সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল ।। নভলেট।। রূপাই পান্তি

সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল


ভোট মানেই যেন রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। গল্পটা মোটেও  তেমন নয়। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে। ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে। এসেছে মানুষের কাছাকাছি। আজকের গল্পটা সেই কাছাকাছি আসার গল্প। প্রেমের। আর সেই প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে ভোট। ব্যাস। গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র কাল্পনিক, আবার কোনও চরিত্রই কাল্পনিক নাও হতে পারে, তাতে আপনার কী? কোনও ঘটনাই আসলে কাল্পনিক নয়, কারন তা তো ঘটেছেই, মনে মনে... তবু... এইসব লুকোছুপি বাদ দিন তো...    তবু “এই এটা তো...” বলে গায়ের জোরে মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাড়াতে বসবেন না। আপনার মনে পড়ে গেলে, সে আপনার স্মৃতির দোষ...      

পরিচ্ছদ: ১


“বাঁ-হাত।”
সেনেটি বাঁ-হাত বাড়িতে দিল।
ঠাণ্ডা। কালো। নির্জন মসৃণ একটা বাঁ-হাত। সেনেটি ঘরামির। নতুন ভোটার। ১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া আদিবাসী এফ পি স্কুল ভোটকেন্দ্রের ১০০১ নম্বর ভোটার।
সম্বর্ত্তক একটু দেরী করে। যতটা দেরী করা যায়। ভরা মরসুমে বেলা পড়ে আসছে। ভোটকেন্দ্রে ওরা মাত্র দুজন। ভোটার সেনেটি আর প্রিসাইডিং অফিসার সম্বর্ত্তক। ওর তিন পোলিং অফিসার খেতে গেলো এইমাত্র। তাই সেনেটি। একা। পোলিং এজেন্টরা ওর ভোটার নম্বর মিলিয়ে বাইরে গেছে। ব্যাপারটা কাকতলীয় কি না, সম্ব জানে না। যেভাবে কেটেছে এই তিনটে দিন!  
“কই? হাত নিয়ে কী করবেন?” সেনেটি ঢেউএর মতো ভাসছে।
“কালি দিতে হবে।”
“নতুন করে আপনি আর কী কালি দেবেন...”
“তোমার প্রথম ভোট সেনেটি...”
“তবু কালি লাগল। ভোট না দিয়েই কালি লাগল বাবু। এ ভোট আমার মনে থাকবে। অনেক, অনেকদিন মনে থাকবে আমার...”
আর আমাকে? এই যার জন্য এত কালি মাখলে, তাকে? সম্ব ভাবল একবার বলেই ফেলে। কিন্তু ঐ যে! নাহ! থাক কী ভাববে! সম্ব ইনডেলিবেল কালির শিশি থেকে প্লাস্টিকের বাড বের করে। ভোটের কালি...
অবশ্য কালি মাখানো, ভোটার লিস্টে নাম মেলানো, সিরিয়াল নাম্বার লিখে সেনেটির দিকে ১৭ এ মানে নির্বাচক নিবন্ধ বা ভোটার রেজিস্টার বাড়িয়ে দিয়ে সই নেওয়া, ই ভি এমের কন্ট্রোল ইউনিটের বোতাম টিপে ভোট নেওয়া, কিছুই ওর কাজ নয়... তবু এই ভরা ভোটের দিন দুপুরে, ১০৭০ ভোটারের ভোটকেন্দ্রে যেখানে  ৮৪৬ ভোট পড়েছে, সেখানে ও একা। একাই সামলাচ্ছে সব কাজ। সামলাচ্ছে মানে ইচ্ছে করেই। সামনে দাঁড়িয়ে সেনেটি ঘরামি ওর কালো চোখে দেখে চলেছে ভোটবাবুকে।
“কতটা দাগ দেব?”
শুনে হাসল সেনেটি। শান্ত পুকুরে একটা ঢিল পড়ে যেন ভেঙে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা... “এতটা দাগ লেগে গেছে... তার পরেও আপনি ভয় পাচ্ছেন বাবু? এ দাগ তো কালই উঠে যাবে...”
“এ দাগ দিনকয়েক থেকে যাবে... দেখ, ভুলে যেতে যতটা সময়...” 
“আপনি যেন কেমন করে বলেন... শুনতে ঠিক...” সেনেটি কেন থেমে যায়... চোখে কি জল আসে? আলোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে মুখটা ভালো দেখতে পারে না সম্ব।
“সেই পরশু থেকেই বলে আসছ, কেমন, কিন্তু সত্যি কেমন... লুকিয়ে রাখছ...”
“নাহ... আপনি ভালো কথা বলেন... এমন কথা কেউ বলে না... এমন করে বলে না...”
“কিন্তু...”
“যাতে মনে থাকে তেমন করেই মাখিয়ে দিন...”
“মনে রাখবে? সত্যি?” সাহস করে বলে ফেলে সম্ব নিজে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে চাইল... আর সেনেটি, হিঙ্গলগঞ্জের কোন দূর গ্রামের এক কালো মেয়ে কবে কখন ওর নাম করে ফুঁপিয়ে উঠবে, ভাবতে ভাবতে ছোট্ট করে কালির দাগ দিয়ে দিল বাঁ-হাতের তর্জনীর নখে। হাতটা কেঁপে উঠল। দাগের টান পড়ে গেল আরও একটু। আঙ্গুলের প্রথম করের গিঁট অবধি... আঁকাবাঁকা... সেনেটি চুপ করে কালি মেখে যাচ্ছে... যেন মনে মনে চাইছে যতটা কালি আছে, মাখাতে চায়, মাখাক, এই অকাল দোলের উৎসবে...
“দেরী হয়ে যাচ্ছে না?”
সেনেটির কথায় পাতাও নড়ে ওঠে। সম্ব কালি মাখানোর বাড সরিয়ে নিচ্ছে। দেখছে, অনেকটা দাগ পড়ে  গেছে। অথচ... ভেবেছিল একটা ছোট্ট কালির ফোঁটা দেবে নখের উপর... এত ছোটো, যে রাতে যখন নেলপালিশ পরবে সেনেটি, তখন যেন ঢেকে যায়... কিন্তু... এই হচ্ছে ওর সাথে গত তিনদিন ধরে... ও ভাবছে এক, আর হচ্ছে আর এক...  
সম্ব কন্ট্রোল ইউনিটের বোতাম টিপে দিল। “তোমার প্রথম ভোট, সেনেটি। বোতাম টেপার পর শব্দটা থেমে যাবে। খেয়াল করবে কিন্তু...”
“সব শব্দ কি থেমে যায় বাবু?” বলতে বলতে সেনেটি ভোটিং কম্পার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যায়।
সম্ব চেয়ারে বসে থাকে। মনে হয়, এই শব্দ যেন না থামে, এই ব্যালট ইউনিটের বিপ্‌ বিপ্‌  শব্দ। একটানা, সারাদিন যা অসহ্য মনে হচ্ছিল।  সেনেটি কম্পার্টমেন্ট থেকে এদিকে তাকাচ্ছে না। সম্ব তাকিয়ে থাকে। সেনেটি বেরিয়ে আসছে। ওর হাত ধরে ডেকে নিচ্ছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে সামনের মাঠ পেরিয়ে, দিগন্ত জোড়া খেজুর আর ইউক্যালিপটাস গাছের সারি পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নদী পেরিয়ে...
“এখন আসি, বাবু। সন্ধ্যায় দেখা করব...” সেনেটি যখন চলে গেছে, তখনও সম্ব ওর হাত ধরে হেঁটে চলেছে... নেবুখালির ঘাট পেরিয়ে,  সাহেবখালির ঘাট পেরিয়ে, সদরের দিকে এগিয়ে চলেছে, শহরের দিকে।  সেনেটি ওকে চেনাচ্ছে, ঐ যে দূরে, দেখছেন, ওদিকে শমশানখালি, তার পরেই বাংলাদেশ। ওদিকে গেলে ভারতের মোবাইলের টাওয়ার পাবেন না। আর ঐ দিকে...  
তখন ১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া আদিবাসী এফ পি স্কুল ভোটকেন্দ্রের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দুটো নীলকণ্ঠ পাখি এসে বসেছে জানালায়। ভোটকেন্দ্রের ভেতর একা সম্ব জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালার ওপাশে ইট পাতানো রাস্তার ধারে খাবার জলের টিউবওয়েল। সেখানে অবিরাম গ্রামের মেয়ে বউরা জল ভরে নিয়ে যায়। সকাল থেকে আজ অবশ্য জল নেবার ভীড় কম। সামনের মাঠের একদম শেষ প্রান্তে হাঁড়িয়া নিয়ে বসে আছে কয়েকজন। বিনে পয়সায় হাঁড়িয়া খাওয়ানো চলছে সকাল থেকে।
সম্ব চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। তাহলে ভোট ৮৫০র বেশি পড়ল না। আর এর জন্য দু দিনের এত নাটক, এত হইচই...   




