।। এন্টিফিকশন ।। পঞ্চম কিস্তি ।। শিমুল মাহমুদ ।।


১. জীবন অর্থ ভারবাহি পশু

জীবনের কোনো গল্প হয় না। জীবনকে গল্পের দিকে হাঁটতে হয় না। জীবন নিজেই গল্প টেনে নিয়ে আসে তার দিকে। জীবন নিজেই গল্প। জীবন অর্থ শরীর; সেই শরীরে যখন নিঃসঙ্গতা প্রবেশ করে তখন শরীরে আত্মা ভর করে; তার আগ পর্যন্ত শরীর আত্মাবিহীন। আর আমরা তো জানি বৃক্ষেরও আত্মা আছে; আত্মা আছে আকাশ অথবা নদী অথবা এক টুকরো মৃত ঘাস তারও তো আত্মা আছে বলেই আমি আমার আত্মাসমেত ঝাঁপ দেই আমার অতীতে রেখে আসা জীবনজালের দিকে। আমার প্রিয় শারীরীয় শৈশব, সমগ্র আত্মাব্যাপি ছড়ানো শৈশব, যাকে এখন স্মৃতি হিসেবে, অতীত হিসেবে আমাদের বোধে পুতে রাখা হয়; সেই পৃথিবীব্যাপি সমগ্র শৈশব আমাকে টেনে ধরে।
আমি নতুন করে শুরু করি, যেন বা মায়ের গর্ভে অভিমানে মায়ের চর্বিবিহীন চামড়ায় জেগে থাকা অথবা না ঘুম না জেগে থাকার মাঝামাঝিতে আমি আমার অস্থিসর্বস্ব পা দিয়ে, কেন-না তখনও তো এই আমার পা জোড়া পৃথিবীর সবুজে ধুসরে জলে কাদায়, পরম মমতায় অথবা যৌনতায়, সূর্য অথবা চাঁদের ছায়ায় জাড়িত হয়নি। তবে একথা ঠিক, মায়ের জরায়ুর বাইরের আলোজলবিহীন, এই আমার পা জোড়ার জৈবিকতা আমি আমার সত্তা দিয়ে, আমার মায়ের জরায়ুর ভেতরে অনুভব করতে শুরু করেছি; আর তখন আমি আমার মায়ের চর্বিবিহীন পেটের চামড়ায় অস্থিসর্বস্ব পা দিয়ে লাথি দিচ্ছি। মা তখন তার পেটে চর্বি জমাবার মতো যথেষ্ট জায়গা পাচ্ছিলেন না; তার সেই জায়গা আমি দখলে নিয়েছি। আমাকে ঘিরে নিঃসঙ্গ নির্জনতার কণ্ঠস্বর নৈঃশব্দ রহস্য সৃষ্টি করে। সেই রহস্য ছুঁয়ে দেখি আমি। ছুঁয়ে দেখি সময়ের সূক্ষ সুতোর শরীর। কার চোখ ভাসে ওই মরা বাতাসের শরীরে?

ঈশ্বর আমাকে ডেকেছিলেন সেইদিন, সেই মায়ের জরায়ুর ভেতর; আমার সেই চিরায়ত নিঃসঙ্গতার জবাব দিতে। আমার আত্মায় অথবা আমার বোধে যদিও তখন পর্যন্ত পৃথিবীর অভিজ্ঞতায় সূর্য অথবা চন্দ্রের জৈবিকতা প্রবেশ করেনি। সেই আমার অনাঘ্রাত বোধের ভেতরে ঈশ্বর প্রবেশ করলেন এবং বললেন, আমিই অহম, আমিই নিঃসঙ্গতা, আমা থেকে তোমার মুক্তি নেই, আমি আদি এবং অনাদি, আমিই চিরন্তন; সুতরাং, আমা হতে তোমার মুক্তি নেই; আর জেনে রাখো হে অহম, একদা সমস্ত রহস্যের মীমাংসা হবে, সমস্ত ভেদ উন্মোচিত হবে এবং সত্যিকার অর্থেই বুঝবে ঈশ্বর অর্থ নিঃসঙ্গতা; তথাপি আমা হতে তুমি স্বাধীন নও, কেননা নিঃসঙ্গতাই একমাত্র চিরায়ত জীবন।

আর তখন আমি মাতৃগর্ভে শব্দবিহীন অর্থবিহীন কষ্টপাতে ক্রমাগত সীমাবদ্ধ হতে থাকলে আমার প্রাণবায়ু পৃথিবীর বায়ুগ্রহণে উদগ্রীব হয়তখনও আমার জানা ছিল না, জীবন অর্থ কতটুকু শরীর আর কতটুকু ঈশ্বর; অর্থাৎ শরীরকে বোধ ও আত্মা; আত্মা ও অহম; অহম ও ভাষায় ক্রমরূপান্তরের শেষসীমা কোথায়; আর সেই শেষসীমানার চূড়ান্ত অন্ত না দেখেই আমি মাতৃগর্ভ থেকে, মায়ের রক্ত থেকে, মায়ের নাড়ি থেকে, নিজেকে টেনে ছিড়ে এনে কত দ্রুত কত বেশি অর্থহীন অপচয়ের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলাম; এই অনিবার্য অপচয় চিরায়ত নিঃসঙ্গতার মর্মবেদনা আবিষ্কারের মতোই চিরায়ত এবং অর্থময়। সেই চিরায়ত মর্মার্থের ভেতরের শাঁস দেখিয়ে দেবার প্রলুব্ধতায় কে যেন ডাক দেয় আমাকে সবুজ ঝোপের আড়াল থেকে। ঝোপের আড়ালে পাখি। পাখিদের লেজে লেজে দোল খায় পরিপক্ক ফল; বেদনার ফলগুলি পেকে উঠবে আবার এই শরতের ছোঁয়ায়।
আর যদি আমার নিঃসঙ্গতা হয়ে থাকে একখানা পরিপূর্ণ ভরাট বিরামহীন ফরেস্ট, তবে সেই ফরেস্টের ভেতর দিয়ে আমি হাঁটছি আর ভাবছি শেষ পর্যন্ত মানুষই চূড়ান্ত অর্থে শরীরজীবী জীব; কেন-না মানুষই একমাত্র জীব যে কিনা তার শরীরের সাথে যুক্ত করেছে তার আত্মাকে, তার অহমকে, তার বোধ অর্থাৎ ভাষাকে; প্রকৃত প্রস্তাবে তার নিঃসঙ্গতাকে। নিঃসঙ্গতার আরেক অভিধা ঈশ্বর। আর এ সবকিছুই তার শরীরকে এত বেশি, এত ছড়ানো ভাবে পৃথিবীব্যাপি ভূগোলের সাথে মিলিয়ে নিয়ে, সূর্যের চুল্লিতে জাড়িত করে নিয়ে, চাঁদের ভাষায় প্রতিবর্ণিত করে নিয়ে চিরায়ত সময় ব্যাপি ভোগ করা যায়, চারিদিকে জীবনআগ্রাসী জীবনভোগের এইসব ক্লান্ত আয়োজন। এই সবকিছুই তো ভোগবাদি জীবনের যাবতীয় আয়োজন; জীবনকে চেখে, উলটে পালটে, নেড়েচেড়ে রঙে বর্ণে শব্দে আলোয় অন্ধকারে ভোগ করার এক অনিবার্য চিরায়ত আয়োজন। এই আয়োজনে পাপপূণ্যের অবকাশ কোথায়?

