পূবালি বাতাস
পিন্টু রহমান
চিলেকোঠা, দিগন্তের সীমারেখা, নারিকেলের চিরলপাতা;এমনকি
লতাগুল্মের পাতায়-পাতায় আলো থাকলেও তাদের
চোখে- মুখে তরল আঁধার ! মানুষগুলো খুবই আশ্চর্য
হয়। আঁধারের
সাথে আঁতাত
করার শর্তে অরাজি
না থাকলেও
কখনো ভাবতে পারেনি, দিনের আলোতেই আঁধারের
সাথে মোলাকাত হবে! খুবই অসহায়
মনে হয়। চোখের কোন বেয়ে গলগল করে আঁধার
নামতে শুরু করে। তথাপি
কার্টুনে ঢোকার পূর্বে আরেকবার বুকভরে শ্বাস
নেয়-
আহ, এ যেন লাশের
কফিন !
নিজেদের
ঠিক মানুষ নয়, এক্সপোর্ট কোয়ালিটি র কোন পণ্য বলে মনে হয়। অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে পৃথিবীর বিভিন্ন
বন্দরে-বন্দরে হয়তো ফেরি করে বেড়াবে; হয়তো
জন্মের ঋণ শোধ করবে!
গোপনীয়তার এক-একটি চৌকাঠ
মাড়িয়ে ট্রাক-লরী হয়ে সোজা জাহাজের অভ্যন্তরে পৌছে যায়। কয়েক দফা হাত বদলের পর অবশেষে বিশালাকায় একটি
চৌবাচ্চার মধ্যে স্থায়ী
হয়। চৌবাচ্চাই বটে! চারপাশে
অন্ধকারের রাজত্ব; ঘুটঘুটে
অন্ধকার। নিঃশ্বাস
চলাচলের জন্য যতটুকুন আলো-বাতাসের প্রয়োজন
ঠিক ততোটুকই- একটু বেশিও না কমও না। চুক্তিপত্রে কথাবার্তা
কিংবা শব্দ না করা বিষয়ে
কঠোর বিধিনিষেধ
আছে। তাই দৃষ্টির প্রখরতায় একে অন্যের
পানে তাকায়; ভয়ার্ত ভাবের আদানপ্রদান
হয়। কমবেশি
সকলেই বিমর্ষ। চোখে-মুখে
বর্ষার থমথমে জল। অলক্ষে কখনো-বা বৃন্তচ্যুত
শিউলীর মতো গড়িয়ে পড়ে। বাবা-মা'র
কথা মনে হয়; মনে পড়ে
তাদের শেষ-বিদায়ের আকুলি-বিকুলি।
দীর্ঘ অপেক্ষায়
যারা বিচলিত হতো না, কটু কথার বিষবাষ্প
ছড়াতো, বিদায়-পর্বে তারাই মুষড়ে পড়েছিল।
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিদায় দিয়েছে। নিজে কান্না থামাতে না পারলেও পুত্রকে কান্না থামানোর মন্ত্র শিখিয়েছে, কান্দিস নি বাপ, এরাম করি কাঁনতি হয় না ; তাছাড়া
কষ্ট না কল্লি কি কেষ্ট
মেলে!
তারপরেও কেঁদেছে।
নান্দনিক কান্নার
বিধিবিধান ভুলে ভেবড়িয়ে-ছেবড়িয়ে কেঁদেছে।
জাহাজের অভ্যন্তরেও কেষ্ট
প্রত্যাশী মানুষগুলো
নিঃশব্দে কাঁদে। তবুও শান্তনা- হয়তো অচিরেই ইটালীর কোনো বন্দরে পৌছে যাবে; আল্লাহ মুখ তুলে তাকালে নিশ্চয় ভাগ্য খুলবে। সংসারের
অচল চাকা সচল
হবে;
দু'মুঠো ভাতের স্থায়ী
বন্দোবস্ত হবে; হতাশার পূঞ্জিভূত দীর্ঘশ্বাস আঁধারে হারাবে! কেউ একজন
হা-হুতাশ করে, রক্ষা করো খুদা, জীবনের
এ কোন পরিক্ষায় ফেললা!
মানিক আহত বাঘের ভঙ্গিতে
ফুঁস-ফাস গর্জন তোলে, থ্যুঁ; কপালে লাত্থি মারি, এইডা
কোনো জীবন হইলো নাকি?
