শিমুল মাহমুদ
শ্লোগান
এন্টফিকিশন : ৬ষ্ঠ কিস্তি
শেষাংশ
মামুনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সিগারেটের পিপাসা পেয়েছে। জফির সেতুকে নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরির দিকে যাওয়া চেষ্টা করলো রাহেল রাজিব। সেঁজুতিকেও ডেকে নিলো। ওরা তিনজন এর ওর পিঠ ছুঁয়ে দিয়ে, চেহারায় কী এক আত্মীয়চিহ্ন জাগিয়ে তুলে, হাত এগিয়ে দিয়ে পথ করে নিয়ে ক্যানভাসে সার বেঁধে মোড়ানো সাইবার ক্যাম্প ধরে এগুতে থাকে। কবি জফির সেতু রাহেলের ওপর বিরক্ত হয় বিনা কারণে অথবা তুচ্ছ কারণে মেজাজ বিগড়ে গেলে মামুনকে রিং করে। নাহ, ফাজিলটার মোবাইল বন্ধ। জফির জানে না, আমি তখন ভূতের গলিতে কোরবানের সাথে বসে আছি; কথা বলছি; রাতটা থাকবো ওর কাছে। গণজাগরণ মঞ্চের ওপর লেখাটা রাত জেগে শেষ করবো; শাহবাগের জমজমাট আন্দোলনের ভেতর লিখতে বসাটা আমার জন্য অস্বস্তিকর। রাহেল কিন্তু মুখে মুখে কবিতা আউড়াতে আউড়াতে ল্যাপটপে লেখার কাজ এগিয়ে নিতে পারে; কবি পরিচয়ের তাড়নায় চোখমুখ খোলা রেখে সব রকমের যোগাযোগের বিষয়ে নিজেকে এগিয়ে রাখলেও বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজেকে উপস্থানের লোভ সে গোপন রাখতে পারে না; চমৎকার কৌশলে পরিচিত জগতকে সে মনে করিয়ে দেয়, সে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার; কাজেই মামুন তার কাছে গুরুত্ব পায় না; মামুন নিজেকে আড়াল করে; সবার ভেতরে থেকেও মামুন যেন বা এক গোপন গ্রহ। মামুন নিজেকে নির্বাসনে রাখে। আমি ফিরে যাই আমার বালকবেলার বন্ধু কোরবানের কাছে, পুরান ঢাকার গলিতে। একটা ওজনদার গদ্য লিখবো ভেবে মাথার ভেতর সব জোগারজন্তর করে রেখেছি। তর্ক থেকে যার সূত্রপাত।
তর্কের সূত্রপাত কবি সরকার আমিনের ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া মন্তব্য থেকে, ‘কবিরাও মাঝে মাঝে কিছু গোনাহ করে, তাকেও বলে কবিরা গোনাহ!’ আর ভয়ানক এই গোনাহর সূত্র ধরে খাজা মইন চিশতি বিনীত স্বরে, ‘সকল বন্ধুদের সবিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি আমাদের দেশের প্রচলিত ধর্মগুলোর ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো নিয়ে এমন কথা বলা উচিত নয় যার কারণে সংশ্লিষ্ট ধর্মানুসারীরা আহত হয়।’ কবি সরকার আমিন, চিশতি ভাইয়ের বিনীত কণ্ঠের গুরুত্ব বুঝতে পেরে লিখলেন, ‘আমাদের মহানবীর উচ্চাঙ্গের রসবোধ ছিল। রসবোধ আর অবমাননা এক বিষয় নয়। শব্দ মাবুদের অপূর্ব কুদরত! শব্দচয়নের দক্ষতায় তৈরি হয় যে মাহাত্ম্য তাতে আহত হবার কিছু নাই। ধর্ম কেবল মাদ্রাসার বিষয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিষয়।’