পরিচ্ছদ:২


“১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া আদিবাসী এফ পি ইস্কুল। ভোটার কত জানেন? ১০৭০। মশায়, রাত কাবার হয়ে যাবে সার। বুইলেন? তারোপোর আদিবাসী এলাকা মোশায়। কপালে যে কী আছে...” স্বপনবাবুর ব্যাগটা যখন বেঞ্চের ওপর পড়ল, তখন সম্বর একটু হলেও চিন্তা হয়েছিলই। 
তো, যখন সাহেবখালি ঘাটের দিকে আসছে, সেক্টর অফিসার অভিজিৎ ওদের চেনাচ্ছে নানা অলি-গলি, নানা সমাধান, যা সম্বকেই বোঝাতে চাইছে বারবার, যে, আপনি তো একদম কমবয়সী, আপনি কী করে পারবেন, যখন ওর হয়ে দিব্যেন্দুদা জানাচ্ছে, গাঙ্গুলি এর আগে দুটো পঞ্চায়েত, একটা লোকসভা, একটা বিধানসভা ভোট করে এসেছে, ওকে বোঝাতে হবে না, যখন ওর বুথের দুই সশস্ত্র পুলিশ বাসের পেছনের সিটে বসে একনাগাড়ে কেশেই যাচ্ছে, একজন ইনহেলার নিচ্ছে, আর ১৮১ না ১৮৩, নাকি ৮৪-৮৫ বুথের কেউ হবে, ও ঠিক চেনে না, হাসছে পুলিশের এই অবস্থা নিয়ে, এই আর্ম নিয়ে কী করে ভোট হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন সম্বর শুধু বাসের জানালা দিয়ে দূরে যতটা দেখা যায়,  তাকিয়ে দেখে  যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না। এই মাঠ-ঘাট, এই রোগা, ক্ষিদের ভারে বেঁকে যাওয়া মানুষগুলো রাস্তার পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের এই গণতন্ত্রের বয়ে যাওয়া। সম্ব শুনতে পাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে হু হু বাতাসের ফিসফিসানি... কেমন এক মনমরা বাতাস। গুমরে উঠছে যেন।
তারপর লঞ্চের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। মেঘ করে এল। বাতাস যেন পাগল হয়ে উঠেছে। স্বপনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি চলছেই। এবার কী হবে, এবার কী হবে?
নেবুখালি ঘাটে ওদের জন্য ইঞ্জিন ভ্যান অপেক্ষায় ছিল। প্রতি বুথের নাম্বার সাঁটা দুটো করে ভ্যান। সম্ব গুছিয়ে বসে। সামনে দিব্যেন্দুদা আর পুলিশকাকু, দত্ত। নিত্যদা, স্বপনবাবু আর সুধীরবাবু, সবচেয়ে বয়স্ক পুলিশ কনেস্টবল, যার আর মাত্র ৫ মাস চাকরী আছে, আর একটা ভ্যানে উঠে পড়েছে ততক্ষণে।
আর ভ্যান ছুটতেই হু হু বাতাস ভারী হয়ে আসে, গুমরে ওঠে। সম্বর মনে হয়, বাতাসের কী একটা বলার ছিল ওকে। এত লোকের মাঝে বলতে পারছে না। ভ্যানের পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে ও আকাশের দিকে তাকায়। বুকে চেপে ধরা ই ভি এম।  ঠোঁট ফুলিয়ে যেন তৈরী হচ্ছে সেও।
আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আটটা ইঞ্জিন ভ্যান প্রবল আক্রোশে ছুটে চলেছে দিগন্ত পেরিয়ে, গণতন্ত্রের সিপাই আর যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম নিয়ে। আর দূরে আবদার না মেটা শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে সম্ব বুঝতে পারছে, এবার কান্না আসবে। ও ভ্যানের ড্রাইভারকে বলে, “বৃষ্টি আসছে তো, আমাদের পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“তা পিরায় মিনিট কুড়ি তো লেগি যাবে ছার...”
তা, কুড়ি মিনিট তো অনেক সময়। ততক্ষণে মনের কথা বলতে না পেরে আকাশ-বাতাসের জোড়া মনখারাপ কান্না হয়ে ছুটে আসছে। ঝমঝম করে নেমে আসছে ওদের ভ্যানের ওপর।
সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ওদের ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা দোকান ঘরের সামনেমালপত্তর নিয়ে বন্ধ দোকানের চালার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা তিনজন।
সম্ব আকাশের দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ বৃষ্টি হবে না মনে হয়। তবু ভোগান্তি...
আর তখনই ছুটতে ছুটতে একটা মেয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর পাশে। ভিজে সপসপে।  লম্বা চুলের বেনী থেকে জল... সম্বর গা ঘেসে দাঁড়িয়ে মেয়েটা চুলের বেনী একপাশে সরিয়ে ঘাড়ের কাছে জমা জল মোছে। কালো রঙেরও এত আলো থাকে, সম্ব আগে দেখেনি। 
যেভাবে ধাক্কা দিয়ে এসে দাঁড়াল, তাতে যেটুকু রাগ হয়েছিল, ভেবেছিল, একবার ডেকে দুকথা শোনাবে কি না... সেসব কেমন ভুলে গেছে বেমালুম। বরং মেয়েটাই এবার লজ্জায় ভেসে বলে দিল, “সরি। ধাক্কা লেগে গেল। দেখতে পাইনি।”
সম্ব কী বলল, তা নিজেই শুনতে পেল না। শুধু তাকাল। সিক্তবসনা।  সাদা সালোয়ার ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। ভিজে জামার নিচে জেগে ওঠা শালুকপাতার মতো অন্তর্বাসের বহর ঠিকরে বেরোচ্ছে। সম্ব দেখছে ভারতবর্ষ। টলটলে দিঘিরঢালু পার বেয়ে নেমে গেছে কালো মাটির রাস্তা। দূর বলে মনে হয় না, তবু এত দূর... লোভ হয়। সম্ব চোখ ফেরাল...
“কুথায় গিচিলি র‍্যা?” ভ্যানোর ড্রাইভার পাশ থেকে কথা বলছে ততক্ষণে
“পড়াতে।”
“অ। তা ছাতা নিস নাই?”
“না গো। ভুলে গেছি। কে জানত যে বৃষ্টি হবে? এত রোদ ছিল সকালে...” 
“ফিরবি কি কর‍্যে?”
“তাই তো ভাবছিএকটাও ভ্যান নেই। তাই হাঁটছিলাম।”
“তুই চিন্তা করিসনে। দাঁড়া, আমি বাবুর‍্যে বইলচি। আমাদের সাথ্যে যাইসখন।”
“এনারা ভোটবাবু নাকি?”
“তো? তুর কি মনে হইচ্ছ্যে?”
সম্ব জানে, ওর কী মনে হচ্ছে।  কিন্তু বলে না। ভ্যানোর ড্রাইভার সামনে এসে বলে, “বাবু, এ আমাগে গেরাম্যের মেয়্যা। সেনেটি। আপনার যদি তেমুন অসুবিধা না হয়, আমাগ্যে সাথ্যে নিয়্যা যাব?”
দিব্যেন্দুদা বিড়ি ধরিয়েছে। সম্বর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সম্ব বলার আগে বলে ওঠে, “আরে বাবা, অসুবিধার কী আছে? যাবে তো নিয়ে চলো না! ভারি তো একটা মেয়ে যাবে... আগে বৃষ্টিটা তো থামুক...”   
সম্ব তখন এক অদ্ভূত গন্ধ পাচ্ছে। সেনেটির গা থেকে। ভিজে সালোয়ার শুকোচ্ছে হাওয়াতে।  শিরশির কাঁপছে সেনেটি। আর ঘামেভেজা কালো শরীর থেকে ভেসে আসছে কী এক অজানা রহস্যের মতো ঘ্রাণ।
তো, একসময় বৃষ্টি থামে। ভ্যানে স্টার্ট দেয় ড্রাইভার। পেছনে সম্বর পাশে সেনেটি। তখন আকাশের মুখে কী এক হাসি লেগে আছে। বাতাসের মেজাজটাও কেমন ফুরফুরে। ভ্যানের ভট্‌ভট্‌ ছাপিয়ে সেনেটির গলা পায় সম্ব।
“আপনি ভোটবাবু?”
“ভোট নিতে এসেছি বটে তবে আমি বাবু-টাবু নই। আমার একটা নাম অবশ্য আছে...”
“তবুও... আসলে আমরা ভোটবাবু বলেই ডেকে আসি। প্রত্যেক ভোটে এক এক দল ভোটবাবু...”
“তুমি পড়াও শুনলাম। কী নিয়ে পড়? না কি শুধু পড়াও?”
“আমি? আমি ভূগোলে অনার্স করছিমাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ছেলে-মেয়েদের ভূগোল পড়াই একটু। হাতখরচটাও উঠে আসে, চর্চাটাও হয়... আপনি কী করেন?”
“আমি? আমি এই ভোট নিয়ে বেড়াই...” রহস্য করে বলে ওঠে সম্ব
“তাই কখনও হয়? চাকরী তো একটা করেনই... অবশ্য যদি না বলতে চান...”
“আরে, না না, সেরকম কিছু না। আমিও পড়াই। একটা স্কুলে। বাংলা পড়াই আমি।”
তারপর সারাপথ এটা-ওটা।  আঁকাবাঁকা পথে দামাল ভ্যানের অবিরাম গর্জন তুলে ছুটে চলার ঝাঁকুনি আর বাকবদলের কল্যাণে সেনেটি টাল সামলাতে না পেরে বারবার গা ঘেঁসে হেলে পড়ছে। আর বারবার সেই অদ্ভূত গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে সম্বকে।




পরিচ্ছদ: ৩


এবার একটা গোলমাল বাঁধবে। শান্তিরাম বেশ বুঝতে পারছে। পার্টি না করলেও ও বেশ বোঝে রাজনীতি এখন কোথায় চলে গেছে এই আবাদে। চার দফায় ভোট হয়ে গেল সারা দেশে। খবরের কাগজে যা বলছে, ও জানে, সত্যিটা তার চেয়ে কোথাও কোথাও যতটা কম, কোথাও কোথাও ততটাই বেশি।  
শীতলিয়া গ্রামে সবাই ওকে চেনে কেননা ও রাজনীতি করে না। এত বছর ধরে সবাই তাই দেখে আসছে। আদিবাসি এফ পি স্কুলের হেডমাস্টার শান্তিরাম হাঁসদা জ্ঞানত ভোতে কখনও গোলমাল দেখেনি। আর এ তো দিল্লির ভোট। যে যে পার্টিই করুক, দিল্লির ভোটের সময় সবাই কেমন খোশমেজাজে থাকে। লাইনে দাঁড়িয়ে হয়ত এ ওর সাথে মশকরা করছে, ও খ্যাপাচ্ছে ওকে, এ বিড়ি এগিয়ে দিচ্ছে তো ও দেশলাই...
হ্যাঁ, পঞ্চায়েত ভোটে সবাই সক্কাল সক্কাল ভোট দেয়। তবু কারোর হাসি মিলিয়ে যায় না। কখনও। সে যেই জিতুক না কেন... ভোটের খবর বেরোলে সবাই একসাথে গোল হয়ে বসে যাবে হাঁড়িয়া খেতে...  
আগে তো পঞ্চায়েতে দাঁড়াতই দুজন। জোর তিনজন। সবাই জানত, কে জিতবে। অবস্থা পালটেছে। এখন চাপা একটা উদবেগ টের পায় শান্তিরাম। গত কয়েকবছর ভোটের দিনগুলোতে কেমন একটা বদল টের পায় ও। না, গোলমাল এ গ্রামে কখনও হয়নি। কত ভয় ভাবনা নিয়ে কত দূর থেকে ভোটবাবুরা আসেন, শান্তি আশ্বাস দেয়, না, গোলমাল হবে না। কত পালাবদল ঘটে গেছে, কত আনকোরা মুখ কোন অজানা শক্তির জোরে কবে কীভাবে মাতব্বর হয়ে গেছে আশেপাশের গ্রামগুলোতে, কিন্তু এ গ্রামে তার কোনও ছায়া পড়তে দেখেনি শান্তিরাম।
দিল্লির ভোট বলে তবু যা নিশ্চিন্তি ছিল, তাও কেমন ভরসা দিচ্ছে না আজ।
পার্টি বলতে তো এখন একটা দুটো না। পেঁচাপার্টি বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াচ্ছে এবারে দিল্লির ভোট ওরাই ঠিক করে দেবে। শোনা যাচ্ছে এখানে ওখানে নাকি বুথে বুথে ওরাই সবার ভোট দিয়ে বেড়াচ্ছে। হরদম মেশিন ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। আশেপাশের গ্রামে গ্রামে দল পাকাচ্ছে ওরা।    
কোকিল পার্টির অবস্থা এগ্রামে তেমন ভালো নয়। আগে দাপট ছিল বটে, সে শান্তিরামের মনে আছে। তারপর তো এল ময়না পার্টি। তাদের দাপট এখন কমে এলেও ওরা সহজে ছাড়বে না। পেঁচারা যদি গোলমাল বাধায়, ওরাও পালটা মজা দেখাতে তৈরি।
আর এসবের ফাঁকে কখন যে অজান্তে শালিখ পার্টির দলে ভিড়ে গেছে গ্রামের কিছু মানুষ... কে যে ওদের বুঝিয়ে গেছে এবার দিল্লিতে শালিখ পার্টির দলের সরকার হবে... মানুষ বিশ্বাস করেছে। মানুষ, যে মানুষ সহজে সাফল্য চায়, সহজে পেয়ে যেতে চায় স্বপ্নের দেখা। পেরিয়ে যেতে চায় দিগন্তের সীমারেখা...
শান্তিরাম হাঁসদার ভয় হয়। এই শান্ত গ্রামের কোন খালের ধারে, কোন কাঁটাঝোপের আড়ালে কে যে অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে আছে, কোন বহিরাগত, কবে কখন কার রক্তে ভেসে যাবে বেলেমাটির এই ক্ষেত, এই দূর-দূর খেজুর আর ইউক্যালিপটাসের সারি... আর কার সব সহজ হিসেব মেলাতে কঠিন হয়ে যেবে এই দিন আনা, দিন খাওয়া, হাড়িয়ার গন্ধে ম ম পড়শিঘরের অন্ধকার... শান্তির ভয় হয়...     
তার উপর নিজের  কানে শুনেছে... ভান্ডারখালি থেকে ফেরার পথে পেঁচাপার্টির গোপন অফিসের পাশে এক চালার নিচে বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাচ্ছিল শান্তি। ওরা দল পাকাচ্ছে। মেশিন দখলের। সেক্টর অফিসারকে হাত করে ফেলেছে প্রায়। শুনেছে, প্রিসাইডিং অফিসারটি নাকি নরম গোছের। দেখতেও খুব সহজ। বয়স কম।  
ওরা প্রথমে প্রিসাইডিং অফিসারকে হাত করে নেবে। তারপর ভোটিং কম্পার্টমেন্টে ওদের লোক দাঁড়িয়ে থাকবে। সব ভোট ওরাই দিয়ে দেবে। প্রিসাইডিং অফিসার কিছু বলবে না।  আর সেক্টর তো হাতের লোক... উপর থেকেও কেউ অবজেকশান করার মতো নেই। ফলে এবারের ভোট জমে গেছে...
শান্তির ভয় হচ্ছে। সত্যি প্রিসাইডিং অফিসারটি যদি তেমন হয়, যদি মেনে নেয় ওদের দাবি... এবার এই প্রথম তবে শীতলিয়াতে গোলমাল হবে... হাঁড়িয়া খাইয়ে ভোটের যে রেওয়াজ নিয়ে ও এতকাল প্রতিবাদ করে এসেছে, আজ যা শুনল, তা যদি ঘটে, তবে তো...
শান্তি দ্রুত পা চালায়। শেষ ভটভটিটা ধরতেই হবে। দেখতেই হবে ভোটবাবুদের...  




পরিচ্ছদ:৪


“আপনারা আজকেই চলি আইলেন যে!”
সম্ব ফিরে তাকাল। বেশ সাজুগুজু করা একটা লোক। পেছনে আরও দু-তিনজন। সম্ব কিছু বলার আগেই স্বপনবাবু এগিয়ে গেলেন।
“আমরা? এসেই গেলাম, বুইলেন... পাঠিয়ে দিল তো! তা আপনারা কী দরকারে যদি বলেন...”
“আমরা? হেঁ হেঁ... মানে রান্না করি দেব... আপনাদির...” সাজুগুজু আবার রান্না করে? দেখে তো মনে হয় না।
“আরে, না, না, বুইলেন, আপনাদের অত কষ্ট করার কী দরকার... ইস্কুলের রান্নার লোক তো আচে, ওরাই করে দেবেখোন...”  
“ইস্কুলির ঐ মেইছেলিরা? উরা আস্‌পেনা। উরা আবার রানতি পারেনায়ি?” সাজুগুজু খ্যাঁকখ্যাঁক হাসে। পেছনের একজন তাল দেয়।
“আপনার বাড়িতেও কি আপনি রান্না করেন?” সম্ব না বলে পারল না।
সাজুগুজু হঠাৎ সিরিয়াস। “আমরা রেঁদি দোবো, পার হেড আমাদের দুশো ট্যাকা অ্যাক্‌বেলা।”   
“আমাদের জন্য রান্নার গ্রুপের লোককে বলা আছে। আপনারা আসুন।” সম্ব সোজা দাঁড়াল সাজুগুজুর সামনে। চোখের দিকে তাকাল। সাজুগুজুর বিড়িখাওয়া কালো দাঁত আর্ধেক বেরিয়ে থাকতে থাকতে কেমন পালাই-পালাই করছে দেখে পেছনের কে যেন বলে ওঠে, “আমাদিরুপর এই গিরামের কেউ কতা কয় না।”
“বুইলেন, সার, এদের সাথে কথা বলে লাভ নেই।  আপনি চলেন।” স্বপনবাবু সম্বর পাশে এসেছে। আর সাজুগুজুর তখনও অর্ধেক দাঁত, অর্ধেক জিভ... ও সুড়ুৎ করে নাল টেনে নেয়।
রান্নার গ্রুপের মেয়েরা স্কুলবাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে ভোটবাবুদের সাথে দেখা করতে এসে সাজুগুজু আর সম্বর এই ফ্রিজ শট দেখছে। দিব্যেন্দুদা নেমে এসেছে ওপর তলা থেকে। পুলিশকাকু।
আর সম্বকে ডাকছে একটা অনেক চেনা গলা। সম্ব তাকিয়ে আছে সাজুগুজুর ঔদ্ধত্বের দিকে, সাজুগুজু তাকিয়ে আছে সম্বর সাহসের দিকে। স্বপনবাবু তাকিয়ে আছে, দিব্যেন্দুদা, পুলিশকাকু, রান্নার দল, আর তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। একটা অদ্ভুত চেনা গন্ধ নিয়ে কাছে আসতে চাওয়ার মতো বিকেল...
মোটরবাইকের শব্দে ঘোর কাটে সকলের। সাজুগুজু চলে যাচ্ছে স্কুলবাড়ির সামনের ইঁটপাতানো রাস্তা ধরে। সঙ্গে ওর সাঙ্গোপাঙ্গো। বাইক থেকে নেমে সেক্টর সম্বর দিকে এগিয়ে আসছে।
সম্ব দেখছে সেক্টরের চোখে কেমন এক অবিশ্বাস। কেমন অচেনা দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। কেমন অচেনা। আর মাঠ পেরিয়ে, সামনের রাস্তার দুদিকের ছোটো ছোটো ডোবা পেরিয়ে তখন বিকেলের আলো এসে খেলা করবে বলে অপেক্ষায় দাঁড়ায় স্কুলবাড়ির সামনের মাঠে। যেন ভয়ে ভয়ে ... সম্ব হাত নেড়ে ওদের ডাকে।  