জীবন অর্থ মস্তিষ্কময় দেহ-অনুগত গতিময় ধারাপাত। সেই চিরায়ত ধারাপাতের যাবতীয় ক্ষুধাকে বর্ণময় করে তোলার নাম জীবন। জীবন অর্থ প্রকৃত দৃশ্যের আড়ালে হলুদ শব্দপ্রবাহের ক্রন্দন; জীবন অর্থ ঈশ্বর। প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের ঈশ্বর নেই। বিধায় তারা এই মহার্ঘ্য শরীরের মর্মার্থ বোঝে না; কেন-না তার দেহের ভেতর নিঃসঙ্গতা নেই, ঈশ্বর নেই। এই শরীর, এই দেহ তো যন্ত্রণা পায় না; যতকিছু যন্ত্রণা যতকিছু কষ্ট সবটুকুই তো বোধ অর্থাৎ ঈশ্বরের। হরিণের ঈশ্বর নেই সুতরাং হরিণের কষ্ট নেই। আমি তো আর সুন্দর হরিণ নই যে আমাকে মানুষ জৈবিকতা আর যৌনতা দিয়ে ভোগ করবে; আমি তো মানুষ; আমি তো ঈশ্বর। সুতরাং আমার অনেক, অনেকগুলো নিঃসঙ্গতা ক্রমাগত জমতে জমতে পৃথিবীর গোলার্ধদ্বয় ভারসাম্যহীন হয়ে উঠতে শুরু করেছে; এতে আমাদের কষ্ট বাড়ছে।

মানুষের কষ্ট থাকতে হয়; তা না হলে তাকে মানুষ বলা যায় না। হতে পারে মহিষ বা ছাগল বাঘ সিংহ; আমি বনে বাদারে ঘুরে ঘুরে জানোয়ার হয়ে ওঠার সাধনায় হাজার বছর অতিক্রম করলেও শেষ পর্যন্ত কষ্টের কাছে ফিরে এসেছি; ফিরে এসেছি সভ্যতার কাছে, কালচারের কাছে, নিঃসঙ্গতার কাছে; যৌনতা ও অতীতের কাছে; যৌনতা ও জৈবিকতার কাছে। আমাকে তো ফিরতেই হয়; মায়ের কাছে; বাবার কাছে; ঘরের দিকে, মহল্লার দিকে; উন্নয়নের দিকে; ভোটের দিকে; রাজনীতির দিকে; কেননা আমি তো এখন শরীর পেয়েছি; এই শরীর বনের পাখি আর মাংসাসী তৃণভোজি জীবের মতো ফরেস্টের নয়। এই শরীর এখন আমার; এই শরীর এখন এই ঘরের, এই তল্লাটের; এই যে আপাত বিশাল একটা বাজার, এই বাজারের; এই দেশ আর এই ভূগোলের। ভূগোল মানে তো বলা হয় মা। এটা মিথ্যাচার; চিরায়ত মিথ্যাচার। ভূগোল মানে ব্যক্তিসম্পদ। ব্যক্তিসম্পদ অর্থ শরীর; শরীর অর্থ আমি; আমি অর্থ নিঃসঙ্গতা।

গৃহপালিত প্রশ্নে আটকে রাখি নিজেকে দেহের ভেতর। আর যখন কেবলি জেগে ওঠে সংশয়, আমি কীভাবে সময়ের ওপর হেঁটে যাবো, কতদূর? এইসব কোনোকিছু না বুঝেই হয়তো বা প্রিয়জন কেমন আছো, এই জিজ্ঞাসা চোখে জাগিয়ে অথবা হয়তো কুশলেই আছি, আর আপনাকে জানা হয় না অনেক দিন অথবা তখন সমকাল থেকে পিছিয়ে থাকা কোনো তরুণ তারাশঙ্কর পাঠে আক্রান্ত হয়ে নিজেকে খুঁচিয়ে তোলে; জীবন এত ছোটো কেন, এই এতটুকু জীবনে কীভাবে আকাঙ্ক্ষা বেঁচে থাকে দেহে? সেইসব রহস্য বাঁচিয়ে রেখে ভালো লাগে এইসব ক্ষুদ্র সময়। অথবা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই, তোমাদের মনে পড়ে যখন। যখন সন্দেহ হয়, হয়তো বা বেড়ে যায় বয়স; এই এক চেনা পৃথিবীর বয়স; এইভাবে চেনা পৃথিবী একদা অচেনা হয়, বেড়ে যায় পৃথিবীর বয়স।
বৃষ্টির সমারোহ শব্দে মাটির গন্ধ জেগে উঠলে দেহে, সন্দেহ হয় আমাদের ভেতর কারো কারো একদিন হয়তো বা কৈশোর ছিল; অথবা এই দেহ, দেহময় শরীর; কোথাও মন নেই, নেই কোনো শৈশব অতীত; শুধুই বয়স বাড়ে পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে। বৃষ্টির শব্দ অথবা আগুনচুলোর ধোয়াগন্ধ নিয়ে বেড়ে যায় বয়স। অতীত পৃথিবীর মতো ফিরে আসে মেঘ, মেঘশূন্য আকাশ অথবা নদী। আমাদের মনে থাকে না এইসব ছবি। তবু ভালোলাগা; অবাক হই অথবা কষ্টের অভিনয় করি; অথবা নাগরিক বৃষ্টির বিকেলে নতুন কোনো নাগরিক প্রেমিকাকে বসিয়ে পাশে শারীরীয় অনুভূতি জাগিয়ে তুলি। অথবা শারীরীয় সময়কে ভিজ্যুআল করে নিতে বৃষ্টি অথবা পাখিচিত্র ফুটিয়ে তুলি আমাদের ভেতর। তবুও ভালোলাগা অনেক। এইসব ভাবতে ভালোলাগে; আর কামশেষ দেহে জেগে ওঠে, ‘চলে যাক নুনিয়া ঝুমুনুনিয়া ঝুমুনামে আমার কি কোনোদিন কোনো এক প্রেমিকা ছিল? এইভাবে অনেকগুলো দিন আর অনেকগুলো রাত প্রেম করি আমরা। আর এক সময় ভুলে যাই জুঁইদি নামে কোনো এক নারী একদা কোনো এক কিশোরবেলায় প্রেম শিক্ষা দিয়েছিল আমাকে। পরজন্মের ঘোড়া এসে ঘাস খেয়ে যায় আমাদের অন্ধ আত্মায়। এই হাত ছুঁয়ে ফেলে মেঘ, মেঘেদের হৃদয় আর সবুজ রমণী। ওগো মেয়ে যতটুকু বাঁচি, তার সবটুকু তুমি আর তোমার হৃদয়।

