এন্টিফিকশন : চতুর্থ কিস্তি ।। মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর ।। শিমুল মাহমুদ ।।


                       এন্টিফিকশন : চতুর্থ কিস্তি
                    মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর
                              শিমুল মাহমুদ




                                       এক 
আমার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারছি শুধুমাত্র আইডিয়ার তথ্যচিত্র অথবা ঘটনার ডিটেইলস অথবা উপস্থাপনার ঐক্যরীতিই এন্টিফিকশনের অপরিহার্য কৃৎকৌশল নয় অর্থাৎ কথাসাহিত্যের জন্য শুধুমাত্র প্রচলিত কৌশলগুলোই ক্রিয়াশীল নয় বরং গোষ্ঠী-অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আইডিয়ার তথ্যচিত্র, ঘটনার ডিটেইলস ও উপস্থাপনার ঐক্যরীতি নয় বরং অসমতা, এই তিনটি বিষয়ের বিষম-ব্যবহার কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে কিন্তু সেই সাথে এন্টিফিকশনের জন্য প্রয়োজন প্রকাশযোগ্য ক্রাইসেসের একটি নান্দনিক উপস্থাপন এক্ষেত্রে পয়েন্ট অব ভিউ থাকতে পারে আড়ালে; তারপরও এই জায়গাটা লেখকের কাছে পরিষ্কার থাকা জরুরি অনেকেই এ জায়গাটি নিজের ভেতরে পরিষ্কার বা চিহ্নিত না করেই লিখতে শুরু করেন এবং ভাবেন যে লেখাই তাকে টেনে নিয়ে যাবে কোন একটা ক্রাইসেসের দিকে; হ্যাঁ এভাবে লেখা যেতে পারে তবে মনে রাখতে হবে, এভাবে লিখতে লিখতে লেখক এক সময় অভিজ্ঞতা প্রকাশের পয়েন্ট অব ভিউ চিহ্নিত করে ফেলেন এভাবে পয়েন্ট অব ভিউ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে পারে ডিটেইলসে; যদি প্রয়োজন হয় তবেই তা না হলে শুধুমাত্র সিম্বল আর ইঙ্গিতের মাধ্যমেও এন্টিফিকশনের মোক্ষম মেসেজটিকে পাঠকের মগজে গেঁথে দেওয়া সম্ভব

এক্ষেত্রে আমি গোষ্ঠী-অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে শুরু করেছি ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে সেভাবে এন্টিফিকশনের ক্ষেত্রেও খুব বেশি দরকার, ‘ল অব কনজারভেশন অব মরাল ভ্যালু’ অর্থাৎ ‘নৈতিক-মানের সংরক্ষিত-বিধান’; যা কখনই ন্যাচার, প্রকৃতি বা চিরায়তের বিপরীতে দাঁড়াতে পারে না অথচ সভ্যতার জন্ম দিতে গিয়ে আমরা ক্রমশ ‘মরাল ভ্যালু’র বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রাত্যহিক এবং চিরায়ত বিপর্যয়কে আমাদের সাথে জড়িয়ে নিতে শুরু করেছি আমরা তো ‘মরাল ভ্যালু’কে সেই অবন্তীধামে বসবাসরত ব্রাহ্মণের মতো সন্তান-পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে পরিত্যাগ করেছি আমরা আমাদের মরাল ভ্যালুকে নির্লজ্জেও মতো পরিত্যাগ করেছি, আমাদের পরিত্যাগকৃত বিগত শতাব্দীর গহ্বরে তারপরও বাঙালিত্বের মানবিক তাড়নায় আমরা কেউ কেউ কামনা করি, ‘সমুদ্র যাদের পতি, সমুদ্ররাজের যারা পত্নী, এরূপ নদীসকল, তোমরা আমাদের রোগনিবর্তক ঔষধ দাও, যার দ্বারা আমরা রোগমুক্ত হয়ে অন্নপানাদি বলকর বস্তু ভোগ করতে পারি’ (অথর্ববেদ : ষষ্ঠ কান্ড, ৩য় অনুবাক, ২য় সূক্ত)

আমাদের ভেতর যখন এমনতর কামনা, এমনতম বাসনা জেগে উঠতে থাকে তখন আহমদ রফিক এর মতো আমার ভেতরও প্রশ্ন ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে,
ক. সত্যিই কি ‘মাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তির খেয়াল-খুশিতে ভারতের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল’?
খ. ‘অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা, স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতাগণ কেন শেষপর্যন্ত ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদের বিনিময়ে ক্ষমতা হাতে নিতে রাজি হয়েছিলেন?
গ. ‘‘পাথুরে ব্যক্তিত্বের জিন্না কেন তার ভাষায় ‘পোকায় খাওয়া পাকিস্তান’ নিয়ে ময়দান ছেড়ে গেলেন?’’--- অথচ মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও বৃটিশ-রাজ এই তিনের থাবা থেকে, এই ত্রিশক্তির ভেতর সেরা নায়ক শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন এর থাবা থেকে ‘ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় জিন্নার জেদ সত্ত্বেও দেশবিভাগ এড়ানো সম্ভব এমন মতামত প্রকাশ করেছিলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ’ অথচ অবশেষে আমরা পেয়েছি ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ আর ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ অর্থাৎ হিন্দু-আইডেনটিটি এবং মুসলিম-আইডেনটিটি
বিনিময়ে আমরা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি মানুষের আইডেনটিটি, বাঙালির আইডেনটিটি বিনিময়ে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় আমার শৈশবের আলমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় আমার বন্ধু হরিহর, রবিন, শংকর, ঘোষ অথবা বসিরকে তখনও আমাদের বাল্যকাল, বাল্যশিক্ষা-পাঠ, বাল্য-বিদ্যালয় সরকারি হয়ে ওঠেনি তখনও তা পাইলট প্রোজেক্ট এর আওতায় আসেনি কেন-না এর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল বাহ্মণকন্যা পাকিস্তানকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা জিন্নার পোকায় খাওয়া পাকিস্তানের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালিরা ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছে মুসলিম-আইডেনটিটি-র বিষাক্ত বাস্তবতা অনিবার্য এবং দ্রুত গতিতে সামনে এসে হাজির হলো জাতিগত আইডেনটিটি এবং ধর্মীয় আইডেনটিটি তখন আমাদের অনিবার্য অথচ চিরায়ত পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে, বাঙালি হিসেবে আমরা কতটা মানবিক অথচ লড়াকু?

          তখনও স্কুল খোলা আছে গলার ভেতর একটা আতঙ্ক নিয়ে স্কুলটা কেবলই ঝিম মেরে বসে থাকে দুপুরের পর পরই স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমি রেল লাইন ধরে চলে যাই চিরতরে উড়ে যাওয়া ১৯৪৬টি পায়রার খোঁজে রেললাইন শেষ হয় না আমি কেবলই হাঁটতে থাকি অনেক উঁচু রেললাইনটা থেকে নামতে শুরু করি পাথর বাঁচিয়ে নামি নেমে এসে রেল লাইনের নীচ দিয়ে যে খোয়া বিছানো রাস্তাটা চলে গেছে, সেই টানেলের ভেতর ঢুকে গুমগুম শব্দে শিহরিত হই টানেলের ওপর রেলপথ টানেলের ওপর একটা তরতাজা লোহালক্করের লাল রেলগাড়ি ছুটে যাচ্ছে চোখ বন্ধ করি মাথার ভেতর রেলগাড়িটা একটা যান্ত্রিক ঝড় তুলে কেবলই ধেয়ে আসতে থাকে যেন বা খানিকটা ভয় পাই রেল লাইনের সুরঙ্গটা হয়তো এখনই মাথার ওপর ভেঙে পড়বে দ্রুত টানেলের নীচ থেকে খোলা আকাশের নীচে বের হয়ে আসি

ঘোষপাড়ার কাছাকাছি আসার পর জি.কে. ক্যানেলের পাড় ঘেঁষে হাঁটতে থাকি ভেসে আসছে ঝাঁকঝাঁক নূপুরের শব্দ মাথার ওপর, অনেক ওপরে হালকা নীল আকাশে আমাদের কবুতর ঝাঁক বেঁধে উড়ছে ওদের কারও কারও পায়ে নূপুর বেঁধে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি কেন যেন মনে হল, পায়রাগুলোকে এখন আর শিকল দিয়েও কাছে রাখা সম্ভব না আকাশের শূন্যতায় ভাসতে থাকা কবুতরের ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকি ওরা চলে যাচ্ছে সীমানা পাড়ি দিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে; ভাসতে থাকা রিফিউজির মত আমার জানা নেই কী সেই সীমানা, আর কত দূরই বা সেই সীমানা আমার চোখে চন্দ্রবিন্দু ফোটায় জল ভেসে ওঠে তারপর খুব সংগোপনে সেই জল গড়িয়ে নামে মথুরাপুরের কেউ সেদিন সেই জল দেখতে পায়নি

কুমারপাড়াটা উঠে গেছে এখন মাত্র দু’ঘর আছে ওরা কুমার পাড়াটাকে প্রথমে চিনতে পারলাম না ননী খুড়োকে দেখে বুকের ভেতরটায় একটা চাপ অনুভব করলাম ননী খুড়ো আমাকে চিনতে পারছে না মাটির দলা মাখাচ্ছে দু’হাতে পাড়াময় সারিসারি শুকোতে দেওয়া ফুলের টব, কলস, হাড়ি, সানকি, পয়সা রাখার মাটির ব্যাংকের ছায়া দেখার পিপাসায় কেবলি ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছি; না সব কিছু কী এক অদৃশ্য মায়াবলে উবে গেছে শিবানীর কথা মনে পড়লো মেয়েটা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে যেত মা’র সাথে সারাদিন টুকিটাকি কাজ শেষে সন্ধ্যায় কুমারপাড়ায় ফিরে আসতো শিবানীদের ঘর দুটো ঠিক কোন জায়গায় ছিল বুঝে উঠতে পারি না ননী খুড়োর কাছে গিয়ে বসি ননী খুড়োর ঘঁষা খাওয়া ঝাপসা চোখ একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাটি ছেনার কাজে মন দেয় ননী খুড়ো সত্যি সত্যি আমাকে চিনতে পারলো না!

