।। উত্তরসূরি ।। পিয়ালি মজুমদার ।। ছোটগল্প ।।



ছবিঃ জলসাঘর 





উত্তরসূরি
'আজকের সম্পূর্ণা'-তে গল্পটি প্রকাশিত হয়।  



ঝুরঝুর করে পলেস্তারা খসছে দুশো বছরের পুরোনো শরীর থেকে। চুন, সুরকি আর শক্ত কাদামাটির গাঁথুনি অনেকটাই আলগা হয়ে এসেছে। জায়গায় জায়গায় ছাল ওঠা। খসখসে শরীর জুড়ে খসে পড়ছে সময়
           সাদা হয়ে-যাওয়া লালে কারা যেন বড়-বড় পায়ের আলপনা ফেলে ছোটাছুটি করছে। ঝুম তাদের চেনে না।
           প্রাসাদ বাড়ির এই ঘরটাই সব চেয়ে বড়।
           কোনো এক কালের বৈঠকখানা। জমিদারির হিসাবপত্র থেকে গ্রামবাসীদের সুযোগ-সুবিধা দেখা, এমনকি বিচারসভাও বসত এই ঘরে, দাদুর কাছে শুনেছে ঝুম।
কিন্তু দাদু কোথায় গেল? দাদুকে খুঁজতেই তো...
দাদুউউউউ... দুই মানুষ-উঁচু দরজার ফাঁক দিয়ে বাতাস ধ্বনিত হতেই ঝুম দেখল, বৈঠকি দেওয়ালের সঙ্গে মিশে থাকা দুটো হাত ধীরে-ধীরে প্রসারিত হচ্ছে তার দিকে আসলে শুধু হাত নয়, গোটা একটা শরীর লেগে আছে দেওয়ালে, কেবল চোখ দেখে মানুষ বলে ঠাহর করা যায়তার সারা শরীর থেকে খসে পড়ছে চুন, মাটি সুরকি...
            ঝুম এক ছুট্টে গিয়ে হাতটা ধরতে যেতেই কী যেন এক তীব্র চুম্বক-টানে পুরো শরীরটাই মিশে যেতে লাগল দেওয়ালের সঙ্গে...মিশে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তেই...   
দাদু! 
            ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বিছানায়।
            এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল..!
            পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঝুম। ভিতরমহলের দোতলায়, চব্বিশটি ঘরের মধ্যে দুটো মাত্র ঘর বাসযোগ্য। এইটায় ঝুম আর অন্যটায় তার বাবা প্রদ্যুম্নের জায়গা হয়েছে। পূবের জানলা থেকে দিঘিটা সরাসরি দেখা যায়। ভোরের আলোয় আয়না হয়ে আছে। শেষ রাতে বৃষ্টি হয়েছে বোধহয়, জানলার ঘষা কাচে এখনও জলের নকশারা কাটাকুটি খেলছে... আর এই খেলায় তাদের হারিয়ে দেবে বলেই বুঝি রঙিন কাচঘেরা জাফরি চুঁইয়ে একঝাঁক সদ্যফোটা রোদ্দুর অপূর্ব ছায়াছবির জাল বুনছে ধবধবে বিছানার চাদরে...
             ঝুম সবটাই দেখল। এবং কিছুই দেখল না। আতঙ্কিত, আনমনা মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে নেমে গেল জীর্ণ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।