অথচ, জীবন এমনই ছোট এক স্ফূলিঙ্গ যে সেখানে একজন কবি বুকে পৃথিবীর সমান বয়স অবধি আগুন ধরে রেখেও শেষাবধি নির্মাণ করতে পারে না কোনো আগুনসমুদ্র। অবাক হইনি, তবে মেনে নিতে পারিনি কবি মামুন মিজানের দেহত্যাগ। আসলেই মামুন মিজান নামে কেউ কি আছেন পৃথিবীতে অথবা ছিলেন? মানুষের দেহ আছে; দেহের কোনো আত্মা নেই; তবে বলা হয় দেহ যে কাজ রেখে যায় পৃথিবীতে, মানুষ তা মনে রাখে। অথচ, যখন আমি নিঃসঙ্গ হলাম তখন বুঝতে পারলাম, মানুষ মানুষের কাজকেও মনে রাখে না। সেই অবকাশ নেই মানুষের। মানুষের কর্মও ক্ষণিক এবং নশ্বর। বেঁচে থাকার ইচ্ছা এক ধরনের নিজেকে প্রবোধ দেওয়া, প্রতারণা।

তবে মানুষ প্রকাশপাগল জীব; নিজেকে সে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক কাজে অথবা ভাষায়। হয়তো এর নামই জীবন। জীবন আমার আত্মজ; জীবন আমার আত্মজা। আত্ম থেকেই তো আমিআমিমানে আমার জীবন; একান্ত আমার জীবন। কিন্তু একান্ত আমারজীবন বলে কিছু নেই। আমিসর্বদা অসম্পূর্ণ, আংশিক এবং খণ্ডিত। যৌথের ভেতর এই খণ্ডিত জীবন পূর্নতা পায়। সুতরাং আমিঅর্থ জীবন নয়; জীবন অর্থ আমরা’; এই পৃথিবীর মানুষ আর মানুষের চারপাশে দৃশ্যমান সবকিছু; একটা মায়া পোকা, ক্ষুদ্র কীট অথবা বিশাল পাইথন, মাথামোটা হাতি অথবা অসভ্য রাষ্ট্রপ্রধান, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা থেকে শুরু করে আমরা যারা সভ্য বলে নিজেদেরকে নিজেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই; এই সব, সবটুকু দৃশ্যমান জগতের নাম জীবন। জীবন অর্থ আমি; আমি অর্থ দৃশ্যমান জগৎ; এমনকি আমার কাছে যা দৃশ্যমান নয় সেই অদৃশ্য জগতের নামও সম্ভবত আমি
আমিমানেই তো জীবন। এই জীবন মানেই তো আমার দেহ; আমার দেহ বদলে যায় পুত্রে অথবা কন্যায়। এই পুত্র-কন্যা আদতে আমার মেধা ও সম্পদের উত্তরাধিকারী। আমি পূঁজি ভালোবাসি, আর তাই পরিবার প্রথায় আমার আত্ম-মালিকানা নিশ্চিত করার নাম চিরায়ত অনির্বাণ অপরিহার্য জীবন। যে জীবনে প্রবেশাধিকার পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের নেই; কেননা তারা অবমানব। অবমানব শুবিধা বঞ্চিত; এবং সম্পদে তাদের অধিকার তারা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে অবমানবে আটকে আছে। তাদের জন্য শুবিধাভোগি সভ্য জগতের যতরকম মানবিক আচরণ; আমাদের দরবারি মানবাধিকারের বচন, এই বচন এক ধরনের গেইম; এই খেলাটাও অবিবেচক ঈশ্বর তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে সৃজন করেছে। সৃজনশীলতার নাম তো জীবন; জীবন মানে পূঁজি এবং ভোগ; ভোগ মানে মেধা এবং শরীর।

আমার একখানা আধা-শরীর আছে। অবমানবদের শরীর আছে; কেন-না তারা পশু জীবনের সমার্থক; শরীরবাদি। আর তাই সভ্যমানুষ তাদের শরীরবাদি প্রয়োজন মেটাতে আধুনিক-অত্যাধুনিক প্রোজেক্ট পরিচালনা করে চলেছে। পরিবার প্রথায় এই অবমানবেরা সভ্য হবার সাধনায় চিরায়ত লড়াই চালিয়ে চলেছে; লড়াই চালিয়ে চলেছে পূঁজির বিপরীতে। অথচ পূঁজি অর্থ কেন্দ্রিভূত শক্তি; কেন্দ্রে পূঁজি কুক্ষিগত হলে সেখানে চিরায়ত শক্তি দানা বাঁধে; সেই দানাদার শক্তি অবমানবেরা অতিক্রমণে ব্যর্থ হয়। সভ্যতা আর পূঁজি সমার্থক। অবমানবদের অবস্থান পূঁজির বিপরীতে। পূঁজি কেন্দ্রিভূত শক্তিকে পুঞ্জিভূত করে; যা মুষ্টিমেয় মানুষের নিয়ন্ত্রণে; অবমানবদের জন্য নয়। অথচ মানুষেরা অবমানবদের সভ্য হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখায়; ভোগযোগ্য প্রোজেক্ট প্রণয়ন করে; এই প্রোজেক্ট প্রণয়নের মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে অবমানবদের আনুগত্য নিশ্চিত করে। এটা একটা গেইম, অবমানবেরা কোনোকালেই তাদের সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না। কেন-না এইসব উন্নয়নবাদি প্রোজেক্টের ভেতর দিয়ে অবমানবদের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সুতরাং ড. ইউনুসদের জন্ম হয়; নোবেল পুরস্কার পূঁজির পক্ষে আরো মহার্ঘ্য ও কার্যকরি হয়ে ওঠে। প্রকৃত প্রস্তাবে গ্লোবাল বাস্তবতায়, ঐতিহাসিক সত্যের ধারাবাহিকতায়, সভ্যতা বিকাশের ধারাবাহিকতায় পক্ষান্তরে আমরা অবমানব হয়ে টিকে থাকার পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি; যাতে তথাকথিত সভ্য-মানুষ পূঁজি কেন্দ্রিভূত শক্তিনিশ্চিত করতে পারে। এবং শেষাবধি যাতে অবমানবেরা শুধুমাত্র অবমানব বৈশিষ্ট্যে আটকে থাকতে পারে।
আমি যখন নিঃসঙ্গ, এই অবমানব এবং মানুষ এর ঠিক কোন স্তরে আমার অবস্থান তা খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছি আমার ভেতর। শেষাবধি নিঃসঙ্গতা নবী-রসুলের জন্ম দিতে পারে; নিষ্কাম-বুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু একজন জৈবজীব কবির জন্ম দিতে পারে কিনা এ বিষয়ে আমার সংশয়; কিন্তু এ কথা ঠিক, নিঃসঙ্গতা আমাকে অবমানব এবং মানবস্তর থেকে ঠেলে, দূরে, সরিয়ে দিতে শুরু করেছে।