পরিচ্ছদ:৫


“রান্নার লোকের সাথে কথা হয়ে গেল, গাঙ্গুলি। চিন্তা করো না। সেক্টর ছিল। ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। ওদের আই কার্ডে একটা করে স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে দাও।” 
দিব্যেন্দুদা মানে টেনশান কমে যাওয়া। সম্ব দোতলায় মেঝেতে কাগজপত্রের স্তুপে মুখ গুঁজে ছিল।  কার্ডগুলোতে সই করে দিয়ে আবার কাজে মন দেয়। এত ফর্ম, এত ফর্ম্যালিটি... আসল কাজের কোনও বালাই নেই...
দরজায় কার ছায়া পড়েছে। কালো চোখের ছায়াটা সম্বকে যেন টেনেই তুলবে। মুখ তুলতেই সরে যায়। কাজে মন দিতে চাইলে আবার ছায়া পড়ে। সম্ব মুখ না তুলেই বলছে, “ভেতরে এস!”
তো, সরে যাওয়া ছায়া ক্রমে কাছাকাছি এসে পড়ছে, দীর্ঘ হচ্ছে, নেমে আসছে ভোটপ্রস্তুতির কাছাকাছি। দেখছে নানান কাগজের স্তুপে ডুবে থাকা ভোটবাবুকে। কিন্তু কিছু বলার সাহস হচ্ছে না। আর তখন রান্নার দল কলকললিয়ে উঠে আসে সিঁড়ি বেয়ে। আর পাশ থেকে ছিটকে সরে যায় এই প্রবল গ্রীষ্মের দেশে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সামান্য আশ্রয়টুকু...   
“ও মা! সেনেটি যে দেকি ইখেনে রইছ্যে।”
সম্ব দেখল। সেনেটিকে। দেখল রান্নার দলের পাঁচ-ছয়জন ঝর্ণার মতো নরম, আঁকাবাঁকা হাসি। কে একজন এগিয়ে এল একপা। “আমি ইদির দলের হেড। সেনেটি আমার নোনোদ হয়, সার।”
সম্ব হাসে। কি বলার আছে এই সাধারণ আলাপের শেষে? তবু, বলতেই হয়, “আজ রাত্রে কী খাওয়াচ্ছেন আমাদের?”
“বিকিলে তো বাজার হবেনি... ডিম রেঁনেদি আইজ? আর ডাইল?”
সম্ব মাথা নাড়ে। নিত্যবাবু ওদের ডেকে নিয়ে কিসব বোঝাতে শুরু করেন। জানালা দিয়ে দূরের মাঠের দিকে তাকালে তখন বিকেলের আলো পেরিয়ে চলে যাচ্ছে চাষিদের দল। মাথায় ঘাস, শুকনোকাঠের বোঝা নিয়ে ছাগল চরিয়ে ফিরে আসছে মেয়ে বৌদের দল।
সেনেটি মৃদু স্বরে ছায়ার কাছাকাছি রেখে দিল একটা রঙিন র‍্যাপারে মোড়া লজেন্স। সম্ব মোড়ক খুলে মুখে পুরে দিতে দিতে দেখল সেনেটির মুখের লজেন্সটা গালের একপাশে কেমন সগর্বে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে
“আপনার কিন্তু খুব সাহস।”
“কেন বলতো?” সাহসের মতো কিই বা করেছে ও এই একবার দেখার মধ্যে? 
“আপনি যেভাবে ওদের সাথে কথা বলছিলেন... ওরা না খুব খারাপ...”
“ভয় পেলে চলবে? লোকে যদি বুঝে যায় আমি নরম, তাহলে তো সবাই মাথায় চড়ে বসবে...”
নিচ থেকে স্বপনবাবু ডেকে ওঠেন। “সাআআআর... একবার নিচেআসেন।”
সেনেটি কখন সিড়ির কাছে চলে গেছে, সম্ব নামতে নামতে কাছাকাছি চলে আসে। সেই অদ্ভুত গন্ধের কাছাকাছি। সারাপিঠ জুড়ে একঢাল কালো মেঘ সরু কোমর পেরিয়ে নানান বাঁক পেরিয়ে কতদূর যে নেমে গেছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না... সম্ব ওর পাশ কাটিয়ে নামতে নামতে বুঝল একটা মেঘের ছায়া তার সামান্য বৃষ্টির সম্পদ নিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর বুক। সেই বৃষ্টির ফোঁটার নরম আদরে সারা শরীর কেঁপে উঠছে ওর। আর ছায়া হেঁসে উঠছে ঝিরঝির...
****
মাঠে অনেক লোক। স্বপনবাবু, নিত্যদাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট দল। দিব্যেন্দুদার কাছে বয়স্ক দুএকজন বলছেন, “ভেইব্যেন্না। সাড়িয়াটশোর বেশি ভোট পড়ব্যেন্না।”
“দেরিও হবেন্ন্যা। দিল্লির ভোটতো... গিরামির অনিক লোকিতো বাইরিই থাকে... তা সের‍্যা আসিওনা, ভোটও দ্যেয়ন্না।”
সম্বকে আসতে দেখে ছোট ছোট দল জুড়ে গেল। সম্ব তাকায়। সবার মুখে যেন কিসের একটা বিস্ময়। ওকে দেখছে। অবাক... কেউ কেউ যেন কীসের আশায় তাকিয়ে থাকে। কেউ সন্দেহে...
“আমরা পেঁচাপার্টিরথ্যে এইছি। ভোটের মেশিন দেখাত্যিবে...”
“আমাদেরও...” দূরের থেকে কে যেন সায় দেয়...
“ভোট সোমবার। সোমবার সকাল ৬টায় মক পোল হবে। তখন আপনাদের সবাইকে মেশিন দেখানো হবে। ওইদিন সকালে সময়মতো আসুন।”
“না, আজই দ্যাখবো।”
“আপনার ইচ্ছে হলেই কি হবে, দাদা? কমিশনের যা নিয়ম, সেটাই হবে...”
“তাই দেখাবেন্না?”
“সোমবার। সকাল। ঠিক ৬টা।” কেটে কেটে বলে সম্ব।
ওর বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। লোক-জন চুপ হয়। আস্তে আস্তে ভিড় কমে। 
সম্ব বুঝতে পারে, পেছনে আবছা অন্ধকারে, সিঁড়ির কোণে একজোড়া চোখ অবাক তাকিয়ে দেখছে ওকে, দেখছে ওর রুখে দাঁড়ানো... আর রাত নেমে আসছে ঝুপ করে। রাতের পেট চিরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে স্কুলবাড়ি যেন জীবন ফিরে পাচ্ছে। যেন কোন নতুন সকাল হবে বলে বেঁচে থাকছে জ্যোৎস্নাভেজা ধূ ধূ মাঠ।  দূর খেজুর আর ছাল-বাকল ছাড়িয়ে নেওয়া সাদা ইউক্যালিপটাস গাছেদের অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রস্তুতি দেখতে দেখতে সম্ব আরও একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
****
রাত বাড়ছে। আর সেই তালে বাড়ছে ঝিঁঝিঁর ডাক। রান্নার দল ওদের খাবার সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে। দোতলার গ্রিলঘেরা বারান্দায় স্বপনবাবুর চলাফেরার শব্দ ছাপিয়ে গিন্নির সাথে সংসারের গোপন কথার চর্চা নিয়ে দিব্যেন্দুদা সম্বকে শোনাচ্ছে নানান গল্প। ওদিকে দত্তবাবু কেশেই যাচ্ছেন, আর সুধীরবাবু বারবার বলে যাচ্ছেন, “আলোটা বন্ধ করেন সার, আলোটা...” এমন সময়, ওদের ওয়াটার ক্যারিয়ার নিচ থেকে ডেকে উঠে ভেঙে দিল সামান্য জ্যোৎস্নাযাপনের মুহূর্তটুকু।
আবার সবাই থমকে যায়। আবার আশঙ্কা গ্রাস করছে সকলকে। দত্তবাবু মুহূর্তে টানটান। পুলিশের জামাটা পরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি দাঁড়ান, গাঙ্গুলিবাবু। আমি দেখছি।” বন্দুকটা নিয়ে জোরপায়ে নেমে যাচ্ছেন দত্ত, ওদের পুলিশকাকু। সম্বর হাসি পাচ্ছিল, ঐ তো বন্দুকেই ছিরি, জীবনেও গুলি বের হবে না...  
আর ভাবতে ভাবতে দত্তবাবুর গলা পাওয়া যাচ্ছে, “গাঙ্গুলিবাবু, নিচে আসবেন একটু? এই ইস্কুলের  হেডমাস্টার দেখা করবেন...”
সম্ব যার সামনে দাঁড়াল, জ্যোৎস্নার আলোয় লোকটাকে তখনও হাঁপাতে দেখা যাচ্ছে। হাত জোর করে নমস্কার জানায় সম্ব। 
“আমি শান্তিরাম হাঁসদা। এই ইস্কুলির হেডমাস্টার। আপনার সাথে কিচু কতা ছেল...” শান্তিরাম আগাগোড়া দেখে নিল সম্বকে। যেমন শুনেছে, ঠিক তেমন। “কতাডা, মানে, খবরডা গোপন... পেঁচাপার্টির লোকজন বাইরির লোকানচে। এড্ডা গোলমাল বেঁধি যাবে যে... উরা মেশিন দখল নেনেবে...”   
“মেশিন দখল? আপনি কী করে জানলেন?” সন্দেহ দানা বাঁধে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ কাউকে ভরসা করে বলতে পারছে না মনের কথাসন্ধ্যের পর গ্রামের বাঁকে বাঁকে অচেনা ছেলের দল বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ঝোঁপে-ঝাড়ে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে, ডানাওয়ালা পিঁপড়ের মতো গ্রামের কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে ছুটে যাচ্ছে, আর আগুনের তাপে ঝলসে যেতে বসেছে এই শান্ত গ্রামের শীতল জ্যোৎস্না...
“আমি নিজির কানে শুনিচি।”
তখন দোতলা থেকে সম্বর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের দলের সকলে। একটা ভোটে এসে এত উদবেগ আগে কারও হয়নি কখনও... সম্ব তাকিয়ে থাকে ওর পুলিশদের দিকে। দুজনেই হাঁপানির রুগি। সুধীরকাকু তো ভালো করে হাটতেও পারেন না... খাতার কলমে ৫ মাস চাকরী বাকি... ১০৭০ ভোট...
“মেশিন দখল নেবে? মামার বাড়ি?” সম্ব তাকায়। দিব্যেন্দুদা...
শান্তিরাম ওর দিকে তাকিয়ে। সম্ব শুধু বলছে, “আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। গোলমাল যাতে না হয়, সে দায়িত্ব আমাদের। আপনি বাড়ি যান। পরে কথা হবে...”
শান্তিরাম তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর সন্দেহ কেটে যাচ্ছে। মানুষ ভালোই চেনে শান্তিরাম। প্রিসাইডিং অফিসারের বয়স কম। ছেলেমানুষ... কিন্তু এ ছেলের মনের জোর আছে। এ ছেলে পারবে... ঠিক পারবে...