ছবিঃ জলসাঘর 







                            দুই
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে সিন্দুকের ডালাটা খুলতেই মিহি আতরগন্ধে ভরে গেল ঘর। খাস আগোরাত। নিভাননী দেবী অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন এই বাড়ির অন্দরসজ্জা থেকে শুরু করে জানলা-দরজার নকশা এমনকি ঠাকুরদালান-নাটমঞ্চ-দোলমঞ্চ পর্যন্ত তিনি নিজের শিল্পীমনের ছোঁয়ায় বদলে দিয়েছিলেন অনেকখানি।
              বৈঠকখানা সাতটি সিন্দুকের একটি নিভাননীর, যার সামনে দাঁড়িয়ে অতীত-গন্ধে ভেসে চললেন রমেন্দ্রনাথ আচার্য। অকালে চলে-যাওয়া প্রপিতামহীকে চোখে দেখেননি তিনি, কিন্তু গোটা প্রাসাদবাড়ির আনাচে-কানাচে তাকে আজীবন অনুভব করেছেন, অত্যন্ত যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার স্পর্শ।
             শুধু কি নিভাননী! নিভে যাওয়া প্রজন্মের সব কয়টি সলতেয় বারবার আগুন ছুঁইয়ে সন্ধ্যার তুলসীবনে স্মৃতিপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কাজটিও তিনি একাই করে এসেছেন বিগত ছিয়াশি বছর ধরে।
             বনের ভেতর পথভ্রষ্ট, ধূলিধূসর রাজকন্যার মতো ক্লান্তির ঘুমে ঢলে-পড়া এই অস্তগামী বাড়িটির মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন আদরে, একেবারে একা।
             এবারে তার ছুটি। বাকি শুধু একটি কাজ।
             উন্মুক্ত সিন্দুকের পাশে ধীরে ধীরে বসে পড়লেন রমেন্দ্র।
দাদু।’
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ঝুম।
এসো, দিদিভাই। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে? 
এমনিই। তুমি কী করছ দাদু? কী আছে এই সিন্দুকে?  
যাওয়ার আগে কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে হবে যে দিদিভাই।’
একটি মখমলের বটুয়া আর লাল শালুতে মোড়া আয়তাকার কিছু সিন্দুকের ভেতর থেকে বের করলেন রমেন্দ্র। বটুয়ার ভেতর একজোড়া সোনার বালা, যার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে সরু সরু অসংখ্য সাপ ও তাদের মাথার জায়গায় মানুষের মাথার অতি সূক্ষ্ম কারুকাজ, ঝিকিয়ে উঠছে! বালাজোড়া ঝুমের হাতে পরিয়ে দিয়েই আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন রমেন্দ্র।
আমি জানতাম এই বালাজোড়া তোমার হাতেই হবে, আমি জানতাম!’
উত্তেজনায় মাথা নাড়তে লাগলেন ছিয়াশি বছরের প্রবীণ।


