গল্পটি দ্বৈপায়ন ( মুদ্রিত) -এর ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত
বৃষ্টি নামল। ক্লান্তি নামল। অথচ
ভিকি এল না।
সুজন রিং করে যাচ্ছে। অক্লান্ত।
অথচ তুলল না।
দুই
মনটা ভাল নেই জোলির। সকাল থেকে যে
তিনটে ছবি পোস্ট করেছে, তাতে গড়ে মাত্র সত্তর-আশিটা ‘লাইক’। অথচ কিছুদিন আগেও ছবি
পোস্ট করার ঘন্টাখানেকের মধ্যে পাঁচ-ছ’শো ‘লাইক’ পড়ে যেত। তার মানে জোলিকে নিয়ে
ফেসবুকে আগ্রহ বেশ কমেছে। হতে পারে। জোলির ফ্রেন্ডলিস্টের নিকিতা সিং ও মনপাখি
মোহিনী রীতিমতো কাঁপাচ্ছে। অথচ আগে ওদের এত ডিমান্ড ছিল না। জোলির ট্রেন্ড অনুসরণ
করেই কিস্তি মাত।
নীল পাখি জোলি। না, এটা তার আসল নাম
নয়। ধার করা। আসল নামটা মনেই করতে চায় না সে। শহুরে বাপ-মা জ্যোতিষীর পরামর্শে কী
যে একটা নাম দিয়েছে! বড্ড সেকেলে। শুনলেই মনে হয় হাটু পর্যন্ত ধুলো, উসকোখুসকো মরচে
ধরা চুল, হলদেটে দাঁত, ধ্যাবড়ানো নাক, দোমড়ানো চুপসে যাওয়া বক্ষ। না, সেরকমটি একদমই
নয় সে। দেখতে বরং বেশ সুন্দর। শুধু গায়ের রঙটাই যা কালো। তাও তাতে এক কাজলা
ঔজ্জ্বল্য আছে। ঠোঁট আর চোখদুটিই তার ইউ.এস. পি.। চোখ আঙুর রসের মতো
মেদুর, ঠোঁট পাকা জামের মতো স্বাদু। এক্কেবারে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। তাই
সব ঝেড়েফুঁড়ে
নতুন পোশাকে, নতুন সাজে ও রূপে। যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে, সেজন্য চোখে রঙিন
চশমা ও উইগ পরে নিয়েছে। বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে দমদম, অথচ এখন থাকে বারাসাত।
খোদ কলকাতাতেই পৈতৃক বাড়ি। যদিও সে-বাড়ি
এখন অন্যের দখলে, যে-বাড়ি কখনও সুখের হয়নি। জ্ঞান হতেই দেখে আসছে বাবা-মায়ের তুমুল
গণ্ডগোল। দুজনেই যে যার অফিসে পার্টিতে ব্যস্ত। বাড়ি এসেই বেঁধে গেল। জ্যোতিষী
বলেছেন, গ্রহের দোষ। কেটে যাবে।
জোলি ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী।
ওয়েল-ডিসিপ্লিনড্ স্কুল। সেখানে ভালোই কাটে। ছুটি হলেই বাড়ি। আর বাড়ি মানেই
কুরুক্ষেত্রে।
বাড়িতে বন্ধু বলতে টুকুর মা।
মাঝবয়সী মহিলা। রান্নবান্না ও ঘর গোছানোর দায়িত্বে। সামান্য পয়সার জন্য সেই ঠাকুরনগর
থেকে এতটা দূরে ভোর বেলা এসে পৌঁছায়, আর সন্ধের পর ট্রেন ধরে। কোনও
কোনও দিন তাকে থেকে যেতে হয়, বিশেষ করে জোলির বাবা-মা বাইরে থাকলে। তাকেও
মা কম কথা শোনান না। চুন থেকে পান খসলেই মুখ ঝামটা! একা থাকলে কখনও কখনও
লুকিয়ে কাঁদতে দেখা যায় তাকে। কী আর করবে। সেও তো অসহায়। ছেলেরা যত বড় হচ্ছে, তার
কাজ ততই বেড়ে চলেছে। ছেলেরা খোঁটা দিতে ছাড়ে না। মাঝে মাঝেই তারা হাত পাতে—টাক দাও!