পরিচ্ছদ:৬ 


“যেদেশে এলাম, মরা গাছ চারিদিকে...”
“কেন? এদেশে কি জ্যান্তগাছ চোখে পড়ল না?”
“তা কেন? তবে, দেখ, দূর দূর যত গাছ, সব কেমন প্রাণহীন দেখাচ্ছে...” জানালা দিয়ে যা দেখছে সম্ব, খেজুর গাছ আর ইউক্যালিপটাসের সাদা বাকল ওঠা সারি...
দোতলা থেকে গ্রামের দূর দূর অবধি দেখা যায়। সকালের খাবার খেয়ে তাই ওদের দলের সবাই বেরিয়েছে।  ‘দেশটাকে বরং ঘুরে দেখি’ গোছের ব্যাপার। ও ভাবে, তারপর যদি মনে হয়, প্রতি মুহুর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে... তখন?
সেনেটি দেখাচ্ছে, জেলেপাড়া, তাঁতিপারা, ঘরামিপাড়া, ঐ দিকে সোরেনরা থাকে। আর ওইদিকে থাকে শীট... মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে... নিচু। চার পাশে জেগে থাকা আলপথ। উঁচু আলপথ।
“এত উঁচু কেন?” 
“যাতে জল ধরে রাখা যায়...”
“কেন, নদীর জল?”
“তাতে কি চাষ হয়? সে তো নোনা জল...” কথা চলে। উঁচু আলপথের বুকে হেঁটে যায় গ্রামের মেয়ে বউরা।  মাঝে মাঝে ইঁট পাতানো রাস্তার ধারে ডোবা। সেখানে বাসন মাজা, স্নান করা চলছে।  
মাঠে মাঠে ছাগল চরে, গরু, সাদা শরীরের ইউক্যালিপটাসের সারি এদেশের মেয়ে-বউদের পাশে বেমানান।
“তাহলে কোন গাছ মানায়?”
“কেন? খেজুর!”
“খেজুর? এ খেজুর খাওয়া যায় না বলে?” 
“না, না, খাওয়ার প্রশ্ন কেন?  দেখ, কেমন বাঁকানো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... এই সৌন্দর্য... এমন তীব্র রোদেও কেমন টানটান...”
“আপনি যেন কেমন কথা বলেন...”
“কেমন কথা?”
কথার অবকাশ খুঁজে নিয়েছে সকাল। প্রাইমারি স্কুলের দোতলার ঘরের মেঝেতে ত্রিপল পেতে ছড়িয়ে বসেছে ভোটবাবুরা। সম্ব এককোণায় ত্রিপলের ওপর সাদা চাদর পেতে কাগজপত্র বাছছে। সাদা চাদর ভরে হলুদ ফুল ফুটেছে। অল্প লতাপাতা। রকমারি ফর্ম, রঙিন খাম। নির্বাচকের নিবন্ধ ১৭ এ-র পাতায় পাতায় সই করে, সিল দিয়ে, দরকারি ফর্মগুলোতে ভোটকেন্দ্রের নাম, সই, সিল দিচ্ছে।
“এ কী ফুল? চাঁপা?”  সেনেটি ঝুঁকে পড়েছে। পিঠের কাছে। দুটো নুড়ির খোঁজ পাচ্ছে সম্ব। যেন নদীর ধারে কাদায় রেখে গেছে কেউ। ও তুলছে না।
“আপনার খুব কাজ?”
“কাজ তো বটেই...”
“আর বাকিদের বুঝি কোনও কাজ নেই?”
“কাজ তো সবার...”
“তবে যে ওরা সাত সকালে ঘুরে বেড়ায়? আর আপনি খেটে যান?”
“তা কেন? ওদের কাজতো ভোটের দিন। আমার তো সব দায়।”
“পুলিশগুলোই বা কী? যদি বিপদ-আপদ কিছু হয়? ওরা পারবে সামলাতে?”
“বিপদ? কেন, তোমরা তো আছ...”
“শান্তিকাকু বলছিলেন কাল। ওরা বাড়ি বাড়ি এসে শাসাচ্ছে।”
“ওরা?”
“কেন, কাল যারা এসেছিল... পেঁচাপার্টি... আমাদের সবার ভয় হচ্ছে। আপনি তো ভালোমানুষ, আপনার না...”
“আমার কিছু হবে না। তোমরা সবাই আছ না...”
সিড়ি বেয়ে তখন সুধীরকাকু উঠে আসছেন। হাপাতে হাপাতে। আর এসেই শুয়ে পড়ছেন ঘরের এককোণে। সম্ব তাকিয়ে থাকে। সেনেটিও। বলে, “চল, সেনেটি, ঘুরে আসি।”
আর সুধীরকাকু কাশতে কাশতে বলছেন, “হ্যাঁ, সার, যান। ঘুরে আসেন। ভালো লাগবে... আমি তো আছি, কোনও চিন্তা নেই...” বলছে বটে, সম্ব ভরসা করতে পারছে না... তবু কীসের টানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে সেনেটির পাশাপাশি। আর নামতে নামতে সিড়ির প্রথম ল্যান্ডিং-এ হঠাৎ ঠোঁটের ওপর নেমে আসছে শান্ত, শীতল এক ছায়া। সম্ব আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণ। শ্বাস নিতে যেটুকু বিরাম...




পরিচ্ছদ:৭ 


এবার মাঠে নেমে দেখা গেল, স্কুলটা আসলে কেমন। এই জীর্ণ, ভাঙা চোরা রাস্তার পাশে, এই ধূধূ বালিয়াড়ির মাঝে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা চর, দু-একটা খেজুর গাছের সারি, দু-একটা পুকুর-দুয়ারি উঠোনের দেশে এই দোতলা স্কুল বেশ বেমানান। তাও আবার প্রাইমারি স্কুল। স্বপনবাবু তো বলেই ফেলেছিলেন, “দেখবেন মশায়,  মাটির ঘর, সাপে না কাম্‌ড়ে দেয়... কারেন্ট তো থাকবেইনা। মহাআআ ঝামেলা হবে এই বলেদেলাম্মোশায়...”
কারেন্ট সত্যিই ছিল না। রাস্তার পাশে স্কুল, রাস্তার ইলেক্ট্রিকের পোস্ট থেকে সেক্টরের বলা ছিল, ওয়াটার ক্যারিয়ার তার জুড়ে একটা আলোর ব্যবস্থা করে দিল। দোতলায় তেমন গরম নেই। চার দিকের এত ফাঁকা মাঠের হাওয়ায় তো গত রাতে ঠাণ্ডাই লাগছিল।  
তো সেই মাঠে এখন একটা ছায়ার পাশাপাশি সম্বর্ত্তক। ছায়া এগিয়ে চলে, আর ও ছুঁতে চাইছে সেই ছায়ার অবসর। উচু-নিচু ঢাল পেরিয়ে, মাঠের পর মাঠ, আলপথের নানা রহস্যের কাছাকাছি ওরা হেঁটেই চলেছে। যেন হাঁটু পর্যন্ত বালিয়াড়ি পেরিয়ে যেতে যেতে, পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বেয়ে, সমূদ্রের মতো, ছবির মতো এই হেঁটে চলার দেশে ওদের কোত্থাও কোনও ক্লান্তি নেই। শ্রামের অবসর নেই...
দূর থেকে মনে হবে যেন কিসের ঢেউ... শুখা মাঠ পেরিয়ে, ফাটল পেরিয়ে, উঁচু আলপথের আড়াল পেরিয়ে, জেলেপাড়া, তাঁতিপাড়া, শীটপাড়া, খেজুরের সারি পেরিয়ে, মরাগাছের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা কত মৃত পশুদের ছাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঢালু জমিতে নেমে গেল সেই ঢেউ... সম্বর শহুরে চোখে নতুন দেশ দেখার সম্মোহন। ওর কেবল অনুসরন করা... যেন অনুসরনের কোনও শরীর নেই...  
সেনেটি মাঠের আল থেকে নেমে ঢালু জমিতে। খেজুরছায়ায় বসলে দেখা যায় দুটো ছায়া কেমন পাশাপাশি নিচু হল। হাত ধরে টেনে নিল একে অন্যকে। সেনেটির বুকের কাছে সম্ব।
এত কাছাকাছি এলে এক অদ্ভুত গন্ধে ঘোর লাগে। ভাবে, যদি কিছু হয়ে যায়... ভাবে, আর ঘোর লাগে। ঘোর থেকে জেগে উঠছে একটা ছায়া। জেগে ওঠে, না ঘোরের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে, সে নিজেও জানে না। দেখে, সেনেটির ঘন চুল ঢেকে দিচ্ছে মুখ। অন্ধকারে ও হাতরায়।
আনাড়ি সাঁতারুর মতো খড়কুটো... শ্বাস নিতে নিতে আবার কেন ডুব দিতে চাইল ও। মনে হল, অসাড় একটা শরীর এতদিন টেনে চলেছিল। মনে হল, ওর সমস্ত অস্তিত্ত্বে কে যেন জীয়নকাঠি বুলিয়ে দিচ্ছেমনে হল, ওর ভেসে ভেসে যাওয়া শরীরের কাছে জলদেবীর মতো এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ওকে বুকে তুলে নিয়ে এতদিনের অসাড় অস্তিত্ত্বের ওপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে কোন এক ছায়া। মুক্ত করে তুলেছে ওকে।
আর সম্বর্ত্তকের ঘোর লাগছে। এ কেমন ঘোর, এ কেমন মুক্তি! সম্ব তলিয়ে যাচ্ছে। আবার ভেসে উঠছে। ও যত দুহাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চায়, মুঠোভরা শূন্যতা ততই সমস্ত বাঁধন খসিয়ে দিচ্ছে। তলিয়ে যেতে যেতেও যে এভাবে ভেসে থাকা যায়, তা আগে বোঝেনি। তলিয়ে যেতে যেতে দুটো ছায়া ভেসে ওঠে। দরদরিয়ে ঘেমে, ধুলোয়, কাদায়, জলে, রোদ্দুরে মিশে, ডুবে, ভেসে, তলিয়ে, সাঁতরে উঠে ওর ঘোর লাগে। আর চোখ খুলতেই সেই ছায়া-ছায়া অন্ধকার...
সেনেটি পায়ের কাছে অগোছাল কামিজ সাজায়। লুটিয়ে পড়া কালো শরীর ওর। ধুলোর রাজত্বে এতসব দাপাদাপির দাগ... অচেনা মানুষের ছায়া মুছে রাখে শহরের দামি বুকে। বুক মানিয়ে গেছে ওর... এখন, এই অগছাল শরীরে... ব্রা আধখোলা। বাবু জানে কীভাবে খুলতে হয়, কীভাবে বাঁধ ভেঙে দিলে কালোমাটির দেশ জুড়ে বন্য বইবে। আর সে বন্যায় ভেসে উড়ে যাওয়া ভুল-চুক মুছে রাখবে দূর গাঁয়ের এক মেয়ে। পায়ের কাছে গোটানো প্যান্টি ততক্ষণে মুছে রেখেছে কিছু তৃপ্তি, কিছু আদিমতা, কিছু চোখ বুজে আয়েসের পরিসর।
সম্ব তাকাতে পারছে না। এত ছায়া, তবু... চোখ ধাঁধিঁয়ে আসছে, লজ্জায়, অপরাধবোধে... ভাবছে, কী করে কথা বলে... ভাবছে ওর আজীবনের কুণ্ঠা সাজিয়ে এই অচেনা গ্রামের অচেনা মেয়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে...
আর সেনেটি ঘরামি চোখ নামিয়ে লজ্জায় বলে ওঠে, “আমাকে ভুল বুঝবেন না, বলুন?”
ঠিক-ভুলের হিসেব করার সময় কখন পেরিয়ে এলাম, সেনেটি, আমিই জানি না... কথাটা কেমন ছ্যাঁত করে লেগে গেল। ও ছায়ার কাছাকাছি আসতে চাইলে, ছায়া সরে যাচ্ছে... মন বলছে কিছু একটা ভুলতো হয়েইছে।
তো, সেনেটি... সম্ব বলছে ওকে, “বল, ভুল বুঝব কেন?” 
“গ্রামের মানুষ আর আগের মতো নেই... সবাই তো সরল হয় না, আপনারা শহরে থেকে জানেন না, গ্রাম্যতা কেমন বিষাক্ত... এ বিষ আমাদের আজীবন বয়ে যেতে হবে...”
সম্ব থমকে গেল। বলে, “কী যেন বলছিলে...” আর ছায়ার দিকে তাকায়। কালো মেয়ের ছায়া। সেনেটির।
তো, সেনেটি আরও সরে যেতে যেতে যা শোনাচ্ছে, তা ঠিক সত্যি, না রূপকথা... ভোটবাবুর হাতটা বুকের নরমে রেখেছে ও। বলছে, “দেখুন, আমার বুক বলবে, আমি মিথ্যে বলছি না।”
সে তুমি যাই বল, আমি বিশ্বাস করব। ভাবছে সম্ব, বলছে, “তুমি বল। আমি বিশ্বাস করব।”
“আপনার খুব বিপদ।”
“সে তো আমি কালই বুঝে গেছি। তোমরা তো আছ। চিন্তা কীসের?”   
“আপনি বুঝছেন না। ওরা আপনাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলবে।”
“সরিয়ে ফেলবে? তা কখনও হয়? ওদের কথা ইলেকশান কমিশন মানবে কেন?”
“ওরা বলবে... বলছে...” সেনেটি অসহিষ্ণু... কিছু একটা গোপন করে গেছে যেন..., সেনেটি, বল, বল, সম্ব মনে মনে কথা বলে ওঠে এবার... কী সেই গোপন...
“ওরা বলবে, ভোট নিতে এসে আপনি আমাদের মেয়েদের সাথে সহবাস করেছেন... নাকি, ধর্ষণ?” মনে মনে বলতে বলতে কখন স্বর পেয়ে যায় ওর ভাবনা... সেনেটি চমকে ওঠে... কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে একটা ছায়া অন্য একটা ছায়াকে জড়িয়ে ধরে... দুটি ছায়া ফুলে ফুলে ওঠে কেমন... দুটি বিপন্ন ছায়া... আর সেই বিপন্নতার উথাল-পাথাল থেকে সেনেটি বলে যাচ্ছে এই মরা গাছেদের দেশের নানা ইতিহাস, নানা ভূগোল, নানা রাজনীতি... নানা শব্দে, নানা দৃশ্যে...
“তুমি চাইলে আমি চলে যাব, সেনেটি। কিন্তু ভেবে দেখ, তোমাদের সেই শান্তির গ্রাম... এই একটা মাত্র সুখ নিয়ে তোমরা বেঁচে ছিলে, যে আমাদের গ্রামে রাজনীতির বিষ আজও ঢোকেনি... ভাবো, সেই সুখের কী হবে... ভাবো, সেই স্বপ্নের কথা... ছোটদের জন্য তোমরা কী রেখে যাবে...”
“আমি এসব চাইনি, বিশ্বাস করুন, বাবু... আমি এসব চাইনি...”
সম্ব তাকাল। কালো পুকুরের জলে একটাও খড়কুটো নেই। ওর ভয় হল... তাহলে শেষমেশ সম্বর্ত্তক গঙ্গোপাধ্যায় ভোট নিয়ে এসে ধর্ষণের দায়ে জেলে যাচ্ছে... মরে গিয়েও শান্তি পাবে ও?
তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্ব দেখছে একফোঁটা জল কেমন পুকুরের পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়ছে। আর শান্ত জলে হঠাৎ কীসের ঢেউ উঠে অস্থির করে দিয়েছে ছায়ায় বসে থাকা এই দুপুরের অবসর।   
সম্ব কিছু বলে না। মাথায় কিচ্ছু আসছে না ওর। আপোষের স্বভাব না থাকা মানুষের মাঝে মাঝে যেমন হতাশ লাগে... আপোষ করতে না জানার জন্য এতবড় মাশুল দিতে হচ্ছে হয়ত। পেঁচাপার্টির কথা মেনে নিলে...  
“আপনি যাবেন না, বাবু...” সেনেটির নরম কণ্ঠের ঢেউ ভেসে এল।  “আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে... দেখবেন...”   
“কী আর ঠিক হবে, সেনেটি? যা একবার ভেঙে গেল... যে বিশ্বাস? তার কী হবে?”
“আমাদের একটা সুখ ছিল, বাবু। এই গ্রামে কোনোদিন ভোটের কারণে গোলমাল হয়নি। এই সুখ আমরা সহজে ছাড়তে পারি? তাহলে আমাদের পরে যারা আসবে, তাদের আমরা কী গল্প শোনাব, বাবু?”
সম্ব তাকায়। টলটলে জলে একটা একটা করে তরঙ্গ উঠছে কেমন...  
“আপনি তো কালই চলে যাবেন... কিন্তু আমাদের তো এ গ্রামেই থেকে যেতে হবে, এই বিষ বয়ে যেতে হবে আজীবন... আমি পারব না, বাবু... নিজের কাছে হেরে গিয়ে কী করে বেঁচে থাকব?”
তুমি সত্যিই জলদেবী, সেনেটি। আমাকে একবার ডুবিয়েও ভাসিয়ে রেখেছ কেমন... সেনেটি ওর পাশে দাঁড়াল তখন। রোদ্দুর তখন মুখ লুকিয়েছে খেজুর গাছের সারি সারি কাঁটার আড়ালে...   
চলে যেতে যেতে সম্বর হাতে হাত রেখে সেনেটি শুধু বলে গেছে, “আমি মনে রাখব, বাবু... আপনার কথা...”