ছবিঃ জলসাঘর 
                         

                             তিন
বালা পরা অনেকগুলো হাত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছে নিজেদের আর চারদিক থেকে ঝুলন্ত বাতিগুলি যেন আরও একটু কৌতূহলী হয়ে আঁকাবাঁকা প্রশ্নচিহ্নের মতো ঝুঁকে পড়ছে সেইসব হাতের ওপর ঘরের একপ্রান্ত থেকে সতেরো বছরের কলকাতাবাসী  ঝুমও দু-চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে অন্যপ্রান্তের সপ্তদশী, আচার্য-বংশের একমাত্র কন্যাসন্তানের দিকে!
নিভাননী এই আয়নাঘরে আসতেন না কেন দাদু? 
নিজের প্রতিবিম্বের থেকে চোখ না-সরিয়েই জিজ্ঞাসা করে ঝুম। এ-বাড়িতে আসা-ইস্তক বিষাদে ছেয়ে আছে তার মন, অজস্র প্রশ্নকাঁটার মতো! ভোরের স্বপ্নটিও অস্বস্তি হয়ে বিঁধে আছে মনের কোনো দুরূহ কোণে। সর্বক্ষণ ঘুরে চলেছে সে আজ রমেন্দ্রর নাকি অজানা অতীতের পিছু-পিছু, নিজেই তা বুঝতে পারছে না। এই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ, প্রাসাদঘেরা বিস্তৃত জমি, যাকে এখন বাগান বলে চেনা শক্ত...বাড়ির পেছনের বিরাট দিঘি, যার এপারে দাঁড়ালে ওপারের মানুষের মুখ ঝাপসা মনে হয়...বারমহল, বৈঠকখানা, আয়নাঘর...নিভাননী, রমেন্দ্র, প্রদ্যুম্ন... এই বাড়ির সব, সমস্তটাই তার কিশোর মনকে এক গভীর রহস্যজালের ভেতর বন্দি করেছে রাতারাতি। অথচ সেই রহস্যের জট ছাড়ানোর সাধ্য তার নেই। অনেক কিছু না পাওয়ার অভিমান, আবার পেয়েও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা থেকে থেকে বুক ঠেলে বেড়িয়ে আসছে শতাব্দীপ্রাচীন দীর্ঘশ্বাস হয়ে!  
নিভাননীর শ্বশুর নগেন্দ্রনাথ আচার্যর ছিল বাইজির নেশা। এই আয়নাঘর তিনি-ই বানিয়েছিলেন। আসলে তা নাচঘর। আসর বসত ফি-সন্ধ্যায়। নিভাননীর স্বামী বীরেন্দ্রনাথও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। এই বংশের অন্য বধূদের ক্ষমতা ছিল না স্বামীদের বিরোধিতা করার। কিন্তু নিভাননী ছিলেন অন্যধাতুতে গড়াতখনকার দিনে বাড়িতে সাহেব রেখে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন মেয়েকে নিভাননীর বাবা জটিলেশ্বর রায়চৌধুরী। স্বামীকে শর্ত দিয়েছিলেন নিভাননী--- হয়  বাড়িতে বাইজিনাচ বন্ধ করতে হবে, নতুবা তিনি গৃহত্যাগ করবেন। শেষমেশ তার কথামতই বছরে একটিবার মাত্র, বিজয়াদশমীর পরদিন আয়নাঘরে বাইজিনাচ প্রথা বহাল থাকে। কিন্তু এ-বাড়ির সর্বত্রগতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রথার ঘোর বিরোধী হওয়ায় কোনোদিন নাচঘরে পা রাখেননি।'
বলতে-বলতে আয়নাঘর থেকে বের হয়ে মূল ভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন রমেন্দ্র, পেছনে পেছনে ঝুম।
          বারমহলের দু-প্রান্ত থেকে থামওয়ালা টানা-বারান্দা মূল ভবনের দরজা পর্যন্ত এসে থমকে গিয়েছে।
          বাড়িটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের আদলে তৈরি।  সময় সময় অনেক রদবদল হয়েছে সেটা নজর করলেই বোঝা যায়।
