অন্যগদ্যঃ প্রথমাংশ ।। শিমুল মাহমুদ ।। শ্লোগান ।। এন্টফিকিশন : ৬ষ্ঠ কিস্তি।।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক শিমুল মাহমুদের 'এন্টাফিকিশন' একটি অসামান্য লেখা। গত ছ'মাস ধরে 'অচেনা যাত্রী'তে লেখাগুলি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এখনও পাঁচ কিস্তি বাকি। কিন্তু 'অচেনা যাত্রী'র প্রথম পর্বের যাত্রা এখানেই শেষ। পাক্কা দু-বছর নিয়মিত প্রকাশের পর। 

এই কিস্তিটি আমরা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে একপাতায় কিছুতেই প্রকাশ করতে পারিনি। এ-আমাদের চরম অক্ষমতা। তাই কিস্তিটিকে চারটি অংশে ভাগ করে নিয়েছি। আশাকরি আপনারা মানিয়ে নেবেন। 
ধন্যবাদ। 
- সম্পাদক।  

শিমুল মাহমুদ
শ্লোগান
এন্টফিকিশন : ৬ষ্ঠ কিস্তি

কাওরান বাজার ঢাকা থেকে পাঠানো চিঠি পেলাম আমি ট্রেনে পরিচিত সেই অবাক শ্রমিকের চিঠি অথচ শেষ পর্যন্ত সেই মানুষগাড়িতে দীর্ঘ জনজমাট জার্নির পরও তার নাম জানা হয়ে ওঠেনি; অথবা বলা যায় লোকটি হয়তো রহস্য ভালোবাসতো; ঠিকানা লিখে দেবার সময় লিখেছিল, ‘মালিকের গোলাম তারপর চার লাইনের ঠিকানা প্রথম লাইনে ছিল প্রযত্নে: সবজি বিক্রেতা আবুল মিয়া সুতরাং তাকে প্রথম বারের মতো চিঠি লিখতে বসে ঠিক কী নামে সম্মোধন করবো, নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিতে পড়লাম লিখলাম, রহস্যময় ধুসর শ্রমিক, আপনাকে লাল সালাম আপনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি অথবা কেন যে আপনাকে লিখছি তা আমার কাছে পরিষ্কার নয় হয়তো বা খেয়াল মানুষের তো কত রকম খেয়াল থাকে তবে আপনার চোখেমুখে যে পাগলামি মেশানো দ্রোহ দেখেছি তা হয়তো আপনার প্রতি আমাকে আগ্রহী করে তুলেছে
হয়তো চিঠিতে আরও কিছু লিখেছিলাম; এখন মনে করার ইচ্ছে নেই লোকটার চিঠির নিচে লেখা, গোলাম মালিক লোকটি শেষাবধিগোলাম মালিক’  হয়ে উঠলো; অথচ আমার জানা ছিল না, লোকটি সকলের কাছে গোলাম মালিক নামেই পরিচিত
কিছু মানুষের মতে, আবেগ দিয়ে পলিটিক্স হয় না চিঠি পড়ে মনে হলো গোলাম মালিক এইকিছুমানুষের দলে নয় হ্যাঁ আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না; তবে এই আবেগ থেকেই দেশপ্রেম হয় গোলাম মালিকের আবেগ আছে; আছে দেশপ্রেম চিঠির ওপরে তারিখ লেখা ১৯ সেপ্টেম্বর ট্রেন ভ্রমণের দিনটি ছিল ১২ সেপ্টেম্বর
কবি ভাই, আপনার চিঠি পেলাম আমার মনে হয় পৃথিবীতে কেউ ভুলতে চায় না ক্লেদাক্ত হৃদয়ের ওপর একটা পাতলা অশরীরী আবরণ পরে মাত্র আসলে আমরা সময় মনের কাছে প্রবঞ্চনা করে চলেছি আর এরও বোধ হয় প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের জীবনে হ্যাঁ সেদিন সেই আমাদের মতো যতসব ছোটলোকদের জন্য ৩য় শ্রেণির ট্রেনের ঠাসাঠাসির ভেতর বোধ হয় সমস্ত কথাই অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল যাক আবার যখন যোগসূত্র পেলাম আশা করি অসমাপ্ত কথাগুলোর সমাপ্তি ঘটানো যাবে জানেন কবি ভাই, আমরা জীবনের জন্য অনেক থিসিস মুখস্ত করেছি কিন্তু বাস্তবে রূপ দিয়েছি কম বাংলাদেশ অর্থাৎ সমস্ত বাঙালি জাতি