পরিচ্ছদ:৮ 


এভাবে যেন হয় না। এভাবে, মানে কী ভাবে, কেউ জানে? নদী-জল-বাতাসের কাছে এই যত কথা আছে, আজ সারাদুপুর ধরে বলে যাচ্ছে সম্ব। একা। যেমন বলে বারবার। আর সবাই দূর থেকে ভাবে, স্বপ্নবিলাস। একটু আগে, সেনেটি আবার এল। দুপুরের খাওয়ার পর।
বৌদি খাবার বেড়ে দিল, হাতেহাতে ননদ। পুলিশকাকু মাথা নেড়ে নেড়ে বলে গেছেন সারাক্ষণ, শহরে লেখা পড়া করল, শহরের বুলি বললেও, দেখ, মেয়ে সেই ঘরের মেয়েই আছে। আর বৌদি সায় দিল।
সম্ব খেয়েছে চুপচাপ। যেমন খায়। আজ আবার ছোবল সামলে দাঁড়াতে হল, নিজের মুখোমুখি। আবার অজানা এক আক্রমণের জন্য তৈরী করল নিজেকে।
“তুমি এত দুঃখী দুঃখী মুখ করে থাকেন কেন, গাঙ্গুলি ? কীসের দুঃখ  তোমার?”
দুঃখ বলছেন কেন, দিব্যেন্দুদা, ব্যাথা বল, আমার কীসের ব্যাথা? যদি জানতেম... সব ব্যাথার কারণ কি জানা যায়? না বোঝানো যায়?
অনেকেই বলে, সম্বর বন্ধুরা, তোমার তো চিন্তার কারণ নেই, চাকরি পেয়েছ, নিশ্চিন্ত জীবন... তবু জীবনের   বাঁকে বাঁকে কে যে বারবার অদৃশ্য অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করে, কে কবে ছোবল মারে... দুখের কারণ কী, সম্ব জানে না। নিজেকে দায়ী করে চলে অবিরাম, ভাবে আমার ভুল, আমার, আর মনখারাপ গ্রাস করে।
ওর বন্ধুরা বলে, মাঝে মাঝে খিস্তি কর। রাগ হলে। অন্য কেউ মেজাজ দেখালে তুই তার দ্বিগুন মেজাজ দেখাবিফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে খিল্লি কর সারারাত। ভাবে, হয় না। সব হিসেব তো আর মেলে না।
সেনেটি পাশে দাঁড়িয়েছে। হাত রেখেছে পিঠে। আর হু হু মনখারাপ... গ্রীলের খোলা দিগন্তের পাশ কাটিয়ে আবার সটান সম্বর মাথার ভেতর...
“এখনও রেগে আছেন?”
“রাগ? কার উপর করব? কী বা অধিকার আছে রাগ করার? এইতো একদিনের পরিচয়...” 
“তবু এতদূর এসে পড়লাম...”
“কী এক গভীর খাদের সামনে এনে ফেলে দিলে আমাকে... এখন পিছনে ফিরলে লোকে হাসবে, আর এগোলেই...”
“আপনার এত অভিমান!” ফিসফিসিয়ে বলেছে সেনেটি... যে কথাটা কেউ কখনও বলেনি ওর কানে কানে... আর শুনে ফিরে তাকায় ভোটবাবু। তাকায় এক ছায়া ছায়া অন্ধকারের দিকে, আলোর দিকে, এক ইতিহাস অন্য আর এক ইতিহাসের চোখে চোখ রাখে...  



পরিচ্ছদ:৯ 


প্রত্যেক দুপুরের পর বিকেল ছায়া এসে এত রোদ্দুরের মলিনতা মুছে দেয়। আজ বিকেলটা কেমন ছন্নছাড়া। আজ মাঠে মাঠে গরু-বাছুরের দল বেঁধে ঘরে ফেরার তাগিদ নেই। পাখিদের দল বেঁধে ফিরে আসার তাগিদ নেই। মাঠে মাঠে কখনও সখনও একটা- দুটো কালো ছায়া দেখে মনে হল, আজ সব হিসেব মিলছে না।
মাঠে একজন দুজন করে লোক জমছে। পেঁচাপার্টির ওরা, সেই সাজুগুজু, আরও কয়েকজন, এদিকে- ওদিকে। স্বপনবাবু আর দত্তবাবু সিড়ির মুখে। সম্ব দোতলায় দাঁড়িয়ে দেখছে মাঠের কাজকর্ম। সেক্টর অভিজিৎ দুজন লোক নিয়ে স্কুলের কাছের একটা পোস্টের গাঁয়ে লেখা পেঁচাপার্টির প্রচার, ওদের সিম্বল চুন দিয়ে মুছে দিচ্ছে। মুছছে আর সাজুগুজুর দিকে কেমন তাকাচ্ছে
কেমন সে তাকানো? যেভাবে গোপন সব কথা চোখে চোখে বলা যায়? সম্ব ভাবছে। হয়ত সেক্টর বলছে, সাজুগুজু, সাজুগুজু, তোমরা চুপ কেন? তোমাদের সেই হইচই করার প্ল্যান, তার কী হল? বল, চেঁচাও, চেঁচাও, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বল, এই প্রিসাইডিং অফিসার ভোট নিতে এসে আমাদের গ্রেমের মেয়ে সেনেটির সাথে যাচ্ছেতাই করেছে, বল, সেনেটির ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে মাঠে নিয়ে গিয়ে...
স্বপনবাবুর সাথে খেজুরে আলাপ জুড়েছে এক মাঝবয়সী মানুষআর তাদের ভেসে আসা সেই একই কথালাপের মধ্যে সম্ব শুধু শুনছে, আমাদের গ্রামে ভোট নিয়ে শান্তি আছে, দেখে নেবেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি...
আর এসবের ফাঁকে মন পড়ে থাকা সেই ছায়ার সাথে ভেসে যাচ্ছে ও। ভেসে ভেসে মেঘেদের কাছাকাছি, সেনেটি বলবে, ঐ যে বাঁকানো বঁড়শির মত নদীর বাঁক, ওদিকে দলদলি, আর ঐ- ঐ দেখছেন সাহেবখালি, বাঁধের পাড়ে কেমন পলি জমেছে দেখুন, ড্রেজিং করার কথা, কিন্তু... এত হইচই... এত মানুষের অসন্তোষ... ভাবুন... ভাবতে ভাবতে সম্বর্ত্তক বিকেলের কমে আসা আলো দেখে, দেখে ঐ সাজুগুজু এগিয়ে আসছে।
তখন, ভ্যানো থেকে তিনটে বড় জলের সিল করা ড্রাম পাঠিয়েছে বি ডি ও অফিস থেকে, ওদের ওয়াটার ক্যারিয়ার সেগুলো তুলে আনতে থাকে উপরে। তখন, কিছু একটা হবে, কিছু একটা যেন এগিয়ে আসছে, ভাবতে ভাবতে সম্ব সিড়ি বেয়ে নিচে এসে দাঁড়াচ্ছে আনমনে।
আর ওকে নামতে দেখে কীসের আশঙ্কায় দত্তবাবু, স্বপনবাবুর হাত ধরে একটানে সম্বর সামনে দাঁড় করিয়ে সিঁড়ির গেটে তালা আটকে দিচ্ছেতখন, সেক্টরকে ঘিরে ধরেছে জনা কয়েক সাজুগুজু। সম্ব শুনতে পাচ্ছে হইচই। আর অপেক্ষার সরিয়ে দাঁড়াচ্ছে, কখন ঝড় আসে।
তো ঝড় এল। মানে সাজুগুজু। আর পেছন পেছন আরও জনা কুড়ি লোক। কমবয়েসি একজন গেট ধরে ঝাঁকাচ্ছে আচমকা। স্বপনবাবু টানছে হাত ধরে। “বুইলেন, সার, পুলিশের খবরদিতি হচ্ছে। এ কী ঝামেলায় পড়া গেল... ”
সম্ব জানে ঝামেলা শুরু হয়নি এখনও। ভেতরে ভেতরে ভয় গ্রাস করছে ওকে। কী হয় কী হয়...
কিচ্ছু শোনা যায় না। শুধু হইহই... ঝন ঝন...  সম্ব সোজা দাড়াল। ঐ তো কঞ্চির মত শরীর। তবু চাবুকের মত সোজা। হাত তুলে থামার ইশারা।   
“এইডে কী হইল্য? আমাদ্দে পুস্টার মুচিদেচ্চেনক্যা? ”
“ভোটকেন্দ্রের একশ মিটারের ভেতরে যে পার্টির প্রচার থাকবে না, সেটা কতবার করে বলা হয়েছিল, মনে পড়ে?”
“আমাদ্যট্টা অনিক দূরি আচে। মেপিদ্যাকেন।”
“ওরাই তো মাপল। আপনাদের গ্রামেরই তো লোক, সেক্টর, না? ওকেও বিশ্বাস করেন না?”
“আমাদ্যে মেপি দ্যাকাতিব্ব্যে” সাজুগুজুর আবদার। সম্ব ভাবে, না মেটালে আবার যদি মাঠে পা ছড়িয়ে কান্না জুড়ে দেয়! আর ভাবতেই দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাজুগুজু, পরনে কিচ্ছু নেই, কোমরে একটা ঘুনশি, মাঠে পা ছড়িয়ে কাঁদছে। শরীরটা শিশুর, কিন্তু মুখের দিকে তাকাতেই... আপন মনে হেঁসে ওঠে ও।
“সার, আমারে তো মোটেও বিশ্বাস করছে না এরা। আপনিই মেপি দ্যান।” সেক্টর তখনও পোস্টের সামনে কোমরে হাত। সঙ্গের লোকরা চুনের বালতি হাতে, চুনকাম করার বুরুশ হাতে থ।
স্বপনবাবু তখন ফিতে হাতে গেট খুলে দরজায়ফিতে এগিয়ে যায়। এগিয়ে চলে জমে ওঠা অসন্তোষ।  পোস্টের কাছাকাছি এসে এক দীর্ঘশ্বাসে থেমে যায় সাজুগুজু। আশি মিটার। সম্ব তাকাল। সাজুগুজু বিড়ি বের করেছে। দু-আঙুলের মাঝে বিড়ি নিয়ে  ডলতে ডলতে কানের কাছে নিয়ে যায় বিড়িটা। আশেপাশে তাকায়।
কে একজন দেশলাই দিল ওকে।  সম্ব দেখছে ওর বিড়ি ধরানোর সমস্ত অভ্যেস। দেখছে আর ভাবছে, আবার কি হয়।
আবার গুঞ্জন ওঠে। আবার কী হল? এবার মনে হল ময়নাপার্টির জনা কয়েক ছেলে। সোজা অভিজিতের সামনে।
“এটা কি ছেলিখ্যালা পেইছ? হাআআআআ? ছেলিখ্যালা?” 
কী হল? আবার কী?
“ইডা কি ছাউ হইছ্যে?”
সম্ব খেয়াল করেনি। মাঠে ভোটকেন্দ্রের দরজার সামনে কিছুটা অংশ ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। দুটো লাইনে জনা পঞ্চাশেক লোক যাতে দাঁড়াতে পারে।
সেক্টর কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু ওরা সুযোগ দিচ্ছে না দেখে সাজুগুজু এগিয়ে গেল এবার। স্বপনবাবু আর দত্তবাবু সম্বকে একরকম জড়িয়ে ধরে নিয়ে এসেছে সিঁড়ির মুখে। ওদের দলের বাকি সকলে একসাথে দাঁড়িয়ে দেখছে। কথা কাটাকাটি কেমন হঠাৎ হাতাহাতিতে পালটে গেল। সাজুগুজুর হাত চলছে, মুখ, কে কাকে মারছে, দেখা যাচ্ছে না।
এ তো আর সিনেমায় দেখানো সাজানো মারামারি নয়, যে যেমন পারে, যাকে পারে মেরে নিচ্ছে, ঘুশি, লাথি, খিস্তি... সম্ব দেখছে, অভিজিৎ কখন ওর বাইকে চড়ে রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে দূরে। যেন কীসের খবর দিতে যাচ্ছে অজানা কমান্ডারকে।
আর ততক্ষণে একটা টহলদার পুলিশের গাড়ি এসে থেমে গেলে মুহূর্তে যে যার মতো পালিয়ে গেছে মাঠ ভেঙে। সম্ব ভাবে, পুলিশ আসে সব গোলমাল শেষ হয়ে গেলে, এই মিথটা তাহলে আজ সত্যি হল না।
তখন পুলিশের গাড়ি থেকে বুথের ইন-চার্জ এগিয়ে এসে খোঁজ করেন প্রিসাইডিং অফিসারের। কথা হয় ভোটার সংখ্যা নিয়ে। কথা হয়, যেকোনও সমস্যায় খবর দিতে। কথা হয় জটলা নিয়েও...  
স্কুলবাড়ির পেছনের পায়ে চলা পথে ততক্ষণে কারা এসে দাঁড়িয়েছে। পায়ের শব্দে সে খবর জেনেছে সম্ব। জেনেছে, দূরে টলটলে একপৃথিবী কান্না নিয়ে কেউ রয়েছে আজ। কাল থাকবে কি না কেউ জানে না।
********
রান্না করতে এসে আজ সবাই কেমন জড়সড়।  দিব্যেন্দুদা বলল, “গাঙ্গুলি, আজ মুরগী রান্না হোক। চলো...”
সম্ব নেমে এসে দেখে রান্নার জোগাড় চলছে তখনও। সামনের পথ দিয়ে কে একজন যেতে যেতে নেশা জড়ানো গলায় একভাবে বলে চলেছে, “হুউউ... এডা এড্ডা ছাউ হইয়্যে? হুউউউউ? ভেঙ্গি দিব্ব্য... কাইলি...” সম্ব রান্নাঘরে মুরগী রান্নায় হাত দিয়েছে।  কুটে বেটে রেখে রান্নার দিদিরা তখন শহুরে বাবুর রান্নার তোড়জোর দেখে মুখ টিপে হাসে। সেনেটি হাতে হাতে মশলাটা, হাতমোছার গামছাটা এগিয়ে দিচ্ছে। বলছে, “বাবু, আপনি এত ঘন ঘন হাত ধুচ্ছেন কেন? আচ্ছা, ছাড়ুন, আমি কষে দিচ্ছি।” আর বৌদি হেসে যাচ্ছে একটানা।
রান্না যখন প্রায় শেষ, মাঠে তখন জ্যোৎস্না ভাসছে। মাঠদুয়ারী স্কুলের বারান্দায় এসে বসে সম্ব। মাংস রান্না শেষ করে। ভাত চাপিয়ে দিয়েছে ওরা। দিব্যেন্দুদা উপরে গেল। সেনেটি এসে বসেছে ওর পাশে। সম্ব আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদের দিকে। বলে,“আর মাত্র একটা দিন। কালকে আর গোলমাল না হলেই বাঁচি। যা সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে...”
আর ফুঁপিয়ে উঠছে একটা ছায়া।
  