পরিচয়-সংকটে কেঁপে উঠি কেন আমার ঠাকুরদাকে প্রতিবেশী ননী খুড়োদের কুমারপাড়াকে অস্বীকার করে চলে যেতে হয়েছিল? হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেবার পিপাসায় তাকিয়ে থাকি ননী খুড়োর কাদাছেনা আঙুলের দিকে যেন বা গতজন্মে ছুঁয়েছিলাম কোন এক ননী খুড়োর মিঠাইজড়ানো আঙুল
স্বপ্নে যে অন্ন আমি আহার করি, প্রাতঃকালে তা দেখি না যেহেতু স্বপ্নদৃষ্ট অন্ন প্রভাতে দেখা যায় না, সেহেতু স্বপ্নে অন্নভোজনরূপ আহারাদি আমার মঙ্গলকারী হোক স্বপ্নে অন্নভোজনের দ্বারা আমার যে পাপ হয়েছে, তা এ মন্ত্রজপে উপশম হোক, কল্যাণকর হোক পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও মৃত্যুকে সালাম জানিয়ে পরলোকে যেতে চাই না; এখানেই চিরকাল অবস্থান করব আমি পৃথিবী ও অন্তরিক্ষের দেবতা, হে অগ্নি, ওহে বায়ু, শক্তির উৎস সূর্য, রূপান্তরের আধার হে মৃত্যু তোমরা আমাকে হিংসা করো না; চিরায়ত ইহলোকে আমাকে রাখো (অথর্ববেদ : ৭ম কান্ড, ৯ম অনুবাক,২য় সূক্ত)

তারপর কী এক চিরায়ত মোহে আমি আবারো ফিরতে থাকি ইহলোকের দিকে ফিরতে ফিরতে একেবারে ননী খুড়োর সাথে আরও কতটা বছর পিছে ফিরে যাই, সে হিসেব আজ অর্থহীন ননী খুড়োর সাথে হাঁটছি আমি খুড়োর দুটো ভার ভর্তি মাটির পুতুল, পয়সা রাখার ব্যাংক, ছোটবড় ঠাকুরমূর্তি, গণেশ, গরুর পাখির ডানামেলা ভীষণ চেহারা ননী খুড়োর সাথে বসে আছি আমি রথের মেলায় ননী খুড়ো আমাকে বসিয়ে রেখে মেলার ভেতরে হারিয়ে গেল আমাকে সবাই পুতুলের দাম জিজ্ঞেস করছে লজ্জায় কথা বলতে পারি না কীভাবে যেনো এক পয়সায় এক জোড়া মাটির দোয়েল বিক্রি করে ননী খুড়োর অপেক্ষায় থাকি মেজো কাকা দেখে ফেলে টানতে টানতে মেলার দক্ষিণ মাথায় নিয়ে নাগরদোলাতে বসিয়ে দেয় নাগরদোলা ঘুরছে আর ক্রমাগত পৃথিবীটা ওলট পালট হচ্ছে ক্রমশ সব কিছু অপরিচিত তলপেটের নীচে সুরসুরি পেশাবের বেগ পাচ্ছে চরকিটা ক্রমাগত ঘুড়েই চলেছে চরকির প্রতিটি বাক্সে বসা ছেলেমেয়েরা সবাই চিৎকার করে হাসছে যেন বা খানিকটা কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছি এবারের চক্করে আমি আর পেশাব ধরে রাখতে পারি না কেঁদে ফেলি, লজ্জাহীন, ঘূর্ণনরত ধীরে ধীরে নাগরদোলার গতি কমে আসছে ননী খুড়োর পাখি বেঁচা এক পয়সা চরকির চক্করে হারিয়ে ফেলেছি ভেজা প্যান্ট নিয়ে দৌড়াতে থাকি কেবলই দৌড়াতে থাকি সবাই বুঝে ওঠার আগেই আমাকে সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে সেই থেকে যেন সারাটা জীবন কেবলই আড়াল হতে থাকি; অপবিত্র জল গোপন করার মোহে কেবলই আড়াল হতে থাকি

আমি আর কোন দিনই ননী খুড়োকে সেই হারিয়ে ফেলা পয়সার কথা বলতে পারে নি আজ এত দিন পর আমার ভেতর সেই পয়সা হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা যেন নতুন করে জেগে উঠতে শুরু করেছে একটা অপরাধবোধ, এত বছর পর আবারও যেনো সেই অপরাধবোধ আমার সমস্ত দেহজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দেহের সমস্ত আলো যেন কেবলই ম্লান হতে থাকে ননী খুড়োকে এক বার ডাকলাম খুড়ো শুনতে পেল না একটা কুকুর ননী খুড়োর দিকে মুখ করে লেজ গুটিয়ে বসে আছে কেন যেন আমার নিজেকে ঐ ময়লা নেরি কুত্তাটার মত মনে হল এই ঠাকুরদার মাটি, এই গোটা মথুরাপুরের ওপর আমার কোন অধিকার নেই মাথাভাঙার মরা জলে শামুকেরা পিঠ শুকোয়, আমার কোন অধিকার নেই সেদিকে তাকানোর

ঘা পচা কুত্তাটার মতো আমি আস্তে আস্তে উঠে আসি তারপর ফিরতে থাকি শিমুলের বড় খালার বাসায় অথচ শিমুলরা আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না আলমডাঙার কেউ না; বাজিতপুরের কেউ না; মথুরাপুরের কেউ না তারপরও শিমুলকে ভালোবাসি আমার সাথে শিমুলের চেহারার কোথায় যেন এক ধরনের মিল আছে শিমুল আমার মতো লম্বা নয় চিকন নাকের সাথে গায়ের রঙ আর চোখের আবেদনটা কীভাবে যেন বেশ মিলে গিয়েছে আমাদের শিমুলের সাথে পরিচয় কলকাতায় রিপন স্ট্রিটে থাকি আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে দেড়খোপের দুইটা ঘর নিয়েছি শিমুল বাংলাদেশের আলমডাঙা থেকে নাটক নিয়ে কাজ করতে এসেছে কলকাতায় সিরাজ ফোক নিয়ে কাজ করছে প্রণব ফাইন আর্টে তিনটা বছর পার করে দিয়েছে আর ভবঘুরে কাজল সল্টলেকে ধরা খেয়েছে বিয়ে করে ফেলেছে তমা দাসকে তমা দাসকে ভালো লাগেনি আমার বর্ধমানের অ-ালে ওদের আদি বাস তমালিকা দাসকে ভালো না লাগলেও ওদেরকে আমি অস্বীকার করতে পারি না অথচ একমাত্র শিমুল ছাড়া ওরা আর একজনও আমার আলমডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেউ না বাজিতপুরের কেউ না সেই ফেলে আসা বালকবেলার আলমডাঙার আকাশ একমাত্র শিমুল ছাড়া ওরা আর কেউ দেখেনি ভূতগ্রস্তের মতো শিমুলের সাথে লেগে আছি আমি কেবলই মনে হতে থাকে শিমুলের শরীরে আলমডাঙার গন্ধ লেগে আছে; আলমডাঙার বাতাস জড়িয়ে আছে কুমারের জলে শিমুল স্নান করেছে শিমুলের ভেতরে আমি যেন কেবলই সেই সোনাপট্টি, রাণীর গলি, কেশবপুর, কেষ্টপুর, বাজিতপুর, মথুরাপুর অথবা আমার সেই হারিয়ে যাওয়া আলমডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছবি দেখতে পাই তারপর মথুরাপুরের সেই ভয়ানক ঘটনাটা, যা ভুলবার জন্য ঠাকুরদাকে স্বর্গে যেতে হয়েছিল, সেই ঘটনারও বিশ বছর পর আবার আলমডাঙার মাটিতে পা রাখলাম আমি; অথচ এই মাটি এখন আর আমার দেশ নয় আমি এখন আগুন্তুক মাত্র ভিনদেশি; পাসপোর্ট বহনকারী অবান্তর মানব

আলমডাঙার বটতলাটাকে চিনতে পারলাম না কোথাও কোন বটগাছ খুঁজে পেলাম না বটতলা নেই; বটতলাকে ঘিরে সেই প্রাত্যহিক বাজার তেলেভাজা; বাদাম; ঘুগনি; নোকনদানা; টিনের বাঁশি, টিনের গাড়ি আর চেনামুখ ভেসে উঠতে শুরু করেছে আমার মগজে; ইতোমধ্যে আমার মগজ পিছিয়ে গিয়েছে আমি খুঁজতে শুরু করেছি আমার প্রাইমারি স্কুল পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে যখন আলমডাঙা সরকারি পাইলট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় ঢুকে গেলাম তখন গল্পকার পিন্টু রহমানের বন্ধু হারেস উদ্দিন যে কিনা এখন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক, অমায়িক, বন্ধুসুলভ, সমাজমনস্ক অথচ গোপনচারী; শিশুঅন্তপ্রাণ; তাঁর স্বপ্ন এক একজন শিশুকে চেঁচেছিলে মানুষের মূর্তিতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখানো; সেই হারেস উদ্দিনের কক্ষে বসে যখন কেবলি ডুবে যেতে শুরু করেছি অতীতে তখন হারেসের কণ্ঠে প্রকাশ পায়, আপনি ঠিক যে জায়গাটিতে এখন বসে আছেন ঠিক এখানেই ছিল আমাদের সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ যা পঁচাত্তরের পর ঝড়ে ভেঙে গেলে দীর্ঘদিন পর গত বছর সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের প্রাচীন শেকড়ের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই একতলা ভবন

এই শহরে একজন বর্ষীয়ান পুরুষ আছেন; তাঁর মুখে শোনা যায় ইউনুস নবীর গল্প, উজান-ভাটির গল্প অথবা শেখ মুজিবের গল্প একদা এক সময় এই শহরে কিছু সুখি মানুষ ছিলো অথবা ছিলো কিছু সুখি বৃক্ষ; পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর আমরা কেউ আর খুঁজে পাইনি তাঁদের
মুহূর্তে আমার ভেতর এক ধরনের অন্ধকার-ভয় অথবা বলা চলে দলা-পাকানো-কম্পন জেগে ওঠে, বটবৃক্ষের শেকড় উপড়ে ফেলে শিক্ষা! অতীত হারানোর যন্ত্রণায়, শেকড়হীনতার ভয়ে, মুহূর্তে সবকিছু তছনছ, আমি কি আমাদের অতীত অস্বীকার করে সীমানা ছেড়ে চলে যাচ্ছি? যেখানে কোনও রাজা অথবা রাস্ট্র নেই তখনও গড়িয়ে নামছে পাথর পাহাড়ের চুড়া থেকে খুঁজছিলাম রাস্ট্রবিহীন মাটি; অথবা দাঁড়াবার মত একখানা সমর্থ পাথর

মুহূর্তেই আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশের ভেতর নেমে এসেছিলো সেইদিন এক অশুভ অন্ধকার; আমরা নীরবে ভারতীয় ফল সহযোগে সেইদিন আলমডাঙার যোগেশঘোষের মিষ্টান্নে মনোযোগ দিলে একটা প্রাচীন পেঁচা সেই ভর দিনের বেলা ঠিক কোথা থেকে যে ডেকে উঠেছিল আমরা কেউই ঠিক বুঝে উঠতে না পারলে আমাদের অনেকেরই সেইদিন সন্ধ্যায় বমির উদ্রেক হয়েছিল আমার শরীরে তখন তাপমাত্রা কিঞ্চিত বেশি বোধ হলে আমি অবাক বিস্ময়ে আমার হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম; এক দুই তিন চার, ঠিক কত সময় বলতে পারবো না শুধু এতটুকুই বলতে পারি সেইদিন আমার ডানহাতের তালুতে একটা পরিষ্কার ফোসকা ফুটে উঠে তা ক্রমশ পোড়া দাগে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল

