এন্টিফিকশন : তৃতীয় কিস্তি ।। শিমুল মাহমুদ ।।

এন্টিফিকশন : তৃতীয় কিস্তি
মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর
শিমুল মাহমুদ

জুঁইদিকে হারানোর আগে একটা গল্প লিখেছিলাম। সেই গল্পের নাম নেই। শুধুই নির্জলা গল্পের দু-একখানা কল্পকথাসহ জুঁইদির দিকে তাকিয়ে থাকি। আর তখন আমার বিশ্বাসপ্রবণ চোখের ওপর নির্ভরতার হাসি ছিটিয়ে জুঁইদি বলে ওঠে, একদিন এমন এক রাত আসবে সেই রাতে আকাশে কোনো তারা থাকবে না, শুধুই প্রকাশ পাবে একজোড়া চাঁদ। 
এই বাক্য, আসমানকথা জ্ঞানে এখনও তাকিয়ে থাকি অসভ্য জোছনার দেহে; যদি দেখা দেয় আকাশের কোনো এক কোণে, কোনো একদিন একজোড়া চাঁদ।
জুঁইদি, কেমন আছো? আমি আমার তেরো বছর হারিয়ে আজ তেরো সালের  বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই; হাঁটতে হচ্ছে আমাকে; জুঁইদি তুমি কি দেখতে পাচ্ছো আমাকে? এমন কোনো নদী নেই যা বুকে ধরে রাখা যায়; এমন কোনো আকাশ নেই যা আঙুলে ছুঁয়ে দেয়া যায়; এমন কোনো প্রেম নেই যা দেহকে ধরে রাখতে পারে আজীবন।
আমি তখন সন্ধ্যার মুখোমুখিতে বসে। লিখতে ইচ্ছে করে না; ভাবতেও ইচ্ছে করে না। তারপরেও মাথায় সম্ভবত এমন কোনো ছবি জেগে ওঠে যা ঠিক ভাষা খুঁজে পায় না। সেই ভাষাহীন বোধের ছায়াভাষায় লেখা হয়, আজকাল শূন্যতার মাঝেই আমি আমার মৌলরূপ খুঁজে পাই। বেঁচে থাকার নাম যদি জীবন হয়, তবে এতটুকু বলতে পারি, বেঁচে থাকা অথবা টিকে থাকার তাগিতে আমরা লড়াই করি; ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হই বারবার কর্মময় যন্ত্রের চাকায়। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। আমরা কি হাপিয়ে উঠতে শুরু করেছি? অথবা শুধুই স্বপ্ন?

আর তখন অবচেতন থেকে জেগে উঠি আমি। চিঠি লিখতে শুরু করি কোনো এক শ্রমিকের কাছে। কোনো এক শ্রমিক নয় বরং সেদিন সম্ভবত ১২ সেটেম্বের।  ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামরায়; তখন সাধারণ নাগরিকদের জন্য তৃতীয় শ্রেণি বলে একটা শ্রেণি ছিল; এখনকার মতো সুলভ শ্রেণি বলে কিছু ছিল না; তখনও বাংলাদেশের ট্রেনগুলোর দেহে সবুজ রং লাগানো হয়নি; সবই ছিল লাল; যেন বা লালমানুষগাড়ি; অনেকটা লাল মালগাড়ির মতো; সেই লাল মানুষগাড়ির কোনো এক কামরায়, তখন কামরায় কামরায় বেঢক দরজায়, লোহার লাল দরজার পাশে ট্রেনের বাহিরদেয়ালে, মেটাল দেয়ালে ক খ গ ঘ ... চ ছ ... ঞ এইভাবে চিহ্নিতকরণ কোনো সূচকচিহ্ণ দেয়া হতো না। কেন-না তখন এরশাদ সাহেবের সামরিক মেজাজ; তখনও তিনি বাংলাদেশ রেলওয়েকে আধুনিকিকরণ প্রজেক্টের আওতায় নিয়ে আসার অবকাশ অথবা ঠিক ভেবে উঠতে পারেননি। সেই ভাবনাবিহীন লালরেলগাড়ির ভেতর সারিসারি খয়েরি কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে সামনের লোকটিকে দেখছি।  