দু'পায়ের ভাজে মুখ গুজে অন্য আরেকজন
আফসোস করে, ঠিক
কইছোরে ভাই, জমি-জিরাত বেইচ্যা ক্যান যে মরতে আইলাম ! আগে জানলে
কিছুতেই আইতাম না; মাইনষের দুয়ারে কামলা দিতাম।
জমি হারানোর ক্ষত কিছুতেই
মনের আড়াল হতে পারে না; সারাক্ষণ
খচখচানি অনুভূত হয়। আহা, কি সোনার-চাঁন জমি! ঘোর অন্ধকারের
মধ্যে ধানের শীষগুলো যেনো
পিট-পিট
করে তাকায় ! তখন এক ধরনের ভালোলাগা
তিরতির করে আড়মোড়া
ভাঙে।
উপরে নীল আকাশ আর মাঠজুড়ে বিস্তির্ন ফসলের ঢেউ; ঐ ফসল
যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে! মানিক উতলা হয়ে উঠতো, কিছুতেই ঘরে মন বসতো না; কারনে-অকারনে ক্ষেতের পাশে ছুঁটে যেতো, আপন
সন্তানের মতো যতœআত্তি করতো- অথচ ঐ জমিটা আর কোনদিন তাকে কাছে ডাকবে না; পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও না। কেনোনা, সে এখন মাতবরের ঘরে বন্দি রাজকন্যা। মানিক একটু-একটু করে চুপসে যায়। পাশ থেকে কেউ একজন গুতো মেরে জানতে চায়, এরাম করি কি ভাইবচু দোস্ত, জমির শোগে মরবা নাকি?
আতিয়ারের কণ্ঠস্বর।
তাগড়া জোয়ান সে।
গায়ের রং তামাটেপ্রায়।
চাকরি খুঁজে-খুঁজে হয়রান।
নিরুপায় হয়ে তাই ইটালীর অভিমুখে।
মানিককে শান্তনা যোগাতে পুনরায় বলে, ক্যা, আমরা কি জমি বেচিনি- ভিটিমাটি সুদ্দু বেচিছ! ট্যাকা যেকুন পুজলু না তকুন ভিটি না বেচি কি উপায় ছিলু!
পানের বরজ, সোনার গহনা, মাঠান জমি- কোন কিছুতেই বাবার আপত্তি থাকতো না, যদি লেখাপড়া শেষে ছেলের একটা চাকরি জুটতো!
আতিয়ার নিজেও
কি কম চেষ্টা করেছে! চাকরির পরীক্ষা দিতে-দিতে সে ত্যাক্ত-বিরক্ত।
কেউ-কেউ চিন্তা করতে নিষেধ করে, এসব আলোচনা বাহুল্য বলে মনে হয়। কিন্তু চাইলেই কি চিন্তারা পিছু ছাড়ে; না, ছাড়ে না। চর্তুমুখী ভাবনা মাথার মধ্যে জট পাকায়। হতাশার পাশাপাশি দু'একজনের মুখে শান্তনার বানীও উচ্চারিত হয়, তয় দেইখি নিয়ু, অম্মা জমি আবার একদিন কিনুম। তারপর আর আমগোরে অভাব থাকবি না; সত্যি-সত্যি কপাল ফিরবো।
বস্তুত এমন একটি স্বপ্নের সাথেই ওদের জুয়া খেলা। বাস্তবায়ন হওয়া অসম্ভব কিছু না; চেনাজানা কতোজন এমনি ভাবেই ভাগ্য ফিরিয়েছে! অতএব ওরাও পারবে।
নিরোদের মুখে দরদভরা সুর। গুনগুন করে গান আওড়ায়, ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া......
তক্তার ওপর ঢুঁ মেরে বন্ধু ফারুকও মাঝে-মাঝে তাল দেয়। মাথা ঝাঁকায়। গানের খ-াংশ আনমনে জাবর কাটে! মাঝে-মাঝে বিবমিষা এসে ভর করে। কোনকিছু ভালো লাগে না তখন। তথাপি একজন আরেকজনকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, চুপ শালা চুপ; গীত গাওনের লগে-লগে কাঁন্তিছো- তাই না? কাঁনবা তো হেনে আইছো ক্যান!