পরিচ্ছদ:১০


আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। কাল ছটায় মক পোল, মানে পাঁচটার আগেই ঘর গোছানো হয়ে যাওয়া দরকার। তারপর তো সারাদিন যুদ্ধ। জারি জনযুদ্ধ।
সন্ধ্যের আগে, রান্নার ফাঁকে সকলে মিলে নীচের ঘরে, যেখানে ভোট হবে, সাজিয়ে রেখে এসেছে।  হাতে হাতে গুছিয়ে রেখেছে সব কাগজপত্তর। একটু আগে ভোটবাবুদের সাথে বসে খেয়েছে রান্নার দলের সকলে। আগে মেয়েরা খেয়েছে আজ। তাই নিয়ে ওদের কী হাসাহাসি। সম্ব বলল, আজ একটু স্বাদ বদল হয়েই যাক...
তখন নটা বাজে। দূরে কোথাও একদল মোটরবাইক নিস্তব্ধ রাত্রির বুক চিরে একটানা গর্জয়। সম্ব কান পেতে থাকে। পুলিশগাড়ির শব্দ। হইচই। নিচ থেকে পুলিশের গলা পাওয়া গেলে ওরা বোঝে, নিচে কারা এসেছিল। দৌড়াদৌড়ির হুটোপুটিতে ঘরের সবাই তখন উঠে বসেছে।
জোরালো টর্চের আলো ঘোরা ফেরা করে মাঠ পেরিয়ে, খেজুরের সারসার অপেক্ষা পেরিয়ে যতদূর অভিমান...
একটু পরে সব থেমে গেলে দত্তবাবু কেশে ওঠেন। সে এক ভয় ধরানো কাশি। দুবার ইনহেলার নিয়েও থামে না সে দমক। উত্তেজনায় সবাই কাছাকাছি এসে বসে থাকে। দত্তবাবু দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়েছেন। সম্ব ওর পাশে বসে। বাবার কথা মনে পড়ে হঠাৎ। কান্না জড়িয়ে আসে...
অবশ্য সে বেশিক্ষণের জন্য না। খানিক পড়ে আবার সবাই শোবার জোগাড় করে। নীচ থেকে কার আকূল ডাকে আবার উঠে বসে সকলে।
দিব্যেন্দুদা বলল, “গাঙ্গুলি, বাদ দাও। যেতে হবে না। কী দরকার ঝামেলায় জড়িয়ে?”
স্বপনবাবুও বারণ করেন। সুধীরকাকুই শুধু বলল, “না সার, আমাদের যাওয়া উচিত। আমি যাচ্ছি। চলেন।”
নিচে শান্তিরাম। শান্তিরাম হাঁসদা। হাতে একটা টর্চ নিয়ে স্কুলবাড়ির গেটে।  “এত রাতে?”
“আপনার একবার যেতিই হবে, সার।”
“কেন? কোথায়?”
“ওরা বাইক ন্যে গুণ্ডা পাঠায়ে বাড়িবাড়ি ধমকাচ্চে। কতা বল্লিই মাইর। এ চোখি দ্যাখা যায়, আপ্নিই বলেন?”
“কারা ওরা?”
“আরকারা, সার? পেচাপাট্টির উরা।”
সুধীরকাকু পাশ থেকে বললেন, “আমাদের যাওয়া কী ঠিক হবে?”
“আপ্নাদ্যে সাথি পুলিশ আচে। একবার চলেন, সার...”
“দেখুন শান্তিবাবু, আমাদের কাজ ভোটের সময়, ভোটকেন্দ্রের একশ মিটারের মধ্যে। তার বাইরে আমাদের কিছু করাটা অনধিকার চর্চা।”
“আপনি দাঁড়ালি উরা ভয়প্যেয্‌যাবে। সার উরা আপ্ননারি বিরাট ভয়পাচ্চে একুন।”
“ভয় না হয় পেল, তারপর? আমি তো কাল বিকেলে চলে যাব। আপনাদের যে সারাজীবন থাকতে হবে, শান্তিবাবু। আমি অচেনা লোক, আর আমি ভোটের কাজে এসেছি মানে, আমি রাজনীতির বাইরের লোক। আমার যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
শান্তিরাম ধপ করে বসে পড়ে সিঁড়ির উপরেই। “আমাদের গিরামে এরোম তো আগে হইনি...” বলছে, আর ভাবছে, তবে কি মানুষ চিনতে ভুল হল তার? ভুল লোকের কাছে এসেছে শান্তিরাম?
বিড়বিড় করে বলছে শান্তিরাম, “বারবার আমাদ্যেসাথি এরম কেন হবে বলেন্তো? রাজা আস্পে, রাজা যাবে, আমাদেত্তো কুনও ঝামিলা ছেল না...”
“আমি একটা কথা বলি, শান্তিবাবু, এ লড়াই আপনার একার। আপনার গ্রামের। সেনেটি বলছিল, আপনাদের গ্রামে দুটো শান্তি আছে, এক শান্তিরাম হাঁসদা, আর দুই, যে, এ গ্রামে যাই হোক, রাজনীতির গোলমাল নেই... এখন, একটা শান্তি বজায় রাখার দায় অন্য শান্তির হাতে। শক্ত হোন।”
“সাআআআর...” শান্তি হাঁ করে তাকায়... মানুষ চিনতে...
“ওরা বাইরেই লোক। তাদের হাতে এভাবে মার খাবেন? একবার উঠে পালটা মারবেন না? যদি না মারতে পারেন, আপনাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কী গল্প রেখে যেবেন আপনি?”
সম্ব দেখল, শান্তিরামের চোখ এই অন্ধকারেও জ্বলছে, জোনাকির মতো... আগুনের মতো... শান্তিরাম সোজা উঠে দাড়াচ্ছে। যেতে যেতে বলে যাচ্ছে, “সার, আপনার বইস কম, কিন্তু আপনার্ত্তে শিখার আছে... অনিক কিচু শিকার আচে
তারপর সে এক হইচই... রাস্তায় নেমে গেছে মানুষ। তখন সম্ব দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত দিগন্তের দিকে দেখছে। চাঁদ। ক্ষয়ে যাচ্ছে। তার সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে বেলেমাটির দেশ... খেজুর গাছের মিছিল, ইউক্যালিপটাস। ওদিকে একটা হইচই... তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ।
স্বপনবাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে কয়েকটা ছেলেকে ঘিরে ধরে ঐ দূরে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মেয়ে বউদের দল। ছেলেরাও সামিল হয়েছে। সেই ছেলেদের রঙিন চুল, রোখা মেজাজ, চোখা জুতো, মেজাজি মোটর বাইক, কোমরে গোঁজা টর্চ, পাইপগান পেরিয়ে একটা স্বপ্নের মিছিল এগিয়ে যেতে দেখছে সম্ব। ওদের মুখে টর্চের আলো পড়েছে।  
গ্রামের সবাই দেখেছে ওদের। আর মুখোশ হারিয়ে ওরা দৌড়ে পালিয়েছে যে যার মতো। স্বপনবাবু বললেন, “বুইলেন সার, শান্তিরামেরে আপনি পাশ করায়ে দেলেন। একদম একশোয় একশ...”



