।। অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের ছ'টি অণুগল্প ।।

ছবি: গুগল ইমেজেস 

নদী
দু-চোখে এখন থইথই করছে জল। জলের মধ্যে ছায়া পড়ছে আমার। নিজেকে ঘনঘন কেঁপে উঠতে দেখছি। সমূহ কুয়াশার স্বর বিষাদের মুদ্রায় ডুবে রয়েছে জলে। জল দুলছে। আমি দুলছি। চোখ স্থির। তাকিয়ে রয়েছি ঐ সহজের দিকে।
         যেই বললাম, ‘দেখিস, একদিন আমার চেয়ে অনেক ভালো বর হবে তোর...’
         অমনি কাঁপতে থাকা স্থির জল নদী হয়ে গেল।


ক্ষমা
সমস্ত মহারথীরা যখন গাঢ় ঘুমের অতলে, তখন ঈষৎ চাঁদ লাট খাচ্ছে আকাশময়।
       সব্বাইকে বেশ স্পষ্ট চেনা যায় এখন। যুদ্ধক্লান্তি নিবিড়তায় খামচে আছে সবকটা শরীরকে। নিস্তেজ এই রাত্রি বুক খুলে আড়াল দিচ্ছে সবকিছুকে।
       ‘কালই প্রাতে আরম্ভ হইবে মহারন...’
       অন্ধকারের মতো কালো বোরখায় সম্পূর্ণ আবৃতা এক নারী নূপুরের শব্দের মতো সন্তর্পণে এলেন। একটি ঘুমন্ত শরীর স্পর্শ করে উচ্চারন করলেন, ‘ক্ষমা...ক্ষমা...’ 


বেশ্যা
অনেক্ষণ আলোআঁধারী গলিটায় দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন বুঝল আজ আর কামকাজ তেমন হবার নয়, তখন চলতে লাগল শেফালী। মেজোবাবুর দেওয়া গায়ের চাদরটা দিয়ে ভালো করে মাথাটা ঢেকে নিল সে। ঘরে ফেরার পথ রোজকার মতোই একঘেয়ে।
        শেফালীর ঠোঁটে এখন মোমশিখার মতো জ্বলজ্বল করছে রাত্রিটা। আজ দেরি হয়ে গেল অনেকটাই
দ্রুত পা চালায় সে। সস্তা সেন্টের গন্ধে লজ্জা পেল মহল্লার হাওয়া। একটা রাতপাখি পিছু নিল ওই গন্ধটার। ছেলেটা বোধহয় একা-একাই ঘুমিয়ে পড়ল।
        আসবার সময়তেও বেশ জ্বর ছিল গায়ে!

অপেক্ষা
সকাল থেকেই লালনীলহলুদের ভেসে যাওয়া। টুকরো মেঘের জিভে ঠোঁটে সুস্বাদের মৌসিনরাম। আজ অরুর সঙ্গে দেখা করতে আসছে নেহা। সারে চার ঘন্টা লাগবে ট্রেনে। নানান সুঘ্রানের স্বপ্নগাছ ও তাদের ছায়াময়তায় বুঁদ হয়ে রয়েছে দুজন। যে যার মতো করে নিজেদের বদ্ধভূমির মাটি তৈরিতে মগ্ন এখন তারা। দুজনেই ঘোর সংসারী।
         পৌঁছবার কথা ঠিক বারোটায়। অরুর সারা শরীর এখন রদ্দুর হয়ে ডালপালা মেলছে। রাত্রে ঘুমটাও আর এল কই সেভাবে!
   মাসখানেক বোধহয়...কিংবা আরেকটু বেশিই হয়তো। ফেসবুকে আলাপ। তার পর ধারাজল যেভাবে বয়ে চলে আর কী...আদরে.. প্লাবনে...স্রোতে...দোটানায়...দুজনের ভিজে ওঠা। আজই প্রথম মিলিয়ে দেখে নেবে তারা একে অপরকে।
        সকাল থেকে অনেকগুলো সিগারেট হয়ে গেছে অরুর। অনেকদিন বাদে এত ঘনঘন ঘড়ি দেখছে সে।


রানু ও ভানু
আজ অনেকে এসেছেন, তাও কেমন ফাঁকা উঠোন। গাড়িবারান্দায় একটা উড়ে আসা টিয়া চিল্লাচ্ছে সেই থেকে। এখানকার মেঘ বহুদিন হল নিস্তরঙ্গ। কোথাও কোনো দোলাচল তৈরি হচ্ছে না তেমন।
        কবি উঠে দাঁড়ালেন। বিকেল নত হল তার সম্মুখে। চারদিক থেকে ঘণ্টাধ্বনি হল। তিনি উত্তরায়ণের দিকে যাবেন হয়ত।
        রানুর চিঠি আসে না অনেককাল...
  কেমন আছে কে জানে মেয়েটা...

পুরনো আগুন

মৃদু একটা হাওয়া মেখে সন্ধে নামল সুতপাদের বাড়ি। স্বপ্নিল আলোয় অম্ল হয়ে রয়েছে শোবার ঘরখানা। বাইরের ধারালো জ্যোৎস্না একটু-একটু করে গ্রাস করছে সুতপাকে। বিন্দুবিন্দু ঘামের কারুকাজ খেলে বেড়াচ্ছে কপাল থেকে ঘাড়-গলা-পিঠ...
         বিয়েটা ভেঙে যাবার পর থেকেই এ-সময়ে খুব-একটা আসে না কেউ।
         নোনা আলোয় ভেতরের খুব চেনা আগুনটা আজ বহুদিন বাদে বাদুড়ের মতো ডানা ঝাপটায়। একটা অলিভরঙা টালমাটাল ঢেউ স্নায়ুময় খামচে ধরে থাকে।
         এখন ঘননীল হয়ে রয়েছে চাদর-বিছানা-বালিশ। বাইরে আছড়ে-পড়া ভাঙা চাঁদের আদরের কথাকলি ক্রমশ প্রবল...
         শরীরের প্রতিটা তারে তারে তরল বিস্ময়ের নড়াচড়া। সুখের গাঢ় আঁচড় ঘন হয়ে গড়িয়ে নামে চুপিচুপি। ভিজিয়ে দেয় ঘাসবন...বহুকালের পুরোনো আচষা খেত...
         এবারে উঠে-পড়ে সুতপা। ঘারে-মাথায় জল দেয় ভালো করে। তার পর, মন্ত্রজপ শুরু করে।
         এ-সময়ে মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়াই নিয়ম। 

                       এই ছ'টি অণুগল্পই টাটকা।  

প্রিয় পাঠক, আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, সবটাই নির্দ্বিধায় জানান এই  ব্লগের 'কমেন্ট'-এ, এমনকি অর্ণব-কেও সরাসরি ফেসবুক বা ই-মেলে জানাতে পারেন। ভালো বা মন্দের ফিডব্যাকটা পাওয়া দরকার আগামীর জন্য। 
অর্ণব চট্টোপাধ্যায়ের ফেসবুক-ঠিকানা  https://www.facebook.com/arnab.chattopadhyay.1806
ই-মেল  arnabchatterjee25@gmail.com 
কবি অর্ণব চট্টোপাধ্যায় 

মন্তব্যসমূহ