লোকটি ডান হাতের নোখ দিয়ে নাক খুটছে, নাকের ময়লা বের করছে; চোখের সামনে নোখ উঁচিয়ে ময়লা পরখ করার পর থাইয়ের ওপর যেখানে ট্রেট্টনের ক্রসচেকওয়ালা প্যান্ট লেপটে আছে সেই প্যান্টের কাপড়ের ওপর নোখ ঘষে নাকের ময়লা পরিষ্কার করছে। অনেক সময় ধরে সে তার এই একান্ত প্রিয় নিবিড় এবং একান্ত ব্যক্তিগত কাজটি করে চলেছে; অথচ যেন বা লোকটি এই প্রচণ্ড ভিড়ের ভেতর থাকা সত্ত্বেও খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে উঠল

লোকটি সরাসরি সামনের বেঞ্চে, আমার দিকে তাকায় লোকটির চোখে কোনো ভাবাবেগ নেই; নেই কোনো অর্থ অথবা ভাষা; যেন বা দৃষ্টিহীন অন্ধ; চোখজোড়া ধূসর; ওর লম্বাটে জুলফির মতো ধূসর। আর তখন লোকটি তার ধূসর জুলফির নীচটায় চুলকাতে থাকলে, সেই জুলফি নেমে এসেছে কান ঘেঁষে কানের নীচে; অথচ সেই সময় এরকম লম্বা জুলফি রাখার চল ছিল না; সেই ধূসর সুলম্বা জুলফির নীচটায় চুলকাতে গিয়ে লোকটি খক শব্দে ওর গলা থেকে কফ উঠিয়ে নেয় জিহ্বার তালুতে; নির্লিপ্ত, এবং তালুর ওপর যত্নে রাখা কফ যেন বা ঘন টকমিষ্টি কোনো নিরাপদ অতি জরুরি বোতলের ছিপিখোলা দ্রবিভূত ধূসরঘন ঔষধ অথবা হতে পারে পোড়া থকথকে দুধের সর; লোকটি সেই গোপনীয় সরতুল্য কফ চালান করে দেয় গলায়; গলা থেকে বুকের খাদে।

খানিক পর, লোকটি নাক খুটানোর কাজে বিরতি নিলে তার ডান হাতের কালো নোখওয়ালা আঙুল যেন বা নোতুন কাজ খুঁজে পায়; এবারে ডান হাতের মধ্যমা এবং বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে নাকের ডোগা, ডোগা থেকে ডোগার নীচে নাকের গোড়ায় কালো নোখের চাপে বেশ কিছুটা যেন বা চেঁছে নিতে শুরু করেছে, যেন বা অতি গোপনীয় কিছু চিপে তোলা হচ্ছে উপরে; এভাবে একান্তে নাকের শাল, সাদা শাল, যা ছিল সূঁচের ডগার মতো ধারালো অথচ দুগ্ধধবল আর এ অবস্থাতেই লোকটি সহসা কথা বলে ওঠে, যেন বা অনেক দূর থেকে পরিচিত কেউ, ছোটভাই কই যাইবেন?

মেজাজ নোংরা হবার পরিবর্তে যেন বা খানিকটা মন্ত্রমুগ্ধ হলাম। পাঁচবার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রবাহিত হতে যেটুকু সময় লাগে ততটুকু পর হেয়ালি কণ্ঠে জবাব দেই, ঠিক জানি না, ঠিক কোথায় যেতে হবে আমাকে অথবা আপনার কোথায় যাওয়া উচিত। লোকটার ভেতর খানিক বিস্ময়। লোকটার জামা থেকে খানিক বিস্ময় ঝরে পড়ে। লোকটার নোংরা গোঁফজোড়া থেকে বিস্ময় গড়িয়ে নামে; সুলম্বা ধূসর জুলফি বেয়ে বিস্ময় গড়িয়ে নামে গলায়। আর তখন, বিস্ময়ের খাদ থেকে চিকন দুর্বল গলায় বোধ বিস্ফোরিত হয়, ছোটভাই কি কবি?

