জ্যোৎস্না-রং থেকে লুভর প্যারাডাইস ।। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী


জ্যোৎস্না-রং থেকে লুভর প্যারাডাইস ।। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী 

গুয়েতমালার একটি শহরে রাস্তায় গজিয়ে ওঠা ভিখিরিপল্লি। জায়গাটার নাম প্লাজা দে আরমাস। রাস্তাটা সিধে গেছে ক্যাথেড্রালের দিকে। সেখানেই 'জ্যানির' বাড়ি। বাড়ি মানে বসত আর কী। মানে ফুটপাতের এক চিলতে জায়গা। 'জ্যানি' আধা অন্ধ এক পিস ভিখিরি। সবাই তাকে 'পাগলা জগাই' বলে ডাকে। কারণ? কানের কাছে কেউ যদি 'মাদার' বলে, জ্যানি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। ইমোশোনাল জ্যানি যা কিছু করতে পারে। প্রয়োজনে খুনও। একদিন এমনই ঝোঁকের মাথায় সে 'মাদার'-এর নামে গালিগালাজ করতে থাকা কর্নেল হোসে পারালেস সোঁরিয়েন্ডেকে খুন করে বসল। ব্যাস। বাকিটুকু মিগ্যুয়েল অ্যাঞ্জেল অ্যাস্টুরিয়াসের 'প্রেসিডেন্ট' গল্পে অনুপুঙ্খ লিখে গেছেন। সাহিত্য এক সময়ে 'মিসরি মেমোয়র্স' লেখবার চল ছিল। অর্থাৎ মানুষের দুর্দশার কাহিনি, তার জান্তব জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণ। পাঠকের বমি আসবে, বই ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু সে কিছুতেই পারবে না। গুয়েতমালার এই বিখ্যাত নোবেলজয়ী সাহিত্যিক এইভাবেই পড়েছিলেন, মনে হয়েছিল, এর পরে কোনও দিন কোনও প্রেম উপাখ্যান লেখা হতে পারে না। কারণ, ছায়াবীথি তলে স্নান করার সময় আমাদের ফুরিয়ে এসেছে। 'প্লাজা দে আরমাস' থেকে সটান ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, ডানকুনি, সন্দেশখালি, টাকিরোড, ধুপগুড়ি, গোয়ালতোড়, আমলাপাড়া ছেয়ে ফেলেছে জরুরী অবস্থা। নিশ্চিন্ত বনবিতানে বসে অশোকগাছের ছায়ায় গদ্য লেখার সময় ফুরিয়ে এল।

              গদ্যকার অমিতকুমার বিশ্বাসের 'আইরিনদের চিলেকোঠায় বুলডোজার ভাঙছে জোছনা-রং' বইটি যেদিন হাতে এসেছিল, সেদিনই তাই খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম, বিরক্তও। কারণ? ওই 'জোছনা- রং' শব্দটি। প্রেমকাব্যের ওপর আমার চরম লোভ উথলে উঠেছিল সেদিন। যাঁরা এর আগেও এই গদ্যকারের পূর্ববর্তী গল্পগুলি পড়েছেন, তাঁরা জানেন এই গদ্যকার দীর্ঘ নামাঙ্কন করেন। দীর্ঘ নামও খানিকটা আমার অপছন্দের। আর ওই 'জোছনা-রং' যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয়, সেটুকুও। এমন ভাবতে ভাবতেই আলাপ হয়ে গেল ভুবন, গুরু, আর ল্যুভর প্যারাডাইসের সঙ্গে। আলাপ গাঢ়তর হল। জোছনা-রং-এর আড়ালে এলইডি আলোর কুৎসিত কারুকীর্তি স্পষ্ট হল চোখের সামনে। পাঁচ ফর্মার এই বইটা নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। গদ্যকার অমিতকুমারের সাফল্য এখানেই।