সরকার আমিনের এমন একটি জবাবে খাজা মুইন চিশতির মতো বুঝবান মানুষেরা হয়তো কবিমাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। অথচ শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’ গল্পটিকে যখন পাঠ্য করা হলো তখন তাকে অনেকেই কাফের ঘোষণা করলো। চিশতি সাহেব কষ্ট পেলেন, ‘মানুষকে কাফের ঘোষণা করলেই মানুষ কাফের হয়ে যায় না’। অথচ আমরা কী এক উন্মাদনায় বাকোয়াজির তুমুল নেশায় আক্রান্ত হতে হতে অবশেষে ভুলে যাই আমার ভাইয়ের নাম; প্রকট হয়ে ওঠে সাদা কালো ধূসর লাল অথবা শ্যামল রঙের মতো প্রতিটি ধর্মের বিভাজনরেখা। শিশুকালে উদার মাঠের বুকে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, ঐ যে দূরে যে বসতি দেখা যায়, সেই বসতির বুকে আকাশ নেমে এসেছে; সেই আকাশকে ছুঁয়ে দিতে দৌড়ে গিয়েছি আমি সেই দূরগাঁয়ে; কোথায় আকাশ? সেই কৈশোরকালে আকাশকে কাছে পেলে, আকাশের বুক ছুঁয়ে বলতাম, আকাশ, আমাকে অনন্ত শব্দ দাও, আর দাও বর্ণমালা দিয়ে সাজানো অবারিত মেঘবৃষ্টি; সেই মেঘবৃষ্টিতে আমি ধুয়ে ফেলবো আমাদের নাম, ডেভিড, শিমুল অথবা রিষিণ পরিমল; আকাশের কাছ থেকে আমাদের জন্য একটিমাত্র নাম চেয়ে নিয়ে ফিরে আসবো আমি আমাদের গাঁয়ে; সেই একটিমাত্র চিহ্ন, ‘মানুষ’ যার নাম।
আমরা কি সবাই গয়েবলস থিউরি প্রাকটিস করছি? কেন? এখানে তো রাজনীতির কিছু নাই। কীভাবে? হাওয়া থেকে বলছি, রাজনীতির কিছু নেই। ’৭১ এ পাক বাহিনীর কাছে লুঙ্গি উঁচাইয়া প্রমাণ করছি মুই সাচ্চা মুসলিম; আর এহন ঢাইক্কা ঢুইক্কা রাখলেও লেবাস ঠিকই ধইরা রাখছি; বুঝলা কবি গাছের বাকল ছিইলা নিলেও গাছের ভিতরের কথা বুঝন মুশকিল কিন্তু আমাদের চামড়া ছিইলা নিলেও আমরা স্বীকার করি না আমরা কার পারপাস সার্ভ করছি। মানে? মানে এখন বুঝবানা কবি, লুঙ্গি উঁচা করলেই বেরিয়ে যাবে শাহবাগ চত্বরের নেতারা কার স্বার্থে অরাজনৈতিক।
মানে জফির ভাই আপনে তাইলে বলতে চান আমরা সবাই সুবিধাভোগী, দালালি করতাছি?
অত অস্থির হইছো কেনো? না, আমজনতা দালালি করার সুযোগ পায় না, তারা গর্দভের মতো শুধু ব্যবহৃত হয়। গণযোগাযোগের ভাষায় ‘গ্রুপ থিংকিং’ বলে একটা থিউরি আছে; আমরা যখন ইতিহাসকে অনুসরণ করি তখন বলি, এই ‘গ্রুপ থিংকিং’ যাবতীয় ধ্বংস আর ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দায়ি। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো, ঠাণ্ডা মাথায়, এখন আমাদের মধ্যে আমরা কেউ কেউ এই ‘গ্রুপ থিংকিং’ এর কারণেই শাহবাগ আন্দোলনের ভেতর আবিষ্কার করছি ন্যাগেটিভ অনেক কিছু।
কিন্তু জফির ভাই, একথা তো ঠিক, যাদের সরকারপক্ষ অর্থাৎ আওয়ামীপন্থি হিসেবে ট্যাগিং করা হচ্ছে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে পুরো বিষয়টার ওপর এক ধরনের অরাজনৈতিক চরিত্র লেপটে রাখার; যে জন্য তারা শত উস্কানিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করে যাচ্ছে; তাদের দলীয় নেতৃত্বকে গালি দেওয়া হলো, পানির বোতল ছুড়ে মারা হলো; ভাবতে পারছেন কিছুই করলো না ওরা; অন্য সময় হলে হাড় গুড়ো করে ফেলতো; অনেকেই বিশ্বজিতের মতো প্রকাশ্য জনসমাগমের মধ্যে ন্যাশনাল লিডারদের মুহূর্তের ইশারায় আওয়ামী পাণ্ডাদের চাপাতির ক্লোজ শটে খবরের হেডলাইন হতাম। অথচ
আশ্চর্যরকম শীতল প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তারা সমস্ত অপমান হজম করে ফেলছে; এর কারণ কী বলে মনে করেন জফির ভাই?