আমার মাথার এলোমেলো চুলে মমতা চিকচিক করে ওঠে। সেই মমতা, চুল বেয়ে কানের পেছন দিয়ে পিঠে নেমে যেতে থাকলে আমি চোখ তুলে তাকাই, আপনি কী কাজ করেন? 
লোকটি নির্লিপ্ত, যেন বা একজন কবিকে এড়িয়ে চলা অথবা উপেক্ষা করা; লোকটি ট্রেনের ছাদের দিকে তাকায়; তারপর অতি ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বাঙ্কারের ওপরে অভ্যেস বসতো বসে থাকা একটা প্রাচীন ট্র্যাভেলিং ব্যাগ, রেক্সিনের গায়ে ধূসর ময়লা যেন বা একরাশ বিস্ময়ের মতো এক রাশ ধুলো ট্রেনের ভেতর বসে থাকা পেসেঞ্জারদের শরীরে উড়ে এসে সবাইকে ধুলোজনিত এলার্জিতে ক্লান্ত করে দেবে; আর তখন পেসেঞ্জারদের ভেতর থেকে কেউ কেউ অসহিষ্ণু বদরাগি মুখ ঝামটে উঠলে যেন বা কিছুই হয়নি এমন একখানা ভাব নিয়ে পুরোনো রং ওঠা চেইনছেড়া ব্যাগখানা নামিয়ে পায়ের থাইয়ের ওপর রাখে। বেগ থেকে বেড়িয়ে এল সিমেন্টের কাগজ দিয়ে তৈরি খাকি রঙের ঠোঙা, ঠোঙার ভেতর থেকে রুটি, রুটির ভেতর আলুভাজি, আলু ভাজির পাশে ডিম সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধর পাশে মরিচ-লবনের মিহি মশলা আর তাজা দুটো কাঁচা মরিচের সাথে এক টুকরো ঘোলাটে কচকচে পেয়াজ। বুঝলেন কবিভাই, মা এখনও একটা একটা কইরা আমি যা যা পছন্দ করি সব গুছায়া দেয়; ট্রেনে খাওনের জন্য দেছে, আমি এখন যদি না খাই, মায়ে কষ্ট পাইবো; তারে ফাঁকি দিতে পারি না; এখনও আইবার কালে খুচরা টাকা পয়সা দিয়া দেয়, পারে না কিন্তু দিবই, আর কইবো রিক্সা ভাড়া, মায়ে জানে আমি রিক্সায় চাপি না, ওইটা একটা বাহানা, পারুক আর না পারুক টাকা দিবো, কিন্তুক আমি যদি রাইগা যাই, তাই নানান কথা আর তহন মায়ে আমারে কোনো কথা কইতে না দিয়া আমার কপালটা বুকের মধ্যে টাইনা নিয়া চুমা খায় আর বিরবিরাইয়া কয়, ও গ্যাদা রাইতে বদ সপন দেখছি আইজ না গেলে চলবো না?