আর না দিলেই যুদ্ধ! একে দাও তো ও শুরু করবে। কাউকে না দাও তো সবাই শুরু করবে। এ
সংসার, না নেড়িকুত্তার যুদ্ধক্ষেত্র? মাঝে মাঝে ঘেন্না হয় বাড়ি ফিরতে। মাঝে মাঝে
মনে হয় ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে সব শেষ করে দেবে! ট্রেনের দরজার কাছে বসে পুটুলি নিয়ে
এসব ভাবে। তবু জীবন ডাকে হাতছানি দিয়ে। জোলিই তার একমাত্র বন্ধু। বন্ধুর দুঃখ
শোনে। তার অবস্থা যে টুকুর মায়ের চাইতেও খারাপ! লাইন অব কন্ট্রোলের আশেপাশের
গ্রামবাসীদের মতোই তার অবস্থা। কখন যে বোমা পড়ে, কখন গুলি!
তিন
বোমাটা আরও জোরে ফাটল। বাবা বিণুদি-কে
নিয়ে এলেন পাকাপাকিভাবে। বিণুদি বাবার বন্ধুকন্যা। তাঁর থেকে বছর চারেকের বড়। কাকু
কাকু বলে মেয়েটা সব সময় গলা শুকাত। আজ ‘কাকু’-ই সেই ‘গলা’ আদ্র রাখার পাকাপোক্ত
ব্যবস্থা করে ফেললেন।
মহাবিস্ফোরণ! সম্পর্কের নতুন
সমীকরণ।
{(আমি-তুমি)+সে}= ‘চলো ইশক লড়ায়ে
সনম!’
বিস্ফোরণের পর মা-ও চলে গেলেন,
বয়ফ্রেন্ড সাগ্নিক-কে নিয়ে। বয়সে বছর দশেক ছোট, সহকর্মী।
সামনেই অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক
পরীক্ষা
জোলির। যদিও জন্মের পর থেকে সে কেবল পরীক্ষা দিয়েই আসছে। ‘ঠাকুর, ও
ঠাকুর—সব ঠিক করে দাও না ঠাকুর।’ ঠাকুর-দেবতা টেনেটুনে এ-পর্যন্ত আনতেই হাঁপিয়ে
উঠেছেন। আর যেন অসম্ভব! তাই নবম শ্রেণিত ওঠার আগেই চলে এল দিদান বাড়ি। বারাসাত।
এটাই এখন তার একমাত্র আশ্রয়। বাবা মানা
করলেন না। বরং খুশিই হলেন। আপদ গেছে।
এখানে এসে একটি বাংলা মাধ্যমের স্কুলে
ভরতি হল। অবৈতনিক। ভালোই লাগে স্কুলটা। কোনও চাপ নেই। শহরের বাংলা
মিডিয়ামের স্কুলগুলো কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে দিন-দিন! বেশির ভাগ দিনই চার
পিরিয়ডের পর ছুটি। অনেকে ক্লাসেও আসেন না। তখন গল্প। বন্ধু পেয়েছে সায়নীকে। ভাল
বন্ধু।
ভাল বন্ধু হবে বলে এগিয়ে এসেছিল
আর-একজন। নাম সুজন। চুলটা একদিকে পাতানো। চোখে মোটা কাচের চশমা। মানে ফুল ক্যালাস!