স্রেফ আন্দোলনের স্বার্থে। কবি, আপনারা বেহুদা তর্ক করতাছেন; কিছু মনে লইয়েন না, বেহুদা আতলামি করতাছেন, স্রেফ আন্দোলনের স্বার্থে আন্দোলনের প্রতি সৎ থাকুন; এইটা কম কিসে? তারা যে সাচ্চা, তারা যে অন্তর দিয়া শাহবাগের সাথে লেপটা মাইরা আছে; তারা যে দলীয় সাইনবোর্ড নিয়া আসে নাই, সেই মহতি প্রচেষ্টার জয়গানে তারা নতুন কালচার চর্চা করতে গিয়া পক্ষান্তরে চমৎকার উদাহরণ বানাইবার লাগছে, এইটা কম কিসে কবি? ভাই প্লিজ, বাম ডাইন বইলা গালাগালি কইরেন না, এই আন্দোলনে আমরা সব্বাইরে চাই; রাজনৈতিক বিভেদ জারি রাইখা কিচ্ছু করন যাইবো না। তার আগে ঠিক করেন রাজনীতি করবেন? নাকি মানবতার এগেইনেস্টে যুদ্ধ করবেন?
ভালো কথা মানলাম, জনতার দাবির বিরুদ্ধে যাচ্ছি না, মানবতার বিরুদ্ধে যাচ্ছি না, কিন্তু এই আন্দোলনের সেনাপতি কে? পর্দার আড়ালে কি কোনো সেনাপতি লুকিয়ে কলকাঠি নাড়ছে?
কোনো সেনাপতি নাই; এইখানে আমরা সবাই সেনাপতি? আপোসহীন? ইউ হ্যাভ টু প্লে অ্যাকর্ডিং টু দেয়ার রুলস অর ফাক অফ।
বাট ইটস অ্যা ডিফিকালট প্রবলেম, শেষ পর্যন্ত কী হবে? নেতৃত্বহীন গণজাগরণ কি লক্ষ্যে যেতে পারবে? আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমাদের, অ্যা ফ্যাশন ডিজাইনার উইদাউট মোরাল ভ্যালুজ ক্যান ডু মাচ হার্ম ফর অ্যা ন্যাশন। অনেই বলছে অন্যান্য ইস্যু এনে আন্দোলনকে মূল টার্গেট থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। কাজেই ফাঁসি চাই; এটাই একমাত্র আন্দোলন।
কিন্তু তারপরও এই জাগরণ আমাদেরকে অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। সেই সব অনিবার্য অমীমাংসিত প্রশ্নের রয়েছে বেশ কিছু ডালপালা। সাম্রাজ্যবাদি, পূঁজিবাদি, করপোরেট লাইফ, শাসকশ্রেণি, তাদের সহযোগী গোষ্ঠী, সরকার অথবা সরকার বিরোধী, রাজনীতিক, সংস্কৃতিওয়ালা, ব্যবসাওয়ালা অথবা এনজিও ওয়ালারা প্রায় সবাই শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির তথা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে কাজ করছে।
এই পর্যবেক্ষণই বা কতটুকু যৌক্তিক? সমাজে যখন শত্রু মিত্রের ভেদ থাকে না, ভাল মন্দের বাছবিচার থাকে না, ক্ষমতা যখন হাতিয়ার হয়ে আঘাত করে তখন একমাত্র অস্ত্র অর্থশক্তি। অর্থশক্তি যখন পেশিশক্তি তখন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নাকচ করা হয়; অপমান করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে তাই করা হয়েছে; রাজনীতির নামে, সামরিকতন্ত্রের জবরদখলে, কথিত সুশিল সমাজের আবরণে।
এর কারণে মুক্তির প্রশ্নে এখন আমরা বিভ্রান্ত। দেবদারু গাছের মতো আকাশছোঁয়া উঁচু আকাঙ্ক্ষা আমাদের; অথচ দেবদারু গাছের মতোই ভঙ্গুর এবং দেবদারু গাছের এলোমেলো পাতার মতোই বিভ্রান্ত এবং নিম্নমুখি। তবে এ কথা ঠিক, যে তারুণ্য আজ জেগে উঠেছে মানুষের বুকে, তা অবশ্যই শুভবুদ্ধির পরিচয়; কিন্তু এই মহাশক্তিকে কীভাবে বৃহত্তর মুক্তির জন্য কাজে লাগানো সম্ভব? কীভাবে গুণগত রাজনীতিতে রূপান্তর করা যায়?