নিরোদ প্রতিউত্তর করে না। তার মন পড়ে আছে দুরে; অনেকদূর- অনিমা যেখানে ঠাঁই
দাঁড়িয়ে থাকতো। গান বিষয়ে রতন একটি টেকসই যুক্তি খাঁড়া করে, আরে ভাই হেইডাও তো একটা জগত, নাকি? তয় একটু গান-বাজনা না হইলি কি চলে!
আরে বাপ, গান-বাজনা রাখ; বিড়ি থাকলে ধরা, দুইটা টান দি- সুখটান।
চলার পথে জাহাজ মাঝে-মধ্যে কেঁপে ওঠে। তখন বুঝতে পারে, সমুদ্রের বুক চিরে ওরা কলম্বাসের দেশে
এগিয়ে চলেছে; ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক নাম না জানা বন্দর। জাহাজের ছাদের উপর দাঁড়ালে হয়তো দেখা যাবে, দৃষ্টির সীমানায় শুধু জল আর জল। তার ওপারে কত না নয়নাভিরাম দৃশ্য! আতিয়ারের ইচ্ছে
হয় জাহাজের ডেকের ওপর একটু দাঁড়াতে।
ইস, কি মজা হবে তখন!
পূবালী বাতাসে তার মাথার চুলগুলোয় ঝড় উঠবে! দুরত্বের বিশালতা একটু-একটু করে কমতে থাকবে! দৃশ্যমান হয়ে উঠবে নেপলসের আলো ঝলমলে পোতাশ্রয় !
কিন্তু ওপরে উঠার পথ বন্ধ; তাহলে গনেশ উল্টিয়ে যাবে যে!
খোঁজখবর নিতে একজন লোক আসে। রোগা-পাতলা গড়ন; টিংটিঙে। সম্ভবত সারেং। হাসিহািস মুখ করে জিঞ্চেস করে, তা কেমন লাগছে ভাইসাব?
জ্বে, ভালো ছ্যার। তয় মশা ইট্টু বেশি।
সারেং লোকটি রসিকতা করে, আরে মিয়া, কদিন বাদে রাজা-বাদশার মতো চলবা; নাইটক্লাবে গিয়া ফূর্তি করবা; সুন্দরী মাইয়াগো লগে কোমর দুলাইয়া নাচবা- মাগার এখন একটু মশার কামড় খাইবা না!
সারেঙের উপস্থিতিতেই রাজ্জাক আলী ফিসফিস করে মনের গোমর ভাঙে, শালা, ইর জন্নিই তো সপ কষ্ট হজম কচ্চি!
রাজ্জাকের চোখে টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করে, কি মিয়া, কিছু বললা নাকি?
রাজ্জাক
কৌশলে প্রসঙ্গ বদলায়, নারে ভাই, কি আর বুলবো; বুলচি, আমাগের যাতি আর কদ্দিন লাগতি পারে?
অপেক্ষার সময়গুলো অনেকবেশি লম্বা মনে হয়। মাঝে-মাঝে ইচ্ছ হয়, পাখির ডানায় ভর করে গন্তব্যে পৌছে যেতে! আর একবার যদি পৌছাতে পারে, তাহলে আবার ঠেকায় কে! গা'এ পিঠে খেটে পয়সা জমাবে। একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে সাধ্যের সীমারেখায় পৌছে যাবে! ফেরার দিন আর জাহাজ নয়, মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিতে উড়োজাহাজে চেপে বসবে।
সারেং চলে যাওয়ার পর নিজেদের মধ্যে চুপিসারে আলাপচারিতা হয়। দুরের স্বপ্নগুলো খানিকটা নিকটবর্তী মনে হয়। তাছাড়া ব্যাটা মন্দ বলেনি; এভাবেই তো জীবনের চাকা ঘুরাতে হয়! কতিপয় হিসেবও বদলে যাবে- ইটালি পৌছানোর পর জেলাভিত্তিক হিসেব আর থাকবে না; সব বাংলাদেশী এক ও অভিন্ন। কাজের ফাকে পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলে জড়িয়ে ধরবে। শপিংমলের অসংখ্য জনতার ভীড়ে একজন বাঙালীর জন্য অপেক্ষা করবে। যে দেশে জন্ম নেওয়ার জন্য আজ ক্ষুব্ধ, হয়তো তার জন্যই বুকের মধ্যে একদিন হাহাকার উঠবে।
দিন যায়, রাত আসে।
রাত আসে, দিন যায়।
যদিও দিনরাত্রি এখােন প্রার্থক্যহীন, তবুও বোধের প্রখরতায় খানিকটা বুঝতে পারে। ঘুম-জড়ানো চোখ রাতের নির্জনতা মনে করিয়ে দেয়। কখনো বানভাসি মানুষের মতো জলমগ্নতা মনে হয়। গল্পে-গল্পে পেরিয়ে যায় আরো কিছু পথ, কিছু পাথরসময়।
উতলা কন্ঠে একজন জানতে চায়, ভাইজান, মিছ গুলবাহার আজ আইবো নািক?