           দশটি ছোটগল্পের সংকলন এই বইটি। গদ্যের ফর্মের ভাঙচুর এই গল্পকারের বরাবরের পছন্দের বিষয়। নির্ভীক যোদ্ধার মতো তিনি গল্পের ফরম্যাট ভাঙচুর করতে পেরেছেন। তবে, শুধু গঠনগত ভাঙচুরই নয়, একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই প্রচেষ্টা আসলে ভাঙচুরগুলোকে খানিক জোড়া দেবার চেষ্টাও। যেমন প্রথম গল্পটি, 'কফিনের অভ্রান্ত ডানা, গোডো আর লাল পিঁপড়ের গল্প'। কোনও চা-বাগান এই গল্পের প্রেক্ষাপট। শীলবাবু নামক এক জনৈক মহা হিতৈষী ব্যক্তির হাতধরে ভুবন জীবিকার সন্ধানে চলে আসে এখানে। আলাপ হয় জোসেফ পাউরিয়ার সঙ্গে। প্রাথমিক রোমান্টিকতা ক্রমশ মিটে যায় যখন একে-একে জানা যায় তাদের বেতন অনিশ্চিত, মালিক ভাবলেশহীন সিস্টেম আর চা বাগানের আনাচে-কানাচ শ্বাপদের মুক্তাঞ্চল। মিটিমিটি কানে আসে, " এই কাছেই এম কে জি চা বাগানে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রীকে পুড়িয়ে চা শ্রমিকেরা তাদের মাংস দিয়ে সেই রাতে আহার সারে।" বড় কাঠ-আলমারিতে উই ধরলে যেমন দিব্বি দেহাতি লাগে, আর টোকা মারলেই ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়ে, তেমনই এক সিস্টেম যখন তার অপদার্থতা ঢাকা দিতে চায়, তখন তার প্রয়োজন হয় আফিমের। এই আফিম নানান রকম, নানান মোড়কে জনগণআর গণতন্ত্র’ –কে বুঁদ করে রাখে। অমিতকুমারের বুলডোজার’-এর নিশানা আসলে এই আফিমের তৈরি জোছনা-রং। ভুবনের ক্ষেত্রে এই আফিমের নাম উলটে যাওয়া মা-কালীর ক্যালেন্ডারের ফোটো।এই নিয়েই তার রফিকের সঙ্গে মারধোর, বিপর্যয়, শেষে সেই রফিকের কাঁধে করে বৈতরণী পার হতে যাওয়া—‘তোর কিছু হবে না দোস্ত। আমি আছি।আফিমের ঘোর কাটতে দেখা যায় ভগবানপ্রতিম শীলবাবু চিটফান্ডের টাকা মেরে দিয়ে পগারপার হয়েছেন, আর বসতির অভিভাবকতুল্য জোসেফ পাউরিয়ার মাংস দিয়ে নৈশাহার করতে উদ্যত চা বাগানের অভুক্ত আদিবাসীরা। গল্পটিতে গদ্যকার দশ শিক্ষাবিদদের মতো পাঠকদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন অমিত---‘ ...সে-ই কি সরকার? না যে দিদিরা মাঝে মাঝে পোলিও খাইয়ে যায়, ম্যালেরিয়ার সতর্কীকরণ দিয়ে যায়, বিনামূল্যে কন্ডোম বিলি করে যায়, যা তাদের বাচ্চা-কাচ্চারা বেলুনের মতো ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, খুব মজা পায়, তাদের তো আর খেলার জিনিস সহজে মেলে না, এঁরাই কি সরকার? না অন্য কেউ আছে? ওই যেদিন ভোট আসে। পুলিশ আসে। নেতা আসে। অনেক কিছু শোনায়। অঢেল প্রতিশ্রুতি।পেশাগতভাবে অমিতকুমার একজন শিক্ষক। বুঝলাম মাস্টারমশাই প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন। কঠিন প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে আরও খননের প্রয়োজন। স্যামুয়েল বেকেটের SAMUEL BECKETT ‘ওয়েটিং ফর গোডো’-র (Waiting for Godot ) শেষে না-হওয়া অপেক্ষায় হয়তো এবার সময়ের বলবার ইট ইজ টাইম