বাঁশের কাজ করতো যারা তাদের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না বাঁশের কুলো, ডালা, ঝাকা, চাটাই আর পাখি রাখা খাঁচা; না কিছুই দরকার হয় না এখনকার মানুষের ওরা থাকতো চাটাইয়ের নীচে ছোটছোট খুপড়ির ভেতর লাল রঙে ওদের মুখ হাত যেন সব সময় কথা বলতো সেই রঙ দিয়ে ওরা সাজাতো ওদের হাতের তৈরি বাঁশের তৈজসপত্র কাঁচা বাঁশের চিকন ছিলানো বাতার ওপর থাকতো লাল টকটকে রঙ আর গভীর সবুজ রঙ ওদের মধ্যে সাত আট জনের একটা দল ছিল ওরা সরু সরু বাঁশের আগায় একের পর এক বাঁশ লাগিয়ে, সেই প্রায় পনেরো বিশ হাত লম্বা জোড়া দেওয়া বাঁশের আগায় যে আঠা লেগে থাকতো তা দিয়ে টিয়ে পাখি ধরতো রঙহীন কাঁচা বাঁশের খাঁচায় সবুজ পাখিগুলো কেবলি চেঁচাতো ওদের সাথে একবার সারাদিন আমি টিয়ে ধরার নেশায় হারিয়েছিলাম আমাকে একটা খাঁচাসহ টিয়ে দিয়েছিল ওরা আজ এত বছর পর যেন সেই সবুজ টিয়ে খুঁজতে শুরু করেছি আবার কেবলই খুঁজতে থাকি কোথাও টিয়ে নেই, চারিধার শুধুই মানুষ

বুকের ভেতর তস্কর বখতিয়ার, ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির এগারোজন অশ্বারোহী লাথি মারছে; তুর্কি লাথি এখনই হয়তো খুব পরিচিত কারও সাথে দেখা হয়ে যাবে পাবো, পরিচিত কাউকে পেয়ে যাবো এখনই একটা লক্করমার্কা বাস এসে থামলো বাসটা চুয়াডাঙ্গার দিকে যাবে কিছুই মেলাতে পারছি না একটু পর বুঝতে পারলাম ঠাকুরদার আমলে এই রাস্তায় মটর চলতো না খোয়া বিছানো রাস্তাটা এখন পাকা হয়েছে কোথাও কোন গরুর গাড়ি অথবা ঘোড়ার গাড়ির বিশাল গোলাকৃতি লোহার পাতে মোড়ানো কাঠের চাকার দাগ নেই আমার ভেতরটা সেই পুরোন দাগগুলো ফিরে পাবার জন্য কেবলই শুকিয়ে যেতে থাকে

রায়বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়টাকে খুঁজে পাচ্ছি না টিনের ঘরের চালগুলো খুলে নিয়ে গিয়েছে মেঝে জুড়ে উঁয়ের ঢিবি সামনের হলুদ দালান প্রাথমিক বিদ্যালয়টাকে আড়াল করেছে কেন যেন ওরা সব কিছু¦ই ঢাকতে চায় কোন চিহ্নই রাখতে চায় না শিমুলের হাত চেপে ধরি ভেতরটা ভারি হয়ে আসে তেষ্টা পায় সোনাপট্টির পেছনের সারিতে যেখানে মারোয়াড়ি পট্টি ছিল সে জায়গাটা তেমনি আছে পুরোন বিশাল বিশাল দালানের কুঠুরিতে এখনও বেচাকেনা চলছে মানুষের শোরগোল সবই আছে অথচ প্রতিটা মানুষ অচেনা অরুণদের তিনতলা মন্দিরের মত বাড়িটা চিনতে কষ্ট হল না অরুণকে বেশ কয়েক বার নিজেদের খোপ থেকে পাহাড়ি কবুতর চুরি করে এনে দিতাম প্রতি বারই কবুতরগুলো উড়ে উড়ে আমাদের বাড়িতে চলে যেত

স্টেশনের পেছনে মেথর পট্টিটাকে ঠিকই চিনতে পারলাম সব ঠিক আছে মেথরপট্টিগুলো সহসা বদলায় না মেথরপট্টির পর শুরু হয়েছে রেলওয়ে কলোনি কলোনিটা ডানে রেখে বিহারীপাড়ার সামনে এসে অর্থহীন দাঁড়িয়ে আছি সহসা হাঁটতে হাঁটতে কোন কিছু না ভেবেই নুসরাতদের বাড়িটা খুঁজে বের করলাম নুসরাতের মামা সাইকেল নিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল বিহারীপট্টির প্রায় সবাই রেলওয়েতে চাকরি করে দেলোয়ার মামা তখন লাইনম্যান এখন কী অবস্থা জানি না শুধু জানি দেলোয়ার মামাকে আমি ভয় পাই দেলোয়ার মামা হয়তো আমাকে চিনে ফেলবে বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছে মাথার মধ্যে সেই শালা মালাউনের বাচ্চা আওয়াজটা এত বছর পরও আবার কামড়াতে শুরু করেছে দ্রুত ফিরে আসতে থাকি পেছনে আরও পেছনে, যেখানে ভিটে হারানোর শব্দ কেবলই গর্জে ওঠে আমি কি সবকিছু মুছে ফেলতে চাই?

আলমডাঙ্গা গার্লস হাইস্কুল পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত ছেলেমেয়ে এক সাথে নুসরাতের সাথে পাঁচ ক্লাশ পর্যন্ত আমিও এক সাথেই পড়েছি নুসরাতের খালা আমাকে নিজের ছেলে বানিয়েছিল শৈশব বেড়ে ওঠে পাখিদের ভালোবাসায় পাখিরা গান গায় আমার গলায় গান ফুটতে চায় না কোন এক হেমন্তের রাতে নুসরাতদের বাড়ির উঠোনে কাওয়ালির আসর বসে প্রথমে দূর্গাপিসির কোল ঘেঁষে বসলেও কোন এক ফাঁকে ফিরে গিয়েছিলাম নুসরাতের খালার কাছে, নুসরাতের কাছে কোন এক দিন নুসরাত টিফিন পিরিয়ডে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল স্কুলে উর্মিলা আপা আমার সাথে নুসরাতকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল আমি ঠিক বুঝতে পারি না নুসরাত কেন ছুটি নিল ওর তলপেটে ব্যথা নুসরাত মুখ টিপে হাসছে আমি বেটাছেলে বেটাছেলেদের নাকি ওসব পেটব্যথার কথা শুনতে নেই মনে মনে ঠিক করি, রাতে দূর্গাপিসির কাছে ঠিকই শুনে নেব, মেয়েদের তলপেটে ব্যথা হলে ছেলেদের তা শোনা নিষেধ কেন

নুসরাত আমার হাতটা ঠেসে ধরে হেসে ফেলি আমি অনেক জল্পনা কল্পনার পর দুপুরে যখন আমরা অরুণদের বাড়ি পৌঁছাই তখনও অরুণ স্কুল থেকে ফেরেনি অরুণ আমাদের থেকে দুই ক্লাশ ওপরে, পাইলট হাইস্কুলে পড়ে অরুণের দিদি ওদেরকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে ঘটি ভরে জল এনে দেয় অরুণরা মারোয়াড়িদের মধ্যে নামকরা কাপড়ের ব্যবসায়ি অরুণ স্কুল থেকে ফিরে এলে বারান্দায় মাদুর পেতে আমরা খেতে বসি খাওয়া শেষে চিলেকোঠায় গিয়ে সাপলুডু খেলার আয়োজনে মেতে উঠি অরুণকে বারবার সাপে কাটতে থাকলে অরুণ বিরক্ত হয়ে সব গুটি এলোমেলো করে দেয় তারপর আমাদেরকে ওর পায়রাগুলো দেখাতে থাকে অরুণের খুব দুঃখ, ওর মাত্র পাঁচ জোড়া কবুতর এক জোড়া চোখ না ফোটা বাচ্চাও আছে বাচ্চা জোড়া চিঁ চিঁ শব্দে ছোট ছোট পশম না ওঠা ডানাজোড়া নাড়াচ্ছে ওর মা এসে বাচ্চাটার ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়ে দানা উগলে দিল বাবা পায়রাটা দুহাত দূরে কেবলি বাকবাকুম ডাকে পড়ন্ত দুপুরকে কাঁপাতে থাকলো নীচ থেকে ভেসে আসছে তবলা হারমনিয়াম আর নুপূরের ঝাঁকবাঁধা আওয়াজ পড়ন্ত দুপুরটা যেনো একটা জীবন্ত স্টিমারের মত কেবলই দুলে দুলে ওঠে

দলটার মধ্যে বেটাছেলের মত দুজন তবলায় তাল দিচ্ছে আর ঘাগড়া পড়া শ্যামলা মেয়েটা হারমনিয়ামের সামনে বসে কেবলই দুলে দুলে হারমনিয়ামের বাজনার চেয়ে আরও খানিকটা উচ্চস্বরে হিন্দি গান গাইছে বুঝে উঠতে পারি না, হয়তো বা এই ধরনের গানকেই কাওয়ালি বলে, গজলও হতে পারে আমাকে ওরা যেন জাদু করতে শুরু করেছে ওদের বিচিত্র পোশাক দেখে কেবলই মনে হতে থাকে এরা ঠিক ছিনেমা থেকে এসেছে যে মেয়ে দুটি নাচছে ওদের বুকের ব্লাউজ সোনালি আর রূপোলি রঙে জ্বলে জ্বলে উঠছে মেয়ে দুটো কোমর বাঁকাতে বাঁকাতে মেঝেতে শুয়ে মাজা দোলাতে লাগলো আমার চোখ লজ্জায় লাল হয়ে এলো তারপর গানের সুরটা আরেকটু চড়ে যেতেই ছিপছিপে লম্বা নাক উঁচু মেয়েটি আমার একেবারে সামনে এসে মেঝেতে ঝুঁকে বুকজোড়াকে দ্রুত ওঠানামা করাতে শুরু করলো নুসরাত লজ্জায় আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গিয়ে অরুণের ছোটবোন বীণার আড়াল নিল

বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছে হিজরাদের নাচ গান যেন আরও ঘন আরও জোরালো হয়ে উঠতে থাকে আমার পিঠে নুসরাত ছোট্ট একটা ধাক্কা দিল তারপর জামা ধরে টান দিতেই আমি চোখ ভর্তি হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকালাম আমার একটা হাত ধরে কাউকে কিছু না বলেই নুসরাত রাস্তায় এসে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসে দেরি হওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেছে নুসরাত ওর হাত ঘামছে নুসরাতের একটা হাত আমি মুঠোয় নিয়ে বসে আছি ঘোড়াদুটো ঢিলে তালে হাঁটছে নুসরাত ফিসফিস করে বললো, গাড়োয়ানটা বিহারীপাড়ায় থাকে চমকে উঠি বিহারী গাড়োয়ান যদি নুসরাতের মামাকে বলে দেয়, স্কুল পালিয়ে আমরা সারাদিন একসাথে ছিলাম! আমার ভেতরটা কেবলই মোচরাতে থাকে নুসরাত আমার জন্য আজ বকা খাবে ওর মা বেশ বদমেজাজি গায়েও হাত তুলতে পারে

আমি নুসরাতের হাত চেপে ধরতেই নুসরাত স্টেশনের মোড়ে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল অনেকটা সময় ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি এক সময় ধীর পায়ে কদম গাছটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বানর খেলা দেখতে শুরু করি বড় বানরটা জামাই সেজেছে রাগ করে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে ওর বউ গালে হাত দিয়ে কেবলি কাঁদছে আমি ঠাই তাকিয়ে থাকলেও আমার মনটা আর কিছুতেই ভালো হতে চায় না

আজকে স্কুলে বিলাতি দুধ দেওয়ার কথা ছিল শেষ পিরিয়ড পর্যন্ত স্কুলে থাকলে পাওয়া যেত বানর খেলা দেখাচ্ছে যে বুড়োটা, ওকে বিলেতি দুধগুলো দেওয়া যেত বানরকে খাওয়াতে পারতো পরমুহূর্তেই সন্দেহ হল, বানর কি বিলেতি দুধ খায়? তারপর চারিদিকে তাকিয়ে প্রতিটি মানুষকে আমার কাছে কেবলই বানরের মতো বলে মনে হতে লাগলো হঠাৎই বড় বানরটা ওর লাল টকটকে পাছাটা নাচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো মুহূর্তেই আমার দিকে তাকিয়ে ভিড়ের সমস্ত বানরমুখি মানুষগুলো উচ্চস্বরে হেসে উঠলে আমি লজ্জায় ভিড় ঠেলে বাইরে চলে আসি কেবলি মনে হতে থাকে, আমাকে কেউ পছন্দ করে না পৃথিবীর সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে নিজেকে ভয়ানক একা মনে হয়

কালিমন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় মেজো কাকার কাছে ধরা পড়ে গেলাম মেজো কাকা আমার হাতের বই খাতার দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না ভেতরে একটা চাপা অস্থিরতা আমাকে শিগ্রি বাড়ি যেতে বলে বাজারের দিকে চলে গেল বড় রাস্তার ওপর মানুষের ঢেউ এগিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না তাকিয়ে থাকি তারপর লম্বা মাঝারি তলোয়ার আর তেল চকচকে লাঠি হাতে জিন্নাহ টুপি মাথায় ২০/২৫ জনের একটা দলকে উত্তমদের দোকানের গলিটার মধ্যে ঢুকে যেতে দেখলাম ওদের মধ্যে মনে হল দেলোয়ার মামাও আছে নুসরাতের মামার হাতে ন্যাংটা একটা লম্বা রামদা কেবলই আকাশের শূন্যতায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে

বাজারের দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসছে ভয়ানক শোরগোল রামমন্দির থেকে অনেকগুলো ঘণ্টা একত্রে একটা আতঙ্ক নিয়ে বেজে উঠলো গঙ্গাদের পাড়া থেকে শঙ্খধ্বনির আওয়াজ ভয়ে ভয়ে দু’একবার বেজে আবার একটানা চিৎকার করে উঠতে লাগলো আমি প্রথমে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলেও কী একটা ভয়ানক আতঙ্কে দ্রুত বাড়িতে ফিরে এলাম বাড়ি ফিরে দেখি দূর্গাপিসি ঠাকুরদার মাথায় জল ঢালছে ঠাকুরদাকে ঘিরে ভিড় তারাপিসির সাথে কাকিমাও কী সব বকে যাচ্ছে আর সুর করে কেঁদে উঠছে দিদিমা গোবর লেপা তুলসি গাছটার নীচে উপুড় হয়ে রামনাম জপতে জপতে ভগবানের কাছে কেবলই নালিশ জানাতে থাকে দূর্গার মুখটা থমথমে উঠোন জুড়ে ভিড় আমার শরীরে একটা অপরিচিত ভয়ের শিহরণ বয়ে যায়

অনেক রাতে যখন গোটা মথুরাপুর একটা আতঙ্কে কেবলি ঝিমোচ্ছে তখন আমি দূর্গার কোলের ভেতর কেবলি গুটিয়ে যেতে থাকি মনে হল ওর দূর্গাপিসি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে দূর্গাপিসিকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বুঝতে পারি ঠাকুরদার গদিঘর লুট হওয়ার ঘটনাটার সাথে একটা ভয়ানক কিছু জড়িয়ে আছে সেই ভয়ানক কিছুর জন্যই আমাদের বাড়িতে আজ রাতে রান্না হয়নি আমরা কেউ যেন আর কোন দিন ঘুমাবো না সবাই কী এক আতঙ্কে চুপচাপ শুধু শুয়েই থাকবো আমি দূর্গাপিসির চোখের নীচে জমে ওঠা জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে নিজেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি দূর্গা আমাকে বুকের আরও গভীরে টেনে নিল

পর দিন সকালে নুসরাতের খবর নিতে গেলাম কেবলই মনে হতে থাকে, ডাকাতগুলো নিশ্চয়ই নুসরাতদের বাড়িতেও হামলা করেছিল রাতে কী এক গোপন লজ্জায় আমি দূর্গাপিসিকে তা বলতে পারিনি বিহারী পাড়াতে ঢুকতেই তিন চার জনের একটা দল এগিয়ে এসে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো ছেলেগুলোর কেবলই গোফ উঠতে শুরু করেছে ওদের মধ্যে এক জনকে চিনতে পারলাম ফরহাদ ভাই নুসরাতের মেজো ভাই ওরা প্রথমে গলা ফাটিয়ে মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দিল তারপর আমার ডানা চেপে ধরে খুব জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিল আশে পাশের সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলে ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে বেকুব বনে যাই ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে অবিশ্বাস তারপর ফরহাদের চেহারাটা ক্রমশ আমার কাছে অপরিচিত হতে থাকলে আমি আর বিহারী পাড়ায় ঢুকতে সাহস পেলাম না দ্রুত স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি একটা লাল মেল ট্রেন ভয়ানক শোরগোল তুলে স্টেশনের ভেতর ঢুকে পড়লো মনে হল গোটা ট্রেনটা যেন আমার বুকের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে

সমস্ত স্টেশন জুড়ে মানুষের হল্লা এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি মানুষের ভিড় দেখছি ট্রেন দেখছি মানুষগুলোকে আবারও গতকালের সেই বানরের মত মনে হল প্রতিটি বানর কুতকুতে চোখে যেন আমাকেই দেখছে আমার চোখের নীচটা ভয়ে কালো হতে শুরু করলে দ্রুত সরে যেতে যেতে সারসার ঘোড়ার গাড়ির কাছে এসে অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকি তারপর অনেকগুলো রেললাইন যেখানে জোড়ায় জোড়ায় এসে মিলেমিশে এলোমেলো চলে গেছে আরও খানিকটা দূরে রেলস্টেশনের গোডাউন বরাবর, সেই গোডাউন বরাবর হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গোডাউনের গোড়াতে চলে এসে অনেক অনেক উঁচুতে গোডাউনের চালের দিকে তাকিয়ে থাকি চালের নীচে অনেকগুলো বাঁশের ঝাকা সারসার বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেখানে জালালি কবুতরেরা বাস করে ডিম পাড়ে বাচ্চা ফোটায় তাকিয়ে থাকি জালালি কবুতরেরা আমার দিকে তাকিয়ে শুধুই ডাকতে থাকে কেন যেন মনে হল কবুতরগুলো বেশ নিরাপদে আছে অথচ নিজেকে আজ এই বালক বয়সেই ভীষণ অরক্ষিত বলে বোধ হল আমার হঠাৎই টর্চ হাতে একটা খাকি হাফপ্যান্ট পড়া লোক আমাকে সতর্ক করে দিয়ে আরও খানিকটা ভয় পাইয়ে দিল

এই ঘটনার সারে পাঁচ যুগ পর আহমাদ রফিক ঢাকায় বসে লিখছেন, ‘গান্ধি মনে হয় এ সময় তার চিন্তায় সুষ্ঠু সামঞ্জস্যবোধে ছিলেন না থাকলে তিনি খোলাচিঠিতে ব্রিটিশরাজকে লিখতে পারতেন না যে, হিটলারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ইংরেজের উচিত আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে জার্মান ফ্যাসিস্টদের মোকাবেলা করা কারণ অহিংসার মাধ্যমে প্রকৃত জয় সম্ভব হাস্যকর এ চিঠি নিয়ে যশবস্ত সিং তার জিন্না বিষয়ক বইতে বেশ সরস ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন মন্তব্য করেছেন মাওলানা আজাদও’  অথচ এ সময় কংগ্রেসের সুভাষচন্দ্র যিনি কিনা বাম ঘরানার স্বপ্নে ক্রমশ কার্যকরী ভূমিকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার কারণে ব্রিটিশরাজের চোখে সবচেয়ে বড়ো শত্রু ১৯৪০ সালে কংগ্রেসের বড়ো নেতারা যখন মুক্ত, সুভাষ তখন কারাগারে সুভাষ খুঁজতে শুরু করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের খপ্পড় থেকে ভারতের মুক্তির পথ সুভাষ জানতেন এই মুক্তি সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া অসম্ভব গান্ধীবাদের সাথে তার এরকম চূড়ান্ত পার্থক্যও শেষ পর্যন্ত ভারতবিভাজন অথবা বিভাজনের পথ ধরে ঠাকুরদার দেশত্যাগ অথবা লাশের মিছিল প্রতিহত করতে পারেনি অবিনাশি সময় ব্যাপি আমার এই ক্ষরণ, যে ক্ষরণ চূড়ান্ত অর্থে আমার শারীরীক বয়সের সীমানাকে অতিক্রম করে গিয়েছে বহু বহু যুগ আগে যখন আমার জন্ম হয়েছিল একমাত্র ঘটে যাওয়া ইতিহাসের পাতায়; যখন অবন্তিধামের আত্মপ্রেমিক বুড়ো ব্রাহ্মণ আমাদের যিনি পিতা বাপুজি আমার মা-কে পরিত্যাগ করেছিল এক অশুভ অন্ধকারের ভেতর; ব্রাহ্মণকন্যাদ্বয় যাদের নাম পাকিস্তান এবং হিন্দুস্থান, তারা সেদিন আশ্রয়দাতা বৃক্ষের কাছ থেকে পায়নি কোন নির্দেশনা আমরা জানি, সেই বৃক্ষে বাস করতো এক ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গোমি; যারা নিজেদের ভেতর ফিশফিশিয়ে বলছিল কুরু-পাণ্ডবের ভেতর, নিজ রক্তের ভেতর ঘটে যাওয়া এক মহাযুদ্ধের কথা যে যুদ্ধ ধর্ম-রক্ষার্থে? নাকি রাজ্যসম্পদ কুক্ষিগত করার স্বার্থে? সেই প্রশ্নের কোন সুরাহা না করেই যখন ১৯৪৬ টি পায়রার বাসস্থান তছনছ করে দিয়ে মুসলমানগণ নাঙা তলোয়ার হাতে ছুটে গেলো হিন্দুদের দিকে আর সনাতনগণ ভ্রুক্ষেপমাত্র নেই, তাচ্ছিল্যজ্ঞানে যবন নিধনে একাট্টা তখন জিন্না ‘পোকায় খাওয়া’ পবিত্র ভূমি পাকিস্তান নিয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের জৌলুসে সার্বভৌম ভূখণ্ডের মালিক অথচ দেবপুরুষগণ, আমরা কি আমাদের ভূভ- পেয়েছি? পাশাপাশি থাকো প্রাত্যহিক ঘৃণা অনিবার্য নিয়তি ক্ষমতার পূজারি জনকণ্ঠের বিবেক বেঁচে দিচ্ছে বাঁশি হাতে জোছনা কুড়ানো বণিক