যে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় দিন যাপন করিতেছে তার মুক্তির সনদ যে কোথায় লুকিয়ে আছে, কোনো রাজনৈতিক অভিধানে খুঁজে পাই না আজ বস্তির রোগক্লিষ্ট প্রেতাত্মা আমার শরীরে ভর করেছে; জীবন নদীর এমনি তীরে দণ্ডায়মান, ডানে সমুদ্র, বামে কাঁটাবন, সামনে সরুপথ, পিছনে ফেরার অবকাশ নেই; জানিনা কোনদিন অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে যাবো যদি পারেন আপনার এলাকাতেই কিছু একটা করার চিন্তা ভাবনা করেন কিছু না করতে পারলেও অনাগত ভবিষ্যতকে আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে কথাগুলো কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যে পরে গেল তা পরুক তবুও মনকে কিন্তু ফাঁকি দিতে পারবো না কথায় বলে, যে নিজেকে ভাবতে শেখেনি সে অন্যকে ভাববে কখন? নিজের শাশ্বত চিন্তাধারার পাশে সহস্র মানুষের কান্না শুনতে পাই অহরহ, কিন্তু কী করবো? আপনি তো কবি, আপনি কি শুনতে পান? নাকি আমার মতো আপনিও ভাবনার আল্পনাগুলো গুমরে মরা আলমারিতে সাজায়ে রাখছেন প্রতিনিয়ত? আপনার একটা কথা মেনে নিতে পারছি না জীবন কোনো দিন জীবনের মূল্য দেয় না তাকে মূল্যায়ন করতে হয় আমাদের কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে আর যেভাবেই দিনাতিপাত করি না কেন, আমি বাস্তবতাতে বিশ্বাসী; বস্তুর পরিমানগত পরিবর্তনের সাথে সাথে যদি গুণগত পরিবর্তন ঘটে তাহলে বলবো আমাদের জীবনের পরিবর্তন ঘটবে; জাতির পরিবর্তন ঘটবে; প্রশাসন পরিবর্তন হবে কিন্তু সে ধৈর্য কোথায় আমাদের? এবার ইতি টানতে হয় মেহনতি মানুষের জয় হোক আপনার কবি জীবনের মঙ্গল কামনায় লাল সালাম
চিঠিটা পরপর দুবার পড়ে ফেলার পর বুঝতে পারি, চিঠির অনেক কথাই গোলাম মালিকের নিজের নয়, কোনো জায়গা থেকে টুকতে গিয়ে সাধু চলিত গুলিয়ে ফেলেছে নিজের মুখের ভাষাতে ধরনের কথাবার্তাও তার পক্ষে চিঠিতে লেখা সম্ভব নয়; হয়তো বা সম্ভব; হয়তো বা সে নিজেই সবকিছু লিখেছে; তবে যাই হোক না কেন চিঠিখানা আবেগ আর লড়াইয়ের চেতনায় স্পর্শকাতর কিন্তু গোলাম মালিক আমার ঠিক কোন কথাটি মেনে নিতে পারেনি, তা আমার কাছে স্পষ্ট হয় না; মনে করতে পারি না চিঠিতে আমি কী লিখেছিলাম; তারপরও আমাকে তার চিঠিখানা আবেগের ভেতর টেনে নিতে চায়
আমার আবেগ আমাকে দিয়ে চিঠির জবাব লিখিয়ে নেয় সম্ভবত সেই জবাবের ভেতর লেখা ছিল, সম্ভবত নয় আসলেই সেই চিঠিতে অনেকগুলো বিষয়ের ভেতর লেখা ছিল, এবারে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারদ্বয় মাইকেল এস. ব্রাউন এবং জোসেফ এল. গোল্ডস্টেন কলেস্টেরোলের রাসায়নিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে গবেষণা করে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই পুরস্কার কিমেহনতি মানুষের জয় হোক’, এই শ্লোগানের পক্ষে কাজ করে? আর যদি আমার এলাকার অবমানবেরা এই আবিষ্কারের ফল ভোগ করে দুএক টুকরো ঔষধ পায় তা হলে আমরা কি সেই ঔষধ ফিরিয়ে দেব? ১১ অক্টোবর ১৯৮৫ পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধী আন্তর্জাতিক চিকিৎসক