            দ্বিতীয় গল্পের আফিমের নাম ছায়াছবি। পূর্ববঙ্গের ব্রাশফায়ারে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া পাঁচুগোপাল ফিল্মি কায়দায় গুরুহয়ে ওঠার গল্প। গল্পের অধ্যায়ভাগে ব্যবহৃত হয়েছে কবিতাগানের লাইন। বিন্যাসটাই বেশ বলিউডি স্টাইলের। গুরুর ভিখিরি থেকে ভ্যানরিকশা চালক হয়ে-ওঠা, রিকশা থেকে ভ্যান, ভ্যান থেকে টোটোর বিবর্তনের জয়যাত্রাপুরোটাই ফিল্মি, ‘শোলেসিনেমার মতো। এই আফিমের নেশাতেই তো বুঁদ আছে তামাম একশো তিরিশ কোটির একটি দেশ। সেখানে গরিবি হটে যাচ্ছে নিমেশে, শত্রুদেশের আঁতুড়ঘরে গিয়ে বুলেট ঠুঁসে আসছে জাবাজ কমান্ডো, পশ্চিম দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে দেশের ক্যারিশ্মাটিক ছেলে-ছোকরারা। তবে দুর্ভাগ্য, এ সবই হচ্ছে রুপোলি পরদায়। গুরু’-কেও এই নেশা পেয়ে বসেছিল। বারবার তাকে তাড়া করে বেড়ানো হ্যালুজিনেশন, বিপর্যস্ত পারিবারিক জীবন, অনিশ্চয়তা, সবকিছু থেকে মুক্তির স্বাদ, ‘দুটো কয়েনের টেল-এর দক ভাল করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে একটা কয়েন তৈরি করে। কিছু সমস্যা হলেই কয়েনটিকে শূন্যে উড়িয়ে-দেবার পর একদম গুরুর ভঙ্গিমায় সেটিকে হাতের তালুতে লুফে নিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘হেড’! গুরুর মানসিক বিকার বাড়তে থাকে, পাগলাগারদের নরকতূল্য যাপনচিত্র যেন সমাজের প্রান্তিক মানুষদেরই জীবনকাহিনি। শেষে প্রবহমানতা। সমাজতান্ত্রিক নিয়ম মেনে ভ্যানরিকশা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, গুরুর অস্তিত্বও, কিন্তু রুপোলি পরদা হয় না। ক্রোড়পতিসহাস্যে নোটভর্তি ব্রিফকেস খোলেন। বান্ডিলে হাত দিতেই নোটগুলো আলগা হয়ে উড়তে থাকে। হুড়োহুড়ি পড়ে যায় চারিদিকে। মানুষ দৌড়োয়, কাড়াকাড়ি করে। উপরের ইলেকট্রিক তারে ঝুলতে থাকে পাঁচুগোপাল ওরফে গুরুর মৃতদেহ।

                কোনও ঘটনার ধারাবাহিকতা অমিতকুমারের গদ্যে গতানুগতিক প্রবহমানতা পায় না। সেই কারণেই সাবেকি গদ্যপাঠকদের, এই গল্পগুলি পড়তে গিয়ে বিচ্ছিন্ন লাগতে পারে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, গদ্যগুলির মধ্যে অন্তর্নিহিত ভাবনাগ্রন্থি বেশ পাকাপাকিভাবেই আছে। খাঁচামানুষ আর পাখিদের নৈসর্গিক উপাপাদ্যগল্পে যেমন সুরবাস্তবতা ধরা দেয় এইভাবে, ‘...প্রথমবার ডানা মেলে দিতে চাইল। পাখির মতো। হ্যাঁ হ্যাঁ, তার চেয়ে হতভাগা আর কে আছে এই পৃথিবীতে। সে ডানা ঝাপটাল। অস্থির প্রজন্মের পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে? মনোবিদ এইনসওয়ার্থের তত্ত্ব মানলে বিগত শৈশবস্মৃতি শুধুমাত্র এক অস্তিত্বকাতর অস্থির ভবিষ্যতের রচনা করতে পারে। অনেক দূরবর্তী ল্যুভর প্যারাডাইসে থাকে উল্লাসের বাবা। ল্যুভর প্যারাডাইসের ভোগলিক দূরত্ব যত, তার থেকে বহুগুণ দূরত্ব দুই প্রজন্মের মননে। উল্লাসের শৈশব নেই। তার শৈশব হৃত। তাই তার প্রয়োজন খাঁচার। সে টেবিলের মধ্যে ঢুকে বসে থাকে। তার স্ত্রী বিস্মিত হয়। কিন্তু সেই বিস্ময়, কৌতুক, প্রেম উল্লাসকে তার সম্পর্কহীনতার সংকট থেকে বের করতে পারে না। হয়তো ফ্রয়েডপন্থীরা এই টেবিলের অ্যানালগকে মাতৃজঠরই বলতেন। হয়তো উল্লাস জন্ম নিতেই ভয় পাচ্ছে। তার কাছে তার মাতৃজঠরই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি এমনটাই হবে? গল্পের পরিণতিতে হঠাৎ ঘটে যাওয়া স্ত্রী সুষমার গর্ভবতী হবার সংবাদ উল্লাসের কাছে একটা ক্রাইসিস হয়ে ওঠে। সেই ক্রাইসিসের পরিণাম কতটা ভয়ানক হতে পারে মনোবিদেরা জানেন। অমিতবাবু এখানে অবশ্য আশাবাদীতার সন্ধান দেখিয়েছেন। পকেটে একখানা চাকু কখন থেকে যে আততায়ীর মতো লুকিয়ে! চাকুটার গলা টিপে ধরল। এক্ষুনি ছেড়ে না-দিলে বোধহয় শ্বাসরোধে মৃত্যু হবে চাকুটার। হোক, তাই হোক। সুষমার অলখ্যে ঘরের কোণে ছুঁড়ে মারে সেটি।অনেকটা মাদকে বুঁদ হয়ে থাকা যুবকের বোধোদয়ের মতো। উইথড্রয়াল আসছে, যন্ত্রণায় কুঁচকে হাত-পা মুখ, তবু সে হারছে না। সে হারবে না। আমাদের পরের প্রজন্ম...