          এখন প্রায় নষ্ট হয়ে গেলেও বারান্দাঘেরা রেলিংয়ে কাঠের ও লোহার কাজ এক সময় দেখার মতোই ছিল।
এই যে চিনিটিকিরির কাজ দেখছ থামের গায়ে, এই সব আগে ছিল না। নিভাননীর উদ্যোগেই নতুন করে সাজানো হয় সব। থামের মাথায় দেখো, তোমার হাতের বালার মতই সাপ এবং মানুষের মাথার নকশা।’  
           মূল ভবন থেকে যে সিঁড়ি নেমে সোজা রাস্তাটি সিংহদুয়ার পর্যন্ত গিয়েছে,
তার প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে ডানদিকের থামের দিকে ইশারা করলেন রমেন্দ্র। চিনিটিকিরির কাজ কাকে বলে দাদু? এগুলো দেখতে তো অনেকটা চিনামাটির মতো লাগছে।’ থামের নকশায় হাত বুলিয়ে বলে ঝুম।
হুম, ঠিকই ধরেছ দিদিভাই। চিনামাটির থালা-ভাঙা টুকরো গেঁথে-গেঁথেই এই নকশা।’
           গত তিনদিন ধরে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে, অথচ জিজ্ঞাসা করবে কি করবে না, দোদুল্যমান অবস্থায় নিশ্চুপ ছিল এতটা সময়, সেই প্রশ্নটা করেই ফেলে ঝুম, এখানে না-এলে জানতেই পারতাম না আমি রুদ্রপুর-জমিদারবংশের সন্তান। প্রথম এবং একমাত্র কন্যাসন্তান। ছো থেকে শুনে আসছি, আমাদের দেশের বাড়ি রুদ্রপুরে, সেখানে আমার দাদু একা থাকেন, জমিজায়গা দেখাশোনা করেন। ব্যস, এর বেশি কিছু আমাকে জানতে দেওয়া হয়নি কোনোদিন। কেন হয়নি, আর এখনই বা কেন আমায় এখানে নিয়ে আসা হল আমি বুঝতে পারছি না দাদু। তোমার কাছ থেকে, এই বাড়ি থেকে আমাকে এতগুলো বছর দূরে সরিয়ে রাখার কারণ কি?’
            সিঁড়ির ধাপে বসে পড়েন রমেন্দ্র। পায়ের নীচেই একটি বড়সড় ফাটল। সেখান থেকে নয়নতারার চারা উঁকি দিচ্ছে ঝুমের উৎসুক মুখের মতোকী করে এই ব্যক্তিগত ফাটল ঢাকা দেবেন, ভেবে পান না। ঘরে ফেরা পাখিদের ডানা ভেঙে গেলে যেমন করে বেদনা ঘনায় সন্ধ্যামালতীর বনে, তেমনই বেদনা যেন রমেন্দ্রর চোখে ফুটে উঠতে দেখল ঝুম।
দিদিভাই, কেন তোমার বাবা এত বছর দূরত্ব বজায় রেখেছিল এই বাড়ির সাথে, এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সে নিজেই দিতে পারবে তোমাকে। শহর থেকে ফিরলে জেনে নিও তার কাছে।’
আর আজ তোমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার কারণ ওই বালাজোড়া। তুমি জানো, দু-একদিনের ভেতরেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এতদিন যক্ষের মত আগলেছি এই বাড়ির সমস্ত সম্পদ, যদিও সম্পদ বলতে অবশিষ্ট আর কিছু নেই তেমন। তবু, যেটুকুই আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বালা দুটি, যা তোমাকে আমি নিজের হাতে পরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম নিভাননীর শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে।’
শেষ ইচ্ছে? 
হ্যাঁ। সব বলছি তোমায়। তার আগে চলো, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে আসি। 
সীতাপতিইইইইই...পিলসুজ, সলতে আর আগুন নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি...
ভেতরমহলের উদ্দেশে হাঁক পাড়লেন রমেন্দ্র।



