গুচ্ছ কবিতা ।। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

গুচ্ছ কবিতা 

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়



তেমন আমি নই আবাসিক

তাহলে কেমন বারান্দাহীন ঘর?
তাহলে কেমন দরজায় লেখা নাম?
ঠিকানার মানে স্বজনের কাছাকাছি
সাফল্য দিয়ে লিখে রাখা সংসার।

আমার তাহলে কী রকম বেঁচে থাকা?
ঝড়ের দাপটে খুলে গেছে ডানাগুলো
সুগন্ধ আর লণ্ঠন নিভে যেতে
ঘর জুড়ে কত অভিমান চমকালো!

দেখতে দেখতে লুকোনোর কোণ খুঁজি,
আমিও যেমন! এই ঘর বাড়ি ছেড়ে
কেমন দেখাবে আকাশের নীচে ছুটে
একা, এক দেশে ফিরে আসা উড়ে উড়ে?

তাহলে কেমন ডানা-হীন উড়ে চলা? 
তাহলে কেমন অহংকারের ঝড়?
ঠিকানার কাছে, লুকোনোর কাছে এসে
রয়েছে কেমন বারান্দা-হীন ঘর?



তেমন আমি নই আবাসিক  

এসেছিলাম ফেরার কথা দিয়ে
ব্যাথার দেশে, এবং সাক্ষাতে
দুরত্ব-হীন অসুস্থ এক মেঘ
দাঁড়িয়ে ছিল আমায় সামলাতে...

এবং আমি উঠেই টলোমলো
রেখেছি হাত, হাতের  রঙ নীল!
অসুখ সেজে, অনাত্মীয় সেজে
টের পেয়েছি, তুমিও সঙ্গিন।

ফিরেছিলাম। সাক্ষী থেকো, নদী।
তুমিও, তার স্রোতের নীচে প্রিয়...
অনভ্যাসের কাঁপতে থাকা ঠোঁটে
ব্যাথায় সেই বিদায় লিখে দিও।

তেমন আমি নই আবাসিক

বরং নিজেকে পড়ি।
গোপনের খোলস ছাড়িয়ে-
অন্ধকার পার হয়ে যতদূর
      ভেবেছি আপন-
ইশারা আঙ্গুল চেনে, আমাকেও...
                  টেনে নিয়ে যায়।

দেখায় মিথ্যের দেশ। লণ্ডভণ্ড, আমি। শুধু আমি! 
আর এক রাত ভর্তি তাঁরা...
নিজেকে দেখার দেশে
খুলেছি নিজেকে আজ, ইতস্তত খুলে খুলে দেখি...

প্রত্যেক গোপন ঠোঁটে
      উদাসীন হলুদ পাহারা!


প্রার্থনা পর্বের লেখা 

দেখেছি, সুরের কাছে-
      গন্ধ তার কী ভীষণ ডাকে...
বলিনি, কারন আমি শুনে যেতে চেয়েছি কেবল।
বোনের দুধারে যত পার হয়ে যাওয়া ফিস-ফিস।
ভাবি, ঠিক পেয়ে যাব, যে মৃত্যুর ঝিঁঝিঁ পোকা, তাকে...

শুনেছি।  বন্ধুরা যা যা
বলে যাচ্ছে আমার বিষয়ে।
ভেবেছি, বলুক। শুনি।
            এই তো এটুকু, তারপর...
আর এই নীরবতা
জানি, আমি তোর কাছে ঋণী...
এ নিশীথ ঈশ্বরের। চুপ থাকা শিখে নিতে পেরে।
এ সুর গন্ধের গায়ে পথে পথে শুধু ডেকে যাবে-
গাছে গাছে ইশারায়। শুধু কাউকে বোঝাতে পারিনি...



তেমন আমি নই আবাসিক 

 বাড়িটা নীরব থাকে, দুপুর গলির মতো, একা।
অন্ধকার ঘরে ঘরে। অভাবের আমিই সীমানা।
তাড়িয়ে বেড়াই রোদ, শালিখের হইচই, আলো...
পাহারা সজাগ থাকে, জেগে থাকে বাড়িটির ডানা।

কেবল মন্ত্রের মতো ঘুম এলে কাঁদি সারারাত।
সময় কমেছে দেখি, জেগে-জেগে কাটানো উচিৎ...
কখন যে ডেকে ওঠে শ্মশানের কলরব, দূরে...
আমার স্নায়ুর ডাকে, আমার মৃত্যুর ডাকে উঠি।

বলি, প্রভু, ক্ষমা করো, একে আমি বাঁচাতে পারিনি।
বলি, কেন প্রতিরাতে আলো-হীন নিভে যেতে রাজি।  
অন্ধকার বড় প্রিয়, পাহারায় প্রতি ঘরে ঘরে
বাড়ির কুকুর আমি, এ বাড়ি ঘুমোলে একা জাগি।



আমার ২১ লেখায়

 বলেছি, ভাষাটি চিনি। সে তো শুধু বলার কথাই!
পড়েছি দু’চার শব্দ, তবু মেঘ মাথার ভিতরে...
আবার খুলেছি বই, যে ভাষায় কথা বলি, তার
অলি-গলি চিনে নেব। চিনে তো নেব। কিন্তু কী করে?

আমার আবেগ শেষ, নিচু স্বর হাস্যকর বলে
থেকেছি নিশ্চুপ আর অচেনা যে বন্ধুদের কাছে
ভোরের ঠিকানা আছে জেনে মন ভালো হয়ে যেতে
লেখার উৎসাহ দেখি, রয়ে গেছে আনাচে কানাচে...

আবার লেখার কথা। একুশের নাম ভেসে এল,
ভাবি, এ তো চেনা ভাষা, এ তো খুব নিজের, নিভৃতে
আপন করার মতো... অতএব অচেনার দেশে-
যেই লিখেছি বাংলায়, রোদ লাগছে শরীরের শীতে!




লেখা 

পায়ে পায়ে এতদূর এসে
আমার যে বেড়েছে আঘাত
চলাচল জানে তার সীমা
লিখে রাখা পুরোনো আকার

তাকে আর কী বা দিতে পারো?
চেনা কোনও গান আছে সুরে?
মরে যেতে চায় যদি আজ
দাঁড়াবে কি ক্ষমার ওপারে?

পায়ে পায়ে বয়সের কাছে
আমি যদি, ধরো, মরে যাই
মেজাজের একতারা ছিঁড়ে
ছেলেবেলা বেসুরে বাজেই...

কীরকম হবে সেই গান?
গানে গানে পুরোনো সময়
তাল নেই, না-বাজানো সুরে
মরে গেছে মরার উপায়...
৪/১/১৯





মন্তব্যসমূহ