এই চেতনা কি এখন জরুরি? এর আগে কানসাট, ফুলবাড়ি, শনির আখড়ার জন-আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হয়েছে; সেই আন্দোলনের উত্তেজনা অশুভ অন্ধকারকে হটাতে পারে নাই; সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন শূন্য আকাশ বরাবর ফুলে উঠেছে মাত্র। ধনতন্ত্রের পরম মিত্র জামাত ও তার সমর্থক দল অথবা আরো আরো চিপাদল, রাস্তার দল, রাইতের দল, জাতীয়দল, মহাদল বিভিন্ন ব্লগে ফেসবুকে তাদের ওয়ালে কৃত্রিম ও বিকৃত ছবিসহ লিখছে, শাহবাগে নাকি নারী ধর্ষিত হয়েছে; ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে মারা গেছে কয়েকজন; গাজা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে অনেকে; জাফর ইকবাল স্যারের মেয়ে মদ খাচ্ছে এবং ছবিসহ আরও আরও অনেক প্রপাগান্ডা। আর ধর্মকেন্দ্রিক দলের মাওলানারা গণজাগরণকে নাযায়েয শয়তান ইবলিসের শেষ জামানার কারসাজি বইলা প্রচার চালাইয়া এর মধ্যে বুঝাইয়া দিলো সব রসুনের গিট্টু এক জায়গায়। অতি দুর্লভ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মাওলানারা কেন যে স্বাধীনতার বিপরীতে অবস্থান নিতে পছন্দ করে, বিষয়গুলার মীমাংসা হওয়া দরকার; আসল বাস্তবতা হাতাইয়া বাইর করন জরুরি।
আফরোজা শিলা এলো। হঠাৎ করে এসে যোগ দিল স্লোগানে। আমাদের কয়েকটা মোমবাতির পাশে তার কয়েকশ মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল নির্দ্বিধায়। সোলায়মান চাচা গলায় প্লাকার্ড বেঁধে ঘুরছেন সারাদিন, দিনের পর দিন। সোলায়মান চাচা টাঙ্গাইল থেকে এসেছেন; মুক্তিযোদ্ধা; পেশা রিক্সা চালনা। তাকে ক্যামেরার সামনে এক প্রকার জোড় করেই নিয়ে যাওয়া হলো; তিনি কেঁদে ফেললেন, বাবা সাহেবরা এই দিনটার জন্য অপেক্ষায় থাকছি, এইবার মুক্তির লড়াই; দেশ স্বাধীন করছি কাদের জন্যি? রাজাকারদের জন্যি, নাকি আমাদের মা ভাই বোন আর ছেলেমেয়ের জন্যি; স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হইবো না এইটা কেমন বিচার? সোলায়মান চাচা ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিটিস্টদের লাল গোলাপের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন সারাদিন। আমরাও তার এই জীবন্ত ধন্যবাদ গ্রহণ করলাম হাতে হাত মিলিয়ে; আর নিজেদের বুকের ভেতরে প্রশ্ন পুতে রাখলাম, কেন? কেন সোলায়মান চাচারা এসেছেন? কী লাভ তাদের? চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ। এই হাজার হাজার মানুষ বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, আমরা বীর বাঙালি। এ সবই কি আবেগ? অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, এর পর কী হবে?
যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি, সেটা আগে পুরণ হোক। সেটার ওপর নির্ভর করবে এর পর কী হবে। আসুন সকলে মিলে আবেগেই না হয় খানিকটা ভেসে যাই; আবেগেরও দরকার আছে। আবেগে দেশপ্রেম হয়; আবেগে ’৭১ হয়। অতঃপর আমরা স্বাধীন পতাকা পাই; স্বাধীন ভূগোল পাই; পাই আমাদের মানচিত্র। এরপর যদি দেশটাকে বদলানো যায়, তাতে ক্ষতি কী?