ছবিঃ জলসাঘর 




                            চার    
খিড়কি-দরজার ওধারে পা রাখতেই বাইরের অন্ধকার ঝুপ করে গিলে নিল দুজনকে। ভেতরবাড়ির উঠোনে টিমটিমে প্রদীপখানি একা, চেয়ে-চেয়ে দেখছে কালের গর্ভে বিলীয়মান দুটি অসমবয়সী মানুষ পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলেছে মহাকালের নাভির মতো গম্ভীর ধ্যানমগ্ন দিঘিটির দিকে।
ভয় পেয়ো না দিদিভাই, সীতাপতি আলো জ্বালিয়ে দেবে এখুনি।’ 
সিঁটিয়ে থাকা ঝুমের হাত শক্ত করে ধরে তুলসীমঞ্চের দিকে এগোতে এগোতে বললেন রমেন্দ্রনাথ। দিঘির পাশেই মূল তুলসীমঞ্চ। এর ঠিক উত্তরে, দশ হাত দূরে দোলমঞ্চ। আগাছায় ঢাকা পড়ে আছে।
         সলতেয় আগুন ছোঁয়ানোমাত্র ম্লান হলুদ আলোয় মহাকালের নিশ্ছিদ্র জটা খুলে পড়ল যেন। তরল অন্ধকার দুলে উঠল বাতাসে। ওদিকে ঝিঁঝির ডাক ক্রমশ ঘন হচ্ছে সন্ধ্যার শ্বাসপ্রশ্বাসে।
এই বাড়িতে আজই আমার শেষ প্রদীপটি জ্বালালাম। পারলে ক্ষমা কোরো তোমরা... 
কাদের কাছে ক্ষমা চাইছ দাদু? 
আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে। আমৃত্যু তাদের সঙ্গ দিতে চেয়েছিলাম। পারলাম না!’
বলতে-বলতে তুলসীমঞ্চের ওপর ঝুঁকে পড়লেন রমেন্দ্র। আলোআঁধারির মধ্যেও
ঝুম লক্ষ্য করল, রমেন্দ্রর শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
           দাদুর হাত ধরে ধীরে-ধীরে দিঘির পাড়ে এনে বসাল ঝুম। শানবাঁধানো ঘাট এখন হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলোয় ঝলমল করছে। ছয়টি ঘাটের মধ্যে একটিমাত্র ব্যবহারযোগ্য। তার পৈঠায় বসে রমেন্দ্র বলতে শুরু করলেন, নিভাননী ছিলেন আচার্যবংশের স্তম্ভ। তাঁর শিক্ষা, রুচি, সংস্কারমুক্ত মন অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল পরবর্তী প্রজন্মকে। তিনি নিজে হাতে আমার ঠাকুমাকে অক্ষর-পরিচয় করিয়েছিলেন  প্রতিদিন দিনলিপি লিখতেন সেই যুগে এমন ঘটনা সত্যি বিরল।’
         ‘আচার্যবংশে কন্যাসন্তান আসেনি কখনও। অথচ নিভাননী খুব চাইতেন তার একটি কন্যাসন্তান হোক। আশায় আশায় তার জন্য গড়িয়েছিলেন মনের মতো নকশা করা একজোড়া সোনার বালা।’
         এতদূর বলে একটু থামলেন রমেন্দ্র। তারপর আবার বলে চললেন, সেবার জমিতে ফলন খুব ভালো হল। বাড়িতে উৎসব। যাত্রার আসর বসেছে নাটমঞ্চে। অঢেল খাওয়াদাওয়া। গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ। নিভাননী এবং বীরেন্দ্রনাথ ঘুরে-ঘুরে তদারকি করছেন সব কিছুর। সবার খুব আহ্লাদ। পুজোপার্বণ ছাড়া এমন খুশির রাত বড় একটা আসে না রুদ্রপুরে।’
         রাত্রি একপ্রহর পেরিয়ে গেছে। জমে উঠেছে রামরাবণ পালা। দোতলার বারান্দায় বসে নিভাননীও খাস পরিচারিকা মল্লিকাকে নিয়ে পালাগান শোনায় বিভোর। হঠাৎ দর্শক-আসনের পেছনের সারি থেকে কেউ একজন হুঙ্কার দিয়ে উঠল। দেখতে দেখতে সিংহদরজা ভেঙে হুহু করে সশস্ত্র ডাকাতদল ঢুকে নিমেষে দখল নিয়ে নিল গোটা প্রাসাদবাড়ির। রতনডাকাত তখন রুদ্রপুর ও আশেপাশের এলাকার ত্রাস। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, গ্রামবাসীদের সাথে মিশে রতন কখন গা ঢাকা দিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।’
ডাকাতের হাতে প্রাণ গেল বীরেন্দ্রর। নিভাননী খিড়কির দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেনযাওয়ার আগে মল্লিকার হাতে সঁপে দিয়ে গেলেন নিজের একমাত্র কিশোরপু্ত্র-পুত্রবধূকে। আর দিয়ে গেলেন সেই বালাজোড়া। ভবিষ্যৎ উত্তরসূরির জন্য। বুদ্ধিমতী নারী জানতেন, সাধারণ পরিচারকার কেশাগ্রও স্পর্শ করবে না ডাকাতসর্দার। শরীর ভর্তি গয়না, বেনারসি সজ্জিতা নিভাননী, স্বেচ্ছায় তলিয়ে গেলেন দিঘির অতল গহীনে।


ছবিঃ জলসাঘর 

   


