।। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী’র তিনটি ‘ফ্রেশ’ অণুগল্প ।।

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী’র তিনটি ‘ফ্রেশ’ অণুগল্প




শুদ্ধেন্দু  চক্রবর্তী, বাঁয়ে, ডানে অর্ণব চট্টোপাধ্যায় 

   
ঘুম
ওকে ঘুমোতে দেখতাম। বেশ লাগত। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে ও। পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে ঘুম। কি ঘুম ভুলে যাবে? উদ্‌বেগ বাড়তেই আরো একবার ওর পড়ার ঘরে উঁকি মেরে দেখে এলাম। না তো! জেগেই তো আছে। প্রাতঃরাশ পার করে দুপুরের ভাতডিমের সময় ঘনিয়ে আসতেই আরো একবার সন্তর্পণে এগিয়ে গেলাম ওর ঘরের দিকে। দরজা খোলাই ছিল। তবু এইভাবে ঢুকে পড়তে ইতস্তত বোধ হচ্ছিল। আসলে একটা বয়সের পর বাবাদের ছেলেমেয়ের ঘরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়তে নেই। পা নাড়িয়ে স্মার্ট ফোনে চ্যাট করছে অর্ণা। ওকে কি বিরক্ত করা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই ভুল করে ফেললাম। অর্ণার কাঁধে স্পর্শ করেই চমকে ফিরিয়ে নিলাম। অর্ণা ঘুমোচ্ছে। চোখ খোলা রেখেই। পা নড়ছে, হাত কাঁপছে মৃদুমৃদু। আমার শের্নোবিল মনে পড়ে গেল। আহা কতোদিন নিশ্চিন্তমনে ঘুমোয়নি মেয়েটা। আহা। ঘুমোক না হয়।



ছবিঃ গুগল ইমজেস





 খিদে
খিদে কতরকম হয়? এই প্রশ্নটা জীবনের নানান ধাপে নানান মানুষ আমাকে নানান ভাবে করেছেন। আমিও উত্তর দেবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। তখন ক্লাস থ্রি। অখিল স্যার টিফিনটাইমে জিজ্ঞেস করেছিল। ক্যাবলার মতো বলেছিলাম, দুই রকম। অনেক খিদে আর একটু খিদে উত্তরে স্যার আমার গাল টিপে দিল। এরপর বড়ো হলাম। সোহিনী ম্যাডামকে ঝাড়ি মারতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম । তখন এগারো ক্লা প্যান্টের পকেটে ফ্রয়েড সাহেব উঁকি দিচ্ছিলেন। ম্যাডাম ধরে ফেলবার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রায় কাকতালীয়ভাবে টিফিন-ঘন্টা বেজে উঠল। ম্যাডাম কটমট করে বললেন, এত খিদে পেয়ে গেল বাপু। বলো তো খিদের রকমফের?আমি গোবেচারা। মনে উত্তর এসেছিল। শরীর শরীর শরীর। মুখ কুলুপ আঁটল। যেন শ্রমিক দিবসের হরতাল। নিরবতা একধরণের উত্তর। নয়? প্রান্তিকাকে অবশ্য বিয়ের পর সরলভাবেই জানিয়েছিলাম নিজস্ব ক্ষুধা কথা। প্রান্তিকা জিজ্ঞেস করেছিল। তখনো জীবাত্মা-পরমাত্মার দর্শন আসেনি আমার। মন টুকু এসেছে সবেমাত্র। বললাম, ‘শরীরের খিদে আর মনের খিদে।’ কী বুঝেছিল কে জানে! হয়তো তখন থেকেই ওর অ্যাফেয়ারটা চলছিল। আমি বুঝিনি তখন। যখন বুঝলাম, অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। জীবনের একদম সমাপ্তিপর্যায়ে অবশেষে বুঝেছি। খিদে দুরকম। মাংসাশী ও নিরামিষাশী। এবার অবশ্য আমায় কেউ প্রশ্ন করেনি। আমার তখন মাংসখিদে পেয়েছে জোর। আমি ফেসবুকের বেনানি প্রোফাইলে পোস্টটা তাই দিয়েই দিলাম। জানি এবার পুরো একটা গ্রামজুড়ে আগুন জ্বলবে এইবার। চারদিকে পড়ে থাকবে শুধু মাংস মাংস আর মাংস। আহা! খিদের প্রকৃত প্রকারভেদ আজ পরিষ্কার হল আমার কাছে। মাংসের খিদেই তো আসল খিদে।


ছবিঃ গুগল ইমেজেস

তৃষ্ণা
আচ্ছা একটা ট্রেনও কি থামবে না? আসলে শান্তিনগরে যে সাকুল্যে দুটোমাত্র ট্রেন থামে একথা শাশ্বতী জানত না। জানার কথাও নয়। এই চোদ্দো বছরের জীবনে কোনোদিন তাকে একলা ছেড়েছে নাকি বাপি। আজ তাই বরিসের মেসেজটা মেসেঞ্জারে পেয়ে প্রথম প্রথম একটু বুক দুড়দুড় করছিল তার। তারপর সে নিজেকে অনেক বোঝাল। দু-দিনের তো ব্যাপার! আর অতগুলো টাকা। শুধু কয়েকটা ফোটোশ্যুট। ব্যস। রাণাঘাট থেকে কল্যানী। ওখান থেকে গাড়িতে স্টুডিও। ডিটেইলস দিয়ে দিয়েছে বরিস। বরিসের বাড়ি স্ক্যান্ডিনাভিয়া। বাড়ির ছবি পাঠিয়েছে ও। দিদি দেখে বলল, ঢপ’। তা তো বলবেই। আসলে জ্বলছে তো মনেমনে। বলল, ওসব খপ্পরে পড়িস না। বাজে লোক। তোকে নিয়ে আরবে বেঁচে দেবে।’ ধুস। যতসব হিংশুটে। বিয়েটা ঠিক হয়ে যাবার পর ওর হেবি দেমাক হয়েছে। ঝামা ঘষে দেবে আজ শাশ্বতী। এইসব ভাবতে ভাবতেই সে দেখল আরেকটা ট্রেন আসছে। দাঁড়া দাঁড়া। প্লিজ দাঁড়া.... ট্রেনটা অবশেষে দাঁড়াল। শাশ্বতীর গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু জল খেলে হয়। টাকাপয়সা সঙ্গে নেই তেমন। এইসব এতক্ষণ তার মনে হয়নি কেন কে জানে! না। বড়ো তেষ্টা পেয়েছে। একটা কল আছে ওইদিকে। সে দৌড়ে যাবে আর আসবে। ভাবতে ভাবতেই যা ভাবা হয়েছিল তাই হল। অর্থাৎ আরো চব্বিশ ঘন্টার জন্য অন্তত আগ্রহী পাঠককে নিশ্চিন্ত করে ট্রেনটা ছেড়ে দিল।


ছবিঃ গুগল ইমেজেস



প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত জানান, ব্লগে, এমনকি সরাসরি শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী-কে, ফেসবুকে বা মেলে। আইরিন সুলতানার ফেসবুক ঠিকানা  https://www.facebook.com/suddhendu.chakraborty
ই-মেল    dr.suddhendu.chakraborty@gmail.com 

মন্তব্যসমূহ