স্লোগানের পেছনে মতাদর্শ থাকে। মতাদর্শ ছাড়া স্লোগান হয় না; মতাদর্শবিহীন স্লোগান হলো প্রলাপ। শাহবাগে স্লোগান; সেখানে কি প্রলাপ? যেখানে ’৭১ আছে, সেখানে প্রলাপের জায়গা নেই। এই চেতনা ’৭১ থেকে জেগে ওঠা চেতনা; এই চেতনার একমাত্র আওয়ামীচেতনা দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত নয়। ‘জয়বাংলা’ আওয়ামীলিগের সম্পত্তি নয়। ’৭১ এর যোদ্ধাদের স্লোগান আজ ২০১৩-এর যোদ্ধাদের কণ্ঠে উঠে এসেছে। স্লোগান গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবার জেদ বাড়ায়। স্লোগান নিজেই এক জেদি ঘোড়া; শুভ্র সাদা ঘোড়া; সাদা ঘোড়ার স্রোত। এই স্রোতের সাথে মিশে যাচ্ছে আগাছা। বড় বৃক্ষের রস নিয়ে কিছু আগাছা প্রাণ পাচ্ছে; এমনই তো হয়; কিন্তু এতে কি মুক্তি নিকটবর্তি? নাকি আরও দূরে সরে যাচ্ছে? আমাদের সংশয় কী আমাদের আন্দোলনকে ইতিমধ্যেই বিভ্রান্ত করতে শুরু করেছে? আমাদের কি সাবধানি হতে হবে? সময়ের সাথে একাত্মতার তাল আর সময়ের গভীরতার তল বুঝে আমাদের স্লোগান দিতে হবে।
আন্দোলনের সাংস্কৃতিক মান বিকশিত করার জন্যই প্রয়োজন স্লোগান। এই স্লোগানের সূত্র ধরে প্রতিদিনের শাহবাগ বুলেটিনে লেখা হলো, ৫দিন ধরে শাহবাগে টানা অবস্থান করছেন শ্লোগানকন্যা লাকি আক্তার। এতটুকু ক্লান্তি নেই তার। সেই অগ্নিকন্যাকে সপরিবারে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এই হুমকি কি তাকে থামিয়ে দিতে পেরেছে? স্লোগানরত ছবি ভিডিও লিঙ্কে পর্নো সাইডে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং এই মুহূর্তে গণজাগরণ মঞ্চের লড়াই বহুমুখি। ধর্মপ্রাণ বাঙালি বিভ্রান্ত। মূল রাজনৈতিক দলগুলো বিভ্রান্ত। লাকি আক্তার কি বিভ্রান্ত? বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদ এর সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক লাকি আক্তার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর সাংগঠনিক সম্পাদক লাকি আক্তার কি বিভ্রান্ত?
বুলেটিন পাঠ শেষ না হতেই জফির সেতুর মোবাইলে কানাডা থেকে ভেসে আসে বন্ধু লিংকনের কণ্ঠস্বর। লিঙ্কনের কণ্ঠে আবেগ, বন্ধু আমার কথা রেকর্ড কর। তারপর মাইকে বিপ্লবী বন্ধুদের শুনাইয়া দে। সংগ্রামী বন্ধুরা, বিপ্লবী শুভেচ্ছা নিন। শাহবাগের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বন্ধুদের বলছি, যারা দেশমাতৃকার কলঙ্ক মোচনে রাত দিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বলছি পৃথিবীর অন্য প্রান্ত কানাডা থেকে। কানাডার সাস্কেচ্যুয়ান প্রভিন্সের রাজধানী ছোট্ট শহর রেজাইনায় থাকি আমি। গিয়েছিলাম পাশের শহরে, যেখানে আমার বন্ধুরা শাহবাগের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ইতিমধ্যে ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে মৌনমিছিল করেছে, মানববন্ধন করেছে। জনসল্পতা, আবহাওয়া, এখন প্রায়ই মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে তাপমাত্রা, সবকিছু মিলিয়ে আমাদের রাস্তায় নামতে একটু দেরিই হয়ে গেল, এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী বন্ধুগণ। তবে এটুকু বুঝতে পারি শুধুমাত্র আদর্শের জন্য, বিয়াল্লিশ বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভের জন্য আপনারা এরচে অনেক বেশি কিছু করতে পারেন। বিশ্বাস করি, দাবি