ভ্রমণ ।। চলো যাই চলে যাই ।। অন্তরা চৌধুরী ।।

  
   
                             চলো যাই চলে যাই
                                  অন্তরা চৌধুরী
প্রাণের লক্ষ কক্ষে বায়ুর ভারী চাপ নিজেকে একটু ধোয়া মোছা করতে; মানে মন জানলা খুলে দে না, বাতাস লাগুক প্রাণে-সেই উদ্দেশ্যেই ভ্রমণ কিন্তু বাঁশী বাজে বন মাঝে কি মন মাঝে? যেখানেই বাজুক, জলে ভেজা মেঘ আর বৃষ্টি গায়ে মেখেই গেলাম দূরে নয়, খুব কাছের কোড়ো পাহাড়ে আশ্চর্য সুন্দর এক পাহাড় এখানে এলেই অবসাদ ভুলে মন ভরে ওঠে এক অজানা আনন্দে গ্রীষ্মটা বাদ দিলে বছরের যেকোন সময় এখানে আসা যায় বাঁকুড়ার রুক্ষ প্রকৃতিতে এক টুকরো সবুজের হাতছানি
        বড় বড় গাছে ঘেরা কোড়ো পাহাড় দীর্ঘ ইতিহাস নেই যে একডাকে সবাই চিনবে তাই পাহাড়ের প্রচারও কম, উচ্চতা আর কম এই ধরুণ মেরে কেটে চারশ ফুট পাহাড়ে ওঠার পথেই রয়েছে স্থানীয় আশ্রমিকদের তপোবন আশ্রম যা কোহিমানন্দ আশ্রম নামেও পরিচিত সেই আশ্রমের চারিদিকে অজস্র সুগন্ধী ফুলের হাতছানি উপেক্ষা করে পাহাড়ে ওঠার কষ্টটুকু করাই যায় যদিও মাঝে কোন জলসত্র নেই তাই মাঝ রাস্তায় হাঁপিয়ে গেলে কেউ জল দেবার লোকও নেই তাই হাতে একটা জলের বোতল থাকা ভাল তবে ভয় পাবার কিছু নেই, খুব একটা সময় লাগবে না পাহাড়ে যাবার এই রাস্তাটা আগে পাথরেরই ছিল, তাই অ্যাডভেঞ্চারের সেই রোমাঞ্চ কাজ করত কিন্তু ইদানিং সবাই হৃদয়ে নাম লেখার বদলে পাথরে এত বেশী করে নাম লিখতে শুরু করল যে নাম গুলো মুছেই গেল তাই রাবণ স্বর্গের সিঁড়ি তৈরী না হলেও, শুধুমাত্র আপনার ক্র্যাক ক্রিম লাগানো সুন্দর গোড়ালির কথা ভেবেই, এখানে এখন পাথরের বদলে সিমেণ্টের সিঁড়ি তৈরী হয়েছে
           নিতান্ত বেরসিক না হলে বর্ষাকালই এই প্রকৃতিকে উপভোগ করার আদর্শ সময় ঠাণ্ডা বাতাসের শীতল স্পর্শ মনকে ব্যাকুল করবেই মন্দিরের চারিদিকে আমাদের সৎ পথে চালিত করার উদ্দেশ্যে অতীতের বিখ্যাত, বর্তমানের সুখ্যাত আর ভবিষ্যতের কুখ্যাত জনেরা উপদেশ দিতে কোন কার্পণ্য করেননি কিন্তু আমাদের ঘটে ঢুকলেতো! মন্দিরের সামনেই রয়েছে নিমপাতার মতই দেখতে, কিন্তু তিক্ত ভাব বর্জিত একটি গাছ অনেকে এটিকে ঠাকুরের মাহাত্ম্য রূপে কীর্তিত করতে চান বিশ্বাস না করতেই পারেন পরিপূর্ণ আপনার স্বাধীনতা সেক্ষেত্রে আপনি দেখুন প্রকৃতি নাস্তিকতার সঙ্গে প্রকৃতির তো কোন বিরোধ নেই
       এই আনন্দে ইচ্ছে করলে টাইটানিকের জ্যাকের মত দু হাত প্রসারিত করে বলাই যায়- I am the King of the Worldওপর থেকেই দেখতে পাবেন পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শালী নদী ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ও তার রং বদলায় যদি আশ্রমিকদের কাছে রাত্রিরে থাকার সুযোগ পান, তাহলে রাতের জঙ্গল আর চাঁদনী রাতের নির্জনতা মনে থেকে যাবে চিরদিন রাতের নির্জনতায় একেবারে অন্য চেহারায় দেখতে পাবেন পাহাড়কে দূরে ঝরে পড়ছে নিয়ন আলো একেই অচেনা জনপদ তার মাঝে আপনি যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাগরিক
           কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত এই পাহাড় অজস্র সোনাঝুরি গাছে ঘেরা এই পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে পার্বতী মায়ের মন্দির মূল বিগ্রহটি অষ্টধাতুর পার্বতী থাকবে আর শিব থাকবেনা এটা হয়না তাই শিবশম্ভুও রয়েছেন বহাল তবিয়তে প্রতি বছর দুর্গা পূজা এবং শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে এখানে বিশাল মেলা বসে ও বিপুল জনসমাগম হয়
       ঘোরা তো হল এবার জঠরাগ্নি নির্বাপণের উপায়তো খুঁজতে হবে একেই পাণ্ডব বর্জিত জায়গা পকেটে টাকা থাকলেও কোন খাবারের দোকান নেই জিনিসপত্র নিয়ে এসে গায়ে গতরে খেটে, হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়াই যায়, তাতে অমৃতের স্বাদ কিন্তু চড়ুইভাতি কি কেবল দঙ্গলে হয়? জঙ্গলে একলা হয়না? হতেই পারে কিন্তু আশ্রমিকদের কাছে খাওয়ার এত ভাল ব্যাবস্থা থাকতে কেউ কষ্ট করে! পাহাড়ে সব্জী খুব একটা পাওয়া যায়না কিন্তু আগের দিন দূরভাষে একটা বলে রাখলেই ব্যাবস্থা হয়ে যায় ব্যাস! এবার – হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃশব্দ যাবার সময় মনে করে কিছু সব্জী কিনে নিয়ে গেলেই হল না নিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই তারপর শালপাতার থালায়, গোবোর গ্যাসের উনুনে তৈরী ঐ রান্না খেতে খেতে আপনার মনে হতেই পারে-যদি জোটে রোজ, বিনা পয়সায় ভোজ ফোন নাম্বারটা এই সুযোগে বরং লিখে রাখুন- ০৩২৪১-২৬৫৩৫০
         স্বাধীনতার আগে কোড়ো পাহাড় এবং তার সংলগ্ন এলাকাগুলি ছিল আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র পরবর্তীকালে বিপ্লবী অমর চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে এখানকার নাম রাখা হয়েছে অমরকানন
          বৃষ্টি নেশা ধরা সন্ধ্যা বেলায় ধূপছায়া, চুপকথা আর বেরঙ্গীন শূন্যতা নিয়ে ফিরে তো আসতেই হবে আবার নিজের ছোট্ট নীড়ে...

      



মন্তব্যসমূহ