লোকটার কি গলা ধরে এল? নাকি আবারো কফের কারসাজি। লোকটা একটা রুটি পরিপাটি করে আমার দিকে এগিয়ে ধরে। আমি রুটির পরিবর্তে দেখতে পাই ময়লা নোখ, যেখানে নাকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ময়লা জমে আছে। কীভাবে ফিরিয়ে দেবো বুঝতে পারি না; হাত গুটিয়ে রাখি। ভাইসাহেব আমার মা সারাটা জীবন শুধু কষ্টই পাইছে, নেন এই রুটিটায় মায়ের হাত লাইগা আছে।  
আর তখন, আমার হাত এগিয়ে যায় মায়ের দিকে, রুটির দিকে।
আপনের মা থাকেন কোথায়?
থাকে না, বাড়ি নাইকা।  
আমি বিরক্ত হই না। মমতাবোধ করি। তা হলে কি লোকটির মা প্রাচীন আকাশের মতো কোনো এক গোপন দূরত্বে বসে আমাদের দেখতে পাচ্ছেন? আমরা কি বিমর্ষ? আমি কি নিঃসঙ্গ, একা? এখনও একা? আমি কি আমাদের ভেতরের যাবতীয় নিঃসঙ্গতা এড়াতে লোকটির সাথে নিবিড় হয়ে উঠতে শুরু করেছি?  
বললেন না আপনার পেশা কী, আপনের নামও তো শোনা হয়নি এখনও?
লোকটা খায়, লোকটা চিবায়, লোকটা কফমাখানো নরম রুটির দলা গিলতে থাকে; লোকটা দাঁতের ভেতর আঙুল চালান করে দিয়ে দাঁতের গায়ে লেগে থাকা রুটির নরম কাদাকাদা আটা পরিষ্কার করে; বোতল থেকে পানি ঢালে জিহ্বার নালিতে, কুলকুচা করে তারপর সেই পানি গিলে ফেলে। এক সময় এই দীর্ঘ রুটিগেলা পর্বের সমাপ্তি ঘটলে লোকটি স্থির হয়ে বসে থাকে।
তারপর, কবিভাই সিগারেট চলবে?   
এই ভায়ানক আহ্বান উপেক্ষা করতে পারি না, চলেন, দরজার কাছে যাই।
ক্যান? এইখানে আরাম কইরা টানেন, ওইদিকে ভিড় বেশি।  
তারপর পাঁচসিকা দামের টিনের একখানা লাইটার, যে লাইটারের ফ্রেম অনেকটা মালগাড়ির সামনে লাগানো কয়লার ইঞ্জিনের মতো গোল লম্বা, নাকের চতুর্দিকে ছোট ছোট ছিদ্র, গোড়াটা মালগাড়ির ইঞ্জিনের মতো অপেক্ষাকৃত এক থাক চওড়া। স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে থেকে ফেরিওয়ালাদের বেঁচতে দেখা লাইটার দিয়ে ফিল্টারবিহীন ক্যাপিস্টান সিগারেট ধরায় লোকটা। এই ধরেন। আমি সিগারেট নেই। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখি, বুকপকেটে রেখে দেই।
আমি একটু পরে ধরাই, সামনের স্টেশনে নেমে চা খাওয়া যাবে, তখন ধরাবো; এখন বলেন আপনি কী কাজ করেন?
লোকটা চুপ করে থাকে; যেন-বা জানা নেই এর কোনো উত্তর। সিগারেটের ধোয়ায় জড়ানো ধূসর মুখ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসে, শক্ত চওড়া ইটা ইটা ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে, হয়তো বা ওই ফাঁকের ভেতর সিগারেটের পাছা ঢুকানোর কথা ছিল; কিন্তু এই ঢুকানোর কথাটা সে ভুলে গিয়ে, ধোঁয়ার ভাবধরা ভাবটা ভুইলা গিয়া বিরবিরাইয়া কয়, কাজ নাই, মালিকের গোলামি করি; রাবার বাগানে। বুঝেন না, রাবার টানলে লম্বা হয়, দিঘলা হয়, বড় হয় কিন্তুক আমারে টানলে কিচ্ছু হইবো না; এই যাই আছি তাই থাকমু।
ওর কথা শুনে মজা পাই; লেখার খোরাক পাই; লোকটারতো হিউমার টনটনা; লোকটার ভেতরে কি পাহাড়ের সমান ক্ষোভ ঘাপটি মাইরা আছে? আমাদের দেশে কি রাবার চাষ হয়?
হইবো না ক্যান? মাইনষের চাষ হইবার পাড়লে, রবারের চাষ হইতে দোষ কোথায়? এই যেমন ধরেন আপনেকেও তো জনগণের পূঁজি দিয়া চাষবাস কইরা বানানো হইতেছে, যাতে আপনে টাকাওয়ালাগো গোলামী করবার পারেন।
আমার ভেতরটা জেগে ওঠে। আমার মাথার চুলে জেগে ওঠা অথবা লেপটে থাকা মমতা পায়ের পাতায় গিয়ে চুলকাতে শুরু করে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না এই রকম জাত আউলানো কথায় আমার কী বলা উচিত। লোকটা কি আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের সাথে যুক্ত? আমার কপালে তখন আগ্রহের স্বেদবিন্দু ট্রেনের ভেতরের ভারি বাতাসের চাপে জমাট বাঁধতে শুরু করে। আসুন আমরা পরিচিত হই, আমি মামুন মিজান, কবিতা লিখি, আপনার নাম?
এইটা কি কইলেন কবি, গোলামের আবার নাম থাহে নাকি? আপনে কবি, কবির নাম থাকনের দরকার আছে, নাইলে আপনারে আমরা চিনমু কেমনে? তাই বইলাতো দুইনার সবাইকে চিননের দরকার পড়বো না?  
তারপর লোকটা থাইমা যায়। যেন বা খুব গোপনীয় কোনো তথ্য ফাঁস কইরা লোকটা হঠাৎ সাবধান হইয়া গেছে। এরপর এক কি দেড় মিনিট পর ঘপ কইরা বইলা বসে, নাম নাই।

লোকটার কি মাথায় ছাট আছে? কবিভাই আমার কথায় রাগ লইয়েন না, মনটা বিষাইয়া আছে; আসলে আমরা সব্বাই ভণ্ড
লোকটা সব্বাইশব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করে যেন তাজা ভারি শব্দটা ওর ঠোঁট আকড়ে এখনো ঝুলছে। আমি শব্দটার চেহারা দেখতে পাচ্ছি; ইচ্ছে করলে হাত বাড়িয়ে ওর ঠোঁট থেকে টেনে ছিড়ে এনে হাতের তালুর ওপর রেখে চোখের সামনে এনে এখন নেড়েচেড়ে দেখতে পারি এই সব্বাইশব্দটি।