                 আফিমের রোগ থেকে মুক্তির শুশ্রুষার প্রথম ধাপটি নেয় ময়নাবিবি। রাক্ষসী আয়লা বিধ্বস্ত একটি গ্রামে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বধ্যপরিকর এইট-পাশ ময়নাবিবি। মোড়লতন্ত্রের জাতসাপ, ইন্টারভিউ, রেকমেন্ডেশন, ব্যাকডোরের ঘুষতন্ত্রের তোয়াক্কা না-করেই তার সংগ্রাম এগিয়ে যেতে থাকে। ঘটনাচক্রে সেখানে তাকে খানিকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অপু। বিভূতিভূষণের অপু-দুর্গা এক অদ্ভুত রূপায়ন লাভ করে, যেন চাকদারোডের সারিসারি শিশুগাছের স্বর্ণলতা আর ফার্নের মালা গয়না ধরে আবার ফিরে আসে জনপদে। ময়নাবিবির সংগ্রাম চলতেই থাকে। যেমন চলতে থাকে নিঃসঙ্গ সুমির সংগ্রামও। যৌনতা ঢুকে আসে। প্রথমে সে আবিশ্যিকতা। পরে সে হয়ে ওঠে দস্যিছেলের ছুটোছুটি করা ক্যানভাস। আর সুমি খুঁজতে থাকে তার জড় অস্তিত্ব, ট্রেনে পা-তুলে বসবার অধিকার।

                 সাঁওতাল পরবের একটি গানের নাম দাসাত্র সেরেঞ্চ। সেখানে কামরু গুরুনামক প্রধান ওঝা, তার সহচর ধর্মগুরু, মারাং গুরু, সিদো গুরুদের নিয়ে মন্ত্রপাঠ করে এই সেরেঞ্চ’-এর মাধ্যমে সাঁওতাল সমাজকে অশুভ আত্মাদের থেকে মুক্তি দেয়। ভূত, ভগবান এবং...গল্পে নুনির মধ্যে এই ভূতের ভয় ছাড়াতে এভাবেই তৎপর হয়েছে সবাই। নুনির মা হাতেনাতে ধরে ফেলেন ভূত। বলেন, ‘ভূতিরা এহন জঙ্গলে চোলি গেছে, বুঝলি নুন্নি। এমন প্যাঁদানি দিছি না!নুনির বিয়ে হয়, তার স্বপ্নের শাহাজাদা ভানচালক নংকুকে সে একদিন মাঝরাতে তার জায়ের বিছানায় আবিষ্কার করে। শেষমেশ একদিন নুনি তার ভয়কে জয় করে। নুনি সটান বলে দেয়, ‘না। আলোটা জ্বলবে!নুনির ভূত পালিয়ে গেছে। নুনি বুঝতে পেরেছে ভূত বলে কিছু হয় না। কামরু গুরুর মতো তার মাথা থেকেও ভূত ঝেড়ে দিয়েছে কেউ! অন্ধভূমি সিন্ধুভূমি’-তে নন্দিতা যেমন অরিন্দমের মেসেজ কাম টু কোর্ট অ্যান্ড টেক দিয়া!পড়ে ঘাবড়ে যায় না। যুদ্ধ যেখানে অনিবার্য সেখানে আলো নিভিয়ে কি হবে? নন্দিতারও মুঠোয় তাই রিমোট থাকে। মুঠো শক্ত হয়।