                                   পাঁচ
আস্তে আস্তে দড়ি আলগা দিতেই কাঠামো জলে পড়ে গেল। ভাসছে। ডুবছে। ডুবে যেতে যেতে প্রতিমার কালো চুলের মতো অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছে অতীত। বিসর্জন সম্পূর্ণ। দিঘির জলে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে-থাকতে ঝুমের তবু মনে হল এই বুঝি উঠে আসবেন দেবী নিঝুম জলের গর্ভ হতে...  
দিদিভাই... 
চমকে উঠল সে। পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে।
আমরা তো এই বাড়িতেই থেকে যেতে পারি  দাদু...’  রাত্রির মতো গাঢ় স্বরে স্বগতোক্তি করল ঝুম। রমেন্দ্র কিছু বলতে গেলেন। সীতাপতির ডাকে বাধা পড়ল, দাদাবাবু সদর থেকে ফিরে এসেছেন। আপনাদের খুঁজছেন।’  
আর একদিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ি খালি করে দিতে হবে, বাবা। কাল থেকেই সরকারি লোক পাঠাবে ওরা সংস্কারের কাজ শুরুর জন্য। বুঝতেই পারছ সামনে ভোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই ওদের লাভ।’   
            চুপচাপ প্রদ্যুম্নের কথা শুনছেন রমেন্দ্র। হেরে যাওয়া মানুষ আর কিই-বা করতে পারে! দুশো বছরের পুরনো জমিদারবাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এক বছর আগেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে নোটিশ এসেছে এ-বাড়ি অধিগ্রহণের। বিশ্ববিদ্যালয় করবে সরকার। মামলা করেও শেষরক্ষা হয়নি। প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে মামলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন রমেন্দ্র। একা আর কত লড়াই করবেন! সন্তানও যে তার পাশে নেই 
          কথা বলতে-বলতে হঠাৎ চুপ করে যায় প্রদ্যুম্ন। ঝুম এসে দাঁড়িয়েছে দরজার পাশে। তার হাতে ধরা লাল মতো কিছু জিনিস।
কিছু বলবে, ঝুম?
রমেন্দ্র চোখ তুলে তাকান। বড় মায়া পড়ে গেছে দু-দিনেই নাতনিটির ওপর
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ভাঙা খাঁচা থেকে। থাক, মায়া বাড়িয়ে কি লাভ!
এতদিন এই বাড়ি থেকে আমায় দূরে কেন রেখেছিলে বাবা? তুমি জানতে না এই বাড়ি আমার অপেক্ষায় রয়েছে? এই বাড়ির প্রত্যেকটি ইট অপেক্ষায় রয়েছে আচার্যবংশের একমাত্র কন্যাসন্তানের?
প্রদ্যুম্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় ঝুম। দু-চোখে জল টলটল করছে 
         এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে যেন জানাই ছিল কোনো ভূমিকা ছাড়াই তাই উত্তর দেয় প্রদ্যুম্ন, বাবা অবসেসড্‌ ছিলেন এই বাড়ি নিয়ে। এই রুদ্রপুর ছেড়ে একদিনের জন্য কোথাও যানি, যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় বাড়ির! না, ভুল বললাম। এই বাড়িকে বাঁচাতে শহরের কোর্টে গেছে দিনের-পর-দিন। জীবনে প্রথমবার। আমার মাকে বাঁচাতেও যদি একবার যেতেন...তাহলে তুই কেন ঝুম, আমিও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতাম না এই বাড়ি থেকে!’   
          ‘আসলে এই বাড়ির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাবার কাছে আর কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু ছিল না.. আমি, মা, মায়ের কার্যত বিনা চিকিৎসায় চলে যাওয়া, আমার বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে গিয়ে ওঠা---কিচ্ছু না...!’   
          ‘বুঝলি ঝুম.. কিচ্ছু না! 
          ‘শুধু এই বাড়ি... এই প্রেতপুরী...আমি ঘেন্না করি এই বাড়ির প্রতিটি ইটকে...ঘেন্না...ঘেন্না...!' বলতে-বলতে মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে প্রদ্যুম্নর। ঘরের ভেতর বাকি দুটি প্রাণী নিঃস্পন্দ, প্রাণহীন।
আজও আসতাম না ঝুম। আমার মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে এই বাড়ির ধুলোয়...আর তোকে নিয়ে আসার জন্য বাবার অনুনয়। তাই শেষবারের মতো...
অনেক দূর থেকে এসেছ, প্রদ্যুম্ন। ধকল গেছে। বিশ্রাম নাও। সীতাপতিকে বলছি, রাতের খাবার দিতে।’ হঠাৎ করেই মৌনতা ভেঙে বলে ওঠেন রমেন্দ্র। অসম্ভব শান্ত, নিঃস্পৃহ দেখায় তাকে! ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান তিনি। চলমান বৃক্ষের মতো। নাকি মৃতদেহ!
            ঝুমের স্বপ্নদৃশ্য মনে পড়ে যায়...মনে হয় যেন দুই প্রজন্মের দুই পুরুষের মধ্যে একটা দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। আর সেই দেওয়াল থেকে খসে খসে পড়ছে চুন, সুরকি, মাটি...  


