অন্যগদ্যঃ দ্বিতীয়াংশ ।। শিমুল মাহমুদ ।। শ্লোগান ।। এন্টফিকিশন : ৬ষ্ঠ কিস্তি।।

 শিমুল মাহমুদ
 শ্লোগান
 এন্টফিকিশন : ৬ষ্ঠ কিস্তি
 দ্বিতীয়াংশ 


আমরা পূর্ণতার সন্ধান করছি অথচ তারপরও ঈশ্বরের মতোষষ্ঠ দিবসে ছুঁয়ে দেখি তার কপাল চুলে লেগে আছে দুঃখ নীরবতা মেঘ মৃত্যু তারপরও ডুমুরবৃক্ষের পত্র সেলাই করে আমাদের আদি জননী লজ্জা ঢাকেন আর তখন আমি আর জফির রমণীর শরীর দর্শনে পেয়ে যাই পবিত্র মানচিত্র, ‘বিস্মিত হয়ে আমি লক্ষ করি আসলে তোমার ফর্সা শরীরেই অঙ্কিত রয়েছে জেরুজালেমের মানচিত্র! তোমার গ্রীবাদেশ থেকে নাভি অবধি নেমে গেছে জর্ডন নামক পার্বত্য নদীটি আর দু-পাশে উপত্যকাময় দুটি শহর লোকে একে জেরুজালেম নামে ডাকেসার্বক্ষণিক এমনতর শারীরীয় পবিত্র সাধনায় আমাদের আত্মা সাড়া দিলে আমরা বুঝতে সক্ষম হই আমাদের সত্যিকারের বিশুদ্ধ শিল্প হল আত্মার শুদ্ধতা আর যখন আমরা শুদ্ধতা ছুঁয়ে দেই, ‘চাঁদের আলোয় তখন প্রস্তরযুগ কাঁপছেএবং আমি হতবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি বিশুদ্ধ আত্মার মতো, ‘নদীর হতবাক মাছগুলোও তখন প্রচণ্ড বেদনায় বিষণ্ন নীল হয়ে উঠেছে
জফিরের কবিতায় সময় সমাজ জীবনের প্রতিফলনে সৃষ্ট ভাবাবেগ অপ্রধান; বরং সমকাল আড়ালে থাকে; এখানেই তার ক্ষমতা কেননা জফির এই আড়ালরেখার ভেতর প্রধান করে তোলে ব্যক্তিকে; যে ব্যক্তি নিছক একজন ব্যক্তির ভেতর আটকে না থেকে মহাজাগতিক মিথে উন্নীত হয়ে মানবচেতনার শাশ্বত সংকটকে অনিবার্য করে তোলে বোধে প্রজ্ঞায়; প্রজ্ঞায় ভাষায় যে ভাষার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ত অহম বোধের সত্তা সুতরাং আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠ করতে থাকি অপৌরুষের বাণী,
      সুতরাং তোমার নগ্নপেটে আমি সূর্য এঁকে দিতে পারি
      আর তোমার কান্নাভেজা চোখে যবগাছের চারা
রোপণ করে দিতে পারি
আর তোমার দুপায়ের মাঝখানে মাথাগুঁজে
মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরও হতে পারি;
আমি অন্ধ আজ, সোনার কাঁটায় বিদ্ধ আমার চোখ
কিন্তু আমার চোখভরা  স্নেহ প্রেম
            (ডুমুরের গোপন ইশারা / পর্ব )

জফিরের সাথে আমার প্রেম মূলত ব্যক্তিজফিরের কারণে তো বটেই তবে প্রথমত ওর কবিতার কারণে দ্বিতীয়ত ব্যক্তিজফিরের চোখভরা স্নেহ প্রেমের কারণে; যে চোখ বিদ্ধ হয়ে আছে সোনার কাঁটায় সেই অন্ধ যন্ত্রণার ভেতর বিদ্ধ হয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের শ্বাস গ্রহণ; আর হাজারটা অতীতের সাঁতারকাল; যে ডুবসাঁতারের স্রোত আমাকে নিয়ে চলে আত্মা বোধের কাছে; আমার প্র-প্রপিতামহের সংস্কৃতি-সংশ্লিষ্ট চেতনা-আক্রান্ত ভাড়ারঘরে; তারপরও তা অথৈ সুতরাং শুধুমাত্র আমার ঠাকুরদার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাথে যুথবদ্ধ নই আমি; বরং আমি সংযুক্ত আছি মানবসভ্যতার অনিবার্য শুক্রানুর সাথে জফিরের কবিতা আমাকে টেনে নামায় শেকড়ে মহাকালের গর্ভে; বিশ্বময়তার কালিক স্রোতে সুতরাং জফিরকে নিয়ে ভাবতে হলে জফিরের মহাজাগতিক চেতনার বিষয় ভাবদর্শনের সাথে তার কবিতাকে মিলিয়ে নেয়ার অবকাশ রয়েছে আমাদের মানসজগতে কি জফিরের কবিতার মতো গুপ্তঐতিহ্য, আর্কাইভ অর্থাৎ প্রত্নচেতনা লুকিয়ে থাকে? হ্যাঁ অনিবার্যভাবেই আমাদের ভাষাস্তরে লুকিয়ে আছে এমন এক অতীত-আশ্রয়ী জগত যে জগত আমাদের পথ দেখায়, আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়, কে আমি? আর এই মহাজগতের একটি ক্ষুদ্র অংশ হয়ে শেষাবধি কোথায় আমার যাত্রাবিন্দু? আমার সত্তা আদতে আমারই অংশ কিনা? নাকি আমি অপর কেউ? শুধু এই পৃথিবীতে অবছায়া অবভাস হয়ে অভিনয়ে লিপ্ত আছি? আমার সত্তা আদতে অপর কোন জগতে স্থির হয়ে, অবিনশ্বর? অনাদিকাল অনন্ত ময়ূরতুল্য মৃত্যুহীন আমার সত্তা?
      একদিন নীল পালক হয়ে ঝরেছিলাম এক ময়ূরীর
      নরোম শরীর থেকে
সেই থেকে আমি আত্মা হারিয়েছি
      সেই থেকে আমি গন্ধলোলুপ ময়ূরমাত্র