পত্রিকার পাতায় চোখ আটকে গেলে ধাক্কা খাই। অথচ ক্রমেই সব ভুলতে থাকি। এই ক্রমাগত ভুলে থাকতে পারার নাম বাস্তবতা। বাস্তবতা আর নিঃসঙ্গতা বিপরিতার্থক। যার ভেতর নিঃসঙ্গতার বাস সে হয়তো বাস্তব জগৎকে ঠিক চিনে উঠতে পারে না; ফলে সে ধাক্কা খায়, কষ্ট পায়। বাস্তবতা নামক ঈশ্বর আড়ালে বসে এই কষ্টকে উপহাস করে। কালের কণ্ঠের ১৩ পাতায় কবি মামুন মিজান মরে লেপটে আছে। কবি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। আমার দুর্বলতা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পর্শকাতর অতীত। কবি মামুন মিজান আমাকে ছুঁয়ে দেবার মতো অবকাশ পায়নি তার আগেই আমি ক্যাম্পাস ছেড়েছি। কিন্ত তারপরও আমরা আমাদের ছুঁয়ে দিয়েছিলাম; কবিতা দিয়ে; নিঃসঙ্গতা দিয়ে। একখানা বিষণ্ন সূর্য ডুবে যায়। নিঃসঙ্গ। একা। পাহাড়ি সমুদ্র জেগে থাকে রাতভর। মেঘের আড়ালে হলুদ বিষণ্ন চাঁদ। পাহাড়ি বাগানে সাদা কুয়াশার সাদা পবিত্র রহস্য; এই রহস্য ভুলবার নয়। আমার আত্মা রহস্যে ঢাকা পরে যায়। আরো দূরে দিগন্তে ভেসে থাকে রহস্য। আমার আত্মার অতলান্তিক রহস্য।

আর তখন পত্রিকা খুলে স্তব্ধ বসে থাকি। আমরা কেউ কেউ তাকে স্বপ্নে দেখি; মামুন মিজান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এরপর এক সময়, শোয়াইব জিবরানকে নিঃসঙ্গতা আক্রমণ করলে ফেইসবুকের আলোকদেয়ালে লিখতে থাকে, ‘মামুন মিজান সময় দিলে না! আট কুঠুরিতে যাব। কবি রহমান হেনরির কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে। ল্যাব এইডের সামনে নেমেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস হতে। নেমেই দেখি কবি মামুন মিজান যাচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেমনটি তাঁকে হাঁটতে হতো। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলাম, স্নেহের। ফিরে তাকালো। মুহূর্তেই তাঁর চোখ ছল ছল করে উঠল। কত দিন পর দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আমার জুনিয়র ছিল। হলে প্রায় সময় রুমে আসতো কবিতা নিয়ে। তাঁর কবিতার কাগজ নিয়ে। পরামর্শ চাইতো। প্রথম পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম, তোমার নাম দীর্ঘ। মিজানুর রহমান মামুন। মামুন মিজান করো। সে তাই করেছিল। এ নামে লিখেই কবিতা চর্চা করছিল। সেদিন দেখায় সে কথা আবার বলল। শোয়াইব ভাই আপনার নামেই আছি। দুজনেই হাসলাম। তাঁর কী যেন কাজ ছিল। বলল, শোয়াইব ভাই যাব না। আজ আপনার সাথেই সময় কাটাবো। তারপর কত কথা তাঁর। সে পড়ায় গাইবান্ধায়। এম.ফিল. করবে। পি-এইচ.ডি করবে। আমি যেন তাঁর ঢাকায় কোথাও ব্যবস্থা করি। করবো মামুন। কিন্তু সে সময় তুমি আমাকে দিলে কই। চলে গেলে কাল, বড় অসময়ে।

ওই গাছে গাছে সন্ধ্যার নগ্ন সুর বাজে; দুঃখ আর বিষাদের ফলগুলি পেকে পেকে ঝরে যায় সন্ধ্যারাতে। হায় সন্ধ্যার অন্ধ চোখ আর বিজন পথের নিঃসঙ্গ ফুল, আমি ডুব দেই নিঃসঙ্গ ফুলেদের অন্তর তৃষ্ণায়; ওদের বিরল অনুভূতিকে স্পর্শ করি। ঐশ্বরিক মুহূর্তগুলি কাঁপে ফুল আর ফলের ভিতর; আমি সেই কম্পনের মধ্যে ছড়িয়ে আছি গুপ্ত ঈশ্বরের মত। অনন্ত নিঃসঙ্গতার নাম ঈশ্বর। মামুন মিজান কি নিঃসঙ্গ? মামুন মিজান কি ঈশ্বর? না, মামুন এখন আর ঈশ্বর নয়; কেন-না মামুন এখন আর নিঃসঙ্গ নয়; মৃত্যুর পর কারো পক্ষে নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হওয়া সম্ভব নয়। মামুন এখন অস্তিত্বহীন; মামুন এখন পৃথিবীর অংশ, মাটির অংশ। মাটি অর্থ সম্পদ; মামুন এখন আমাদের সম্পদ। সম্পদ নিঃসঙ্গ নয়; সম্পদ দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং ভোগযোগ্য বাস্তবতা। মামুন এখন ভোগযোগ্য অভিধা মাত্র। কত বিস্ময়কর এই শরীর। শরীর নেই তো মামুন নেই।