প্রথম দিন একটা হেল্প দিয়ে শুরু বন্ধুত্ব। তার জন্য আরও বন্ধুত্বের দিকে হাত
বাড়ানোটা ঠিক নয়—এটা বোঝাতেই একদিন ডেকে কড়কে দিল ভালমতো। তবু সে খোঁন নেয়, শুধু
বন্ধু হবার জন্যই, নিঃশর্ত বন্ধু হয়েই।
সায়নী সঙ্গে করে জোলি-কে একদিন বাড়ি নিয়ে আসে। ছিমছাম
সায়নী যে
তলে তলে এত পাকা জানা ছিল না একটুও। ‘লাভলি পুনম’ নামে একটা ফেক প্রোফাইল আছে তার। কত
বয়ফ্রেন্ড! আর তাদের সঙ্গে নিয়মিত চ্যাটিং। এরোটিক! কারও কারও সঙ্গে
দেখাও করেছে। এসপ্ল্যানেডে। পার্ক স্ট্রিটে। চোখ খুলে যায় জোলির।
আগে ফেসবুকটা জানত। গণ্ডগোল থামলে মা-কে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখেছে। অনেক রাত পর্যন্ত কার
সঙ্গে যেন চ্যাটিং করত বোধহয়। সাগ্নিক বসু? উফ্ কী হ্যান্ডসাম! মায়ের মোবাইল
থেকেই দেখা। একবার সেও চ্যাটিং করেছে, জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর দিন! বলেছিল,
থ্যাঙ্কস ডার্লিং!
-ডার্লিং?
-কেন? আমি তো বাবাকেও ডার্লিং
বলি!
-হা হা হা!
( সঙ্গে একটা স্মাইলি-ইমোটিক)
সেই প্রথম। সেই শেষ। মায়ের বকাও
জোটে।
এইসব ভার্চুয়াল জগতকে কখনও তেমন
আমল দেয়নি। প্রশ্রয় দেয়নি। কিন্তু আজ মনে একটা লিবিডো পোকাটা টুক করে কামড়ে দিল
ঘিলুতে। বাড়ি
এসে নিজেই উইগ, গগল্স ও কয়েকটা রিং কানে নাকে থুতনিতে ভ্রুতে ঠোঁটে লাগিয়েই পটাপট
সেলফি। তারপর একটা ফেক অ্যাকাউন্ট। সপ্তাখানেকের মধ্যে হাজার বন্ধু। মাস যেতে না-যেতেই
কোটা পূরণ!
বিভিন্ন সাজে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বিভিন্ন
ছবি। ছবিতে বোঝা যায় না সে এতটা কালো। সামান্য এডিট করে পোস্ট করে। ব্যাস। পোস্ট
করার সঙ্গে-সঙ্গেই
লাইক-লড়াই! ঈষৎ ক্লিভেজ-ব্লো। অমনি ছেঁকে ধরে ক্ষুধার্ত পুরুষ। ইনবক্সে আসে। দু-একটা হায়
হ্যালো বলার পরই বলে, লভ ইউ বেব। বলে, কিস ইউ বেব। বলে, ফাক ইউ বেব! চলে সেক্স
চ্যাটিং। আরও
একটু গভীর হলে ভিডিও চ্যাটিং। তবে মাস্ক পরে। দেখা করতে বলে। জোলি রাজি। বলে কলোনি
মোড়ে, বেদীর উপর, ঠিক দুপুর দুটো বেজে এগারো। ভাঙা
ঘোড়ার উপর নেতাজির মতো আঙুল
তুলে দাঁড়াবে, ব্যাস!
দ্যাখে তার প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে
নেতাজির সাজে।
ক্লিক্ ক্লিক্। ল্যাদ খাওয়া ছবিটা
ইনবক্স করে।
হাট্টিমাটিম টিম
তারা আস্ত ঘোড়ার ডিম
তারা ইয়ো ইয়ো ফানি সিং!
বুঝতে পারে কী মুরগিটাই না হয়েছে!
লাইনে চলে আসে পরের জন।
এভাবে এক...দুই...তিন... চার...
