গল্পটি দ্বৈপায়ন ( মুদ্রিত) ডিসেম্বর ২০১৬ তে প্রকাশিত
দবির যেদিন প্রথম মতিঝিল এসেছিল, মাথা
চক্কর দিয়ে উঠেছিল ওর । মাথা চক্কর দিয়ে উঠতেই মতিঝিল চত্বরে দাঁড়িয়ে পড়ে বুক ভরে
বাতাস নিতে চেয়েছিল দবির। সিদ্দীক বখশ হাসতে হাসতে বলেছিল, টাকার
গন্ধ নাকে লাগে? টাকার গন্ধ সেদিন পায়নি দবির। গরম বাতাসের
গন্ধ নাকে লেগেছিল। গরম বাতাসে ভরে গিয়েছিল ওর কিশোর ফুসফুস। যা কেবল নদী পাড়ের
বাতাসই চিনেছিল এত কাল। ভুস করে শ্বাস ছেড়ে কপালের ঘাম মুছে সিদ্দীক বখশের সাথে এগুতে এগুতে মতিঝিলের নানা
গন্ধ পেয়েছিল দবির। ফুটপাতের দুর্গন্ধ। ভিড়ের ভেতর নোনা ঘামের গন্ধ। পনের বছরের দবির
টাকার নগরী মতিঝিলের কালো পিচের গরম রাস্তায় খালি পায়ে চলতে চলতে উফ করে দাঁড়িয়ে ছল ছল চোখে
চেয়েছিল সিদ্দীক বখশের দিকে। এই সিদ্দীক বখশই তাকে ডুব সাঁতার নদীটা থেকে দূরে
মতিঝিল নিয়ে এসেছে।
টাকার গন্ধ নিতে দবির মতিঝিলের অলিগলি ঘুরতে থাকে। যেদিক দিয়ে বার হয় দবিরের
সামনে হাজির হয় একটা উঁচা-লম্বা ব্যাংক। গ্রামের লোকে বলেছিল, মতিঝিলের
বাতাসে ট্যাহাই ট্যাহা। সিদ্দীক বখশ বলেছিল, ট্যাকার গন্ধের
কাছে মাইয়া মাইনষের সুগন্ধিও ফেইল মারে। কেবল দবিরই টাকার গন্ধ পাচ্ছিল না । দোতলা
বাস ঠাসা মানুষের আনাগোনায় দবির বুঝেছিল মতিঝিলের বাতাসের টাকার খবর গোপন নয় কারো
কাছে। হরেক চেহারার মানুষ দেখতে দেখতে দবির ভাবে, এরা সবাই
কি তার মত নদী ভাঙা গ্রাম থেকে মতিঝিলে এসেছে?
একটু একটু করে নদীর পাড় ভাঙ্গনে ভোলা গ্রামেও ভাঙ্গন ধরেছিল। কিচিরমিচিরে
ভরপুর গ্রামটা ক্রমে ক্রমে নৈ:শব্দকে আলিঙ্গন করলো। ভুতুড়ে নিস্তব্ধতায় নিয়ম করে
কানে বাজতো কেবল পাড়ের ভাঙ্গন। আর দবিরের বুকের ভেতরের কান্দন। মতিঝিলের শাপলা
চত্বরের বিশাল শাপলাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে দবির ভাবে, এটার
চারপাশে কেমন পোক্ত বেড়া, এমন করে কেউ যদি ওদের গ্রামের
নদীটায় বেড়া দিত, তাহলে ওর ডুব সাঁতার নদীটা কি এমন
সর্বগ্রাসী হতে পারতো?
নদী ভাঙ্গনের ওই
বছরও সিদ্দীক বখশ গ্রামে গিয়েছিল। চপচপে তেল চুলে পরিপাটি আঁচড়ানো সিদ্দীক বখশ
ঢাকায় সিএনজি চালায় দশ বছর। ঢাকার কয়টা গলি, কয়টা বাড়ি সব
তার জানা। দুই বছর পর পর গ্রামে গেলে ভোলা গ্রামের মানুষ এমন করে পান খাওয়া লাল
ঠোঁটের সিদ্দীককে ঘিরে ধরতো, যেন সিদ্দীক দুবাই ফেরত শেখ।
দবিরের বিধবা মা ছেলের জন্য একটা বন্দোবস্ত করার পরামর্শ চাইতে এসেছিল সিদ্দীকের
কাছে। তখনই সিদ্দীক বলেছিল ঢাকা আসার কথা। কিন্তু ঢাকার কিছুই চেনে না দবির। ঢাকায়
কেউ নেই তার। কী করে খাবে?