আতিয়ার ধমকায়, এই শালা, মিচ না মিচেচ তা কেরাম করি বুজলি; একজামিন করিচিস নাকি?
না না তা করি নাই, তয় শরীলের আঁটসাট বান্দন দেখলি মনে হয়...
মুখ গুজে বসে থাকা রাজশাহীর নিরব ছেলেটি সরব হয়, কিতা বুজসো গো মামা!
বোঝাবুঝির পর্ব শেষ না হতেই দৃশ্যপটে গুলবাহারের আগমন। মৃদু আলোয় বেশ বোঝা যায়, চোখে তার শিকারীর ইঙ্গিত। শরীর বেয়ে উড়ে আসে পারফিউমের উগ্র ঘ্রাণ।
গুলবাহারই প্রথম কথা বলে, কিরে, এতো হাসতাছোস ক্যান; পালে হাওয়া লাগছে নি! ছবুর কর বাজান সবুর কর; মক্কা অহনো বহুত দুর।
সাগরজলে এই গুলবাহারই তাদের একমাত্র
আপনজন, দেখভাল করার সব দায়িত্ব তার। এজেন্সির পক্ষ হতে এমনটাই বলা আছে। রাজ্জাকের মধ্যে অকারন অস্থিরতা। গুলবাহারের আগমনে অস্থিরতার মাত্রা আরো খানিকটা উর্ধ্বমুখী হয়। চুলের মধ্যে আনমনে আঙুল চালায়। খকখক শব্দ করে কাশে। দু'একবার গুলবাহারের চোখে চোখ পড়ে।
কিরে, কিছু কইবার চাস?
রাজ্জাক আলী মাথা নাড়ায়, হ মেডাম, বিড়ি-ছিকারেট কিচ্চু নি; মনের মদ্দি কেরাম আঁকুপাঁকু
কচ্চে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলবাহার তার গাল বরবর থাপ্পড় লাগায়। জামার কলার চেপে ধরে পুনরায় থাপ্পড় মারে। তারপর হাঁফাতে-হাঁফাতে বলে, খানকির পোলার ছাহোছ কত, বিড়ি খাইবার চায়! তর মুখের
মধ্যে গু পুইরা দিমুগা।
অন্য কারো মধ্যে টু'শব্দ নেই। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো স্তম্ভিত।
রাগে-ক্ষোভে গুলবাহার নিজেও কম্পনরত। উত্তেজনার রেশ খানিকটা স্তিমিত হলে নতুন করে আবার গালমন্দ করে, মাংগের পূত; থাপড়াইয়া দাঁত ফেলায়া দিমু, লাশ বানামু! তগো লাইগ্যা জীবন বাজি রাখছি, ধরা পড়লে ফাইস্যা যামুগা।
গুলবাহার চলে গেলেও অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারেনা। রাজ্জাকের চোখে নিরব কান্না। আতিয়ার ওর পাশে গিয়ে বসে; আলতো করে পিঠে হাত রাখে; শান্তনা দেয়, কান্দিসনি ভাই, জীবন আসলে এরামই; ছোট
না হলি নাকি বড় হাওয়া যায় না!