পরিচ্ছদ:১১


তো, এইভাবে শুরু হয়েই গেল ভোট। সেবারের লোকসভা নির্বাচন। সেইবার, মানে, যেবার সেনেটি ঘরামি  প্রথম ভোট দিল।
মক-পোলের সময় মোট পাঁচজন এজেন্ট এসেছে। ভিডিও ফটোগ্রাফারের সামনে মক পোল হল যখন, সারা ঘর থমথমে। সেক্টর আসেনি। মক পোলের পর গুছিয়ে যখন বসা গেল, হুড়মুড়িয়ে সেক্টর হাজির। সঙ্গে একটা ভিডিও ফটোগ্রাফার। কী ব্যাপার? না নতুন ক্যামেরাম্যান ডেপ্লয়েড হয়েছে। নতুন করে মক পোল করুন। একেবারে লাফিয়ে উঠেছে পেঁচাপার্টির লোকেরা। হ্যাঁ, হ্যাঁ। নতুন করে।
সম্বর মাথায় ঢুকছে না এই নতুন খেলাটা। সাতটায় যেখানে ভোট শুরু করতে হবে, সেখানে নতুন করে মক পোল! সেক্টরের দিকে তাকাল সম্ব। কিছু তো লুকোচ্ছে লোকটা। মেশিন খুলতে যাবে যখন সেক্টর, সম্ব এগিয়ে গেল, “নতুন ফটোগ্রাফারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা আগে দিন। নতুন করে মক পোল করার অর্ডারটাও।”
সারা ঘরে যেন কীসের এক নিস্তব্ধতা। সেক্টরের মুখ ফ্যাকাশে। ও তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। পেঁচাপার্টির এজেন্ট কী একটা বলতে যাচ্ছিল। সম্ব হাত তুলে থামায়। সেক্টর গুছিয়ে নিচ্ছে। “না, মানে, অর্ডার কেন?  আমি সেক্টর, আমি বলছি...”
“আমি এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিংআমি চাইছি।”
“না, মানে, ভার্বালি পাঠানো হয়েছে ওকে...”
“ভোটে ভার্বালি কিচ্ছু হয় না, সেটা আপনিও জানেন, আমিও জানি। আই বিলিভ অনলি ইন রিটেন পেপার অর্ডারস। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
বাইরে খবর চলে গেছে। দরজায় একদল লোক। সম্ব দেখে, শান্তিরাম... ও সোজা দাঁড়ায়। পেঁচাপার্টির এজেন্ট কখন বসে পড়েছে ওদের নির্দিষ্ট জায়গায়। সেক্টর তাকিয়ে দেখছে, আশে পাশে কেউ নেই। সম্ব জোর গলায় ডাকল, “দত্তবাবু, লাইন থেকে প্রথমজনকে আসতে বলুন। আমি মেসেজ পাঠাব।”
মোবাইল হাতে নিল সম্ব। ১৮২ নম্বর ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার। মেসেজ লিখল, পি এস। সেন্ড হল। সারাটা সময় সেক্টর ঘরের মধ্যে হাঁ। সম্ব নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে, “মক পোলের সার্টিফিকেটটা  নিয়ে যাবেন। মনে করে।”
******
ভোট আসলে এক রহস্য। আর রহস্য মানেই তাকে জানার এক আকূলতা... সম্ব বেশ বুঝতে পারে... এই যে যাদের জয়ের জন্য এত আকূলতা, তাদের সব স্বপ্ন তো পূরণ হয় না। হয় না তা বুঝেও ওরা আপ্রাণ চেষ্টা করে, কীসের এক নেশা, কীসের এক প্রত্যাশায়...
সেক্টর চলে গেছে। প্রথম ঘন্টার টার্ন আউট দেওয়ার পর সম্ব ভাবল, যাক, শুরুটা ভালোই হয়েছে, আশা করা যায়, ভালোয় ভালোয় কেটে যাবে। ওয়াটার ক্যারিয়ার বাইরে বসে আছে, পুলিশের সাথে, ভোটের লাইন ঠিক করতে। দু-একজন ভোটার আসছে অন্ধ সেজে, যাদের আদৌ অন্ধ বলে মনে হচ্ছে না। সম্ব আপত্তি করেছে, কিন্তু পোলিং অফিসারদের আপত্তি নেই। “সার, উরা লিখতি পারেনায়ি? ইউএসবি ফরমটরম রাকেন্দ্যি...”
সম্বর অভিজ্ঞতা আছে। সব পক্ষেরই এরকম কিছু শিওর ভোট থাকে। সবাই মিলে এই বিলিবন্টন করে রেখেছে এই দেশে। তুমিও খাও, আমিও খাই... শুধু মুর্খ সাধারণ মানুষদের কিছু খাওয়ানোর দরকার নেই...
সম্ব তখন একটা একটা ফর্মের কাজ এগিয়ে রাখছে। পিএসও-০৫... এই এক নতুন আমদানি... আরও কত কিছু যে করতে হয়, যার কোনও মানেই হয় না। কাজ করতে করতে নজর রাখছে। বাইরে একটা গুঞ্জন... আবার... সম্ব মুখ তোলে। বারান্দার কাছে কারা দল বেঁধে এসেছে।
“হেইইইইইইই... আমাদ্যে ভোটির ছবিতুলি নেযাচ্চ্যে...”
জটলা থেকে কে আওয়াজ দিতেই এক দল লোক ছুটে এল বারান্দার কাছে। নিমেষে ভোটের লাইন থেকে সবাই ছুটে পালাচ্ছে। সম্ব দেখল, হাঁড়িয়ার পসরা সাজানো খেজুর তলা থেকে আসছে লোক, এদিক থেকে, ওদিক থেকে... পুলিশকাকু বসে ঝিমুচ্ছিলো, হঠাৎ এই কলরবে সোজা দাঁড়িয়েছে। ডিউটি... বন্দুক হাতে টানটান। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ। সম্ব শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।  
“কী ভেবিয়েন? যাখুশিতাই করিন্যএ যাবেন?”
“আমরা কী কিচুইবুজতি পারিন্যে?”
“হেইইইইইই... চদিনি, ক্যামিরা ভেঙিফ্যালায়ে দইতিহয়ে... ”
সম্ব হাত তোলে। ডানহাত। সোজা তাকায়। “কী সমস্যা সেটা বলুন।”
“ভিতুরি ছবিত্যুলত্যিইয়েন কেন? কে কারি ভোটদেচ্চে সব দেখিনেচ্চেন?”
“ছবি কীসের তোলা হচ্ছে, তা কি জানেন?” সম্ব জোর গলায় বলে।
“কেন? আমরা কী কিচুইবুজতি পারিন্যে নায়ি?”
“ক্যামেরা কি আগের ভোটে কখনও ছিল না? নতুন তো দেখছেন না। একজন তবু এসে দেখে যান ভেতরে...”
“নতুন্তো আপ্নারেও দেখচি... তাইলি?”
“তাহলে একজন ভেতরে আসুন...” সম্বর বেশ হাসিই পাচ্ছিল।  দূরে খেজুরগাছের আড়ালে যে কার ছায়া দেখা যাচ্ছে, অসহিষ্ণু, কিছুতেই তাঁর কোনও প্ল্যান কাজে না আসার অসন্তোষ...
কেউ আসছে না দেখে সম্ব আবার বলল, “কই? আসুন একজন?”
ততক্ষণে জটলা কেটে যাচ্ছে, ভেতরে নিজের চোখে সত্যি ঘটনাটা দেখার হিম্মত হারিয়েছে প্রায় সবাই। সম্ব যখন দূরে তাকাল আরএকবার, ভেতরে স্বপনবাবুর চিৎকার আচমকা ভেঙে দিল সাময়িকের নেমে আসা নীরবতা। সম্ব তকলাফে ভোটিং কম্পার্টমেন্টের কাছে। আর ভেতরের লোকটা তখনও নিড়ানির মাথাটা ব্যালট ইউনিটের ভেতর ঢুকিয়ে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে। সম্ব চেপে ধরেছে ওর হাত।
ব্যাপারটা এমন মুহুর্তে ঘটে গেছে, সম্বও বুঝতে পারছিল না, ও কি করে এক ঝটকায় ঘরে ঢুকেই এই প্রান্তে ভোটিং কম্পার্টমেন্টের সামনে এসে চেপে ধরেছে লোকটার হাত। পোলিং এজেন্টরা তখন ওর আশেপাশে। পুলিশকাকু। জানালায় জটলা, শান্তিরাম, গ্রামের মেয়েবউরা।
তাহলে ক্যামেরা নিয়ে ওই জটিলতাটা ওকে বাইরে আনার জন্য ছিল। ততক্ষণে ব্যালট ইউনিটটা যদি ভেঙেচুরে দেওয়া যায়... স্বপনবাবু বলল, ওর ভোট হয়ে গেছে আগেই। কন্ট্রোল ইউনিটের আলো আগেই নিভে গেছে। থেমে গেছে শব্দও।
বাইরে ভোটারদের লাইন আবার দাঁড়িয়েছে। সবাই তখন চাইছে লোকটাকে তাদের হাতে তুলে দিতে। এজেন্টরা মাথা বাঁচাতে বলে দিয়েছে, পুলিশে দিতে। আর সেই নিড়ানি হাতে লোকটা কে তাকে এই মেশিন অকেজো করার নির্দেশ দিয়েছিল, সে কথা বলেই দিয়েছে সম্বর কানেকানে, তাকে কে বা কারা পাঁচশো টাকা দিয়েছে এই ভোটের আগাছা উপড়ে ফেলার জন্যে, সে কি করে জানবে কীসে কি হয়...
তখন অদূরে শালিখপার্টি, ময়নাপার্টির এমনকি পেঁচাপার্টির লোকেরাও একজোট“আমাদের হাতে তুলেদ্দেন্দি... পুলিশি কাজ হবেন্ন্যে...” সম্ব তাকায় ওদের মুখের দিকে। তারপর লোকটাকে। মুখে হাঁড়িয়ার গন্ধ ভুরভুর... ফোনটা বের করেও আবার পকেটে রেখে দেয়। শান্তিরামের মুখের দিকে তাকালবাইরে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে শান্তিরাম।  
যাও। আমাদের গণতন্ত্রের এই আগাছা উপড়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টার কথা আর সবাইকে নাই বা জানালাম। কত জঞ্জালই তো রয়েছে। সেসব কে কবে সাফ করে... এই তো ভারি একটা আগাছাসমৃদ্ধ মাটি... তাও আসমস্ত ব্যর্থ... একটা হাহাকার-সংকুল গ্রামের কথা, একটা ইতিহাসহীন আবেগের কথা, একটা ভুলের কথা আর নাই বা বলে বেড়ালাম... কার কাছে মহান হতে পারতাম এত করে?   


             

পরিচ্ছদ:১২


সেনেটি চলে গেছে। তার প্রথম ভোট দিয়ে, স্বপ্নের দেশ গড়ার ইচ্ছে নিয়ে গেছে আঙুলের কালিতে... কলঙ্কের কালি যতটা মেখেছিল, সবটুকু না হোক, কিছুটা মনে হয় ধুয়ে গেল আজ সারা দিনে। সারাদিন আজ উৎসব শুরুর আগেই কেমন ভাঙা সুরে সবার মনভার। মাঠে লোক কমে এসেছে। ধূধূ দুপুরের দিকে তাকিয়ে তেষ্টা পায় সম্বর ঘরে লোক নেই। ভোটের লাইনেও। পোলিং অফিসাররা হাত-পা ছড়িয়ে বসে।
সম্ব জল খেল। ১৭ এ খাতাটা খুলে দেখার ইচ্ছেটা একবার চাপতে পারে না। পাতা জুড়ে জ্বলজলে টিপছাপ, নিত্যবাবুর লেখা এপিক নাম্বারের চারটে ডিজিট... কে কাকে খুঁজে বেড়াবে এখানে? কে কোন চিহ্নের কাছে নিজেকে প্রমাণ দিতে যাবে? কে কাকে খুঁজে পাবে এই লেপ্টে দেওয়া কালির দাগের সমুদ্রে?   
তখন প্রায় চারটে বাজে, শান্তিরাম জানালা দিয়ে ডাকল মাঠে লোক নেই বললেই চলে। যে দু-চারজন আছে, তাঁরা মাঠের দূরে দূরে নিতান্ত কাজ না থাকায় ঘুরছে। তেমন অসুবিধের কিছু করবে না।
শান্তিরামের ভয় কেটে গেছে। আরও একবার ভোটে গোলমাল হল না। আশেপাশের গ্রাম থেকে খবর আসছে, অশান্তির। ১৮৩, ১৮৪ বুথে বাইরে থেকে পুলিশ আসার খবর ছড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। কারা যেন বুথের চারপাশে ঘুরঘুর করছিল, পুলিশ এসে আচমকা লাঠির ঘা বসিয়ে দিয়েছে কালো কালো শক্ত মাটি ভাঙা পিঠের ওপর... বেচারা... সারাবছর তো সেই মাঠের কাজ করেই খেতে হবে, একদিনের জন্য রাজা সাজতে গিয়ে... রাজা সাজার এই উৎসবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাজ কি? শান্তি জোরে প্যাডেল চালায়।
প্যাডেল ঘুরে ঘুরে এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা স্বপ্নের দেশ। একটা ইতিহাসের হাতছানি। ধূধূ পথের বাঁকে সাইকেলের মুখ ঘুরতে চায় না। কে যেন টেনে ধরেছে চাকা... শান্তিরাম দামাল ঘোড়ার রাশ টেনে পেরিয়ে যাচ্ছিল তেপান্তর, তাঁর এই সামান্য রাস্তার সাদা ধুলো, ইঁটের টুকরোর আনাড়ি মাথা তোলা থামাতে পারে?
প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে নিয়েচঝে শান্তিরাম। সামনের বাঁক পেরোলেই...
এমন কত কত বাঁক পেরিয়ে আসতে হল আজ... কত অজানা বাঁক পেরিয়ে আজ অবশেষে এই বিকেলের রোদ পিঠে নিয়ে ঘরে যাচ্ছে ও। এই ঘর, এই উঁচুনিচু অসমান জীবনের রাস্তার ধারে এক উঠোন জলের সীমায় একটা ঘর... আনমনা করে দেয় ওকে। ঘর, মানে এক আশ্রয়...
আনমনে রাস্তার বাঁক পেরিয়ে গেছে শান্তিরাম। খেজুর গাছের দীর্ঘ ছায়ার কাছে না-রাখা অভিমানের হিসেবে ওর সাইকেলটা যেন লাফিয়ে ওঠে।
ছায়ার আড়াল থেকে কেউ কি ডেকে উঠল ওর নাম ধরে? শান্তি আনমনা হয়। একটা বাতাস কানে কানে কি বলে যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে... শান্তিরাম হাঁসদা কান পাতবে বলে ডানদিকের খেজুর গাছের দিকে তাকাল।
আর আচমকা বিদ্যুতের মতো কি একটা ছুটে এসে লাগল ওর কাঁধের কাছে।
তখন যেন আলো নিভে গেছে। শান্তিরাম তাকায়। সাইকেলটা কাছেই দাপাচ্ছে। ওর চালিয়ে রাখা প্যাডেলের জোরে তখনও ঘুরে যাচ্ছে চাকাদুটো... অবিরাম। আর সামনের মাঠঘাট, গাছপালা সব কেন যে দাপাচ্ছে, দাপাতে দাপাতে উলটে পড়ছে শান্তিরামের গায়ের ওপর... আর চোখের কোণা দিয়ে ও দেখছে কালো টলটলে জল পুকুরের বুক থেকে ছিটে আসছে ওর গায়ের উপরে। ঢেউ আসছে, একটু একটু করে কালো জলের ঢেউ ছুঁয়ে যেতে যেতে শান্তি কান পাতে... কে যেন বলছে দূরে... মরেনি, মরেনি...পালা, পালা...
আর শান্তির ঘুম পাচ্ছে। সারাদিনের অবিশ্রাম হাহাকারের পর এই ঘুম। শুধু গলাটা...
দূরে একটা বাইকে স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শোনা যায়। তারপর আরও একটা একটা করে চারটে বাইকের পালিয়ে যাওয়ার শব্দ। মাথায় একটা শূন্যতা নিয়েও শান্তির মনভার হচ্ছে না। ও জানে, একটা ইতিহাসের গড়ে ওঠার পিছনে এই অনিঃশেষ পতনের কিছু মূল্যতো আছেই...
তখন ভোটকেন্দ্রে একটাও লোক নেই। মাঠে যে সামান্য দু-চারজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, তারা সবাই অপেক্ষার আছে কখন ভোট শেষ হবে। অপেক্ষায় আছে তাদের স্বপ্নের দেশ তৈরির বার্তা নিয়ে এই সন্ধ্যায় দূর শহরে ফিরে যাবে ভোটবাবুরা... তাদের হাতেই সব... শহরের হাতেই সব। ওরাই বলে দেবে তোমরা তো ওদের হাতে তুলে দিয়েছ দেশের ভার, ওর হাতে তো দাওনি...   
শহরই তাহলে শেষ কথাতাদের স্বপ্ন গড়ে দেবে এই শহরের বাবুরা। তাই এই পাহারার ক্ষণ শেষ হতে থাকে, মন চায় না।
আর দূরে এক ছায়ার কাছে একটা সাইকেল তার মাথা তুলে পড়ে থাকে এবড়োখেবড়ো রাস্তায়। তার চাকাদুটো শেষবারের মতো পাক খেয়ে যেন পৌঁছুতে চাইছে স্কুল অবধি, ভোটকেন্দ্র অবধি... ছুঁতে চাইছে সেই ছিপছিপে তরুণ ছেলেটিকে যে ওদের আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে বলেছে... শান্তি এত তাড়াতাড়ি ভাঙে না... এত...