      আমার প্রপিতামাতার চেহারা আর মনেও নেই
      শুধু তোমার কবরের গর্ত থেকে
হ্রেষারবে ঘননীল মেঘ ভেসে আসে, সন্ধ্যার বাতাসে
                  (ময়ূর উজানে ভাসো / )

ঘননীল মেঘের ভেতর আমাদের বাস ঘনসবুজের আত্মার ভেতর আমাদের বাস উঠতি পৃথিবীর তরুণ শহরের পেটের ভেতর আমাদের বাস সেই পেট থেকে সন্তর্পণে আমরা আমাদের নদীর কাছে ফিরে আসি নদীর তীরে আমাদের বাস রক্তে-মাংসের গোপন-গহীনে মাটি জলের গন্ধ মিশে আছে; এই ঘ্রাণ মিশে আছে আমাদের প্রত্ন অভিজ্ঞতায় মানব সভ্যতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই প্রত্ন অভিজ্ঞতার তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে প্রয়োজন নিজেদের রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাস শিল্প সাহিত্যের ক্রমবিকাশ অনুধাবন এই অনুধাবন প্রক্রিয়া জফিরের কবিতার ভেতরতলে সন্তরণশীল; কাজেই জফিরকে আমি পেয়ে যাই প্রত্ন অভিজ্ঞতায় সংযুক্ত অথচ ক্রমশ মুক্ত-পৃথিবীর দৈনন্দিন পাঠে মগজে আর এই মগজ বন্ধক রেখেছি আমি বহুকাল জফিরের কবিতার ভেতর
ওরা অমরত্বের কথা বলে

আর আমি দেখি ঝিনুকের খোলের ভেতরে
একটি লাল গ্রীষ্ম আনন্দঘোড়ার মতো কাঁপছে
                  (গ্রীষ্ম-জন্মের গর্ভ, ১৫ / সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা)

