জিগোলো
সুদেব ভট্টাচার্য
সুন্দর ঘুম থেকে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি। তারপর বাসি মুখে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো। এখন তো দিনের বেশির ভাগ সময়টাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেটে যায়। মুখে চোখে অবসাদের ছাপ দিনেক দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সাতাশেই ওকে এখন সাতচল্লিশ দেখায় যেন।
দু-হাতের তেলোয় চোখ মুখ কচলে নিয়ে আয়নার সামনে ঝুকে পড়ে বিশ্লেষণ করতে লাগল নিজেকে। যেন খুটিয়ে খুটিয়ে তাকে এখন অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সুন্দর আদতেই খুব সুন্দর। রঙ, হাইট, শরীর সবকিছুতেই একটা আলাদা অ্যাপিল। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে যে কেউ ওর দিকে অন্তত দুবার তাকাবে। অবশ্য ওর পরিচিত জগতে ওকে সুন্দর হিসেবে খুব কম লোকেই চেনে। স্যান্ডি -এটাই ওর পেশাদারী নাম।
রাতের পার্ক স্ট্রিট এই নামেই একডাকে চেনে ওকে।
আগের থেকে আরো একটু রোগা লাগছে কি? জিম করা পেশীবহুল শরীরটা আরো কাট কাট দেখাচ্ছে যেন। হ্যা, নিঃসন্দেহে ওজন কমেছে। এবার একটু ত্যারচা করে পিঠটা দেখার চেষ্টা করল সুন্দর। ফরসা, চওড়া পিঠে এখন অজস্র লাল আচিলের মত র্যাশে ছেয়ে গেছে। কালকের থেকে আজকে আরো কিছু বেশি। সুন্দর স্নানে ঢুকে পড়ল। তার শরীর কেপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। শাওয়ারটা চালিয়ে শরীরটা তাজা করতে থাকল। পেশীবহুল লোমহীন ফরসা শরীর পেয়ে জলের ফোটারাও মুগ্ধ। মুখ দিয়ে ফু দিয়ে জল বের করতে করতে সুন্দর ভাবছিল ওই নতুন ওঠা লাল আচিলগুলোর কথা। তার মনের ভয়টা আরো যেন জাকিয়ে বসছে। কিন্তু কি থেকে কী হল তা বোঝার উপায় নেই। খড়ের গাদায় সুচ খুজলে লাভ কিছু হবে না। আর জেনেই বা কী করবে সে? এত পুরুষ, এত নারী, এত বিছানা, শয়ে শয়ে মুখ ভেসে উঠছে। নিজের পুরুষাঙ্গর দিকে চাইল একবার। জল চুইয়ে পড়েছে ঋজু অঙ্গটি বেয়ে। নিজেরই গা কেমন শিউরে উঠল সুন্দরের। মাই গড! শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্রও একটা জীবন কে এভাবে চরম অন্ধকারে নিয়ে যেতে পারে?
তাড়াতাড়ি নাকে মুখে গুজে সরকারী হাস্পাতালে ছুটল সুন্দর। শুনেছে ওখানে এসবের বিনামুল্যে ওষুধ পাওয়া যায় নাকি। মৃত্যুটা একটু পিছিয়ে দেওয়ার ওষূধ। তাও ভাল, কিছুদিন পাওয়া যাবে হাতে। আজ আর জিম যাওয়া হবে না।আজকাল বেশি কসরত করতেও পারছে না, হাপিয়ে পড়ছে। ভাঙন যে নিঃশব্দে শুরু হয়ে গেছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই ওর মনে। এখন শুধু অপেক্ষা!