আতঙ্ক উত্তমদের দোকানে গিয়ে অযথাই বসে থাকি উত্তমের কাছে জানতে পারি রেলকলোনির পাশের বস্তিতে নোটন ঘোষের মেয়েকে স্টেশনের গোডাউনের ভেতর ন্যাংটা অবস্থায় পাওয়া গেছে তখনও ওর দেহে কাঁপুনি ছিল উত্তম ধর্ষণ শব্দটার অর্থ বোঝানোর জন্য নানা তাল বাহানা শুরু করলেও আমি ঠিক কিছুই বুঝতে পারি না বরং আমি কল্পনায় দেখতে পাই নুসরাত সেই বিশাল গোডাউনের ভেতর দিয়ে কেবলই ছুটছে আর চিৎকার করে আমাকে ডাকছে পরমুহূর্তে নুসরাতের মামার ছবিটা ভেসে উঠতেই নুসরাতের ছবিটা হারিয়ে ফেলি রাতে যখন দূর্গার সাথে ঘুমাতে গেলাম তখন জানতে চাইলম ধর্ষণ কথাটার মানে কী দূর্গা ভয় চোখে তাকায়, তারপর আমার মুখ চেপে ধরে বলে ওঠে, আর কক্ষোনো এমন কথা বলবি না কক্ষেনো না, কোনদিন না

ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে ঠাকুরদার দেশে আর মাত্র তিন দিন থাকতে পারবো মথুরাপুর যাবার জন্য আমরা রিক্সা খুঁজছি আশ্চর্য এক জনও মথুরাপুর চিনতে পারলো না আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বোঝাতে থাকি, কাশিয়াডাঙ্গা পাবার আগে শেখপাড়া তারই আগের পাড়াটার নাম মথুরাপুর রিক্সাআলা জানালো, ওখানে কোন মথুরাপুর নাই জায়গাটার নাম মোহাম্মদপুর শিমুল শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদপুরেই নিয়ে যেতে বললো আমার মেজাজটা প্রথমে খারাপ হলেও রিক্সায় ওঠার পর থেকে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা কাঁপুনি বোধ করছি শরীরটা একটু যেন গরম গরম লাগছে পাঁচদিন আলমডাঙাতে কাটলো আলমডাঙ্গার কেউ আমাকে চিনতে পারেনি আমার কাছে কিছু কিছু মুখকে পরিচিত মনে হলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই আর মিলিয়ে নিতে পারিনি রায়বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নরেন স্যারকে আমার বাবার নাম বলার পরও যখন তিনি আমাকে ঠিক চিনতে পারলেন না তখন শিমুল ওর ঠাকুরদার নাম বলাতে চিনলেন অথচ কোথায় সেই আবেগ, কেমন যেন পুরোন মানুষগুলোও সব বদলে গিয়েছে কেবলই মনে হতে থাকলো নরেন স্যারকে জড়িয়ে ধরব উপুড় হয়ে পায়ের ধুলো নেবো কিন্তু না শেষ পর্যন্ত কিছুই করে উঠতে পারি না বরং হঠাৎই স্যারকে কেমন যেন অপরিচিত বলে মনে হয় নরেন স্যারও কেমন অচেনা গলায় পান চিবুতে চিবুতে চশমা চোখে শ্লেষ্মা গলায় বলতে শুরু করলেন, আজ সাত দিন হল ব্লাড যাচ্ছে, পাইলসের ব্যথাটা আবার চাগা দিয়ে উঠেছে

হঠাৎ-ই মনে হল পুরো আলমডাঙ্গার পায়ুপথ দিয়েই যেন ব্লাড যাচ্ছে, দুর্গন্ধ, রক্ত পুঁজে মাখামাখি একাকার

রিক্সা স্টেশনের মোড় পার হতেই একটা ফ্রক পড়া মেয়েকে দেখে চমকে উঠলাম মাথার ভেতর ঘুমিয়ে পড়া ছবিগুলোর যেনো ঘুম ভাঙে হ্যাঁ একটা মেয়ে ছিল চোখ জোড়া বড় বড় চোখে সব সময় পানি জমে থাকতো মেয়েটার জন্য একটা কিছু করতে চেয়েছিলাম মেয়েটা কথা দিয়েছিল আর ভিক্ষে করবে না প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেছিল তারপর আসা বাদ দিল অনেক দিন মনে মনে বাজারে রাস্তাঘাটে বস্তিতে রেলস্টেশনে ওকে খুঁজেছি পাইনি শিমুলের কাছে মেয়েটির কথা, নিজের অনুভূতির কথা খুটিয়ে খুটিয়ে বলার পর শিমুল ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়ে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করাতে ভয়ানক কষ্ট পেয়েছিলাম আমি আসলে ওকে কেউ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে না আশে পাশের প্রতিটি প্রিয় জনই খুব বেশি মাত্রায় প্র্যাকটিক্যাল এতদিন পর বুঝতে পারছি, মেয়েটিকে ভালোলাগার কোন একটা কারণ হয়তো ছিল মেয়েটার ভেতর কী একটা মায়া জড়ানো বিষয় ছিল

চোখের সামনে তাকিয়ে আছে একটা মাঝারি গোছের সাইনবোর্ড মোহাম্মদপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসা মাদ্রাসার পাশে শুয়ে আছে একটা মরা নদী নদীর নাম মাথাভাঙা

পুকুরটা ঠাকুদার আমলে ছিল না আমি চণ্ডী মন্দিরটা খুঁজতে থাকি হ্যাঁ এই তো শালবনের সারি মাথাভাঙার তীর ঘেঁষে শালগাছগুলো যেন কেমন নিঃসঙ্গ সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা আমার ভেতরে একটা বাস্তসাপ কেবলই নড়েচড়ে ওঠে ছোটকালে শুনেছিলাম বাস্তসাপেরা তাদের ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে পাহারা দেয় আমি কি আজ সেই বাস্তসাপ খুঁজতে খুঁজতে কুচবিহারের ছোট্ট একটা মফসসল শহর মাথাভাঙা, সেই মাথাভাঙা শহর যেটা কিনা আমার শহর না; আমার ঠাকুরদার শহর না; সেই ভীনদেশি শহর থেকে আজ আবার এতদূর, আমার ঠাকুরদার মাথাভাঙা নদীর তীরে? আমি দাঁড়িয়ে থাকি মাদ্রাসার পাশে মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে মাদ্রাসার বারান্দায় সার বেঁধে বালকেরা সুর করে পাকে কোরআন পাঠ করছে তাবলিগের একটা দল পাশের খোলা চত্বরে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত

মসজিদ পিছে ফেলে এগুতে থাকি ভীষণ পুরোন আর পুড়ে যাওয়া উঁচু সেকেলে মোটা মোটা পিলারের দালানগুলো চোখে পড়লো একটা সাইনবোর্ড দেখা যাছে হয়তো কোন সরকারি অফিসের হবে দূর থেকে ঠিক পড়তে পারি না সেই ভীষণ পুরোন গাব গাছটা যেখানে ছিল সেখানে শুধুই ঝোপঝাড় রাধা-কৃষ্ণ আমলের সেই পাকন গাছটা এখনও আছে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত পাকন গাছটার দিকে এগিয়ে যাই কোথাও কোন সিঁদুরের চিহ্নমাত্র নেই পাকন গাছের মোটা সেকেলে গোড়াটা, যেখানে পিসিমারা প্রতিদিন সকালে সিঁদুর মাখিয়ে দিত, সেই গোড়াটা কালো আলকাতরার রঙে কেবলই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে যেতে চাইছে আর পাকন গাছটার পেটের ওপর একটা জংধরা ছোট্ট টিনের গায়ে লেখা আছে, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এবং নীচের লাইনে মোটা কালো কালিতে লেখা, মোহাম্মদপুর এনিমি প্রপার্টি

আমার চোখ কেবলই মথুরাপুর নামটা খুঁজতে থাকে তারপর নামটাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে গঙ্গাদের আড়াই তলা দালান ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকি মন্দিরের মত আড়াই তলাটাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি হাঁটুমুড়ে মাটিতে বসে পড়বে আড়াই তলার মাজার সাথে একটা সাইনবোর্ড ঝুলানো কী একটা ক্লাব ঘরের সাইনবোর্ড প্রথমে সাইনবোর্ডটা পড়ার চেষ্টা করলেও কী ভেবে গঙ্গাদের বাড়ি থেকে চোখ নামিয়ে নেই একটা কালো কুকুর আমার দিকে তেড়ে এসে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে আমি পিছাতে থাকি পিছাতে পিছাতে ফিরে আসি মসজিদ চত্বরে

শিমুল কী এক রহস্যময় কারণে আমাকে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে মসজিদের গহ্বরে দাঁড়িয়ে আমার ভেতর চণ্ডী দেউলের ছবি ভেসে ওঠে মসজিদের ভেতরের ছবিগুলো পালটে যেতে থাকে মা চণ্ডী হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে একটা মায়া মায়া পরিচিত ঠোঁটে কী যেন বলছে চারিধার ফুল ঠাকুরদাকে খুঁজতে থাকি ঘাড়ের ওপর দূর্গাপিসির ঘন নিঃশ্বাস আমাকে যেন-বা কেবলই জাগিয়ে দিতে থাকে খানিকটা অস্থির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক আমাকে কাতার সোজা করে দাঁড়াতে বলে অথচ আমার কখনও জানা হবে না তাবলিগ দলের সাথে আসা এই যুবকটি গতরাতে যখন ঘুমিয়ে ছিল এই মসজিদের ভেতর, তখন তার জীবনের অজস্র রেতঃপাতের মতো গতরাতেও বেহুশ ঘুমের ঘোরে রেতঃপাত ঘটে গেছে এই মসজিদেরই মেঝেতে