পরিচ্ছদ:১৩  


ছ’টা বাজলে সম্বর্ত্তক বারান্দায় দাঁড়াল। মাঠে জনা দশের লোক সেই থেকে ঠাই দাঁড়িয়ে... আলো নেভে বিকেলের। সম্ব নিয়মমতো ঘোষণা করে, “১৮২ নম্বর বুথের কোনও ভোটার যদি ভোট দিতে বাকি থেকে থাকেন...” মাঠ থেকে কে চেঁচিয়ে বলে, “নেই সার, নেই... কেউন্যেই...” এত উদবেগের মধ্যেও তবু হাসি পেল ওর...   
ঘরে আলোর নীচে সিলিং হবেসম্ব হিসেব নিয়ে বসে পড়েছে ততক্ষণ। কত ভোট হয়েছে, তার নথি নেবে পোলিং এজেন্টরা।  দিব্যেন্দুদা জানতে চায়, “কত হল, গাঙ্গুলী?”
“৮৫৭। মেশিন কী বলে?”
“মেশিন তো ঠিকই বলে, কিন্তু আমাদের স্বপনবাবু যে বলেছিল ৮০০ ছাড়াবে না?” স্বপনবাবুর দিকে তাকায় দিব্যেন্দুদা, সবার চোখ স্বপনবাবুর দিকে, সারাদিনের এক টানটান উত্তেজনার পর সামান্য আমোদের লোভ কে বা সামলায়... “তাহলে স্বপনবাবু আমাদের কী খাওয়াচ্ছে গাঙ্গুলী? আর সি তে গিয়ে না কি এখানেই?”
স্বপনবাবু একমনে গালা সিল করছেন। নিত্যদাও আওয়াজ দিলেন... এসবের দূরে সম্ব দেখছে স্কুলের রান্নাঘরে আলো জ্বেলেছে কারা। তাদের ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, তাদের রিনরিন চুড়ি... তাদের খিলখিল হাসি...
খাতা আর মেশিনের ৮৫৭ দেখে ফিরে গেছে কয়েকজন। তাদের ফিরে যাওয়ার পথে ঘরে ঘরে রটে গেছে উৎসব শেষের বিষাদ, উৎসব শেষের এক  গোপন হিংসার কথা... একমাত্র হিংসার কথা, গ্রামের ছোটোবড়ো সকলের কাছে এ এক বিস্ময়... হিংসার কি সত্যিই কোনও দরকার ছিল?  এই যে বছর অন্তরের আমাদের স্বপ্ন সাজয়ে দূর শহর থেকে এক ঘোষণা দেওয়ার সাজানো খেলা, যা আমাদের দূর ওই শহর ঠিক করে দিল আজীবন... সেখানে হিংসার কিছু দরকার ছিল কি?
গালার ওপর মেটাল সিল দিচ্ছে সম্ব, আর দিব্যেন্দুদা এগেন্টদের বুঝিয়ে দিচ্ছে ১৭ সি ফর্ম। সম্বর পিআরও ডায়েরি ঘন্টায় ঘন্টায় লিখে রাখা ছিল, ছিল পিএসও ০৫, তবু এত কাজ... পুলিশ সেক্টর খবর দিল, “ফোর্স না এলে মুভ করবেন না। ১৮৪ তে দেরী হচ্ছে।  আমরা একসাথে মুভ করব।”
সম্ব ঘড়ি দেখল, ন’টা বাজতে গেল। আশেপাশে একটাও ছায়া নেই।। অন্ধকার বলে, টিমটিম করে দূরে দূরে ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। গ্রামের ঘরে বিদ্যুৎ এসে গেছে মানে, তার সব রহস্য যেন মাটি হয়ে গেল বলে মনে হয় সম্বর।
একা ভোটকেন্দ্র আগলে আছে ও। সবাই যে যার স্বপ্ন সামলে এখন ফিরে যাচ্ছে নতুন প্রস্তুতির কাছে। মন ভার হয়, ছায়ার কাছে যেটুকু আশ্রয় পাওয়া যায়, রাত নেমে এলে তাও কেমন অচেনা লাগে...
সেক্টর ফোন করছে, “আপনি মুভ করে যান। পুলিশ আসবে না... রাত হলে লঞ্চ দেওয়া হবে না...” সেক্টরের গলা কাঁপছে। সবাই তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। দিব্যেন্দুদা মাথা নাড়ল।
“না, গাঙ্গুলী, পুলিশ ছাড়া যাওয়া ঠিক হবে না। পথে যদি কিছু হয়...”
পুলিশকাকুও একমত। সম্বর শুধু স্বস্তি, আরও কিছুক্ষণ ছায়ার, আওর কিছুক্ষণ এই উত্তাপ। তারপর আরসিতে গেলে কে কার খোঁজ নেবে? সময় বয়ে যায়, রটে যায় শান্তিরামের নিখোজবার্তা। কে এসে খবর দিল, বাড়ির কাছে ডোবার ধারে রক্তমেখে পড়ে থাকা হেডমাস্টারের কথা।  
কাছাকাছি হাসপাতাল নেই। স্কুলঘরের বারান্দায় শান্তিরামকে এনে বসানো হল। সেনেটি বাড়ি থেকে এনেছে ফার্স্ট এইডের বাক্স। জলের বালতি। সম্ব রক্ত ধুয়ে দিচ্ছে। রক্ত তখন তার পথ ধরে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছে।
নিত্যবাবু টর্চ ধরেছেন। নাহ্‌, তেমন মারাত্মক লাগেনি। স্পিরিট দিয়ে পরিশকার করা হলমারকিউরোক্রোম ছিল, রক্তের সাথে মিশে যেতে যেতে সে ওষুধের ঘ্রাণে আরও একবার কাছাকাছি এসে পড়ে ছায়া সুনিবিড় পশ্চিম শীতলিয়া গ্রাম, গ্রামের মানুষ। মাথায় একটা ছোটো ক্ষত। যন্ত্রণা... সম্ব ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। গরম চা এনে দিল সেনেটির বৌদি। কাল ডাক্তার দেখিয়ে নিলে হবে। শান্তিরাম অলীক দৃষ্টিতে তাকায়...
পুলিশ খবর দিল, “আমরা আর আদাঘন্টার মধ্যে মুভ করব। আপনারা রেডি থাকুন।”
আর বিদায়ের সুরে একটা থালায় গরম ভাত, ডাল, আলুভাতে, পেঁয়াজের টুকরো, কাঁচালঙ্কা সাজিয়ে গ্রামের বউরা বরন করে নিল শহরকে, শেষবারের মতো। সেনেটির বাড়িয়ে দেওয়া থালার দিকে তাকিয়ে দেখছে ভোটবাবু, ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে যেন নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন ভেসে যাচ্ছে...
তাড়াতাড়ি ডিম সেদ্ধ করে দিয়েছে সেনেটির বউদি। “খেন্যেন, বাবু, নেবুখালি ঘাটে ভুটভুটি আটক্যে গেলি খুব খিদিপে যাবে...”
গ্রামশুদ্ধু লোকের সামনে কীকরে খায় ওরা... “আরেট্টা কতা, রাত্তিরির খাপারের দামদে আমাদ্যে লজ্জা দেবেন্না যেনি... আপ্নারা না থাক্লি...”
সেনেটির চোখ ভোটবাবুর দিকে... দূরে ভ্যানোর শব্দ পেলে সবাই আবার যেন জেগে ওঠে স্বপ্ন ভেঙে।  




পরিচ্ছদ:১৪   


পুলিশ উঠে পড়ল। বাক্স গুছিয়ে যে যার জায়গায়। পেছনের ভ্যানে সম্ব আর দুই পুলিশের সাথে পুলিশ সেক্টরের প্রধান। ফোন বেজে ওঠে সম্বর। “সার ভোটন্যে যেতি পারব্যেন্না। পথির ধারি বন্দুকন্যে সব দাঁড়ায়্যেছে...” সম্ব হাসল। শুনে পুলিশসেক্টরও... ওরা যে পাঁচজন... আমি যে শম্ভু... “কই, স্টার্ট দাও...”সম্ব তাড়া দেয়...
মাঠ ভেঙে কে যেন ডাক দিল, “হেইইইইই... দ্যাকদ্যি, আমাদ্যে ভুট ঠিকঠিক যাচ্চেন্যায়ি...”
পাশ থেকে পুলিসসেক্টর বলে, “আরে, বাবা, ঠিক আছে। এত চিন্তার কী আছে, শুনি?”
“ঠিকাছে মাইন? আমাদ্যে ভুট... দিল্লিব্ধি যাবে... দেখিদ্যিতি হুয়েন্যা?”
তার মুখের ভুরুভুরু হাঁড়িয়ার গন্ধে সারা মাঠ ভাসছে। মাথায়, পিঠে ব্যান্ডেজ নিয়ে এল শান্তিরাম। সম্বর হাত ধরে তাকায়। যেন বলছে, আপনি কী পেলেন, জানি না। আমরা তো ইতিহাসের সাক্ষি থেকে গেলাম। আমাদের সেই সুখের দিনের জন্য আমাদের এই সামান্য রক্ত যেন সফল হয়...
মাঠ ভেঙে কোকিলপার্টির এক এজেন্ট ছুটে এল। পেছন পেছন পেঁচাপার্টি, ময়না, শালিখপার্টির এজেন্টরাও। তাদের সাথে গ্রামের আরও কিছু লোক। আপনার ভয় নেই, সার। পথে লোক জেগে আছে। আমারা পেছন পেছন যাচ্ছি... সবাই।
তো, ভ্যানের পেছনে সম্ব পা ঝুলিয়ে বসে। ভ্যানো স্টার্ট দিতে মাঠে এক কলরব ভেসে ওঠে। সেনেটির হাত এগিয়ে এসে তখন ছুঁয়ে দিয়েছে সম্বর হাতদুটো। ফিসিফিসিয়ে বলছে, “স্যার, আমার প্রথম ভোট... মনে থাকবে...”

ভ্যানো চলতে শুরু করেছে। হাতের ছায়া সরে যেতে সম্বর মনে হল, বাতাস ফুঁপিয়ে উঠেছে। একফোঁটা জল পড়ল কি আঙুলের ওপর? 


       

মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
ভালই লাগল। প্লটটা সুন্দর।

বিশ্বজিৎ।