* * * *
প্রতি তিন মাস অন্তর বিধান ল্যাবরেটরীতে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করায় সুন্দর। এটাই প্রোটোকল আর কি। তবে এমাসের রিপোর্টটা যে তার পায়ের তলার মাটিই কেড়ে নিয়েছে। হ্যা, পসিটীভ।এইচ আই ভি পসিটিভ! রিপোর্ট হাতে পেয়ে কিছুক্ষন বসে ছিল সুন্দর। তারপর নিশ্চুপে বেড়িয়ে এসেছে ল্যাব থেকে । রাতে না খেয়ে, একলা বিছানায় শুয়ে সারারাত তার অসাবধানতার ভুল আর অদৃষ্টের দোষারোপ করে গেছে।
স্যান্ডির খোজে প্রতিদিন বহু পুরুষ আর উচু সোফিস্টীকেটেড বাড়ির মহিলা ক্লায়েণ্টরা আসে। এছাড়া কিছু বাধা-ধরা ক্লায়ন্ট তো আছেই। ওরা জানে পার্কস্ট্রিটের কোন নির্দিষ্ট জায়গায় গেলে পাওয়া যাবে স্যান্ডিকে। আগে একটা এজেন্সীর হয়ে কাজ করত বটে, কিন্তু মুনাফা বেশি পাওয়া যেত না। তাই একটু নাম, পরিচিতি বাড়ার পর থেকেই ফ্রীল্যান্সিং বেছে নিয়েছে সুন্দর। ভদ্র স্বভাব আর আকর্ষনীয় চেহারা ওকে খুব কম সময়েই পপুলার করে তুলেছে জিগোলো ওয়ার্ল্ডে। ওই এক কানে দুল, স্কিন টাইট পোশাক পড়া ফরসা ছেলেটাকেই ক্লায়েন্টদের পছন্দ। মাঝে মাঝে এক রাতেই তিন/ চারটে ক্লায়েন্ট-ও নিতে হয় ওকে। সুতরাং ওর ওয়ালেটে ভায়াগ্রা থেকে বিদেশী তেল এবং সুগন্ধী কন্ডোম - সবই রাখা থাকে। যখন যেটা দরকার! কিন্তু অনেক ক্লাইন্ট পছন্দ করে না প্রোটেকশন, তাই অগত্যা কন্ডমের প্যাকেট বের করেও রেখে দিতে হয়। ক্লায়েন্টকে খুশি করাই মোদ্দা কথা। এখানে টিকে থাকতে গেলে ক্লায়েন্টদের স্যাটিস্ফ্যাকশনটাই আসল। আর তারই খেসারত দিতে হচ্ছে আজ ওকে। কোথা থেকে একটা সামান্য ভাইরাস চালান হয়ে গেছে ওর শরীরে তা বুঝে ওঠার আগেই চলে এসেছে রক্তে ভয়ানক কীট!
* * * *
আজ তিনদিন হল সুন্দর বাড়িতে বসা। বেরোয়নি একদম। কিন্তু এভাবে চলবে কি করে? সব থেকে কষ্ট হচ্ছে যে এই অবসাদ সে কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছে না। কাকে বলবে? সুদুর গ্রামে বাবা মা আর বোন পড়ে রয়েছে। খুবই অভাবী সংসার। ওদের কথাই বারবার মনে আসছে। বাড়িতে জানে ছেলে শহরে চাকরী করে। এসব কথা জানলে ওরা... সুন্দর আতকে উঠলো ভেবেই! যতই হোক , বোনটার একটা বিয়ে-থা না হওয়া অব্দি অন্তত ওর গা ঢাকা দিয়ে থাকতেই হবে। নিজের কাছেও, সমাজের কাছে তো বটেই।
আজ রাতে সুন্দর বেরোবে ঠিক করল। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো হবে না। তিনটে মুখ হা করে বসে আছে ওর পাঠানো টাকার দিকে চেয়ে। সুতরাং অন্য কোনও রাস্তা নেই - চাচা আপন বাঁচা!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর কানের দুলটা গলিয়ে নিল। গায়ে সুগন্ধী স্প্রে দিয়ে, চুলের নকশা পালটে, হাল্কা কাজল পড়ে খুব কম সময়েই হয়ে গেল স্যান্ডি। অদ্ভুত রূপান্তর। ব্যাগে গুছিয়ে নিল কন্ডোম, তেল আরো সব সামগ্রী। অবশ্য এখন ওগুলো ফর শো! অন্তত ওর জন্য তো তাই! তবে শরীর ভাঙছে। তাই আজ থেকে চার্জ ডাবল।
রাতের ঝলমলে পার্কস্ট্রীট। মোড় থেকে ডান দিকে আধো অন্ধকারে, হাতে লাল রুমাল নিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে মার্সিডিসটা এগিয়ে গেল। গাড়ির নাম্বার স্যান্ডির চেনা। বিজনেস টাইকুন - মিসেস বাগানি। সামনে আসতেই গাড়ির গতি কমে এল, নিশব্দে দরজাও খুলে গেল। একগাল হাসি হেসে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসরঘরে ঢুকে পড়ল স্যান্ডি। ফাকা নির্জন পথে ওদের মার্সিডিস হু হু করে ছুটে চলল এস্প্ল্যানেডের দিকে।
মন্তব্যসমূহ