ফিরে আসি লোকালয়ে। লোকালয় অর্থ, অর্থময় বিশাল এক ফরেস্ট। দেবেশ রায়ের অপেলচাঁদ ফরেস্ট; গাজোলডোবা, ক্রান্তি হাট, চ্যাংমারি হাট, মালবাজার, লাটাগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, নাগরাকাটা, মাদারিহাট, তোর্সা নদী, তিস্তা নদী অথবা তিস্তা ব্যারেজ থেকে রংপুরের টাউনহলের জনসভা পর্যন্ত। অথবা ইন্দোনেশিয়ার এশিয়ান ব্যাংকে কর্মরত আমার বান্ধবি সুজিয়ারা রিনি; যে রিনি বাংলাদেশে আসতে চেয়ে আমাকে মেইল করেছে; এখানে বিনিয়োগ করবে; শিল্প প্রতিষ্ঠা করবে; পূঁজি বানাবে। অথচ রিনি কর্পোরেট লাইফ মেইনটেন করেও বুঝতে পারে না তার ক্যাপিটেল শেষাবধি তার হাতে থাকবে না; পূঁজি কেন্দ্রিভূত হবে। সুজিয়ারা রিনি কর্পোরেট লাইফের ব্যস্ততায় ডুবে আছে; আর তার বন্ধু অভিধায় স্বামী সম্পর্কের ব্যক্তিটি তাকে ছেড়ে চলে যায় আরো এক রমণীর বেডরুমে; বিয়ে করে, ঘর বাঁধে। রিনি একা; একা হয়ে যায়। আমার কাছে ডিভোর্সের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে নিজেকে সুখি প্রমাণ করার চেষ্টায় মেতে উঠলে আমি আমার সেই অস্বাভাবিক সুন্দরী বান্ধবির ভেতরটা দেখে ফেলি। রিনি নিঃসঙ্গ; অথচ রিনিতো কবি নয়। তাহলে? তাহলে, নিঃসঙ্গতার অর্থ কী কবি অথবা ঈশ্বর? নাকি কর্পোরেট জীবন? নাকি বন্ধুহীন জীবন? নাকি মামুনের মৃত্যু? নাকি দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বৃত্তান্ত? অবমানব বাঘারু? ‘যেইলা ফরেস্টারচন্দ্রের বাঁ পাছাত আর ডাহিন পিঠত বাঘের দুইখান থাবার দাগ আছে ঐলা ফরেস্টারচন্দ্র আসল। ত দেখাও। সগায় পাছার কাপড় তুলি দেখাও। তুলো হে তুলো। পাছার কাপড় তুলো আর পাছাখান ঘুরাও।... সগার পাছাত হাগা আছে, বাঘা নাই।... এলায় ত জানি গিছেন, যায় বাঘারু, সে-ই সাচা ফরেস্টার।

আমি কি বাঘারু? ই-মানুষ? নাকি ই-মেইলের মতো ই-মানুষ? আমার আর রিনির প্রেম কি নিঃসঙ্গ, ই-প্রেম? আমি কি কবি মামুন মিজান? আমার কি বিস্তর বন্ধু ছিল? কোন এক বন্ধু কি আমাকে ডেকেছিল একদা কাছে? না হলে ফেইসবুকের আলোকদেয়ালে কেন ঝুলে থাকে নিঃসঙ্গতা? সেখানে কেন লেখা হয়, ‘তবু এলাকার সূত্রে কিনা জানি না, উনি আমার সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতেন। মাঝে মাঝে ফোন দিতেন। ৩১ মে শুক্রবার ১২ টার দিকে বেরিয়েছি, শাহবাগ এলাকায় যাবো। মামুন ভাই ফোন দিলেন। বললেন, ঢাকা এসেছেন। আমার সাথে কি দেখা হওয়া সম্ভব? শাহবাগ গিয়ে আজিজ মার্কেটে বই দেখলাম। অনুরণনের জন্য সুকুমার রায় সমগ্র কিনলাম। প্রিন্স এলো, কল্লোল এলো, মোহাম্মদ আরজুও। হালকা ভাঙ্গা পদক্ষেপে উনি বৃষ্টি নিয়ে এলেন। শাকুর ভাইও আসলেন। মামুন ভাইয়ের মধ্যে একটা উদ্বেগ টের পাচ্ছিলাম। লেখকত্ব নিয়ে গভীর এক উদ্বেগ। কোনো ঈদসংখ্যায় যদি উপন্যাস ছাপা যায় বা কোনো নামি প্রকাশনা সংস্থা থেকে যদি বের করা যায়, তবে হয়তো তার খেটে লেখা উপন্যাস কেউ কেউ পড়বে। লেখা পড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ বটে, বিশেষ করে যারা ঢাকার বাইরে থাকেন তাদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। সাহিত্যের জগৎটা নিষ্ঠুর। কারো কারো জন্য মাখনের মতো নরম, কারো কারো জন্য লোহার মতো কঠিন। আমি মামুন ভাইয়ের উদ্বেগের ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ব্যস্তটার কী আছে? হাতে সময় আছে, ধীরে ধীরে আগাতে হবে, এমনই নানা কথা আমি বলছিলাম। এইসব পলিটিক্স অব সাইলেন্সের মধ্যে মামুন মিজানের মতো সাহিত্যিকের সার্ভাইভাল কীভাবে সম্ভব ভাবছিলাম। আমি তো আর জানতাম না মামুন ভাই এরই মধ্যে পরপারের ডাক পেয়েছেন। যে একবার ডাক পায় তাকে তো একটু তাড়াহুড়া করতেই হয়। শেষ দিন ১৪ জুন বসুন্ধরা সিটিতে মোস্তফা মার্টে কেনাকাটার ফাঁকে তার কথা মনে হয়েছিল। ফোন করার কথা ছিল। কেন যেন ওই সময়েই মনে পড়লো। বলছিলাম, ব্যস্ততার কিছু নেই। ধীরে ধীরে সবই জয় করা যাবে। তা আর হলো কই? গুড বাই মামুন ভাই।
জীবনকে কি এত সহজেই গুড বাই জানানো সম্ভব? সম্ভব। মরে গেলে এভাবে সহজেই সম্ভব হয়ে যায়। আর বেঁচে থাকলে জীবন অর্থ এক ভারবাহি পশু। চূড়ান্ত সত্য হলো, মানুষ তো আসলে শারীরীয় প্রাণী; শরীর অর্থ পশু। অবশ্য মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে নিলে মানুষ হয়ে ওঠে অবমানব। আমরা কি অবমানব থেকে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াইয়ে ব্যস্ত? আর আমি তো অবমানব আর মানুষ নামক অভিধা থেকে ছিটকে পড়েছি তখন, যখন দেহের সাথে মনকে একাকার করে ফেলেছি।

২.    আমি কি জুঁইদিকে কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেছিলাম?