গোষ্ঠীকে (আইপিপিএনডব্লিউ) ১৯৮৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল আমেরিকান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বার্নাড লোওন এবং সোভিয়েত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ইয়েভগেনি চাজভ যুগ্মভাবে এই পুরস্কার লাভ করেন এই পুরস্কার কি জনতার অর্জন, নাকি ব্যক্তির উন্নয়ন? জনাব গোলাম মালিক, বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
পরের সপ্তাহে গোলাম মালিক বিষয়ে কোনো অভিমত না দিয়ে এবং কোনো তত্ত্বীয় আলোচনায় না গিয়ে গোর্কীর মা-কে নিয়ে আবেগ লেপটানো একখানা কবিতা লিখে পাঠায় কবিতা পাঠে আমি বিরক্ত হই; এবং উত্তর দেবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আমি কি আত্মকেন্দ্রিক? অথবা গোলাম মালিকের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাটা কি আমি নিরাপদ মনে করিনি? কবি-মন জটিল অথবা সাবধানি; অথবা অল্পতেই আগ্রহ হারায়; যেখানে তার জন্য কোনো লাভ নেই অথবা অন্যকে পাঠ করার বিষয়ে কবি নিষ্কাম, অনাগ্রহী; শুধুই আত্মরতিতে নিমগ্ন?
হয়তো বা আর সব কবির মতো আমার ক্ষেত্রেও রকম মন্তব্য খেটে যায় ঠিকঠাক মতো তারপরও অহমের দাসত্বের কারণে আমাকে বলতে হচ্ছে, এগুলোর একটিও আমি নই; হতে পারে অন্য কেউ তা না হলে আজ অনেকগুলো বছর পর পুরোনো চিঠিপত্রের ভেতর গোলাম মালিকের কবিতার ওপর কেনই বা আমার চোখ আটকে যাবে? অথচ গোলাম মালিকের চেহারা আমি হারিয়ে ফেলেছি গোলাম মালিকের কবিতার শিরোনাম, ‘তৃতীয় শ্রেণির কামরা’; শুরুটা হয়েছে অভিমান মেশানো ক্ষোভ দিয়ে সবাই আমাকে একা রেখে চলে গেলো সময়ের হাত ধরে; নস্ট চাকার রেলগাড়িতে বিয়ারিং চলেছি আমি, টিকিট কাটিনি অথচ সময় আমাকে বিয়ারিং বুক করে তুলে দিলো এক তৃতীয় শ্রেণির কামরায়; যেখানে দেখতে পেলাম গোর্কীর মা-কে, যেন বা নতুন সংস্করণ তৃতীয় শ্রেণির এক কামরা, যেখানে নিঃশ্বাসের ভারি শব্দকে শ্লোগান বলে ভুল হয়; যেখানে তামাকের বাষ্পে জন্ম নেয় সকাল তোমরা চলে গেলে ইতিহাসকে স্বাক্ষী রেখে; অথচ আমি রয়ে গেলাম তৃতীয় শ্রেণির কামরায়
আজ দেড় যুগেরও পর গোলাম মালিকের কবিতায় আক্রান্ত হলাম অথচ কিছুতেই গোলাম মালিকের মুখ মনে করতে পারি না অস্বস্তি হয় বাসে চেপে বসার পরও অস্থিরতা কাটে না জানালায় তাকাই নিজের কবিতার লাইন আওড়াবার চেষ্টা করি, ভুলে যাই; পারি না
শেষাবধি শাহবাগের পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ভিড়ের দৃঢ়তায় বুকের ভেতর এক ধরনের চাপ বোধ করতে থাকি আমি ভেসে আসছে শ্লোগান আর তখন দেড়যুগ আগের মানুষগাড়ির ভেতরে ঠেসে বসে থাকা গোলাম মালিকের মুখ ভেসে ওঠে মাথায়; মাথা থেকে বুকে; বুক থেকে চোখে, চোখের তারায় গোলাম মালিক কি শ্লোগান দিচ্ছে? গোলাম মালিক কি নিজেকে চিনতে পেরেছে বলেই এইভাবে শ্লোগান দিতে পারছে? গোলাম মালিক কি এতদিনে মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখেছে? এখনো কি তার সেই আবেগ নিয়ে সে হেঁটে যায়, মাথা ঝাকিয়ে খানিকটা বুকের দিকে মাথাটা এলিয়ে দেবার ভঙিতে?
