।। পিয়ালি মজুমদারের দুটি অণুগল্প ।। পৌষ ১৪২৪ ।।

সৌজন্যে: গুগল ইমেজেস 

পিয়ালি মজুমদারের দুটি অণুগল্প

ফেরা

ট্রেনটা বেশ জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠতেই হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল সিক্তার। একটু তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল। তুলে দেখল দশটা মিসড কল। শান্ত! 
চোখ কচলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল গন্তব্য থেকে ঠিক কতটা দূরে এখন। দু-পাশে সার সার কলাবাগান ছাপিয়ে ধূ ধূ জমি, তার মাঝে মাঝে চওড়া কপালে হলুদ গোল টিপের মতো গাদা ফুলের বাগান... মানে শহর, আধা- শহর ছাড়িয়ে অনেকটাই গ্রাম্য সরলতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে জটিল রেলবিন্যাস। 
 ও যে মানে না মানা... আঁখি ফিরাইলে বলে...’  
 শান্ত কলিং...  
ফোনটা কেটে দিল সিক্তা। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না এখন। গলা পর্যন্ত তেতো হয়ে আছে। 
        নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল একটু। মা এখন কী করছে কে জানে? বেরিয়ে আসার সময় তো দরজাটা ভেজানো ছিল। ডেকেও সাড়া পায়নি। একটা ফোন করবে? 
       নাহ, থাক। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে সিক্তার। 
       শান্তর সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তিক্ততা কাল রাতে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তারপর আর... কৃষ্ণনগরের ওই লেডিস হোস্টেলে চাকরি আর থাকার বন্দোবস্ত আজ তাকে যে করেই হোক করতে হবে। তাহলেই পাকাপাকিভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসা যাবে। মা বুঝবে তখন! 

            সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে ঝোঁকের মাথায়, এতখানি বেলা হয়েছে, কিচ্ছু পেটে পড়েনি, ক্ষিদেয় নাভি পর্যন্ত জ্বালা করছে। কোনো হকারও ওঠেনি এর মধ্যে, তিনটে স্টেশন পেরিয়ে গেল। ধুর! এর পর কোন স্টেশন কে জানে!
বিরক্তিতে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সিক্তা। একবার পেছন ফিরে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় কামরার চারিদিকে। কারোকে কি জিজ্ঞাসা করবে? খুব একটা যাত্রী নেই কামরাটায়, দু-তিনজন মহিলা এমন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে জানালার বাইরে চেয়ে আছে, যেন অনন্তকাল ধরে শুধু এই কাজটাই তারা করে আসছে।   উলটোদিকের দরজার কাছে একজন পাগলি-মতো মহিলা, উবু হয়ে বসে নিজের ঝোলার মধ্যে কী যেন খুঁজে চলেছে আঁতিপাঁতি করে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। একবার সিক্তার দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করল, তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের খোঁজাখুঁজিতে। 
          বাইরে তাকাল সিক্তা। দরজার রড ধরে একটু ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। সামনের ধূ ধূ মাঠ  উধাও। তার জায়গায় সারিসারি  বাঁশঝাড়  এখন আলো-আঁধারির গল্প বলতে বলতে ছুটে চলেছে সিক্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।  কোথাও যেন বৃষ্টি হয়েছে। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া মায়ের মতো আঁচল বুলিয়ে গেল মুখেচোখে।  দুপুরে মায়েরও খাওয়া হয়নি আজ। সিক্তা জানে। কিন্তু... 
          হঠাৎ পিঠের ওপর কীসের যেন টোকা পড়ল। মুখ ফিরিয়ে দেখে, পাগলিটা! জুলজুল করে তাকিয়ে আছে কেমন। হাতে একখানা ভাঙা বিস্কুট সেই দিয়েই টোকা দিয়ে চলেছে সিক্তার পিঠে। অন্য মুঠোয় খানকতক আরও। মেলে ধরল মুখের সামনে
খাবি? নে, নে, খেয়ে নে সেই কখন ফিরেছিস ইস্কুল থেকেক্ষিদে পেয়েছে না তোর? খেয়ে নে! নে না রে মেয়ে! নে না...’  
          খুব ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকে পড়ে ট্রেন। সিক্তা নামে।  পেছন পেছন পাগলিটাও। 
          ঝাপসা চোখে টাইম টেবিল হাতড়ায় মেয়ে। 

         মা এখন কী করছে কে জানে! বেরনোর সময় দরজাটা তো...