আমাদের প্রাচীন লালরেলগাড়িটা গুয়াখাড়া স্টেশন অতিক্রম করতে থাকে। লোকটার পাশে বসে থাকা মহিলার নিতম্বদেশের গোপন গর্তে অসভ্যরকমের ফুলে ওঠা গুটিকয়েক পাইলস খোঁচাতে শুরু করলে অবমানবীর শ্যামলা রং ঘন হতে গিয়ে পক্ষান্তরে কালো হয়ে উঠলে মাতারি বেটির পান খাওয়া, চামচিকার মতো খয়েরি দাঁত জংলি বিড়ালের মতো হা হয়ে ওঠে

আমি শুনতে পাই ওর নাকফোলানো পাইথন আওয়াজ; যেন-বা আমার মুখে এসে ভর করে মহিলার প্রাচীন গন্ধে ঠাসা জংলি নিশ্বাস। মহিলার চোখ ফুলে ওঠে; তারপর  গোল গোল মৌচাক হয়ে যেন-বা তাচ্ছিল্য করে আমাকেআমার গলার ভেতর থুথু আটকে যায়। আমি থুথু আটকে রেখে জানালায় তাকাই, দেখতে পাই দুইখানা অবমানবের বাচ্চা ট্রেনের দরজা ধরে ঝুলতে ঝুলতে নেমে যাওয়ার চেষ্টায় পক্ষান্তরে দ্রুত এগিয়ে চলা রেলপাতের অজস্র পাথরের শরীরে আছড়ে পড়ছে।

এক দঙ্গল ট্রেনভর্তি অবমানবদের বানরমাথাগুলো থেকে অজস্র কালো বাদামি চিকন ফোলানো অথবা গর্তে ঢোকানো কুতকুতে বিস্ফোরিত তীরবিদ্ধ দৃষ্টি। চিৎকার। পকেটমার হালায় মরছে উচিত কাম হইছে।
আর তখন চুলদাড়ির একটা ছোটোখাটো জবুথবু বোঝা ঘাড়ের ওপর নিয়ে, যেন বা নিজেরই মাথা নিজেকে বহন করার দায় ওর নেই; নিজের জামার বুকের ভেতরটা খামচে নিয়ে পকেট উদলা করে চেঁচায়, হালায় আমার সব নিয়া গেছে, হালায় আমার পকেট কাটছে।
আর তখন ওকে যেন বা ঘিরে ধরে ভিড়ের চোদনে চেপটে ফেলবে এমন একটা জটলার ভেতর থেকে বেয়াক্কেল টিটি সাহেব, এই এত্তগুলান মাইনষের মধ্যে বেয়াক্কেল বেটাছাওয়াল তোমরার পকেট কাটলো, তুমি কি হালার বেহুশ, নেশা খাইছো?
ট্রেনটা তখন একটা প্রাচীন মরিচা ধরা এক দঙ্গল লোহার সাঁকোর উপর দিয়া পার হইয়া যায়; পার হইয়া যায়, আর আমাগের দেশটা রেলের চাক্কার নীচে রেপ হইবার লাগছে; আর তখন রেলগাড়ির প্রাচীন ইঞ্জিন পাথ্থরের উপর দিয়া যাইবার লাগলে মনে লয়, মনে মনে পাত্থরগুলানকে গাইল পারে, নটির ছাওয়াল, হোগা মারা দেওনের আর টাইম পাওনা?

কবি মামুন মিজান হাপিয়ে ওঠে; পেছনে তাকায়। সেই দিন রাতে সে তার মফস্বল শহরে ফিরে গিয়ে লোকটার কাছে চিঠি লেখে। চিঠি লেখে মহেশখালির রাখাইন পল্লীতে মিতাশ্রীর কাছে; তারপর প্রিয় জুঁইদিকে। মামুন যেন আর কোনো কাজ খুঁজে পায় না; বুঝতে পারে না কেন ওর জন্ম হয়েছে? কী কাজের জন্যই বা ওর বেঁচে থাকা? বই ঘাঁটে, হুইজিঙ্গারকে ভাবতে থাকে, আনন্দ করার ক্ষমতাকে জিইয়ে রাখতে পারার জন্যই মানুষ প্রাণীজগতে অনন্য। হুইজিঙ্গারের এই নটিমার্কা কথা নোতুন কিছু না। অনন্তের রহস্যকে উন্মোচনের জন্যই আমাকে কবিতা লিখতে হবে; মানুষের গল্পগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দিতে হবে আগামী মানুষের জন্য।



মন্তব্যসমূহ