কিছু কিছু মানুষের মতে, আবেগ দিয়ে পলিটিক্স হয় না আবেগ দিয়ে রাজনীতি চলে না কিন্তু এই আবেগ থেকেই দেশপ্রেম হয়; এই আবেগ থেকেই৭১ হয়; এই আবেগ থেকেই শাহবাগের গণজাগরণ হয় আর তারপর আবেগের মতো একদিন তা বিপদ ডেকে আনে জন্ম হয় হেফাজতি জনগণের; দীর্ঘদিনের দানা বেঁধে ওঠা মোল্লাতন্ত্র তলোয়ার উচিয়ে ছেন্ডেল ছুঁড়ে দেয় বায়তুল মোকারমের ভেতর; আগুন ঢেলে দেয় পবিত্র পুস্তকের দেহে, আর তখন ধর্ম রক্ষার তেজে তেজিয়ান ঘোড়ার মতো ছুঁটে আসতে থাকে পূঁজির পেছন পেছন পেশি; হাতের মাসলগুলো সব জোট বেঁধে রগ ছিড়ে ফেলতে চায়
কেমন সকাল! রাতের চেয়েও আঁধার আঁধার কুয়াশা কিছু মানুষ খুব নীরবে অহঙ্কারে নষ্ট হয়ে যায় একটা মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হওয়ার কষ্ট আছে অথচ অনেক মানুষ, নষ্ট হলে কি আমরা কষ্ট পাই? শুধু অধিকার, শুধু অধিকারের কথা বলি, দায়িত্বের কথা বলতে শুনিনি কাউকে আমিও কি দায়িত্ব বিষয়ে ভেবেছি কোনোদিন? বরং এখনো আমরা বাড়ি ফেরা মানুষের ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসি বাড়ি ফেরা মানুষগুলো বড় ভালো তাদের চোখে মুখে একটা সবুজ আভা আছে উৎসবে আনন্দে ঈদে পূঁজোয় অথবা শাহবাগ থেকে, জাগরণ মঞ্চ থেকে; স্টেশন রেলস্টেশন লঞ্চ টার্মিনালে ঘুরে বেড়াই; গভীর আগ্রহে দেখি সবুজ মানুষের ঝাঁক হয়তো ঝাঁক বাঁধা কই গভীর জলে, স্রোতের শরীরে, বালুতীর অথবা সবুজ ধানক্ষেত কচুবন পাটবন ভুট্টাবন অথবা সরিষা ক্ষেতের আইলে গিয়ে পথ খোঁজে; কোথায় যেনো যাবার কথা ছিল; কোথায় ফেরার পথ? পেছনে বর্ষা, বর্ষাবৃষ্টি; মায়েরা অপেক্ষায় থাকে মায়ের ফাঁকা বুকের ভেতর অপেক্ষা মায়ের জড়ায়ুর ভেতর অপেক্ষা, ফিরে আয়, নিরাপদে, আহ্লাদে, ফেরার কালে শানপুকুরের বুড়ো পাকুড়গাছের ছায়া বাঁচিয়ে ফিরে আয়, ফিরে আয় ঘরে কবি ফেরে না ফেরে না স্টেশনে ঘুমোনো মানুষেরা রাতের ক্লাবের মানুষগুলোও ফেরে না কেন? কবির ফেরা হয় না; অথচ, বাড়ি ফেরা মানুষেরা সাথে করে নিয়ে আসে তাজা সবুজের আভা
প্রকৃত প্রস্তাবে আমার এই কবিতা ছিল স্বপ্ন কেননা তখন ফেরার সময় নয় আমরা তখন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আমাদের মায়েরাও তখন বাইরে কোনো এক বালকের মা, কোনো এক বালিকার মা অথবা কোন এক পিতার মা, কোনো এক মাতার মা, ঠিক কার যেন মা, এক প্যাকেট বিস্কুট এগিয়ে ধরে আমাদের দিকে মায়ের মুখে স্বপ্ন, উত্তেজনা; একটা কিছু করার দৃঢ়তায় মায়ের মাথার কাপড় নেমে আসে কাঁধে; মায়ের হাতের শিরায় রক্ত চলাচলের দৃশ্য লাফিয়ে ওঠে; আমরা ভিড়ের ভেতরে মাকে টেনে নেই