আরে! আমি আছি না? ঢাকার
চাপ্পাচাপ্পা চেনা আছে আমার। মতিঝিলের হাওয়া একবার বুকের ভিতরে গেলে ধান্ধাপানির
বন্দোবস্ত এমনে এমনে হয়ে যাবে। দু’আঙ্গুলে তুড়ি বাজাতে
বাজাতে বলেছিল সিদ্দীক।
মতিঝিলের গরম
হাওয়া দবিরের কিশোর বুকের ভিতরে গেছে। তবে দবির শুকে বেড়ায় বাতাসে টাকার গন্ধ। তার
মা তিন গ্রাম পরে গিয়ে ক্ষুন্নিগিরি শুরু করেছে নিজের পেট চালাতে। তিন গ্রামে পরে
গিয়ে মা যদি টাকার গন্ধ পায়, তাহলে দবির কেন মতিঝিল পর্যন্ত ছুটে
এলো?
সিদ্দীক ভরসা দেয়। আমি আছি না? সিদ্দীক তার
থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল। নদী ভাঙ্গা উদ্বাস্তুদের বস্তি
রয়েছে মিরপুরে। ওখানে দবিরের গ্রামের কালাচাঁনও আছে। সিদ্দীকের অনুরোধে কালাচাঁনের
ঘরে থাকার জায়গা পেল দবির। সিদ্দীক খুচরা কিছু টাকা দিয়েছিল কালাচাঁনকে। দবিরের
খাওয়া খরচা বাবদ। কালাচাঁন মিরপুরে রিকশা চালায়। দবিরকেও রিকশা চালানোর কাজ জুটিয়ে
দিতে চায় কালাচাঁন। কিন্তু দবির তো ঢাকা এসেছে মতিঝিলের টাকা ধরবে বলে।
মিরপুরের গলিতে রিকশা চালিয়ে কি মতিঝিলের টাকা মিলবে?
![]() |
ছবিঃ গুগল ইমেজেস |
অতপর দবিরের একটা
কাজ জুটল। তাতে রোজ মতিঝিল যাওয়া পড়বে দবিরের। মিরপুর টু মতিঝিল বাসের হেলপার
দবির। বাসের গায়ে ঠকাস ঠকাস তালে চাপড়াতে থাকে দবির, আর
বাস ছুটে চলে মিরপুর ছাড়িয়ে মতিঝিল। দবিরের মনে হয় সে ঘোড়া দৌড়িয়ে মতিঝিল যাচ্ছে।
এ ঘোড়া বাজির ঘোড়া। সকাল বেলা বাসে উপচে পড়ে যাত্রী। ভাড়া কাটতে গেলে ভিড়ের ভেতর
দম বন্ধ হয়ে যায় দবিরের। এত লোক মতিঝিল যায়? যাত্রীরা ভাড়া
দিলে টাকা গুণতে গুণতে দবির ভাবে এ কি মতিঝিলের টাকা?
ওস্তাদ, পেশাব
করতে যামু! একটা বাহানা করে মতিঝিল স্ট্যান্ডে বাস থেকে নেমে আসে দবির। বাসে না
ফিরে মতিঝিলের পথে পথে ঘুরতে থাকে । উঁচু উঁচু ভবন দেখতে থাকে। দেখে পথচারীদের
ব্যস্ততা। তাদের জামা। হাতের ব্যাগ। পায়ের জুতা। এদিকে জুতা পালিশের ব্যবসা
জমজমাট। কি সকালে কি দুপুরে, লোকজন পথের ধারে থেমে জুতো চকচক
করে নিচ্ছে। আবার ডালায় করে সাজানো জুতাও বিক্রি হচ্ছে বেশ। দেখতে বিদেশি জুতার
মত। দামও প্রথমবার বিদেশি। তাতে ক্রেতা পিঠ দেখিয়ে যেতে থাকলে দোকানি ’লন স্যার’ বলে লোকাল দামে জুতা বেচে দিচ্ছে। ফুটপাতের
একটা পসরা নজর কাড়ে দবিরের। দোকানি অভিনব কায়দায় জুতা বেচে। জুতোগুলো ভরে
রেখেছে কাঁচের বয়ামে। ফুটপাতে পলিথিন বিছিয়ে তার উপর এক সারিতে দশটা বয়াম। একেকটা
বয়ামে এক জোড়া জুতা। কোনটা কালো। কোনটা খয়েরি। বয়ামের ভেতরে খাড়া করে রাখা
জুতাগুলো দেখতে পথচারীদের ভিড় বেশ। রোদের আলোয় বয়াম চকচক করছে। বয়ামের ভেতরে চকচক
করছে পালিশ করা কালো জুতা। খয়েরি জুতা।
লোক আসছে লোক যাচ্ছে। দবির জুতা
দোকানের কাছাকাছি এক জায়গায় খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের পর ভিড়টা কমেছে।
দোকানি এতক্ষণ গলা চড়িয়ে বলছিল, কিনেন কিনেন এক বয়াম জুতা কিনেন।
চকচকে জুতা। ধুলাবালি ছাড়া জুতা। দুপুর গড়াতে দোকানি গলাটাকে আরাম দিল। একটু
এদিক-ওদিক দেখে যখন বুঝলো, আপাতত ক্রেতা নেই