আদায়ের আগে আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন না। এই সময়ে আমরা সামান্যতম হলেও সাহায্য করতে চাই আপনাদের। আপনাদের একশ ভাগের একভাগ লোক জড়ো করে কয়েক ঘণ্টার একটা সমাবেশ করতেই রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। যেহেতু এই আন্দোলন গণ আন্দোলন, কোনো নেতা বা দলের নেতৃত্ব ছাড়াই আপনারা সফল একটি আন্দোলন করছেন। সাহায্য পৌঁছানো একটা সমস্যা বটে! তবে, একটা সহজ সমাধান আমার হাতে আছে, সেটা হলো, আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো বন্ধু আছে, যারা শাহবাগের আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, যারা সৎ, যাদের আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বস্তজনদের সাহায্যটা একত্রিত করে, আন্দোলনকারী বন্ধুদের হাতে পৌঁছে দিতে পারি। বন্ধুকে বলতে পারি এই কজনের জন্য একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে, এই কটা ব্যানার করে দিতে, অথবা একটা ম্যাডিকেল টিম এর ব্যবস্থা করে দিতে, কিছু ফার্স্ট এইড বক্স এর ব্যবস্থা করে দিতে, মোমবাতি বা মশাল কিনে দিতে। যেহেতু আমরা ক্ষমতালোভী না, আমাদের দল অথবা কোনো নেতার প্রয়োজন নেই। আমরা মাঠে নেমেছি বন্ধুদের হাত ধরে, বন্ধুদের হাত ধরেই আমরা সফলতার সূর্য ছিনিয়ে আনবো।
তিনি জিন্স পড়েছেন, টিশার্ট পড়েছেন, কেডস পড়েছেন। ছিপছিপে শ্যামলা, ছেড়ে দেওয়া চুল, শেষভাগ লালচে ঢেউতোলা। তিনি আসলেন ভিড় ঠেলে সুকৌশলে যেন বা ভিড় বাঁচিয়ে অথবা ভিড়কে কোনো পাত্তা না দিয়ে এবং লক্ষ করার বিষয় হলো তিনি একা অর্থাৎ ভিড়ের কেউ তার পরিচিত নন; অথচ সকলেই ওনার বন্ধু। উনি, বয়স ত্রিশ অথবা চল্লিশ। হয়তো, চল্লিশ নয়। সেঁজুতি জানে না যে, তার বয়েসি মেয়ে রয়েছে মহিলার; বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। মহিলা আসলেন এবং পিঠে ঝুলানো ব্যাকপ্যাক থেকে একের পর এক মোমবাতি বের করছেন আর একের পর এক রাস্তায় সাজিয়ে যাচ্ছেন; একে একে আমরা সবাই তখন তার সাথে হাত মিলিয়েছি; তিনি স্মিত হাসছেন; তিনি চুল ছেড়ে দিয়ে যেন বা পাকা রাস্তাকে আদর করছেন। তিনি সাজিয়ে চলেছেন মোম; এবং তারপর মোমের কাজ শেষ হতেই যোগ দিলেন শ্লোগানে। তারপর আবারও শ্লোগান। তারপর মোমের আলোরা সবাই একসাথে জ্বলে উঠলে শ্লোগানরত তাকে অতিশক্তির পারদবাতিতুল্য আমরা আমাদেরকে মুগ্ধ হতে দেখি। আমার ঠোঁটে স্লোগান নেই। আমি তাকিয়ে আছি মহিলার মুখের দিকে। যেন বা পৌরাণিক পাথর আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি এবং এক সময় আমরা টিভি ক্যামেরার সামনে নিজেদেরকে সরব করে তোলার চেষ্টায় সচেতন হলে আমি ধীর পায়ে ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে নেই।
সেঁজুতি, মিরা, ঝুমুসহ তিনি, তিনি টিশার্টে সজ্জিত টানটান লম্বাটে একজন মহিলা যার কণ্ঠস্বর সবাইকে ছাপিয়ে উঠতে চাইলেও তা একই সুরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল এবং তারপরও তা শেষাবধি কেন যেন পৃথকই থেকে যাচ্ছিল। তিনি যেন বা একবারের জন্য স্লোগান থামিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন। হয়তো বা চমকে উঠলেন অথবা একটুও চমকালেন না এবং না চমকিয়ে স্লোগান থেকে মাত্র একবারের জন্য বিরতি নিলেন। তারপর স্লোগানের নেতৃত্ব তুলে নিলেন নিজের কণ্ঠে।
মন্তব্যসমূহ