১৪ মে রাত ১২টা ১৪মিনিটে কুলদা রায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলেন, ‘জানালা দিয়ে মানুষ দেখা যায়। সেই মানুষ আধখানা মানুষ। পূর্ণ মানুষ নয়। সেই মানুষ নিয়ে যখন কেউ লেখেন সে মানুষগুলো নিজেরা কথা কয় না। লেখক তাদের হয়ে কথা বলেন। তাদের হয়ে লেখকই অভিনয় করেন। তখন আর আমরা প্রকৃত মানুষকে পাই না। কিছু বানানো মানুষ পাই। কিছু বানানো জীবন পাই; এটি না-জীবন। জীবনের খোলস মাত্র। এদের আমরা সহজে ভুলে যাই।

আসলে কি তাই? নাকি জীবনের গোপন সত্য যা আমরা আমাদের চারপাশের জীবন্ত মানুষের সাথে মানুষকে ছুঁয়ে দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার পরও সেই মানুষ অথবা আমি সেই অনুদ্ঘাটিত জীবনকে ছুঁয়ে দিতে পারি না; দেখতে পারি না সাদা চোখে; লেখক সেই অনুদ্ঘাটিত মানুষটিকে উপস্থাপনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন; ফলে লেখকের সৃষ্ট মানুষগুলো হয়ে ওঠে চিরায়ত; প্রকৃত প্রস্তাবে লেখক-সৃষ্ট এই মানুষগুলো আমাদেরকে মানুষ চিনতে শেখায়; সমাজ আর সমাজের রহস্য বুঝতে শেখায়। পক্ষান্তরে কুলদার এই বানানো মানুষগুলোই সমাজবাস্তবের মানুষের চেয়েও হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য, শিল্পের মানুষ।
শিল্পের মানুষগুলো কি জীবনের খোলস মাত্র? গোর্কির চরিত্রগুলো কি শুধু অভিনয়ে অংশ নেয়? টলস্টয় অথবা দস্তয়ভস্কি অথবা আরও অনেকেই? তাহলে কেন আমরা আমাদের লেখায় মানুষ নির্মাণ করি? সমাজ নির্মাণ করি? জীবন্ত সমাজ আর সমাজের জীবন্ত মানুষ নিয়েই কেন তুষ্ট থাকি না; কেন ছিঁড়ে ফেড়ে আবিষ্কার করতে চাই, ছিঁড়ে ফেড়ে দেখতে চাই পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত অবয়ব?

পক্ষান্তরে লেখকের কলমে তৈরি এই মানুষ আর মানুষের প্রতিবেশ আমাদের অতিসত্যের ইশারায় অমোঘ আকর্ষণে কাছে টানে; এই অনিবার্য টেনে নেয়া থেকে আমার অথবা আপনার মুক্তি নেই। ফলে আমাকে অভিজ্ঞতার বাস্তবতা ঘেটে আত্মজৈবনিক চেতনাকে ক্রমাগত বস্তুজৈবনিক করে তুলতে হয়। সাকিন উন্মোচনে পক্ষান্তরে আমি আপনার প্রকাশিত মুখের পাশাপাশি অনুদ্ঘাটিত মুখোশটিকেও আঁকতে ইচ্ছুক। যদিও আমি পাভলভের মতো কিডনিকে কিডনির জায়গায় রেখেই নিরীক্ষা করতে ইচ্ছুক। সুতরাং জুঁইদিকে আমি আমার জীবন থেকেই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। অবশেষে একজন জুঁইদি এক জীবন থেকে কীভাবে ক্রমশ হয়ে ওঠে বহুজীবন, গোষ্ঠীজীবন; রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভলগা থেকে গঙ্গার নিশার মতো কীভাবে একক চরিত্র সমাজবাস্তবতায় মহাকালের ছায়ায় হয়ে ওঠে অনিবার্য চিরায়ত মানবী যে কিনা পক্ষান্তরে আমাকে আপনাকে আমাদের প্রত্ন-অভিজ্ঞতার কথাই মনে করিয়ে দেয়; ইশারা দেয় অনাগত মানুষের। এখানেই জুঁইদি হয়ে ওঠে সর্বকালিক, আমার আপনার তাহার; যা বাস্তবে আমার অথবা আপনার আশে পাশের কাউকে দিয়ে সম্ভব নয়; যা সম্ভব হয়ে ওঠে লেখায়। অথচ এই লেখা, এই কথন, এই আখ্যান সবটুকুই সরাসরি ঘটে যাওয়া ঘটনা অথবা সমাজ থেকে আমার অথবা আপনার জীবন থেকে টুকে নেওয়া। শিল্পের রহস্য এখানেই। যেমন বলা যেতে পারে, জুঁইদি এখন কী করছে? জুঁইদির কি মন খারাপ? মৌমাছিরা সবাই ঝাঁক বেঁধে কোথায় চলেছে? কী ঐশ্বর্গিক ওদের আয়োজন! মৌমাছির ঝাঁকের ভেতরে আমি আমাকে মেলাতে পারি না, মেশাতে পারি না; আমি একা পিছিয়ে পড়া এক যুবক; জুঁইদি আমাকে মনে রাখবে না; এ কথা জেনেও আমি এগিয়ে যাই জুঁইদির দিকে।

জুঁইদি আমার থেকে বয়সে বেশি; কতটা বেশি? অর্ধেক শতাব্দি অথবা অর্ধযুগ? টিভিতে ঢাকাইয়া ছিনেমা; শাবানা-আলমগির। অবমানব প্রেম। আলমগির রিক্সাওয়ালা। শাবানা শিল্পপতির মেয়ে। শাবানার বুক কেঁপে উঠলে আলমগিরের হাতে তার ভারি দেহটা মোচড় খায়। চোখের বিন্দুতে ক্লোজ শট।  রিকসার প্যাডেলের গোলকচক্র ঘুরতে শুরু করলে নায়িকার জন্য যৌবনের ভার বহন করার কী যে যন্ত্রণা; সেই যন্ত্রণা গান হয়ে নায়ককে জড়িয়ে ধরে; আর তখন নায়িকার বুকের ওড়না বাতাসে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বিঁধে থাকে। হঠাৎই টিভির পর্দায় ভেসে উঠতে দেখা যায় নৌকাবাইচ, ঢাকঢোলের আওয়াজে তিনখানা পানসি দ্রুত জল কেটে এগিয়ে যেতে থাকে। পানসি নৌকার নৌকাবাইচের তুমুল ঢাকঢোলের ভেতর আমি যখন চিঠি লিখছি তখন অর্থাৎ সেই দিন রাতে লক্ষি সিনেমা হল থেকে রামচন্দ্রপুরের সেকেন্দার মিয়া সেকেন্ড শো দেখে মাছবাজারের গলিতে পেশাব করতে দাঁড়ায়। তখন তার মাথার পর্দায় ভেসে ওঠে ভাত দে হারামজাদানামের বাংলা ছবির ফাঁকফোঁকরে কৌশলে জোড়া মেরে দেওয়া ইংরেজি ছবির কাটিং। সেকেন্দার মিয়া জোড়ায় জোড়ায় শাদা ফকফকা দুধের ওপর হাত রেখে মুততে থাকা লেওড়াটাকে থামাতে পারে না; অবশেষে, যা শালা খানকি মাগিগুলানের লাইগা ঝাইড়া ফালাইলাম। অথচ এ ঘটনার সাথে অর্থাৎ আমার বন্ধু সেকেন্দার মিয়ার এহেন শরীরবৃত্তীয় আচরণের সাথে আমার আপাত কোনো যোগসূত্র না থাকলেও আমি সেই রাতে এক ধরনের নিরাপত্তাবিহীন উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করি, আর তখন সেই চেষ্টা করতে থাকা ঘুমের ভেতর একটা লালরেলগাড়ি একখানা বিশাল অজগর সাপ হয়ে আমাকে আক্রমণ করে। চাপা পড়ে যায় জুঁইদির স্বপ্ন।

