সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল
রূপাই পান্তি
ভোট মানেই যেন
রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। গল্পটা মোটেও তেমন নয়। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি
বিপ্লবের দৌলতে। ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে। এসেছে মানুষের কাছাকাছি। আজকের গল্পটা
সেই কাছাকাছি আসার গল্প। প্রেমের। আর সেই প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে ভোট। ব্যাস।
গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই
অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র
কাল্পনিক, ঘটনাও, স্থান-পাত্রের কাকতলীয় মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাতড়াতে
বসবেন না। আপনার মনে পড়ে গেলে, সে আপনার
স্মৃতির দোষ...
পরিচ্ছদঃ ১৩
ছ’টা বাজলে সম্বর্ত্তক বারান্দায়
দাঁড়াল। মাঠে জনা দশের লোক সেই থেকে ঠাই দাঁড়িয়ে... আলো নেভে বিকেলের। সম্ব
নিয়মমতো ঘোষণা করে, “১৮২ নম্বর বুথের কোনও ভোটার যদি ভোট দিতে বাকি থেকে থাকেন...”
মাঠ থেকে কে চেঁচিয়ে বলে, “নেই সার, নেই... কেউন্যেই...” এত উদবেগের মধ্যেও তবু
হাসি পেল ওর...
ঘরে আলোর নীচে সিলিং হবে। সম্ব হিসেব নিয়ে
বসে পড়েছে ততক্ষণ। কত ভোট হয়েছে, তার নথি নেবে পোলিং এজেন্টরা। দিব্যেন্দুদা জানতে চায়, “কত হল, গাঙ্গুলী?”
“৮৫৭। মেশিন কী বলে?”
“মেশিন তো ঠিকই বলে, কিন্তু আমাদের
স্বপনবাবু যে বলেছিল ৮০০ ছাড়াবে না?” স্বপনবাবুর দিকে তাকায় দিব্যেন্দুদা, সবার চোখ
স্বপনবাবুর দিকে, সারাদিনের এক টানটান উত্তেজনার পর সামান্য আমোদের লোভ কে বা
সামলায়... “তাহলে স্বপনবাবু আমাদের কী খাওয়াচ্ছে গাঙ্গুলী? আর সি তে গিয়ে না কি
এখানেই?”
স্বপনবাবু একমনে গালা সিল করছেন।
নিত্যদাও আওয়াজ দিলেন... এসবের দূরে সম্ব দেখছে স্কুলের রান্নাঘরে আলো জ্বেলেছে
কারা। তাদের ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, তাদের রিনরিন চুড়ি... তাদের খিলখিল হাসি...
খাতা আর মেশিনের ৮৫৭ দেখে ফিরে গেছে
কয়েকজন। তাদের ফিরে যাওয়ার পথে ঘরে ঘরে রটে গেছে উৎসব শেষের বিষাদ, উৎসব শেষের এক গোপন
হিংসার কথা... একমাত্র হিংসার কথা, গ্রামের ছোটোবড়ো সকলের কাছে এ এক বিস্ময়...
হিংসার কি সত্যিই কোনও দরকার ছিল? এই যে
বছর অন্তরের আমাদের স্বপ্ন সাজিয়ে দূর শহর থেকে এক ঘোষণা দেওয়ার সাজানো খেলা, যা
আমাদের দূর ওই শহর ঠিক করে দিল আজীবন... সেখানে হিংসার কিছু দরকার ছিল কি?
গালার ওপর মেটাল সিল দিচ্ছে সম্ব, আর
দিব্যেন্দুদা এজেন্টদের বুঝিয়ে দিচ্ছে ১৭ সি ফর্ম। সম্বর পিআরও ডায়েরি ঘন্টায়
ঘন্টায় লিখে রাখা ছিল, ছিল পিএসও ০৫, তবু এত কাজ... পুলিশ সেক্টর খবর দিল, “ফোর্স
না এলে মুভ করবেন না। ১৮৪ তে দেরী হচ্ছে।
আমরা একসাথে মুভ করব।”
সম্ব ঘড়ি দেখল, ন’টা বাজতে গেল।
আশেপাশে একটাও ছায়া নেই।। অন্ধকার বলে, টিমটিম করে দূরে দূরে ঘরে ঘরে জ্বলছে
বিদ্যুতের আলো। গ্রামের ঘরে বিদ্যুৎ এসে গেছে মানে, তার সব রহস্য যেন মাটি হয়ে গেল
বলে মনে হয় সম্বর।
একা ভোটকেন্দ্র আগলে আছে ও। সবাই যে
যার স্বপ্ন সামলে এখন ফিরে যাচ্ছে নতুন প্রস্তুতির কাছে। মন ভার হয়, ছায়ার কাছে
যেটুকু আশ্রয় পাওয়া যায়, রাত নেমে এলে তাও কেমন অচেনা লাগে...
সেক্টর ফোন করছে, “আপনি মুভ করে যান।
পুলিশ আসবে না... রাত হলে লঞ্চ দেওয়া হবে না...” সেক্টরের গলা কাঁপছে। সবাই তাকিয়ে
থাকে ওর দিকে। দিব্যেন্দুদা মাথা নাড়ল।
“না, গাঙ্গুলী, পুলিশ ছাড়া যাওয়া ঠিক
হবে না। পথে যদি কিছু হয়...”
