অনূদিত অণুগল্প
গল্পকার: গ্লাদিস সেপেদা
দেশ: আর্হেন্তিনা,
ভাষা: স্প্যানিশ
কবি-পরিচিতি: নব্বই দশকের আর্হেন্তিনীয় কবি গ্লাদিস সেপেদা
মাদ্রাগোরা ছদ্মনামে স্পেনীয় সাহিত্যজগতে পরিচিত, জন্ম ১৯৬৩
সালে রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে । আজন্ম সাহিত্যই জীবনযাপন তাঁর, বিভিন্ন শিল্প
ও সাহিত্য কর্মশালার সংগঠক, কবিতাকে অডিওভিশ্যুয়াল মাধ্যমে
প্রকাশ করতে নিজের দেশে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, কবিতা ও গল্প
পাঠ করেছেন মেক্সিকো, চিলে, ইউরোপে
এবং আমন্ত্রিত কবি হিসেবে বিভিন্ন দেশের বইমেলায় ।
বিভিন্ন দেশের নতুন কবিদের কবিতা মেলে ধরেন আর্হেতিনীয় রেডিও-টিভিতে, বেশ কিছু সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদিকা এবং "লাকবেরনা"সহ তিনটি অনলাইন
পত্রিকার পরিচালিকা । পেয়েছেন আর্হেতিনার সাহিত্য পুরষ্কার আর কলম্বিয়ার সিনে পুরষ্কার ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই: আভেইয়ানেদার কবি, ঘুমাও শব্দ, শান্তির কাব্যগ্রন্হ ।
অনুবাদক: মৈনাক আদক
কারণ ( মূল গল্প: কাউসা )
"আমার দুর্ভাগ্যের উৎস কোথায়?"
- লোকটা সাপের মতো তাকিয়ে বলে উঠল।
সে জানলার ধারে দাঁড়িয়েছিল, মেয়েটার ঘাড়ে এসে পড়া লতানে মাথার এক কণ্ঠস্বর শব্দসৃষ্টিরত।
শব্দটা খুব আস্তে শোনা যাচ্ছিল।
লোকটার আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো, মাত্র কয়েক সেণ্টিমিটার দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা বলল: "ঝকঝকে চোখ আর অর্থহীন
আঁতেল মুখ নিয়ে অপাপবিদ্ধ নির্মল হতে চাওয়া,
আপনি তো সরাসরি উত্তর দিতেও জানেন না, শব্দের
খেলায় হারিয়ে যায় আসল কথাটা। যা বলতে চান, তা বলেন না।
বোঝার জন্য আপনি হাজারবার শুনুন, তারপর ভয়ডরহীন উত্তর দিন।"
আর ঝামেলা না বাড়িয়ে
লোকটা লতানেকে ধন্যবাদ দিল, অলস ভাবনায় ডুবে
যেতে যেতে জানালা বন্ধ করে দূরে সরে গেল: ছোট্ট গাছটা যেন প্রাজ্ঞ, প্রশ্নের মতোই ধারালো উত্তর দেয়।
শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে লোকটা দৃঢ় সংকল্প নিল আর কখনো
ওকে এরকম প্রশ্ন করতে আসবে না, তার চেয়ে মেনে নেবে ধাঁধাঁর
জটিলতাহীন মুক্ত মানুষ হিসেবে তার কপাললিখন, অবাধ স্বাধীনতার
যাপন...
হট্টগোল ও জানালার কাঁচ (মূল গল্প: সোনেস ই ভিদ্রিয়োস)
হৈ-হল্লার ওপর নজরদারী চালাই, ওরাও আমার পিছু পিছু আসে, কোথাও আটকাতে পারি না
ওদের, কারণ আমি জানি, ওরা আমাকে থামাতে
চায় যাতে আমি ওদের দিকে মনোযোগ দিই। কিন্তু আমি তো তা চাই না, ওরা তো আমার কেউ না,
পাশের বাড়ীর জানলায় থাকা অযাচিত হৈচৈ শুধু, সবসময় আমায় খুঁজে বেড়ায়, দুচক্ষে দেখতে পারি না
ওদের, অব্যাহতিও পাই না।
জঘন্য! ... যাচ্ছেতাই! অপমান আর ফাজলামি ছাড়াও ওরা সারাক্ষণ
ফিসফিসিয়ে কথা চালিয়ে যায়। সকাল থেকে ওদের কাজ হল অন্যদের হল্লার সঙ্গে নিজেদের হৈচৈ মেশানো বা নাক ডাকা।
রাত থেকে ওরা চরতে বেরোয় হল্লা করার জন্য, ইঞ্জিনের শব্দ, পাখার শব্দ, পাথরের শব্দ, খাড়াই বাঁধ থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ,
বকবকানি আর উচ্চগ্রামের সঙ্গীত, ফাঁকা প্লেট
থেকে পড়ন্ত মৃত ফুলের শব্দ, সোনালি খাঁচায় বন্দি শিংওয়ালা
কাল্পনিক পশুদের শব্দ, কাগজ স্পর্শ করার আগে বোলতার গুণগুণ,
কাঠ আর প্লাইউডের মেঝেয় বুটের শব্দ, বাচ্চাদের
কান্নার আর রঙিন গ্লোবের নতুন আলোর শব্দ, আকাশে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
জীবাণুর শব্দ, বহুদূরের লাইব্রেরীর প্রাচীন বই পড়ে যাওয়ার
শব্দ, এইসব আওয়াজে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যায়, ওরা বারবার আমার দুঃস্বপ্নে ফিরে আসে।
যদি সবকটাকে সাবাড় করতে পারতাম! ওরা জানলায় না থাকলে হয়তো
বিস্মৃতি আর যন্ত্রণায় মরেই যেতাম, হয়তো বেঁচে থাকতাম
আমার অন্তরাত্মার নিজস্ব শব্দমালার নৈঃশব্দে...