মাথার ভেতরে জেগে ওঠা চণ্ডী দেউলটা কেবলই ঝাপসা হতে থাকে রেতঃপাত ঘটানো যুবকটি আবারও কাতার সোজা করে দাঁড়াবার আহ্বান জানাতেই আমি ধীরে ধীরে আমার ঠকুরদার চণ্ডী দেউল থেকে বের হয়ে এসে মরা মাথাভাঙার উঁচু ঢিবিটার ওপর গিয়ে বসি সব কিছুই যেন মুহূর্তে পরিচিত হয়ে এলো ঠাকুরদার মথুরাপুরটাকে চিনতে পারছি চিনতে পারছি বাস্তসাপের পাহারায় থাকা সেই চণ্ডী দেউল মনে হল অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে উলুধ্বনি দূর্গাপিসির কণ্ঠটাকে চেনার জন্য অস্থির হয়ে উঠি গলার ভেতরটা শুকিয়ে আসছে চোখের সামনেই যেন দেবী চণ্ডীর মুখ থেকে শুধুই রক্ত ঝরছে থামতে চায় না সেই রক্তের প্লাবন দেবীর হাতের ত্রিশুলটা ভীষণ রবে নড়ে উঠতেই আমি উঠে দাঁড়াই আর তখন নরেন স্যারের মত কেবলই আমার মনে হতে থাকে আমার পায়ুপথেও ব্লাড যাচ্ছে রক্ত পুঁজ দুর্গন্ধে ভেজা পুরোন দলা পাকানো থকথকে মল মিশ্রিত ব্লাড

 

                     
                                          দুই
আমার বাল্যবন্ধু মৃণাল বসুচৌধুরীকে যেদিন যশোরের বেনাপোল বর্ডারের ইমিগ্রেশন পার করিয়ে আলমডাঙা ফিরে এলাম তখন আমাকে নির্বাক রোগ পেয়ে বসেছে মৃণালের অসম্ভব রকমের কষ্ট বুকের খুব কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে একই বিছানায় শুয়ে এর পর মৃণাল আর এক দিনের জন্যও বাংলাদেশে আসেনি তার ঠাকুরদার আলমডাঙা, বাজিতপুর, মথুরাপুর, মাথাভাঙা অথবা কুমার নদের কাছে ফিরে আসেনি
জন্মসূত্রে আমি বাংলাদেশের নাগরিক নাম : শিমুল খন্দকার পেশা : কবিতালেখক অথচ এই নাম-পরিচয় আমি আমার পাসপোর্টে উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছি মৃণাল যাওয়ার সময় হাতে করে নিয়ে গিয়েছিল আহমদ রফিক এর ‘দেশভাগ : ফিরে দেখা’ ফিরে গিয়ে এই বই থেকে বেশ কিছু বিষয় কোড করে আমাকে ওর আবেগ ব্যর্থতা আর বাস্তবতা বোঝাতে চেয়েছে আমি ওর অনুভব একটু একটু করে লিখে রাখার চেষ্টা করি; যতটা সম্ভব সততায় নিজের সততার কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই ক্রমশ আত্মজৈবনিক হয়ে উঠতে থাকে বস্তুজৈবনিক অনুভবের পাশাপাশি নিরেট বাস্তবতা, ঘটে যাওয়া ঘটনাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আলোকে নির্মোহ আবেগে উলটে পালটে দেখার তাড়না ও দায়বোধ থেকে জন্ম নিতে থাকে ‘বস্তুজৈবনিক’

মৃণাল এখনও বেঁচে আছে সে এখনও কবিতা লেখে; আমার সাথে তার অনুভব শেয়ার করে মৃণাল এখনও চিরকুটে লেখা তার এলোমেলো অনুভব অথবা ডাইরির পাতা থেকে ছিঁড়ে তোলা আত্মকথা আমার কাছে পাঠায় এইসব এলোমেলো অনুভব আমার মতো করে আমার নামে প্রকাশ করার জন্য ক্রমাগত তাড়না দিতে থাকলে আমাকে লিখতে হচ্ছে এন্টিফিকশন, ‘সাকিন’ অর্থাৎ ঠিকানা; ভিটা-পরিচয়; মাটি-পরিচয় আর এ কথা ঠিক, এই ‘সাকিন-সংকট’ থেকে মুক্তি পেতে মৃণালকে আরেকবার জন্ম নিতে হয়েছিল সেটি ছিল তার লেখকজন্ম; কবি মৃণাল বসুচৌধুরী

অভিমান এবং বিচক্ষণতার সমন্বয়ে আমার বন্ধু মৃণালের কবিতার প্রেক্ষাপটে জড়িয়ে রয়েছে এক ধরনের সহজাত সরলতা অবশ্য এই সরলতার ভেতর নেই কোনো তরল অভিব্যক্তি; অথবা নেই কোনো নির্বোধ অনুভব; বরং আছে অর্থবিস্তারি প্রতি-অনুভব এই প্রতি-অনুভবই ওর কবিতার শক্তি এই ক্ষমতার কারণেই মৃণালের শব্দ-বুনন, শব্দ-আকুলতা শেষাবধি কবিতা হয়ে ওঠে তা না হলে কবিতা সৃজনে তাকে ব্যর্থ হতে হত যেমন হয়েছে ওর সময়ে লিখতে আসা অধিকাংশ আবেগ-আক্রান্ত যুবক এক্ষেত্রে মৃণাল বসুচৌধুরী অবশ্যই সতর্ক আমার বাল্যবন্ধু আবেগকে বুকে রাখে ঠিকই; কিন্তু এও জানে সেই আবেগ কীভাবে যথার্থতায় উন্নীত করে ঢেকে রাখতে হয় ব্যক্তিত্বের পোশাকে এই ব্যক্তিত্বটুকুই ওর কবিতা আর এই ব্যক্তিত্বের কারণেই সে বলতে পেরেছে, ‘পুনর্জন্মে আকাশকুসুম যা কিছু চেয়েছি, সমস্ত দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে’ আমি আজও প্রশ্নসহ ওর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, মৃণাল কি পুনর্জন্মে সাতচল্লিশের ভুলটাকে সংশোধন করতে পেরেছে? রবীন্দ্রনাথ এক সময় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ এশিয়া গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তাহলে, সবই কি এখন শুধুমাত্র তাত্ত্বিক ‘ডিসকোর্স’?

অনুভব বিনিময়ে আমাকে লিখতে হয়েছিল, জন্মই যদি সহজ ইচ্ছে তবে গর্ভে নাও আমাকে; এশিয়ার গর্ভ থেকে জেগে উঠুক কেউ; পৃথিবীর পৌরাণিক ফুল জরায়ু-শয্যা থেকে জেগে উঠে অনেক দিন ঘুমাইনি আমি গর্ভে ধরে বসে আছেন মা, এশিয়ার ইতিহাস; বর্ধিষ্ণু পুত্র তিনবিঘা কড়িডোর পিছে ফেলে দহগ্রামের দুঃখ ফিরে আসছে আবার আমাকে কেউ একজন পিতা একটি শাদা জামা দিন; মানচিত্র এঁকে বুকে ও পিঠে ফিরে যাব অমীমাংসিত সীমানা-ঘৃণায় কাটাতারে ঝুলে আছে গুলিবিদ্ধ বালিকা নারীর নিতম্বের দিকে তাকিয়ে বুঝেছি আমরা ভারবাহি পশু কাঁটাতারে রেখে আসা গুলিবিদ্ধ কন্যা আমরা চিৎকার করছিলাম; রাষ্ট্র তখন বধির আমরা গর্জে উঠেছিলাম; রাষ্ট্র তখন নিপুণ অভিনেত্রী

মৃণাল বসুচৌধুরীর স্বগত প্রশ্ন বা আত্মখনন শুধুমাত্র ওর ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা নয় বরং সেখানে আমি আমার নিজের মুখও দেখতে পাই মৃণাল কবিতার সৌন্দর্য থেকে নিজেকে খানিকটা পৃথক করে নিয়ে এক ধরনের দৃষ্টি আকর্ষণের ভূমিকায় অগ্রসর হয় ভাবালুতায় অর্থহীন হয়ে যাওয়ার দিকে সে কবিতাকে এগিয়ে যেতে দেয় না যদিও অভিমান, আবেগ আর কবিতার নমনীয়তা নিয়েই সে এগিয়ে গিয়েছে; ওর কবিতার বৈশিষ্ট্য নমনীয়তা; ঋজুতা অথবা খটমটে শব্দবুননের পথে মৃণাল ঠিক অভ্যস্থ নয়

কবির পত্রের জবাবে আমাকে লিখতে হয়েছিল, আমিও বলতে চেয়েছি সরল চোখে; আর সরলতাই যদি হয় প্রকৃত আরাধনা, তা হলে এ কথাই ঠিক, শয়তান শয়তান; শয়তানের অতিরিক্ত কিছু দেখি না আমি আমার ভেতর অবলা গর্দভের মত শিখেছি অভিনয়; ভেতরে লোভের বলক অথচ মহাকাল থেকে কবির যে বিশ্রামের জন্য আহাজারি সেখান থেকে  প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা কী মেসেজ পাই? আসলেই কি চেতনাপ্রাপ্ত অথবা প্রজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষের পক্ষে মহাকালের কাছে বিশ্রাম পাওয়া সম্ভব? অথবা এক জীবনে, মানবজীবনের যাবতীয় আকাক্সক্ষার প্রতিফল কি আমাদের অভিজ্ঞতার মানচিত্রে ফুটিয়ে তুলতে পারি? না, তেমন কোনো জীবন উপস্থাপক মানচিত্র আমরা ফুটিয়ে তুলতে পারি না আমাদের চেতনায় অথবা বাস্তবতায় সুতরাং মুক্তি নেই, বিশ্রাম নেই, ছুটি নেই এই বিশ্রাম না থাকার মধ্যেই কিন্তু মানব জীবনের চিরায়ত অনুলোক, বোধ ও প্রজ্ঞার সংযুক্তি রয়েছে; রয়েছে চিরায়ত দর্শনবোধ; যা কেবল ভারতীয় দর্শনেই সম্ভব; লোকায়ত দর্শনেই সম্ভব এই মহাকালকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার অনিবার্য আকাক্সক্ষা একাধারে বৈদিক আর অবৈদিক উভয় দর্শনের উপলব্ধিতে থিতু হতে দেখা যায়; যে থিতু অবস্থা থেকে জেগে উঠে মৃণাল উচ্চারণ করে, ‘যাও, বিমূর্ত বিষাদ’