আমাদের মা, নাম তার রুকসানা বেগম পরিচিত, কত চেনা স্মৃতির সাথে মাকে সাথে নিয়ে পাকা রাস্তায় আমরা সবাই বসে থাকি, চিৎকার করি, হেসে উঠি তারপর সমস্ত জড়তা আর ভয়, প্রকৃত প্রস্তাবে সেখানে কোনো দ্বিধা ছিল না, সেখানে কোনো জড়তা ছিল না, সানোয়ার সিরাজের খড়খড়ে গলার রগ ফুলে উঠলে সিরাজের সাথে মায়ের প্রাচীন আর চিকন চির ধরা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে ওঠে, ‘ তে কাসেম মোল্লা; সেই পরিচিত চিরায়ত, আর সত্যিকার অর্থেই এই এক সপ্তাহের মধ্যে কি কোনো চেতনা চিরায়ত হয়ে উঠতে পারে (?) এই ভুল প্রশ্নকে উপেক্ষা করে রাগি গলায় গল্পকার পিন্টু রহমানের সাথে, কবি রাহেল রাজিবের সাথে ওরা সবাই ঘৃণা উগলে দেয়, ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার আসলে এই ঘৃণাতো কবি জফির সেতুর মতো, কবি মালেকুল হকের মতো, কবি আমিনা শেলীর মতো অথবা আপনার মতো ওরা সবাই পুসে রেখেছে এক শতাব্দি (?) অর্ধ শতাব্দি (?) যাবত মায়ের বয়স কত? চিরায়ত? মায়ের বয়স তো আর৪৭, ’৫২, ’৭১ এর ভেতর আটকে থাকে না; আটকে থাকতে নেই আমরা মায়ের দেওয়া মাত্র এক প্যাকেট বিস্কুটের ভেতরে আটকে থাকা ২১টি বিস্কুট গ্রহণ করি পরম মমতায় আমাদের ভেতর পরম মমতায় জেগে ওঠে ২১; আমাদের ভেতর পরম মমতায় জেগে ওঠে মা
কবির সাথে যখন আমার প্রেম হলো তখন বুঝতে পারলাম প্রেমকে হতে হয় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ আর আমরা যখন এই অনিবার্য নিরপেক্ষ সত্য আবিষ্কার করলাম তখন আমাদের বেঁচে থাকা হয়ে উঠলো অজস্র অর্থময় ঈশ্বর অথবা বেশ্যাকণ্ঠে ঠাসা এক একটি জাদুর কলস পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম, ‘দুধগাছ আমার মা সুতরাংমা আমার চিরহরিৎ, অন্নপূর্ণা; বাবা বিষগাছ--- করুণ ওষধি!’
কবি জফির সেতু জেগে আছে এমন এক সময়ের চাদরে যখন ব্যক্তি ক্রমশ সময়ের অনিবার্যতায় যুক্ত হয়ে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে নিজেকে ব্যক্তি এখন গোষ্ঠী ব্যক্তি এখন গোষ্ঠীচরিত্রের ছাঁচ বা পূর্বকাঠামো মাত্র যে কাঠামোর ভেতর ঠাসা আছে জন্মান্ধ, বিকৃত নখর, ছদ্মবেশী অথবা প্রগলভ মুখোস সুতরাং, ‘মহাসমর শেষে সকলের মুখ কেবলি বিকৃত একাকার হয়ে আছেঅথচ তারপরওএইটুকু জীবনে আমি যত মেয়ে দেখেছি দেখে মুগ্ধ হয়েছি--- মেয়েদের গর্ভের ফুল সর্বদা আমাকে তাদের ভেতরে টেনেছেক্রমশ গহনে টেনেছে আমাকে জফিরের কবিতার গর্ভজাত ফুলযেখানে একটা আস্ত বটগাছ প্রেমে মজে আছেতারপর কবি পৃথিবীবাসির জন্য লিখে দিচ্ছেন একখানা অমোঘ চিরকুট,
      স্তন থেকে দুধ ছলকে পড়ছে
      এই দুধ অনাগত শিশুর জন্য
     
      পদ্মযোনি থেকে রক্তপাপড়ি ঝরছে
      এই আর্দ্রবীজ উন্মাদ পৃথিবীর জন্য

      মানুষের জন্য আমার এই শেষ চিরকুট
                        (কর্কট / তাবুর নিচে দূতাবাস)


মন্তব্যসমূহ