তখন প্রতিনিয়ত আমি ফিরে আসতে থাকি আনন্দঘোড়ার কাছে যে ঘোড়ার অনিবার্য গতির ভেতর ফেলে আসা শিশুকালে জেগে উঠতে দেখেছিলাম একটি লাল টকটকে গ্রীষ্মঋতু আমি আর জফির সূর্যের সিড়িতে পা রেখে কেবলই তলিয়ে যেতে থাকি; মাথার ওপর সবুজ চাঁদ; আমরা দুবন্ধু আমাদের শ্রবণতন্ত্রী প্রসারিত করি; খুব সংগোপনে শুনতে পাই অমরত্বের পিপাসায়, ‘কুয়াশার মাঠে একটা অধীর পাখি ডাকছে
আমাদের আর ফেরা হয় না আমার আর ফেরা হয় না আর আমরা তখনও জানতাম না, কবি মামুন মিজানের আর কোনো কালেই, গণনাবিহীন সময়ের পথ বেয়ে মামুন আর কোনো কালেই বাড়ি ফিরতে পারবে না কোনোদিন না কক্ষনো না এই বাড়ি না ফেরার গল্প শুনবার জন্য আমরা মোটেও সতর্ক ছিলাম না কেননা আমরাতো বাড়ি ফেরার গল্প শুনতেই অভ্যস্ত বেশি ভালোবাসি ঘরের দিকে ফেরার আয়োজনে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে খুব শিশুকালে আমার একজন মা ছিলেন; আমি কি ভুলে গেছি মায়ের মুখ? মায়ের মুখ কি জুঁইদির মুখের মতো? তাকে কি ভুলে যেতে হয় কখনো? আর তখন, আমরা ক্রমাগত অনেকগুলো রাতের ভেতর দিয়ে নিজেদেরকে খুঁজে পাই; খুঁজে পাই মাকে আর এই রাতগুলো নিজেই তখন ভয় পায়; ভয় পায় আমাদের যাবতীয় আয়োজনকে; মায়ের যাবতীয়, মায়ের সবগুলো ভালোবাসাকে ভয়, ওইসব দূরাগত রাত আর তখন সেই পরাভয়ের ওপর একসাথে জেগে ওঠে হাজার কোটি অথবা ২১, ৫২, ৭১ তারকাতুল্য মোমের আলো মোমের আলোয় আমরা ভুলে যেতে বসি, এইখানে এই শাহবাগে কোনোদিন কখনো কোনো রাত নেমেছিল আর তখন আমাদের কাছে এই হাজার লক্ষ মানুষের মুখগুলোকে, আমার দেশের মানুষের মুখগুলোকে, শাহবাগের মুখগুলোকে ভীষণ পরিচিত আর আত্মীয় বোধ হতে থাকলে আমরা ক্লান্তি ভুলে যাই আমাদের গলায় তখন জেগে ওঠে, ‘ আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা
আমার মাথা নিচু হয়ে আসে; নিচু হতে হতে এক সময় পাকা রাস্তায় ঠোঁট ছোঁয়ায়; আর তখন কবি রাহেল রাজিব পেছনে তাকিয়ে দেখে, সেঁজুতি কাঁদছে, সেঁজুতি ফোঁপাচ্ছে; সেঁজুতি চোখের জল ছেড়ে দিয়েছে; এলোমেলো সেঁজুদি সেই এলোমেলো জল গোপন করার চেষ্টা করছে না; যেন বা সে বুঝতে পারছে না যে, সে কাঁদছে কেন-না ওর চোখে তখন হাসি মুখ খোলা হাসি সেই খোলা মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে, ----- বাংলা চিরায়ত আকাশের সমান উঁচুতে প্রবহমান স্পর্ধিত আর অহঙ্কারজাড়িত আবারো ---- বাংলা আবারো চেতনাতল স্পর্ধিত ---- বাংলা এবং আবারো দেবদারু গাছ উপড়ানো আওয়াজ শাহবাগের বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের প্রাচীন আকাশমুখি অট্টালিকা অথবা বিলবোর্ডের বাজারদখল ভাষাকে উপেক্ষা করে; আর তখন মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন সম্মানিত আসামি পুলিশ পাহাড়ায় চিকিৎসারত, পিজি- কেবিনের দরজা জানালা লোহার কেবিনেট, রড দিয়ে ব্রিটিশ কায়দায় তৈরি চকি, সেই চকি থেকে নামার জন্য জলচৌকিতে তিনি পা রাখলে সবাইকে কেমন এক বিহ্বলতা পেয়ে বসে; মুহূর্তেই সকলে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করতে থাকে; তখন নিজের বুকের হার্টবিট বিষয়ে সচেতন হলে সম্মানিত যুদ্ধাপরাধীর চোখের তারা ক্রমাগত ঘোলা হয়ে ওঠে; স্বাধীনতাবিরোধী পরকালআশ্রয়ী গভীর বিষণ্ন সেই চোখ
আবারো ভেসে আসে সেই বিরামহীন চিরায়ত মহাসেনতুল্য অথবা সিডরের সাথে ঠিক তুলনাযোগ্য নয় অথচ সেই দেবরমণীদের দেবশিশুদের দেবমানবদের সম্মিলিত নেতৃত্বহীন আওয়াজ এবং বিরামহীন আওয়াজে টিভি- স্ক্রিনে সংবাদ পাঠিকার দৃষ্টি কেঁপে ওঠে; সংবাদ পাঠিকার চোখে তখন হাসির অভিনয়ের পরিবর্তে ফুটে ওঠে উদ্বেগ; এবং অনিবার্য অমীমাংসিত প্রশ্ন, এরপর কী হবে? আর ঠিক তখন, ঠিক তখন কবি রহমান হেনরী তার ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছেন তারপর উত্তেজনা; না উত্তেজনা ঠিক বলা যাবে না; বলতে হবে উত্তেজনা-আবেগ পেয়ে বসলে এক ধরনের কষ্ট; না কষ্ট ঠিক না, এক ধরনের নিঃসঙ্গতা; নিঃসঙ্গতা ঠিক নয়; তবে কথা ঠিক সম্মিলিত গণমানুষের এমন সম্মিলিত নিঃসঙ্গতার রূপ কোনো কবি কোনোদিন কোনোকালে এমন করে দেখতে পাবে তা তারা ভাবতে প্রস্তুত ছিলেন না কখনো অথবা বলা সম্ভব এই ভাবনার প্রস্তুতিকালিন সময় তাদের যাবতীয় কবিকল্পনাকে অতিক্রম করে গিয়েছে


মন্তব্যসমূহ