প্লোরুনিও ( মূল গল্প: প্লোরুনিও )
ওই তো ওখানে প্লোরুনিও।
মনে হয় এবার ওর সময় এসেছে, ওকে খুঁজে
বেড়াই আমার মননে আর সামনে। কোন্ প্রাচীন আকাশে নাক্ষত্রীয় বরফের প্রতিটা ফোঁটার হিমায়নে ব্যস্ত ছিল?
আমার তো ওকে ধরে এনে আদর করতে ইচ্ছে হয়: প্লো-রু-নিও, ও যেন আত্মহারা, ও যেন বৃদ্ধের অন্ধ চোখের মতো
ভারী যার বসবাস পার্কের বেঞ্চে। কি ভয়াবহ! বেচারার সুখ-শান্তি নেই, পুরোনো যন্ত্রণায়
ছটফট করে শুধু।
অসম্ভব স্বপ্নে কে যেন ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার অসহনীয় শর্তে হতভাগ্য
ফেলে যাওয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে যায় । তাই ও এরকম...
আমার পাঁচতলার শান্তশিষ্ট প্রতিবেশী হুয়ান ওর ওপর রাগে অগ্নিশর্মা
হয়ে ওঠে, জগতের সব খারাপ কাজে প্লোরুনিওর হাত থাকুক বা না থাকুক।
দারুণ অলৌকিক কিছু ঘটবার আশায় বাকী সবাই যখন ভাগ্যের অন্বেষণে
অন্য মহাদেশে পাড়ি দেয়, ভাবি, প্লোরুনিও
যদি সবার কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত, আসলে লোকে ওকে বুঝতেই
পারে না।
কেউ জানে না প্লোরুনিওর বসবাস নিজেরই অন্দরে
সবসময় একই মুহূর্তে ( মূল গল্প: সিয়েমপ্রে আ এস্তা ওরা
)
সবসময় একই মুহূর্তে নিজেকে ছেড়ে দিই অন্তহীন সময়ের টানাহ্যাঁচড়ার
মাঝে, অফিসের চার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত কফির চুমুকে, কম্পিউটার, ফাইল আর কাগজের তাড়ায় ন্যুব্জ অনিদ্রার
রোগী কলিগদের সামনে, সুন্দরী মেয়েটা দস্তানায় মোড়া হাত দুটো
ছড়িয়ে দেয় আমার দিকে, ওকে ছুঁতে পারতাম, হারিয়েও যেতে পারতাম অচেনা কোটি কোটি লোকের মাঝে, কিন্তু নিজেকে সংযত করি, কিন্তু আমি তো পরাজয়ের
জারকরসে অব্যর্থ পদ্ধতিতে সৃষ্ট
এক দৈবনির্দিষ্ট পুরুষ, লজ্জায়
মাথাটা নিচু হয়ে যায়, অনস্তিত্ব আর হারাকিরি খেলার গভীরতায় ডুবে যাওয়া... খেলাটা
জ্বালাতন করেই চলেছে যতক্ষণ না নশ্বর মহাসাগরে নিমজ্জিত কালের অন্ধকারে হাড়মাসে ভিজে
চুপচুপে যায় মন, জীবন আর অপেক্ষা করবে বলে মনে হয় না,
ক্ষুরের খোঁচা লাগে পিঠে, ঘাড়ের দিকে মসৃণ
গতিতে এগোয়, যেন মুক্ত রক্তবাহ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে,
কিন্তু সবটাই আসলে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তোলার রোজকার ফাঁদ, যখন ঘড়িটা জানিয়ে অফিসে বেরোবার সময় হয়েছে, যদিও
আজ অন্য কোথাও যাবো।
মন্তব্যসমূহ