করে সে আজ পর্যন্ত নিরানব্বইটাকে আস্ত মুরগী বানিয়েছে। মারিয়া জোনস্-এর ‘My Hundred Honest Fuckers’-এর মতো সেও একটা বই লেখায় হাত দিয়েছে, Those Whom I Virtually Fucked! বই হবে। থাকবে চ্যাটিং ও পল্ট্রি-মুরগীদের (মোরগ?) ছবি।
চার
শেষ মুরগীটা বাকি। একশোতম শিকারের
খোঁজে জোলি।
ভিকি রায় নামে একজন প্রথম দিন থেকেই
খুব জ্বালাচ্ছে। তাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। প্রোফাইলের ছবিটা নিজের মনে হয়নি কখনও। ফেক
মনে হলে তাকে এড়িয়ে যায়। কী মনে হল, আজ আগ বাড়িয়েই সে বলে, আসল ছবি পাঠান। কথা আছে।
হ্যাঁ, দিল। তেইশ-চব্বিশের ঝকঝকে
যুবক। বেশ ভালই। এরকম আরও কয়কটি ছবি পাঠাল ইনবক্সে। ডিপিটাও পালটে গেছে। অন্য ছবি
ভাল করে পরীক্ষা করে মনে হল, পারিবারিক ছবি, পিকনিকের ছবি যখন আছে, তখন ঠিকই আছে।
কথা এগোল। কথায় কথা বাড়ে। আরও
বাড়লে শুরু হয় সেক্স-চ্যাটিং। এটা-ওটা-সেটা। ভিডিও-চ্যাটেও ডাকে। সাড়া দেয় জোলি। ভিকির
মুখে মাস্ক। সেও মাস্ক পরে নিল। রুটিন মাফিক ভিকি’র পুরুষাঙ্গ দেখতে চায়। দাবিটা মেটে। ভিকিও চায়। একে অপরকে
সব দেখায়। এভাবে
কাটে বেশ ক’দিন।
ভিকিই এখন দেখা করার জন্য উন্মাদ।
ঠিক হল আগামীকাল। শর্ত, মাস্ক থাকবে না কারও। ঠিক
দুটো এগারো।
ভাঙা ঘোড়ার পিঠে উঠে নেতাজি, দিল্লি চলো!
পরদিন হাই জুম ক্যামেরা নিয়ে দূরে
দাঁড়িয়ে জোলি।
কিন্তু দুটো-দশ পর্যন্ত কেউ আসে না। কেবল চায়ের দোকানটাতে দু-একজন। বাস ধরার জন্য
আরও এক-দুজন। রাস্তাদিয়ে কিছু গাড়ি যায়। কিছু লোকও, ফুটপাতে।
আড়াইটে...তিনটে...
তাহলে কি ভিকি রয় তাকে মামু
বানিয়ে গেল?
তিনিটে পনেরো...
ফিরে যাবে? ফিরে যাওয়াই উচিত।
এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে অন্যরকম সন্দেহ করতে পারে।
তাহলে নিরানব্বইতে আউট।
সেঞ্চুরিটা অধরা থেকে গেল। স্টাপড্ বাই ভিকি রয়।
হঠাৎ ফোনটা এল। এই তো...ফোনে ভিকি
হাঁপাচ্ছে...
-ডার্লিং, এসে গেছি! এক্সট্রিমলি
সরি বেব! টায়ার পাংচারড্! এই দ্যাখো...আমি...এখানে...হিল্লি চলো...মেরে বিল্লি
চলো...
ক্যামেরাটা জুম করতেই চোখটা আটকে
গেল!
তবু ক্লিক্ ক্লিক্!
এখন ভাঙা ঘোড়ার পিঠে রাজধানীর
দিকে টগবগ করে ছুটছেন নেতাজি বিবেকানন্দ রায়চৌধুরী ওরফে ভিকি রয়, জোলি’র বাবা!
মন্তব্যসমূহ