পুলিশকাকুও একমত। সম্বর শুধু
স্বস্তি, আরও কিছুক্ষণ ছায়ার, আরও কিছুক্ষণ এই উত্তাপ। তারপর আরসিতে গেলে কে কার
খোঁজ নেবে? সময় বয়ে যায়, রটে যায় শান্তিরামের নিখোঁজবার্তা। কে এসে খবর দিল, বাড়ির কাছে ডোবার ধারে রক্তমেখে
পড়ে থাকা হেডমাস্টারের কথা।
কাছাকাছি হাসপাতাল নেই। স্কুলঘরের
বারান্দায় শান্তিরামকে এনে বসানো হল। সেনেটি বাড়ি থেকে এনেছে ফার্স্ট এইডের বাক্স।
জলের বালতি। সম্ব রক্ত ধুয়ে দিচ্ছে। রক্ত তখন তার পথ ধরে যেতে যেতে থমকে
দাঁড়িয়েছে।
নিত্যবাবু টর্চ ধরেছেন। নাহ্, তেমন
মারাত্মক লাগেনি। স্পিরিট দিয়ে পরিস্কার করা হল। মারকিউরোক্রোম ছিল, রক্তের সাথে
মিশে যেতে যেতে সে ওষুধের ঘ্রাণে আরও একবার কাছাকাছি এসে পড়ে ছায়া সুনিবিড় পশ্চিম
শীতলিয়া গ্রাম, গ্রামের মানুষ। মাথায় একটা ছোটো ক্ষত। যন্ত্রণা... সম্ব ওষুধ দিয়ে
ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। গরম চা এনে দিল সেনেটির বৌদি। কাল ডাক্তার দেখিয়ে নিলে হবে।
শান্তিরাম অলীক দৃষ্টিতে তাকায়...
পুলিশ খবর দিল, “আমরা আর আদাঘন্টার
মধ্যে মুভ করব। আপনারা রেডি থাকুন।”
আর বিদায়ের সুরে একটা থালায় গরম ভাত,
ডাল, আলুভাতে, পেঁয়াজের টুকরো, কাঁচালঙ্কা সাজিয়ে গ্রামের বউরা বরন করে নিল শহরকে,
শেষবারের মতো। সেনেটির বাড়িয়ে দেওয়া থালার দিকে তাকিয়ে দেখছে ভোটবাবু, ধোঁয়া ওঠা
ভাতের সাথে যেন নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন ভেসে যাচ্ছে...
তাড়াতাড়ি ডিম সেদ্ধ করে দিয়েছে
সেনেটির বউদি। “খেন্যেন, বাবু, নেবুখালি ঘাটে ভুটভুটি আটক্যে গেলি খুব খিদিপে
যাবে...”
গ্রামশুদ্ধু লোকের সামনে কী করে খায়
ওরা... “আরেট্টা কতা, রাত্তিরির খাপারের দামদে আমাদ্যে লজ্জা দেবেন্না যেনি...
আপ্নারা না থাক্লি...”
সেনেটির চোখ ভোটবাবুর দিকে... দূরে
ভ্যানোর শব্দ পেলে সবাই আবার যেন জেগে ওঠে স্বপ্ন ভেঙে।
পরিচ্ছদঃ ১৪
পুলিশ উঠে পড়ল। বাক্স গুছিয়ে যে যার
জায়গায়। পেছনের ভ্যানে সম্ব আর দুই পুলিশের সাথে পুলিশ সেক্টরের প্রধান। ফোন বেজে
ওঠে সম্বর। “সার ভোটন্যে যেতি পারব্যেন্না। পথির ধারি বন্দুকন্যে সব
দাঁড়ায়্যেছে...” সম্ব হাসল। শুনে পুলিশসেক্টরও... ওরা যে পাঁচজন... আমি যে শম্ভু...
“কই, স্টার্ট দাও...” সম্ব তাড়া দেয়...
মাঠ ভেঙে কে যেন ডাক দিল,
“হেইইইইই... দ্যাকদ্যি, আমাদ্যে ভুট ঠিক্ঠিক যাচ্চেন্যায়ি...”
পাশ থেকে পুলিশসেক্টর বলে, “আরে,
বাবা, ঠিক আছে। এত চিন্তার কী আছে, শুনি?”
“ঠিকাছে মাইন? আমাদ্যে ভুট...
দিল্লিব্ধি যাবে... দেখিদ্যিতি হুয়েন্যা?”
তার মুখের ভুরুভুরু হাঁড়িয়ার গন্ধে
সারা মাঠ ভাসছে। মাথায়, পিঠে ব্যান্ডেজ নিয়ে এল শান্তিরাম। সম্বর হাত ধরে তাকায়।
যেন বলছে, আপনি কী পেলেন, জানি না। আমরা তো ইতিহাসের সাক্ষি থেকে গেলাম। আমাদের
সেই সুখের দিনের জন্য আমাদের এই সামান্য রক্ত যেন সফল হয়...
মাঠ ভেঙে কোকিলপার্টির এক এজেন্ট
ছুটে এল। পেছন পেছন পেঁচাপার্টি, ময়না, শালিখপার্টির এজেন্টরাও। তাদের সাথে
গ্রামের আরও কিছু লোক। আপনার ভয় নেই, সার। পথে লোক জেগে আছে। আমারা পেছন পেছন
যাচ্ছি... সবাই।
তো, ভ্যানের পেছনে সম্ব পা ঝুলিয়ে
বসে। ভ্যানো স্টার্ট দিতে মাঠে এক কলরব ভেসে ওঠে। সেনেটির হাত এগিয়ে এসে তখন ছুঁয়ে
দিয়েছে সম্বর হাতদুটো। ফিসিফিসিয়ে বলছে, “স্যার, আমার প্রথম ভোট... মনে থাকবে...”
ভ্যানো চলতে শুরু করেছে। হাতের ছায়া
সরে যেতে সম্বর মনে হল, বাতাস ফুঁপিয়ে উঠেছে। একফোঁটা জল পড়ল কি আঙুলের ওপর?
মন্তব্যসমূহ