                            ছয়
বিবাহের পূর্বে ভাবিতাম, এ অঞ্চলে একটিও বিদ্যালয় নাই কন্যাদিগের শিক্ষাদানের নিমিত্ত, আমি বড় হইয়া পিতার গৃহের পাশে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিব। তখন বুঝি নাই, কন্যারা আসলে শ্বশ্রূগৃহের বংশরক্ষার এক মাধ্যমমাত্র, আর কোনো পরিচয় উহাদিগের নিমিত্ত সমাজ ধার্য করে নাই। আর পিতার বংশে কন্যারা ব্রাত্য।
আমার কোল আলো করিয়া কন্যা আসিবে যেইক্ষণে, সেই হইবে আমার বংশপ্রদীপ। এই বংশের কন্যাসন্তান এই গৃহব্যতীত আর কোনো স্থানে যাইবে না। এমনকি বিবাহের পরেও সে পিতৃগৃহে পুত্রের সমান অধিকার লইয়া বসবাস করিবে। এমনই প্রথা আনয়ন করিব এই আচার্যবংশে, আমি নিভাননী দেবী।’
             হলুদ, ভঙ্গুর পাতাগুলি সাবধানে ওলটাতে থাকে ঝুম। কত গল্প, কত অনুভূতি ছাপ রেখে গেছে সময়ের গাছকৌটোয়। লালশালু মোড়া একটি খেরোর খাতা, যাকে এখন খাতা বলে চেনা শক্ত, ঝাপসা হয়ে-আসা অক্ষরগুলি কোনোমতে পড়া যায়, সুতোর বাঁধনও ছিঁড়ে গেছে কবে কে জানে! এখন সামান্য হাওয়া দিলে ধুলো হয়ে উড়ে যেতে চায় নিভাননীর দিনলিপি।
           আর এক জায়গায় লেখা, এ গৃহের চৌহদ্দি হইতে বাহির হইবে নিভাননী...একমাত্র মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়া, নতুবা নয়।’ 
          সত্যিই তো।
          মৃত্যু ছাড়া আর কে ছুঁতে পেরেছে তাকে!
          এক মহিমাময়ী নারীর মুখচ্ছবি কল্পনা করতে-করতে উদাস হয়ে যায় ঝুম।
কী যেন ভাবে। তার পর পূবের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বালা-পরা দু-হাত বাড়িয়ে দেয় শূন্যে।
           অলৌকিক কোনো স্নেহস্পর্শে চোখ বুজে আসে তার। ঠোঁটে অপার্থিব হাসি! দিঘির জলে চাঁদ ডুবে যায় চিরতরে।



