জ্ঞাতব্য
দেবাশিস রায়চৌধুরী
ভোরবেলা কথা বলল রঘুপাগল। কথা বলে সে নিজেই অবাক। কত দিন,
কত বছর আগে সে কথা বলত, সে কথা তার স্মরণে নেই। জাগতিক বিষয়ে নিস্পৃহ হতে হতে, কম কথা বলতে বলতে, কখন সে সম্পূর্ণ কথা
বলা বন্ধ করে দিয়েছে সে কথাও মনে পড়ে না। এই রকম বোবা হয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছে দিন।
আজ আচমকা কথা বলে ফেলে সে নিজেই অবাক হল।
প্রতিদিনের মতো ভোরে শহর পরিক্রমায় বেরিয়েছিল। একটা স্কুলবাস
যাওয়ার সময় তার গায়ে ছড়িয়ে পড়ল অজস্র ফুল। ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল, জানলা থেকে হাত
বাড়িয়ে টা টা করছে একদল কচিমুখ। তখনই অনেকদিন পরে তার মুখ থেকে শব্দ বেরিয়ে এল,
‘ভালো থাকিস বাছারা আমার।’
সকালে নিয়ম মতো বটতলায় এল। বটতলার এক দোকানী তাকে রোজ এক
ভাঁড় চা আর একটা পাউরুটি দেয়। বাঁধানো বটগাছের নীচে ঢিপি হয়ে পড়ে আছে শীতলা, মনসা
ইত্যাদি প্রতিমা। দোকানে ঢোকার আগে সেখানে দাঁড়াল একবার। মুখে মজার হাসি, কথা ফুটল
আবার, ‘তোমারা কেউ ঠাকুর নাগো, সবাই পুতুল। আমার ঠাকুর ওই যে।’ ইঙ্গিতে সে
দোকানীকে দেখাল।
প্রচণ্ড গরম। আরও গরম ভোটের হাওয়া। দুপুরে সে শুয়েছিল
বাচ্চদের স্কুলের সামনে। কদমগাছের ছায়ায়। ছুটির পর মা-বাবার সাথে ছেলেমেয়েরা বাড়ি
ফিরছে। আচমকা একটা ফুটফুটে মেয়ে দৌড়ে এল। তার সামনে আইসক্রিমের একটা কাপ রাখল।
আবার দৌড়ে ফিরে গেল। রঘু এই নিয়ে তিনবার কথা বলল, ‘বড়ো হয়ে তুই মস্ত এরোপ্লেন
চড়বি।’
সন্ধ্যায় প্রেমিক–প্রেমিকা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তাকে পাশ
কাটিয়ে গেল। সে উদাসীন তাকাল। খানিক পর, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে গান গেয়ে উঠল, “গোলেমেলে
গোলেমেলে পিরীত করো না।”
রাতে তার জন্য অলিখিত বরাদ্দ, পার্কের বেঞ্চে সে ঘুমিয়ে
পড়ল। মাঝরাতে পাশ ফিরতে গিয়ে সে দেখল,
বেঞ্চের সামনে ঘাসের উপর চারজন মানুষ। আবছা আলোতে দেখা গেল কয়েকটা বোতল, খাবারের
প্যাকেট। নাকে ভেসে এল মাংসের গন্ধ। শুনতে পেল চারজন কাউকে মেরে ফেলার আলোচনা
করছে। আধো ঘুমে রঘু দিনের শেষ কথা বলল, “পাপ, পাপ। মানুষ মারা মহাপাপ।” নিস্তব্ধ
রাত্রে সে-কথা গ গড়িয়ে গেল খানিকটা দূর। পরদিন সকালে হতচকিত শহরের মানুষ দেখল,
কপালের মাঝখানে একটা ফুটো নিয়ে লাশ হয়ে শুয়ে আছে রঘুপাগল।
অনেকের জানতে ইচ্ছে করেছিল পাগলকে কেন খুন করা হল। অনেকে
জানতে চেয়েছিল বোবার কোনো শত্রু হয় নাকি!
মন্তব্যসমূহ