তারপর একদা জুঁইদির চিঠি আসে। শিমুল কেমন আছো তুমি? বাঁধন আমার সহ্য হবে না, কোন দিন না। যেমন হয় না ভালোবাসা। কিন্তু তবুও ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি। পরস্পর বিরোধি মনে হয় অনেক কিছু তবুও হাস্যকর এটাই, আমরা জেনে শুনেই সবকিছু করি। তারপরও তোমাকে প্রায়ই মনে হয়, তুমি এক পরস্পর বিরোধি মহৎ সত্তা।

আর আশ্চর্য, এই সামান্য কলাইন, যা আমার কাছে অসামান্য হয়ে ওঠার কথা ছিল; অথচ আমি ডায়রিতে লিখতে থাকি, ধীর পায়ে অলস ভঙিতে এগিয়ে যাচ্ছে দিন। এইচ.এস.সি.-র রেজাল্ট হবে। তারপর আবার পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা। জীবনের মোড়টা কোন দিকে বাঁক নেবে তারই পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি আমাকে নিতে হবে। অথচ পারছি কই? আজীবনই আমি না পারার যন্ত্রণায় ভুগলাম। না পারার বিলাসিতা আমাকে ছাড়তে চায় না। তবে কি অস্তিত্ব বিপন্ন? জুঁইদি, তুমি কি বিপন্ন?

সন্ধ্যায় কেমন এক অস্থিরতা নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবেই জুঁইদির বাসায় যাই। দরজায় জুঁইদি, তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি কিছু বলি না; পাশ কাটিয়ে ভেতরে গিয়ে জুঁইদির মা-র কাছে বসি। খালাম্মা চায়ের কাপে চা ঢালছেন। তাকে বেশ সুন্দর লাগছে; ছিপছিপে ধারালো আর চৌকস। কিরে, তোর মুখটা এমন পানসে লাগছে কেন? জুঁই কিছু বলেছে? চা খাবি?

এলোমেলো লাগে, অস্থির লাগে। অথচ কেবলি মনে হতে থাকে অনেক দিন পর, আজকে ভালো লাগছে আমার। কেন এই ভালোলাগা? খালাম্মার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকি; চোখের দিকে তাকাতে পারি না। সহসা মনে হয়, খালাম্মার ঠোঁটজোড়া ভায়ানক সুন্দর আর মায়া মাখানো। লিপজেল ছোঁয়ালে কি ঠোঁট থেকে মায়া ঝরে পড়ে? আমি কি আমার আঙুলে ঐ ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে পারি?

তখন জুঁইদির চিঠির কথা মনে পড়ে আমার, কান্নার সৌন্দর্য তুলনাবিহীন। তাই কাঁদতেও পারে না সবাই। গোপনচারি কান্নাগুলো যদি শুনে ফেলে কেউ; মনে হয় ছুঁয়ে দেবো অথচ অক্ষম মানবচিন্তা, ভাষা দেয়ার কী দুর্মর অপপ্রয়াশ। পারিনি কখনো ভাষা দিতে, পারবো না। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। প্রিয় দীপ, জানিনা আবারো কেনো আমি ফিরে আসি সেখানে, যেখানে বিকল কার্যকরণতত্ত্ব। তাই অনুরোধ, দার্শনিকতা ভরে ভরে আমার কথাগুলোর পেট মোটা করে দিও না। তোমার মতো চিন্তার সূক্ষতা নেই আমার, তা করতে গেলে বিপত্তি বাধাটাই স্বাভাবিক। আমি দুঃখিত দীপ, যদি আমি তোমার আলোয় পুড়ে যেতে না পারি। যদি আমি আলোকিত না হয়ে থাকি তোমার স্পর্শে, তাহলে দুঃখিত আমি; কিন্তু আমি মৃত নই। ভালোবাসতে পারি; একমাত্র গর্ব এটাই। এখনো ভালোবাসা আছে বুকের ভেতর তরতাজা রক্তের মতো; এ আমার এক ধরনের অহংকার। ভালোবাসার বিকল্প কী জানা নেই। বরাবর বিশ্বাস করি তুমি শিল্পী। দীপ তুমি শিল্পী। আর কী বলবো। কিছু মনে করিনি; শুধু এ কথাগুলোই ভীষণ সুন্দর, কবিতার ওপর কবির অধিকার যেমন, তোমারও আমার ওপর চিরদিন।

জুঁইদি এই চিঠিখানা লিখেছিল ২০ আগস্ট। অথচ জুঁইদি তখনও জানতো না আমাকে সে মিথ্যে লিখছে, নাকি এই আবেগের সত্যিই কোনো বাস্তবতা আছে। তবে এ কথা ঠিক, জুঁইদি যা লিখতো তা সে তার সমগ্র সত্তা দিয়ে ধারণ করতো তার ভেতর। অথচ তারপরও এ কথা ঠিক, তখন জুঁইদির জন্য জুঁইদির মা তার বোনের ছেলেকে পছন্দ করে রেখেছে। জুঁইদি বিষয়টা জানতো। হয়তো জুঁইদি বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। জুঁইদি তখন আমার কাছ থেকে বই সংগ্রহ করছে; সংগ্রহ করছে নিজেকে; আবিষ্কার করতে শুরু করেছে অনন্তের পৃথিবী।