                          সাত
মরচে-ধরা চাবিগোছাটা অনেকক্ষণ ধরে হাতে নিয়ে বসে আছেন রমেন্দ্রনাথ। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। এমন দিনে এটাই যেন স্বাভাবিক। বৈঠকখানা দরজা দিয়ে সোজাসুজি তাকালেন বাইরের দিকে। সিংহদুয়ার হাট করে খোলা। এতদিনের চৌকিদারি শেষ হল। নিজের মনেই হাসলেন খানিক মাথা নিচু করে।
            লাল মেঝেতে কার যেন ছায়া পড়ল?
            প্রদ্যুম্ন।
            দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত ভাবে।
ভেতরে এসো।’
বাবা, একটা কথা ছিল।’
হ্যাঁ, বলো। আমারও দরকার ছিল তোমার সাথে।’ বলে চাবির গোছাটা গুঁজে দিলেন ছেলের হাতে।
ওদের সাথে বাড়ি হস্তান্তরের বিষয়গুলো তুমি বুঝে নিও। যাওয়ার বেলায় আমি আর এ-সব ঝামেলায় থাকতে চাই না।’
বাবা, তুমি আমাদের সাথে কলকাতা চলো। ঝুমের ভালো লাগবে।’
তা হয় না প্রদ্যুম্ন। সারাজীবন খাঁচায় কাটিয়ে ডানা ভারি হয়ে গেছে যে। পরিযায়ী হই সাধ্য কি বলো!’   
         ‘চিন্তা কোরো না, ডাক্তারজেঠুর বাড়িতে আমার আর সীতাপতির মাথা গোঁজার ভালো ঠাঁই জুটেছে। দুই বুড়ো কাটিয়ে দেব ঠিক। আর এই বাড়ির হাওয়ার মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস না-নিলে হাঁপিয়ে উঠব আমরা। ভেবো না তুমি।’
কিন্তু, বাবা!’  
প্রদ্যুম্নর কথা শেষ করতে না-দিয়েই দুজনের মাঝখানে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সীতাপতি। মুখে চোখে আতঙ্ক। 
সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবু, বিরাট সর্বনাশ!হাঁউমাঁউ করে কঁকিয়ে উঠল সে!  
‘কী হয়েছে সীতাজেঠু, অমন হাঁপাচ্ছ কেন?
ঝুম, ঝুম দিদিভাই...কোনোরকমে দীঘির দিকে ইঙ্গিত করল সীতাপতি। 
           লালশালুতে যত্ন করে মোড়া দিনলিপি। তার ওপরে নিভাননীর বালাজোড়া। ঠিক পাশেই রিমলেস চশমাটা গুছিয়ে রাখা। ঝুমের। চশমার নীচে চাপা দেওয়া দুটি কাগজ।
           ঘাটের সিঁড়িতে ধপ্‌ করে বসে পড়লেন রমেন্দ্র। কাঁপা-কাঁপা হাতে তুলে নিলেন কাগজ দুটি...একটিতে নিভাননীর সেই সংকল্প, -গৃহের চৌহদ্দি হইতে বাহির হইবে নিভাননী..একমাত্র মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়া, নতুবা নয়।’
           অন্যটিতে ঝুমের, তুমি এবার নিশ্চিন্তে যেতে পারো দাদু। আমি থেকে গেলাম। নিভাননীর স্বপ্নের উত্তরসূরি। আচার্যবংশের একমাত্র কন্যাসন্তান। কি করে তাকে ছেড়ে, এই বাড়ি ছেড়ে যেতাম, বলো!  

           বিস্ফারিত চোখে দিঘির দিকে চেয়ে রইলেন রমেন্দ্র। স্পষ্ট দেখতে পেলেন, ইতিহাস হাত ধরে আছে অন্য এক ইতিহাসের। দুজনের হাতেই সময়ের অদৃশ্য বালা। আলো ঠিকরাচ্ছে। অবিশ্রাম।
ছবিঃ জলসাঘর










প্রিয় পাঠক, আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, সবটাই নির্দ্বিধায় জানান এই  ব্লগের 'কমেন্ট'-এ, এমনকি পিয়ালি-কেও সরাসরি ফেসবুক বা ই-মেলে জানাতে পারেন। ভালো বা মন্দের ফিডব্যাকটা পাওয়া দরকার আগামীর জন্য। 
পিয়ালি মজুমদারের ফেসবুক-ঠিকানা https://www.facebook.com/piyali.majumder2

ই-মেল  piyalimajumder289@gmail.com 



পিয়ালি মজুমদার

মন্তব্যসমূহ