                 আইরিনদের চিলেকোঠায় জ্যোৎস্না-আফিমের শেষ দুটি গুলি আনে বুবুন ঘরে ঢুকছেআর গল্পের গোরু আকাশে উড়তে চেয়েছিলগল্পদুটি। প্রথম গল্পের আফিম ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। রবার্ট অ্যান্ড দ্য ডেভিলস। রবার্ট নামে এক সাধারণ যুবক কুস্তি, বক্সিং এমনকি ঘোড়াদৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হয়, তারপর উদ্ধার করতে যায় শহরবাসীদের, ডেভিলসরা গোটা শহরটাকে একটা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে, নির্বিচারে খুন করছে সাধারণ মানুষদের, শিশু- কিশোরদের। তাই ডেভিলসদের মারতে বেরিয়ে পড়ে সে...এক অনিবার্য উটপাখিতত্ত্ব, যাতে আধুনিক প্রজন্ম তাদের ক্যাথারসিস খুঁজে পেয়েছে। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে রিপ্লের সুযোগ আছে, আসল পৃথিবীতে নেই। দ্বিতীয় গল্পের আফিম মুক্তযৌনতা। উইধরা কাঠ-আলমারিতে বাস-করা জীবজন্তুগুলো যে-সব না-পাওয়ার কাহিনি নিয়ে সংগ্রাম করবে ভেবেছিল, তাদের এক লহমায় শান্ত করে দেবার দাওয়াই। নেপথ্যে মাইকেল জ্যাকসনের জাস্ট বিট ইটগান। দেশপ্রেমব্যাপারটাকে দশ এয়ারটাইট প্যাকেটে মুড়ে তাকে বিপণনযোগ্য করে তোলা। দৃশ্যটা সেলিব্রেট করার জন্য উপস্থিত যুবতিদের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরুষাঙ্গ আকৃতির নানান রঙের আইসক্রিম, আর যুবকদের হাতে যোনি আকারের। সবাই মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ করে চুষতে শুরু করে। পটাপট ছবি। আপলোড। ইয়ে মেরা ইন্ডিয়া, আই লভ মাই ইন্ডিয়া’ ’

              জ্যোৎস্না-রঙের আফিম ভাঙবার নেশায় অমিতকুমারের গদ্যের বুলডোজার কতটা সফল হল, তা পাথকই বলবেন। নবারুণ ভট্টাচার্যের রোডরোলার নিয়ে একটা ছোটগল্প পড়েছিলাম। রোডরোলার চালক হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করে দাঁড়িয়ে থাকা দামী দামী বিলেতি গাড়িগুলো তার রোলারে পিষতে শুরু করলেন। আইরিনদের চিলেকোঠায় বুলডোজার ভাঙছে জোছনা-রংগল্পসংকনটি নিরিবিলি স্নিগ্ধ বীথিকায় পড়বার সংকলন নয়। আইরিনরা অস্থির, সংকটাকূল আর ডেসপারেট। তাই পাঠক, হেলমেট পরতে ভুলবেন না। সতর্কতা না নিয়ে এই বই পড়লে বিপর্যয় হতে পারে।

আইরিনদের চিলেকোঠায় বুলডোজার ভাঙছে জোছনা-রং
অমিতকুমার বিশ্বাস
অভিযান পাবলিশার্স
মূল্য ১০০ টাকা।

লেখাটি 'ইতিকথা এখন'-এর  বইমেলা সংখা-২০১৭ তে প্রকাশিত। 


মন্তব্যসমূহ