একদিন জুঁইদি, অভিমান হতে পারে, রাগ হয়েছিল হয়তো ভীষণ; খানা পুস্তক না পড়েই আমার দিকে ঠেলে ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেই ভাড়া বাড়ির আঙিনায় জুঁইদিদের একখানা পাকা ইঁদারা ছিল। জুঁইদি গরম সহ্য করতে পারতো না। প্রায় সমস্ত ঋতুতেই জুঁইদি শরৎ বাবুর নায়িকাদের মতো ইঁদারার ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে আমার সামনে এসে অনেকগুলো সন্ধ্যায় বসে থাকতো। দিনে তিনচার বার ঠাণ্ডা জলে গা ধোয়ার বাতিক কি আমি জুঁইদির কাছ থেকে পেয়েছি? জুঁইদি গা ধুয়ে এসে সন্ধ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার কথা শুনতে থাকে অনেকটা যেন বা ঘোরের মধ্যে বসবাস। ভেজা চুলে জড়ানো থাকতো জুঁইদির সেই সবুজ গামছা। জুঁইদি কি খুব সাধারণ ছিল? ছিপছিপে শ্যামল; উজ্জ্বল বড় বড় মেঘবরণ চোখ; সেই চোখে পাখির ছানারা মমতায় ডানা ঝাপটায়; সেই ডানা ঝাপটাতে থাকা চোখ থেকে সেইদিন কি জল গড়িয়েছিল?

আমি বই ছখানা টেনে নিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসি জুঁইদির ঘর থেকে মাটির উঠোনে। তারপর পাকা ইঁদারার জলে ছলাৎ ফেলে দেই ছখানা বই; দ্রুত টিনের গেইট দিয়ে মাঠে নেমে আসি; খোয়া বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে রেলরাস্তার ওপর; পাথর আর পাথর; সোজা দুচোখ চলে যায় দিগন্তবিহীন সমান্তরাল রেলপাত ধরে।
তারপর অনেক অনেক দিন আমি হেঁটে গেছি রেলপথ ধরে। আমার জানা নেই, কতদিন কেনই বা এভাবে হেঁটেছিলাম আমি। জুঁইদি কোনোদিনও তা জানতে পারেনি। জুঁইদি জানতে পারেনি ছখানা বই ইঁদারার ঠাণ্ডা জলে বিসর্জন দিয়ে এসেছি আমি; যে জলে জুঁইদি রোজ গা ধোয়। জুঁইদি কি আজ ফেলে আসা পুস্তকের জলে গা ধুয়ে নিজেকে সর্বজ্ঞানী ভেবে গুটিয়ে নিয়েছে? জুঁইদি তো কোনোদিন জানতে পারেনি সেদিন আমি জুঁইদির ফিরিয়ে দেওয়া বইগুলো ইঁদারার জলে ফেলে দিয়ে এসেছি। হয়তো আজ এত বছর পর সেই বিদ্যা বিসর্জনের পাপে আবারো জুঁইদির মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। আমি কি এ জন্য প্রস্তুত ছিলাম? আমি আমার অতীতকে বুকে চাপা দিয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছি; জুঁইদির মুখোমুখি হতে চাইনি। তাহলে কি জুঁইদি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি? ছুটে এসেছে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩০৫ নম্বর কক্ষে। তখন আমি অনেক বেশি ম্যাচিওর্ড; ভেতরের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে এনে সেই আবেগ নিয়ে খেলতে শিখেছি। তারপরও তুমিতো আমার জুঁইদি, আমি কীভাবে বেঁচে আছি? আমরা কি কোনো দিন এমন কিছু ভেবেছিলাম, আমরা চিরকাল বন্ধু হবো? নাকি চিরায়ত কালিক বন্ধু? যে বন্ধুকে দেহ দিয়ে ছুঁয়ে দেয়া যায় না কখনো।

একটা সুন্দর অনুভূতিতে আচ্ছন্ন ছিলাম। আজ ভোর বেলা মনে হয়েছিল জীবনটা ভীষণ ভালোলাগার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো হাঁটবো। হাঁটলাম। বাবলা গাছের নিচে। ভেজা ঘাস আর হলুদ নিম পাতার শরীরের ওপর। কী যে ভালো লাগছিল এ নির্জন একাকীত্ব। একাকীত্বের স্বাদটা সম্পূর্ণ আলাদা। কিছু কিছু দুপুর আছে ভীষণ সঙ্গীতময়। সব নির্জন। একটা ঘুম ঘুম আমেজ সব দিকে। বাইরে কড়া রোদ তবু মনে হয় পেলব, পিচ্ছিল।

বিষণ্ন আকাশ। ভেতরে ফ্যানের হু হু আওয়াজ। সামনে হারানো শৈশবের মন কেমন করা ছবি। অকস্মাৎ ফ্যানের শব্দ ছাপিয়ে পায়রার ডাক। যেনো সাগর পাড়ে আছি। একাকীত্বের এ আনন্দটা বিশাল, গাঢ়। একটা ভেজা ভেজা আনন্দ। সত্তার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। এ উপলব্ধির তুলনা দিতে পারি না। ভালোবাসার এও এক রূপ। অখণ্ডঐশ্বর্গিক। একাকীত্বের সংজ্ঞা অন্য রকমেরও। ভয়ংকর রকম। ভয়ানক অভিশপ্ত আর বিশ্রীরকম জঘন্য। এ অসহ্যতার সীমা পরিসীমা নেই। পারিপার্শ্বিকতাকে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। পারা যায় না। শুধু আর্তের মতো বলা যায় প্রকৃতি, মুক্তি দাও। নিজেকে কি এরকম নিঃসঙ্গ ভাবা পাপ? অন্যায়, নাকি ভুল? হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে তীব্র আকাক্সক্ষা, ভালোবাসো, আমাকে ভালোবাসতে দাও; আমি মানবের, আমি প্রকৃতির, আমি চিরায়তের, আমাকে ভালোবাসতে দাও, আমি ভালোবাসতে চাই।
ভালোবাসার এই চাহিদা জীবন্ত, জান্তব, বাস্তব আর একান্ত দরকারি। নিজেকে অন্যের ভেতর বিম্বিত দেখার আনন্দ চিরায়ত। এ জন্যই তো আমরা অবমানব থেকে মানুষ হয়ে উঠতে চাই। এই চাওয়া-পাওয়ার লড়াই চিরন্তন। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিম্বিত দেখার আনন্দ অন্যরকম; আর সেই অন্যযদি হয় অনন্য’, বলা যায় ভালোবাসো। আর পাওয়াটা যদি চাওয়ার সাথে মিলে যায়, তাহলে কি আমি সার্থক? না। তারপরও বলবো হয়তো বা; কেন-না, উপলব্ধিতে আনন্দ আছে; স্পর্শে আছে সুখ। আমি কি জুঁইদিকে কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেছিলাম?


মন্তব্যসমূহ