মৃণাল কবিতার ভেতর এমন এক অবচেতন-বৈশিষ্ট্য অনুপ্রবেশ করিয়েছে; যে বৈশিষ্ট্য একাধারে ধারণ করে মানসজগত ও সৃজনশীল ক্ষমতার জগৎ; আর এই উভয় জগৎ নিয়েই তৈরি হয়ে যায় তার ব্যক্তিত্ব; এই ব্যক্তিত্ব কিন্তু উপন্যাসে উপস্থাপিত চরিত্র অথবা আমার আপনার চোখে দেখা ব্যক্তিত্ব নয়; এই ব্যক্তিত্ব একজন কবি ও কবিতার ভেতর লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব কথা বলার ঢং থেকে শুরু করে চেতনা ও বিশ্বাস; জগৎসংসারের প্রতি কবির অভিমান ও কর্তব্য আর সেইসাথে জীবনের সাথে অনিবার্য সংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়েই তো মৃণাল বসুচৌধুরী? এই মৃণাল বসুচৌধুরী কীভাবে সংযুক্ত হয়েছে জীবনে ও অভিজ্ঞতায়, সেই অবর্ণনীয় প্রজ্ঞার সীমাবদ্ধ উচ্চারণই তো তাঁর কবিতা; সীমাবদ্ধ বলছি এই কারণে যে এই মহার্ঘ্য অবিনাশী একটিমাত্র জীবন, এই এক জীবনের সবটুকু অনুভব আসলে মানবভাষায় পুরোপুরি উন্মোচন সম্ভব নয়; আর সম্ভব নয় বলেই তা প্রকাশের তাড়নায় ভাষার এত আকুলতা; সেই আকুলতার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে একজন কবি সহসাই সাধারণ থেকে ক্রমাগত পৃথক হয়ে ওঠে ক্রমাগত পৃথক হয়ে ওঠা কেন? আর সেই পৃথক হয়ে ওঠার রূপটিই বা কেমন? এই যে পৃথক হয়ে ওঠা, এই পৃথক হয়ে ওঠার গতিবিধি বুঝতে পারলে কবিকে হয়তো কিছুটা বুঝে ওঠা সম্ভব মৃণালের এই পৃথক হয়ে ওঠার সীমারেখা বোঝা যায় ওর কবিতাপাঠে এই পৃথক হয়ে ওঠার কারণেই সে উচ্চারণ করতেপেরেছেন, ‘উন্মাদ বাউল এসে কেড়ে নেয় ঘুম/ অভিশপ্ত খাটের দু’পাশে পড়ে থাকে সবুজ পাঞ্জাবি/ গন্ধভরা শিশি/ জ্যোৎস্নায় উড়ে যায় সঙ্গীহীন পাখি/ উড়ে যায় অমোঘ নিয়তি/ জয় নয়, পরাজয়ে এলোমেলো বেঁচে থাকা/ কবিদের আদিম অভ্যাস’

মৃণাল সময়কে ভেঙেছে; জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে ভেঙেছে ফলে মানবজীবন হয়ে উঠেছে অন্তহীন চেতনার সীমাহীন অভিযাত্রা যে অভিযাত্রা ক্রমশ অবন্তীধামের দিকে কুচক্রী ব্রাহ্মণের দিকে? সময়ের সীমানায় আটকে থাকা, দেহের সীমানায় আটকে থাকা, দমবদ্ধকর অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত জীবনকে কীভাবে সীমাহীন স্বাধীন অনুভবে বিবর্তিত করে নিয়ে জীবনকে প্রাত্যহিকতা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব তারই অনুভব এই উচ্চারণ এই উচ্চারণ সহসা জীবনে জেগে ওঠে না বরং তা জীবন পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ক্রমশ জেগে ওঠে যখন কবি পরিভ্রমণে পেয়ে যায় জীবনের সেই মহার্ঘ্য অনুভব; যা একমাত্র এই ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানায় বেড়ে উঠে অর্জন করা সম্ভব মৃণালও সেই মহার্ঘ্য অনুভব পেয়েছিল অবিভাজিত ভারতবর্ষের বাঙালি জাতির ধুলোবালিমাটি ও কাদার কথনে

আমরা কি এখনও যুদ্ধ করছি সেকুলার বৈষম্যহীন সমাজের জন্য? দেশভাগজনিত রক্তপ্রপাতের দায়ভার কীভাবে মেটাবো আমরা? দায়মুক্ত হতে পারবেন কি আমাদের পিতাগণ, দেশভাগের নায়কগণ? বাস্তচ্যুত প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের মতো আমরা আমাদের ক্ষরণ থেকে বলতেই পারি, ‘দেশভাগ ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ’; আদৌ কি তাই? তাহলে কি, ভুল পরিচয়ে বেঁচেছি এতকাল? দলিলে লেখেছি ভুল নাম? ভুল বুক থেকে চুষে নিয়েছি দুগ্ধরস-স্বেদ? অপ্রসন্ন কৈশোর বসিয়ে রেখেছে আমাকে আমারই মুখোমুখি

অথচ আমার বাল্যবন্ধু মৃণাল বসুচৌধীর মতো ব্ল্যাক-কালার র‌্যাব, সেনাবাহিনী, আদালত, পুলিশ সবার কাছে বেঁচে দিয়ে মাথা ফিরতে চেয়েছি আমি কাদাখোঁচা পাখির মত মাটির কাছে পাখি শাবকেরা উড়ছে আর গান গাইছে দেশগান এই ভাবে দেশগান গাইতে গাইতে পাখিরা বুঝতে পারে না দেশপ্রেমিক মানুষেরা কীভাবে পাখির পালকের নীচে লুকিয়ে থাকা চর্বি থেকে চুষে তোলে তাপ এইভাবে একদিন আমিও লিখতে লিখতে মৃণালের কবিতা আবিষ্কার করে জেগে উঠলাম শতাব্দীর ওপার থেকে যেখানে জেগে আছে আজো ভিটে-মাটি হারানোর শোক ও শোকসঙ্গীত

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, সাহিত্য পণ্য নয়, সাহিত্য তার চেয়ে বড়ো; ঢের মহৎ একটা কাজ-- একটা ব্রতের মতো সঙ্গত কারণেই আমাদের অনুসন্ধান সেই ব্রতটা আসলে কী অথবা কোন অর্থে সেই সাহিত্য মহৎ? আমরা আরও প্রশ্ন করতে পারি, সাহিত্য কি জীবন অপেক্ষাও মহৎ? হ্যাঁ জীবন অপেক্ষাও মহৎ জীবন কী, এই উপলব্ধির কাছে টেনে নিয়ে এসে আমাদের অবাক হতে শেখায় উপলব্ধি-বোধ ও ভাষা আর যে ভাষা প্রাত্যহিকতা থেকে কেজো আচরণ থেকে আমাদের মুখ ঘুরিয়ে দেয় অনন্তের সীমাহীনতায়; সেই ভাষার আশ্রয়ে আমরা সীমাহীনতার সীমানা ছুঁয়ে দিতে চেয়েছি; আর এক্ষেত্রে তো সাহিত্য জীবন অপেক্ষা আরো কিছু; যদি না এমনতর ভাষাবোধ সাহিত্যিকগণ উপলব্ধিতে নিয়ে এসে তার প্রকাশ না ঘটাতে পারতেন তা হলে মানবজীবন যে কতটা উপাদেয় আর কতটা মহার্ঘ্য, এমন কোন চেতনার জন্ম হতো না আমাদের প্রজ্ঞায়; ফলে জীবজগতের আর সব প্রাণীজগতের মতো আমাদের মানবজীবনও হয়ে উঠতো দৈনিকতার ভেতর আটকে যাওয়া অর্থহীন এবং রুগ্ন; ফলে আমরা একমাত্র দৈহিক ক্ষুধার ভেতর জীবজগতের আর দশটা প্রাণীর মতো একমাত্র দেহনির্ভরতার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকতাম; অনুভূতি মন ও প্রজ্ঞার সংযুক্তি সেখানে অসম্ভব; আর তাই অনিবার্য মানবদেহের এই চেতনা চিরকালীন; সেই আদিম গুহাজীবন থেকে এখনো জীবনের অনুভবকে নিত্যনোতুন অনুভবে ও প্রকাশে ক্রমাগত আমরা উন্মোচন করে চলেছি এ প্রক্রিয়া অনিবার্য মানবজীবনের জন্য; যেহেতু আমরা মানবজীবন নিয়ে জীবিত আছি; আমরা তো আর পশুজীবন যাপন করছি না যদিও মুহূর্তেই পশু হয়ে উঠি আমরা; আর তখন আমরা মানব-পরিবার ভয় পাই, ছুটে যাই নবীর কাছে, ছুটে যাই কবির কাছে যারা উচ্চারণ করতে পারেন সেই মহার্ঘ্য শব্দবন্ধন, যে শব্দবন্ধনের অলৌকিক তাড়নায় আমরা আমাদের অনুভবে এমন এক দিব্যচোখের উন্মোচন ঘটাতে সক্ষম হই, যে চোখের আলোকে আমরা পশুজীবন থেকে আমাদের মানব পরিবারকে রক্ষা করতে পারি সুতরাং ‘কেবল আমিই জানি/ কত জোর হাওয়া এলে/ ছিঁড়ে যাবে পাল’

এরপর মৃণালের বোধে অনুভূত হয় আলোড়ন ক্রমশ সমাজের ভেতর লুকিয়ে থাকা সংক্ষুব্ধতার ভেতর থেকে নির্জনতার কণ্ঠস্বরকে আলাদা করে চিনে নেয়ার অভিপ্রায়ে পক্ষান্তরে সমাজের প্রকৃত অভ্যন্তরীণ রূপকেই যেন আবিষ্কার করে ফেলে মৃণাল কলকাতার নানাবিধ গোপন লজ্জা ও অহম, কলকাতার নানাবিধ সংগুপ্ত সামাজিক ব্যাধি ও আচরণ আর গতিময় ধারাপাত এসে সংযুক্ত হতে থাকে কবিতায় কবিতায় অংশগ্রহণ করে ট্রেন অথবা সমুদ্র, নিমন্ত্রিত অতিথি অথবা রজনীগন্ধায় সজ্জিত দরজা, বালুতটে উদ্দাম ঢেউ অথবা বহু পূর্বে পিছে ফেলে আসা আমাদের গুহাজীবন অথবা একান্ত নিবিড় বৃষ্টি; ভাদ্র অথবা শীত; রাত অথবা নিঃসঙ্গ জোছনার পাশাপাশি জেলখানার কয়েদি অথবা মাধবীলতার কাছে হেঁটে যাওয়া পাহারাওয়ালার বাঁশি; বড্ড খারাপ সময় অথবা বধ্যভূমির মাটি; আর তখন আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, ‘মরো আর বাঁচো ছেড়ো নাকো কলকাতা’ অথচ এক সময় আমরা বুঝতে পারি এই কলকাতা শহরে আমরা কেউ আমাদের বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না, ‘হাত-পা কেমন যেন স্নায়ু শিরা বাড়িটা কোথায়...’ এভাবে একান্ত নিজের একটি বাড়ি হয়ে ওঠে সভ্যতার মহাকালিক চরিত্র; মানবের যাত্রাপথ অথবা উদ্দেশ্যবিহীন ঠিকানাবিহীন মানব সম্প্রদায়