রাজ্জাক তার চোখের জল কিছুতেই সংবরণ করতে পারে না; ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বিলাপ করে, এরাম জীবন আমি চাইনি, তুরা আমাক বাড়ি নি চল; আমি বাড়ি যাবো, মরতি হয় দ্যাশেই মোরবু।
আর কেউ না জানলেও আতিয়ার জানে, রাজ্জাকের বিদেশ যেতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকে কেউ ভালো চোখে দেখেনি। কারো কাছে বাহুল্য বলে মনে হয়েছে।
মেয়ে, বউ আর আলমডাঙা বাজারেরর ঐ গুড়ের আড়ত নিয়ে সে কি এমন কষ্টে ছিল! বরং অনেকের চেয়ে ভালো ছিল। মফঃস্বল শহরের এমন রমরমা ব্যবসা কেউই হাতছাড়া করতে চাইবে না। বাবা পলান ম-ল নিজেও ছেলেকে অনেকবার বুঝিয়েছে, বাপরে যারা যাচ্চে যাক, তোর আর বিদেশ যাওয়ার দরকার নি। আজুড়ি ওকেন যায়ি কি করবি? একেনেই কি তোর আয়-ইনকাম কম হচ্চে? তাছাড়া মেয়িডার ভাবনাউ তো ভাবতি হবে! কদিন পরেই তো উক স্কুলি ভত্তি কত্তি হবেনে!
কোন পিছুটান রাজ্জাককে টলাতে পারে না। সূদুরের হাতছানির কাছে জীবনের আর সবকিছু তুচ্ছ বলে মনে হয়। বাবাকে আস্বস্থ করতে জানায়, চিন্তা কোরু না আব্বা, কডা বছর থাকি আসলি আমাগের জীবনডা বদলি যাবে; তুমি খালি পা'র পোরে পা তুলি বসি-বসি খাবা।
বদলে যাওয়া জীবনের কিছু উদাহরনও রাজ্জাক জেনে নিয়েছ। বিদেশ প্রসঙ্গ উঠলে রাজ্জাক ঐ নামগুলো পূণপূণ আওড়ায়। পলান ম-ল তথাপি নিশ্চন্ত হতে পারে না। ছেলের ভাবনা ভেবেই তো সে গ্রাম্য জীবনের টান ভুলে শহরমুখী হয়েছে! মেকুরপুরের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে আলমডাঙার পাকা-রাস্তায় পা রেখেছে। শুধু আলমডাঙা কেনো, ব্যবসার কারনে মাঝে-মধ্যেই তাকে খুলনা যেতে হয়। এই অবস্থায় ছেলের অনুপস্থিতিতে ব্যবসা ধরে রাখা কষ্টকর।
রাজ্জাক চলে গেল!
সবার চাহনি উপেক্ষা করে ছেলেটি চলে গেল!
পৃথিবীর সব টান ভুলে আটলান্টিকের অতল জলে হারিয়ে গেল!
দুজন সারেং ধরাধরি করে লাশটা জাহাজ থেকে ফেলে দিল! অথচ মৃত্যুর পূর্বেও অনুনয় করে সঙ্গীদের বলেছিল, ভাই, ভাইরে, আমি বোদহয় বাঁচপোনানে; আমার মেয়িডাক তুরা দেকিস, তার জন্যি বড় একটা ফুতুল কিনি পাটাবি- আমার মেয়িডার খুপ ফুতুলির হাউস। আর যেদি পারিস লাশটা আমার মা'র কাচে পাটি দিস; মা বড় হতভাগীরে!
রাজ্জাক আলীর মা সত্যি-সত্যি হতভাগী। একটা পুত্রসন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে কত কান্নাকাটি করেছে, পীর-মুরশীদের মাজারে সিন্নি মানোত করেছে! অথচ সেই ছেলে তার আগেই না ফেরার দেশে পৌছে যাবে!
রাজ্জাক সত্যি-সত্যি চলে গেল!
আতিয়ার হঠাৎ-হঠাৎ আঁতকে ওঠে। নিজের চোখ দুটোকেও তার অবিশ্বাস! মৃত্যুটাকে চরম ধাধা বলে মনে হয়। প্রচ্ছন্ন ভাবনায় আচ্ছন্ন হলেও ঐ মৃত্যুর দায় তার কাঁধে এসে ভর করে। সেদিন যদি গুলবাহার চড়-থাপ্পড় না মারতো তাহলে সে হয়তো মরতো না। বিক্ষুব্ধ মূহুর্তে সব রাগ গিয়ে জমা হয় গুলবাহারের উপর।
রাজ্জাকের মৃত্যুতে আঁধারের যাত্রা যেনো আরো প্রকট হয়! শোকের আবহ কিছুতেই ম্লান হয় না। ভয়ার্ত চোখে কেবলই অপেক্ষার লম্বা প্রহর! মাঝে-মাঝে হাফিয়ে ওঠে। জীবনের সাথে আর কত জুয়া খেলবে! কতদিনই বা চৌবাচ্চার অন্ধকারে! অন্য সবার মতো আতিয়ারের মধ্যেও পরিবর্তনের ঢেউ। বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে। রাজ্জাকের স্মৃতি মনের মধ্যে ওঠানামা করে। কষ্মিনকালেও কি ভাবতে পেরেছিল, আলোর মুখোমুখি হওয়ার আগেই সতেজ একটি ফুল ঝরে যাবে!