আসেপাশে, তখন উঠে দাঁড়াল। ফুটপাতের আরেকপাশে কোণায় গেল। পেশাবের বেগ
পেয়েছে তার।
ছর ছর আওয়াজ কানে আসে
দবিরের। দবির পায়ে পায়ে বয়ামের সারির দিকে এগুতে থাকে। আশেপাশের কেউ দবিরকে আলাদা
করে খেয়াল করছে না। দবির বয়ামগুলোর একেবারে কাছে। হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায়। দোকানি
তখনও পেশাব দিয়ে ফুটপাতের কোনার দেয়াল ভিজিয়ে চলেছে। দবির ওদিকে তাকিয়ে দোকানিকে
দেখে নেয় একবার। তারপর কুঁজো হয়ে হাত বাড়ায়। কালো চকচকে এক জোড়া জুতা ভরা একটা
বয়াম তুলে নেয়। বুকের উপর চেপে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।
রোদ লেগে বয়ামটা গরম। আর দবিরের ঢিপ ঢিপ বুকটা উষ্ণ। দবিরের কানের কাছে কে যেন বলে
ওঠে, পালা দবির! পালা! দবির খালি পায়ে দ্রুত হাঁটা দিল।
পেছনে তাকাচ্ছে না সে আর। মতিঝিলের এ গলি ও গলি, এই ব্যাংক সেই ব্যাংকের সামনে দিয়ে
ভিড়ে মিশে মিশে দবির দ্রুত চলতে থাকে।
দবির মতিঝিল থেকে
হেঁটে হেঁটে মিরপুরের বস্তিতে ফিরল। বুকে তখনও আঁকড়ে ধরে রেখেছে বয়ামটা। কালাচাঁন
ওকে ফিরতে দেখে বলল, ওই ছেঁড়া! বাসের ড্রাইভার আসছিল
নালিশ করতে। তুই নাকি দুপুর বেলা বাসের হেলপারি করস নাই? দবিরের
বুক ধড়ফর করছে। মুখ শুকিয়ে গেছে। বয়ামটা বিছানার এক পাশে রেখে কলস থেকে পানি ঢেলে
ঢক ঢক করে খেলো। বুকে আটকে গেল পানি। খক খক করে কাশি দিল। তারপর ধপ করে শুয়ে পড়ল
বিছানায়। বয়ামটা মাথার পাশে রেখে চোখ বুঁজে বলল, কাইল থেইকা
মতিঝিলে জুতার ব্যবসা করমু। বাসের হেলপারি ছাইড়া দিসি।
শাপলা চত্বরের কাছে মিরপুরগামী বাসস্ট্যান্ড। এ চত্বরটা বিশাল। এক কোণায় একটা
নীল প্লাস্টিক বিছিয়ে তার ওপর কাঁচের বয়ামটা রাখে দবির। এটাই ওর ব্যবসার মূলধন।
এটাই ওর বিনিয়োগ। বয়ামটার গায়ের ধুলো মুছে নেয় দবির। কালো জুতা জোড়া ঝিলিক দিয়ে
ওঠে। দবিরের চোখের কালো মণিতেও একই ঝিলিক। দবির এক দলা থু থু গিলে চেঁচিয়ে ওঠে, জুতা! জুতা! এক বয়াম জুতা! ধুলাবালি ছাড়া চকচকে কালা জুতা!
মতিঝিলের গরম বাতাসে দবিরের গলার স্বর নতুন সংযোজন। পথচারীরা আচমকা দবিরের
হাঁকডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আরো কোন তামাশা আছে নাকি ভেবে সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ
জুতার দাম, কেউ বয়ামের দাম জানতে চায়। দবিরের মুখে সূর্যের
আলো পড়ায় চোখ কুঁচকে ক্রেতাদের দেখতে থাকে। ক্রেতার দামাদামি শুনতে শুনতে কানে ঘোর
লাগে ওর। গরম বাতাসে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলে দবিরের নাকে এসে লাগে আজব গন্ধটা। মতিঝিলের
টাকার গন্ধ।
প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত জানান, ব্লগে, এমনকি সরাসরি আইরিন-কে, ফেসবুকে বা মেলে। আইরিন সুলতানার ফেসবুক ঠিকানা https://www.facebook.com/laboni
ই-মেল ireen.sultana.bd@gmail.com
প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত জানান, ব্লগে, এমনকি সরাসরি আইরিন-কে, ফেসবুকে বা মেলে। আইরিন সুলতানার ফেসবুক ঠিকানা https://www.facebook.com/laboni
ই-মেল ireen.sultana.bd@gmail.com
![]() |
আইরিন সুলতানা |
মন্তব্যসমূহ