দাগ
ধুলোপড়া ল্যাম্পশেডটাকে পাশ কাটিয়ে একটা প্রায়ান্ধকার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বোঝা যায়, এ বাড়িতে আলোর বিলাসিতা থেমে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। ঢুকব কী ঢুকব না ভেবে ইতস্তত করছি, ভদ্রমহিলা বললেন, উনি ভেতরেই আছেন। চলে যানআর হ্যাঁ, উত্তর দিতে না চাইলে খুব বেশি জোর করবেন না। উনি মানসিকভাবে অসুস্থ।’ 
           কী ফ্যাসাদেই পড়লাম রে বাবা! চাকরি বাঁচাতে গিয়ে পাগলের কামড়-টামড় না খেতে হয় শেষে।  
           আমাদের চ্যানেল থেকে এ বছর ঠিক হয়েছে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন কিছু মানুষ, যারা বর্তমানে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করে সম্মান জানানো হবে। 
           হরনাথ মুৎসুদ্দি এমনই একজন বিস্মৃত প্রতিভা। যার খোঁজে আমি আজ এই তেরো নং কালীচরণ ঘোষ রোডের এক প্রায় ভগ্নদশাপ্রাপ্ত বাড়ির দোতলায়, এক অস্বস্তিকর থমথমে পরিবেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। 
ভালো আছেন হরনাথবাবু? 
প্রায় আসবাবশূন্য ঘরের ঠিক মধ্যিখানে রাখা চেয়ারটিতে বসতে বসতে বললাম আমি। প্রায় দশ মিনিট নীরবতার পর উত্তর এল, 
কী দরকার? 
বিছানার ওপর আধশোওয়া বৃদ্ধের মুখ তখনও জানালার বাইরে ফেরানো। ঠিক কোন দরকারের কথা উনি বলছেন? জিজ্ঞাসা করব? যাক গে, কথা না বাড়িয়ে কাজের কথায় যাওয়াই ভালো।
আপনি তো বিখ্যাত চিত্রপরিচালক সুগত রায়ের ছবি বসুধারা’-তে  অভিনয়ের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান আমরা চাই সাধারণ মানুষের সামনে আবার আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সসম্মানে। আমাদের বৈতালিক' চ্যানেলের তরফ থেকে তাই একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, সেইখানে সকলের উপস্থিতিতে আপনাকে কিছু দিতে চাই আমরা, সাম্মানিক হিসেবে এই নিন সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র। 
        এক ঝটকায় বিছানা থেকে নেমে আমার হাত থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন ভদ্রলোক ছানিপড়া দু-চোখ জ্বলে উঠল সহসা এক পা এক পা করে এগিয়ে এলেন আমার এক হাত দূরত্বে 
দেবে? আমার বন্দুকটা দেবে আমায়? ফিরিয়ে এনে দেবে? সত্যি বলছ?
হতবাক আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। বন্দুক মানে? 
ভদ্রমহিলা আশেপাশেই ছিলেন। টের পাইনি। আমায় ইশারায় বাইরে ডাকলেন।  তারপর ধীরে ধীরে বললেন,প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দেহরক্ষী ছিলেন। কুড়ি বছরের বিশ্বস্ত সঙ্গী। মিথ্যা চুরির অপবাদে তার বন্দুক এবং লাইসেন্স কেড়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রাক্তন সেনাপ্রধানের পক্ষে এই অপমান সহ্য করা সম্ভব হয়নি, তারপর থেকে। কিছু মনে করবেন না। এখন বরং আপনি আসুন। 
         চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় চোখ পড়ল ল্যান্ডিং-এ রাখা ছবিটার দিকে। ছবির ভেতর থেকে পাশাপাশি হাসি বিতরণ করছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং হরনাথ। ছবিটার ঠিক মাঝ বরাবর কাচে চিড় ধরার মতো একটা দাগ। সত্যি দাগ না আমার মনের ভুল! 
        বুঝতে পারলাম না...




মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
এ কালের অত্যন্ত শক্তিশালী লেখনী । আরও অনেক অণুগল্প ও বিভিন্ন ধরণের লেখা পড়তে চাইবো।
Sampa বলেছেন…
মা পড়েছিলাম আগে। দাগ প্রথম পড়লাম। দুটি গল্পই অনবদ্য।