁচ তলা
ফ্ল্যাটবাড়ি। ঘরদোর আঁধার। স্বপ্নে আঁধার। নিষ্প্রাণ লাগে।
নারাজ মাকে প্রায় উপড়ে নিয়ে এল শিবব্রত। নদীহীন, খেতহীন,খোলা আকাশহীন এ-বাড়িতে। মনেমনে চাইনি। জানত, সে মায়ের বড্ড আদরের, তবে মাটির গন্ধ মায়ের প্রাণবাতাস। কিন্তু উপায় ছিল না। বাবা তিন বছর নেই। পঁচাত্তরের মা। বুকে মাঝেমাঝে যন্ত্রণা। ঘুমঘোরে গোঙানি। ইসিজি রিপোর্ট ভালো ছিল না। নামী হার্ট-স্পেশালিষ্টের পরামর্শ, এই বয়সে ওপেন হার্ট করা যাবে না। যা কিছু ওষুধপাতির উপর।
এ-শহরে মায়ের জন্য গাঁ নেই। জেলেমহল্লা নেই। কথা বলার লোক নেই। শিবব্রত আর পায়েল দুজনেই চাকুরে। বিয়ের দশ বছরেও ছেলেপুলে হয়নি। প্রতিবেশীর অভাব। কাজের মেয়ে ফিরে গেলে সার পৃথিবীর মুখে দরজা বন্ধ। মা একা।
নারাজ মাকে প্রায় উপড়ে নিয়ে এল শিবব্রত। নদীহীন, খেতহীন,খোলা আকাশহীন এ-বাড়িতে। মনেমনে চাইনি। জানত, সে মায়ের বড্ড আদরের, তবে মাটির গন্ধ মায়ের প্রাণবাতাস। কিন্তু উপায় ছিল না। বাবা তিন বছর নেই। পঁচাত্তরের মা। বুকে মাঝেমাঝে যন্ত্রণা। ঘুমঘোরে গোঙানি। ইসিজি রিপোর্ট ভালো ছিল না। নামী হার্ট-স্পেশালিষ্টের পরামর্শ, এই বয়সে ওপেন হার্ট করা যাবে না। যা কিছু ওষুধপাতির উপর।
এ-শহরে মায়ের জন্য গাঁ নেই। জেলেমহল্লা নেই। কথা বলার লোক নেই। শিবব্রত আর পায়েল দুজনেই চাকুরে। বিয়ের দশ বছরেও ছেলেপুলে হয়নি। প্রতিবেশীর অভাব। কাজের মেয়ে ফিরে গেলে সার পৃথিবীর মুখে দরজা বন্ধ। মা একা।
শিবব্রত অবশ্য দোতলার
ছাতকে গাঁয়ের খেত বানিয়ে দিতে চেয়েছিল। মা ভালো থাকবে। কয়েকশ টব। মা তাতে ফুলগাছ উচ্ছে, বেগুন, ধনেপাতা লাগান। স্ত্রী পায়েল হাত লাগায়। টব ভরে থাকে আদরে, স্নেহে।
কতদিন দূর থেকে দেখেছে শিবব্রত, মা রেলিংয়ে ভর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে। ঘরে ভালো না লাগলে মা ছাতে চলে আসে। জিজ্ঞেস করেছে কতদিন, ‘এখানে তোমার ভালো লাগে না, বলো!’
কতদিন দূর থেকে দেখেছে শিবব্রত, মা রেলিংয়ে ভর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে। ঘরে ভালো না লাগলে মা ছাতে চলে আসে। জিজ্ঞেস করেছে কতদিন, ‘এখানে তোমার ভালো লাগে না, বলো!’
‘লাগে তো!
তোমাদের কাছে আছি এই তো ভালো।’
তিন দিন আগে মা কথাহারা হল। সেরিব্রাল অ্যাটাক। ইশারায়, গোঙানিতে কী যেন বলতে চায়। শিবব্রত সব শক্তি দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, ‘বলো না মা, বলো না...কী বলতে চাও!’
মা বলতে পারেনি। কয়েক ফোটা জল বেয়ে নামছিল মায়ের চোখ থেকে।
শ্মশানের এ সন্ধ্যা বড় নীরব। মাথায় কে যেন ধাক্কা দিল, ‘এই যে বাকহীন স্পন্দনহীন দেহ সে কি তোর মা? তোর মা তো কথা বলে। কত কথা বলতে চেয়েছে!’
পিছনে তাকাল শিবব্রত।
তিন দিন আগে মা কথাহারা হল। সেরিব্রাল অ্যাটাক। ইশারায়, গোঙানিতে কী যেন বলতে চায়। শিবব্রত সব শক্তি দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, ‘বলো না মা, বলো না...কী বলতে চাও!’
মা বলতে পারেনি। কয়েক ফোটা জল বেয়ে নামছিল মায়ের চোখ থেকে।
শ্মশানের এ সন্ধ্যা বড় নীরব। মাথায় কে যেন ধাক্কা দিল, ‘এই যে বাকহীন স্পন্দনহীন দেহ সে কি তোর মা? তোর মা তো কথা বলে। কত কথা বলতে চেয়েছে!’
পিছনে তাকাল শিবব্রত।
না কেউ
নেই।
উঠে
দাঁড়ায় শিবব্রত। বিবর্ণ সূর্য জলে মিশে যাচ্ছে।
মন্তব্যসমূহ