বলা সম্ভব সুধীনদত্ত অথবা বুদ্ধদেব বসুর ঘরানা আশ্রিত যে পাণ্ডিত্যনির্ভরতা অথবা বুদ্ধিনির্ভরতা থেকে বাংলা কবিতাকে যেন মুক্ত করার চেষ্টায় রত হয়েছে মৃণাল বসুচৌধুরী যদিও এর ফলে মৃণালের কবিতা আত্মজৈবনিকতা থেকে সহসা মুক্তির পথ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টায় সক্রিয় তথাপি অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত সীমানা ও ল্যান্ডস্কেপ এবং বিষয়সংকটের ভেতর আটকে যাবার ঝুকিও সবসময় থাকে; এটা জেনেও মৃণাল ঝুকি নিয়েছে; আবার এ বিপর্যয় থেকে মুক্ত হবার জন্য ফিরে এসেছে অধিবিদ্যার কাছে; কেন-না অনেকের মতো সে-ও জানে বাংলা ভাষায় প্রকৃত কবিতার জন্ম হয়েছে অধিবিদ্যা থেকে ফলে দৈনিকতানির্ভর শব্দ সহজেই জাদুশব্দে রূপান্তরিত হতে থাকে তাঁর কবিতায় অবশ্য এই জাদুমোহ অনেক সময় অভিমাননির্ভর অথবা ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে; যেমন অভিমান আক্রান্ত কাব্যগ্রন্থ ‘শব্দনির্মাণ’ তারপরও সেখানে থেকে গেছে শিথিল শব্দবুনন, অবসন্নতা আশ্রিত মোহ ও ক্লান্তিঘন সংবেদ অথচ তা ‘যদি ওড়ে উড়ে যায়’ কাব্যগ্রন্থে এসে এই প্রথমবারের মতো তাঁর কবিতায় বাস্তববাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় এখানে সমাজ মনস্কতার ইশারা ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী চেতনায় বিবর্তিত হয়েছে আত্ম উপলব্ধি ও পারিপার্শ্বিকতা বনাম সভ্যতার সীমানার সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অসঙ্গতি ও দীর্ঘশ্বাস কবিতার শরীরে নিয়ে এসেছে এক ধরনের মায়া কাতরতা মায়াবী উত্তাপের ফলে এই কাব্যে এসে দেখা যায় নস্টালজিয়া, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি অনুষঙ্গ; সেইসাথে প্রথা বনাম মানবিক চেতনা ও মানবজীবনে সংজ্ঞা ও তাৎপর্য, অভিমান ও আত্মবোধ, দেহ ও মৃত্যুচেতনা বিভ্রম, ঘুম, অসুস্থ্যতা এবং এভাবে আমরা দেখতে পাই ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছে চূড়ান্ত কবিতার দিকে, ‘মানুষেরা শুভেচ্ছা জানাতে/ আবার এগিয়ে যাবে মানুষের দিকে/ এবার হয়ত/ সমীকরণের কথা ভাবতে ভাবতে/ শীতল নদীর কাছে/ উড়ে যাবে ম্রিয়মান পাখি’ (এবার হয়ত / মায়াবী উত্তাপ)

কবি স্রষ্ঠা তাঁর চেতন অবচেতনে শিল্প সঞ্চারের বোধ কার্যকর থাকে স্রষ্ঠার শিল্পীসত্তা বা সৃষ্টিকর্ম কখনো নেতিবাচক হয় না হয় মহাকল্যাণের সম্মিলন প্রয়াসী আর এ জন্যই ঐতিহ্য বা ভাষার ব্যবধানে দেশে দেশে কালে কালে শিল্পের আদি ও চিরন্তন কেন্দ্রবিন্দু মানুষ কবির যাত্রা মানুষের দিকে, চিরন্তন ভালোবাসার দিকে, শিল্পের দিকে সুতরাং অবলীলায় মৃণাল উচ্চারণ করে,
একটু জোরে হাঁটলেই
হয়ত তোমার হাত ধরতে পারতাম ঠিক সময়ে
ঘুরিয়ে দিতে পারতাম তোমার গতিপথ

সত্যিই কি ইতিহাসের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব? সময়টিই আসলে বিভ্রমের এবং একই সাথে উপভোগের কেমন সেই উপভোগ? স্বপ্ন! ধর্মভিত্তিক নিজের একখানি স্বাধীন ভূমি! কেমন সেই বিভ্রম? ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ভোগযোগ্য অভিধার অপর নাম, উপভোগ? অথবা যে ফরাসি বিপ্লব সামন্তবাদের বিকাশে সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিকে ত্বরান্বিত করছে, সেই পুঁজির পথকে সুগম করে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে আবারও ধর্মকে ব্যবহার করে একটি পাকভূমির জন্ম দেয়া? বিভ্রমের নাম তাহলে এই পাকভূমির জন্ম-রহস্য?

এমনতর নানাবিধ সন্দেহের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম, গুজরাটি ঝীনা ভাইয়ের পুত্র মহম্মদ আলী ঝীনা যিনি দ্রুতই স্যুট কোট পরিহিত ব্যারিস্টার জিন্নাহ হয়ে উঠেছেন তিনি শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে ইসলামাবাদে লাঞ্চে মিলিত হয়েছেন কেন এই লাঞ্চ? মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অর্থাৎ পবিত্র ভূমির জন্ম হয়েছে সুতরাং রোজার দিন হলেও জিন্নাহ সাহেবকে দুপুরের জৌলসে খানাপিনা আর সুরার দরিয়াতে উৎফুল্ল হতে হয়েছে কেন-না পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য একটি দেশের আবির্ভাব হয়েছে আর সবচেয়ে মজার বিষয়, এ অবস্থায় সূচিত হল এমন এক সভ্যতার যেখানে এই ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ এর ঠিক সাতষট্টি বছর পর হুমায়ূন আজাদ অথবা বিশ্বজিৎ রায়ের মতো মুক্তচিন্তার অধিকারীদের জন্য বসবাসের মতো পূর্বপাকিস্তানে, যখন সেই পূর্ব পাকিস্তান বাধ্য হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ হয়ে উঠতে, সেই স্বাধীন ভূমিতে বসবাসের জন্য তাদের মতো মানুষের কোন অধিকার থাকবে না; ভূমি থাকবে না প্রকাশ্যে তাদের হত্যা করা হবে এবং পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র যন্ত্রটি হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের এমন এক চারণভূমি যেখানে একুশ শতকে এসেও মালালার মতো কিশোরীদের বিদ্যালয়ে যাবার অপরাধে গুলি করা হবে অথবা মুনতারান মাইয়ের মতো মহিলাকে জনতার সামনে রেপ করা হবে; আর সবকিছুই চলতে থাকবে জনতার খেয়ালখুশি মতো মৌখিক আদেশে যে আদেশসমূহ জন্ম নেবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা মোতাবেক মুসলমানদের জন্য রাস্ট্র যন্ত্রটি ততদিনে ধর্মীয় খসবু ও আতর উত্তেজনায় আইএস অর্থাৎ ইসলামি স্টেট প্রতিষ্ঠার জেহাদে ক্রমশ বর্বর হয়ে উঠতে থাকলে সারা বিশ্বে শান্তির ধর্মটিকে গুটিকয়েক মুসলমান ভীতিপ্রদ ধর্ম হিসেবে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে আর এই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র আরও খানিকটা গুছিয়ে তুলবে নিজেদের?

সেইদিন চৌদ্দ আগস্টের পরদিন এক দিনের ব্যবধানে ১৫ আগস্টে জন্ম নিচ্ছে হিন্দুদের জন্য আরেকটি দেশ হিন্দুস্থান; ভারত নেতা, ব্যারিস্টার করমচাঁদ গান্ধী স্যুট-টাই ফেলে গায়ে তুলেছেন ধুতি, পায়ে চপ্পল বিষণ্ন, ধুমধামের বাইরে রাতের তারার নীচে বসে তখনও ভাবছেন তিনি জনতার কাছে যে অঙ্গিকার করেছিলেন সেই স্বপ্নের কথা; অথচ যা আজ অর্থহীন, ‘ভারতকে ভাগ করবার আগে তোমরা আমাকে দু ভাগ করো’ অথচ ড্রাফটম্যান র‌্যাডক্লিফ যিনি কিনা কখনও ভারত দেখেন নি, তাকে লন্ডন থেকে নিয়ে আনা হলো তিনি টেবিলের ওপর বিছানো ভারতের মানচিত্রের ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে, যেখানে মুসলমানের বাস বেশি সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করলেন; আর বাহ কি চমৎকার, আমরা স্বাধীন হলাম! আর আমরা পাঠকেরা তখন ধন্ধে পড়ে যাই, বুঝতে পারি না আসলে ব্রিটিশ হটাও বা অসহযোগ অথবা স্বরাজ আন্দোলন বলে আসলেই কখনও কিছু ছিল কিনা; নাকি সব কিছুই ইতিহাসের সাজানো নাটক?

এই একই যোগসূত্রের দায়বদ্ধতা থেকে বলছি, আমি হতবাক হই না মোটেও যখন এই ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমার কবি বন্ধু মতামত প্রকাশ করলো, যেহেতেু আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, সুতরাং আমি দুই রাষ্ট্র নায়কদের কাছে অনুরোধ করছি প্লিজ দুই বাংলাকে এক করে দিন মজার বিষয় পশ্চিমবাংলা থেকে মূখ্য মন্ত্রীর সাথে আগত বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক দেব ঠিক এ কথাটিই প্রকাশ করেছিলেন তার বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অনুভব প্রকাশ, আহ এ জীবনে কি এমন কিছু দেখে যেতে পারব? এ বিষয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেভাবে পূর্বজার্মানিরা বার্লিন দেয়াল ভেঙে মিলিত হয়েছিল পশ্চিম জর্মানির সাথে, সেভাবেই তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে কাঁটাতার কেটে কলিকাতায় দেখেছি সেখানে হিন্দির দাপটে আস্তে আস্তে বাঙালি সংস্কৃতি বিলীন হতে যাচ্ছে ভাষার ক্ষেত্রে হিন্দি, ইংরেজি, কিংবা খোট্টা ভাষার দাপট বাড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যে সেখানকার বাঙালিরা পিছিয়ে এই প্রেক্ষিতে ওখানকার বাঙালিরা বাংলাদেশের সাথে মিলিত হতে চাইলে আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা স্বাগত জানাবো কিন্তু দিল্লিকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদী শক্তি তা কি হতে দেবে? আগে স্বাধীন হতে হবে পশ্চিমবাংলাকে


 

মন্তব্যসমূহ