সময়ের টানাপোড়নে রাজ্জাকের স্মৃতি
হয়তো খানিকটা ঝাঁপসা হবে; হয়তো কাজের চাপে মনটা এলোমেলো হবে, আরো আরো অন্ধকার এসে গ্রাস করবে- কিন্তু আজীবনের জন্য ঐ মুখটা কি আড়াল করতে পারবে! আতিয়ার দাঁতের নিচে ঠোঁট চেপে ধরে কাঁধ ঝাঁকায়।
পলান
মন্ডলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি জবাব দেবে সে!
কখনো যদি রাজ্জাকের মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ায়!
যদি বাবার কথা জানতে চায়!
প্রচলিত সমাজব্যবস্থা যদি তাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়; যদি দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে!
শেষের ভাবনাটি মোটেও অমুলক নয়। এ রকম অনেক নজির তার জানা আছে। তাছাড়া দলের মধ্যে
আর কেউ পারিবারিকভাবে সংশ্লিষ্ট নয়।
কখনো কখনো
ভাবনাগুলো অর্থহীন মনে হয়। মনে হয়, এসব তার অসুস্থ মানসিকতার ফল! তাছাড়া আলোহীন ঘরে আর কতদিনই বা সুস্থ থাকা যায়! কমবেশি সবার মাঝেই অস্থরতা; মুক্ত বাতাসের স্বাদ নেওয়ার উতগ্র বাসনা।
সারেঙের চোখে ভোরের পূর্বাভাস ; স্বপ্ন পূরণের সম্ভানা। হাসি-হাসি মুখ করে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ভাইজান, আপনারা এখন মুক্ত;জলদি নামেন, মেহমান
দাঁড়িয়ে আছে!
মানুষগুলোর বুক থেকে হঠাৎই যেনো জগদ্দল পাথর নেমে যায়! খানিকটা নড়েচড়ে বসে। শূন্যে দু'হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে। ঠিক এমন একটা সংবাদের জন্যই ওরা অপেক্ষা করছিল।
ফলে ঝিমিয়ে-পড়া উৎফুল্লতা নিমেষেই রক্তে নাচন ধরায়।
আবার চিন্তা কিসের!
আজ আর কোনো লুকোচুরি নয়, উৎফুল্ল চিত্তে সারিবদ্ধভাবে নেমে আসে; সূর্যের আলোয় বুক ভরে শ্বাস নেয়। আহা কতদিন আলোর দেখা নেই! আলোহীন জীবনটা বড্ড তেঁতো ও বিস্বাদ মনে হতো। তাই অচেনা দ্বীপের আলো গায়ে মুখে মেখে উচ্ছ্বসিত হয়। কিন্তু ঐ উচ্ছ্বাস বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না, মেহমানের চোখে চোখ পড়তেই আঁতকে ওঠে! পেটের মধ্যে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়! ফ্যাঁকাশে দৃষ্টিতে নিজেদর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। ওদের হিসেব ভুল হয়েছে।
বিশেষ পোশাকের মানুষগুলো কোন মেহমান নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য!
নিয়তি!
আহা, কি নিষ্ঠুর নিয়তি!
আলো-আঁধারীর লুকোচুরি খেলা যেন-বা!
যে আঁধার চোখে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছইল, ক্ষণিক বিরতিতে ঐ আঁধার পুনরায় তাদের গ্রাস করে। অসহায় ভঙ্গিতে আরেকবার দরিয়ার পানে তাকায় ; ঝাঁপসা দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে, সাপের মতো ফনা তুলে প্রকাণ্ড একটা ঢেউ ছুঁটে আসছে- সাঁ, সাঁ, সাঁ...
মন্তব্যসমূহ