হরিপদ
অমিতকুমার বিশ্বাস
হরিপদ'র একটাই গুণ-টিউশানি করা। সকাল বিকেল রাত। সব সময়। বাকিটা সময় স্কুলে নমো
নমো করে কাটিয়ে দেয়। ছুটির দিন সকাল থেকে
রাত বারোটা-সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলমান এ-মহাযজ্ঞ। এ-সব করে তার প্রচুর টাকা।
এদিকে স্কুলে পড়ানোর ফুরসত নেই। সেখানে
বার্ড ফ্লু-র
ডেমোন্সট্রেশন
। চক-ডাস্টার ছাড়াই ক্লাসে গিয়ে গল্প, বলে 'বাকিটা টিউশানিতে’।
হরিপদ এক নামি ইস্কুলে পড়ায়। সে-আমলে বাবা পার্টির হোমরা-চোমরা, ব্যাস্! ছেলে তাই কোনওমতে পাশ করে ঢুকে গেল।
ঢুকেই রাতারাতি বিগ-বেন, কারণ সে-এক বিখ্যাত স্কুলের শিক্ষক ছিল ।
হরিপদ বিয়ে করেছিল কি না জানা যায়নি, তবে বিয়ে করে থাকলে অন্তত দশ ভরি সোনা আর তিন লক্ষ টাকা নগদ অবশ্যই নেয়, আর তারপর পাঁচ-পাঁচটি মেয়ে হয়, ছ-নম্বরে ছেলে ট্রাই করতে গিয়ে বৌটার অক্কালাভ, নইলে আবার মেয়ে, তবে প্রতিবন্ধী। পরে আবার বিয়ে। এবারে গেইনার। একটা ছেলে। সবই লালবাবার কৃপায়! সে তো
নিমিত্ত মাত্র। মনে তাই হেব্বি ফুর্তি।
স্কুলে ঢুকে পার্টিকে চাঁদা দেওয়া, মাঝে মাঝে মিটিং-মিছিলে ঢ্যামনার মতো দাঁড়িয়ে থাকা, ভোটভোটের সময়
গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে মিছলের পিছু পিছু যাওয়া ইত্যাদি প্রভৃতি কাজগুলো মন দিয়েই করে হরিপদ।
কিন্তু তাঁকে কিছু বলতে বললেই সে একদম চুপ মেরে যায়, কারণ টিউশানি ছাড়া আর কোথাও ভালো বলতে পারে না সে। বাড়িটা দোতলা ছিল। পরে তা তিনতলা হয়। তিনতলায় তার এক অবিবাহিত শালিকা থাকত। যদিও সে শালিকা কি না তা কোনো দিনই জানা যায়নি।
টিউশানির মাস-মাইনে বকেয়া থাকে না, কারণ মাস শেষ হবার আগেই হরিপদ চেয়ে চেয়ে মাইনে সংগ্রহ করে, কিংবা মাস শেষ হবার পর কোনও ছাত্রছাত্রী আর পড়তে না এলে সে নিজে গিয়ে অথবা চাকরকে পাঠিয়ে বকেয়া মাইনেটা আনিয়ে নেয়।
হরিপদ টিভি দ্যাখে না। পেপার বা বই-ও পড়ে না।
কখনও যাত্রা শোনে না।
টলিউড-বলিউডের সিনেমা দ্যাখে না। তবে মাঝে একদিন এক পানু
সিনেমা হলের ব্যালকানিতে ঢুকে পাশে বসা এক উঠতি ইয়াং ছেলেকে পর্দার নায়িকার মুখে
মিসাইল বেগে বীর্য নিক্ষেপ করতে দেখে তার সবকটা মাথায় উঠল! এরপর বেঁধে গেল গণ্ডগোল। হুড়োহুড়ি।
ফলে সব পণ্ড ! শেষে মান-সম্মান
বাঁচানো দায়। কারণ স্কুলের অনেক ছাত্র সেখানে ছিল।
ভাগ্যিস সময়টা শীতকাল। চাঁদর আর মাফলারে মুখ ঢাকা।
তবু মুখের দিকে দু-একটা ছোকরা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে, যেন এখুনি 'ইউরেকা ইউরেকা' বলে চিৎকার শুরু করে দেবে, আর হরিপদ রাজপথে দিগম্বর হয়ে ছুটবে অবিরাম! উত্তরাধুনিক রিভার্স সুইং। এই ঘটনার পর অশ্বত্থামা
হত। অগত্যা বাড়িতেই সকল ব্যবস্থা নির্মাণ ।
হরিপদ-র বাড়ির কাজের মহিলারা মোটা মাইনে পায়। তাদের নানাবিধ কাজ। মাঝে মাঝে গা-টা ম্যাজ ম্যাজ করে। তখন। স্কুলের কারো সঙ্গে কোনো
ঝামেলা বাধায় না হরিপদ। হেডমাস্টার কাজ না করলে
বা ‘ক্যানপুর’ থেকে বাড়ি বসেই রেগুলার ডিগ্রিলাভ
করলেও হরিপদ বিজয়ার দিন বাড়ি গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কার্তিক ময়রার মিষ্টির
হাড়িটা মিনি বৌদির হাতে তুলে দিয়ে আসে। তেমনই অন্য শিক্ষকেরা শিক্ষিকাদের সঙ্গে ঝাড়ি মারলে কিংবা ঝাণ্ডাবাহী দপ্তরী টেবিলে পা তুলে বিড়ির ধোঁয়া মহাশূন্যে ছুঁড়তে থাকলেও কোনো প্রশ্ন তোলে না হরিপদ। স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো। বগলের পাশ দিয়ে তাদের
হাত ধরা, চুলে বিলি কেটে দিয়ে কথা বলা কিংবা কারও কারও ক্ষেত্রে চওড়া পিঠে হাত রাখা হরিপদ’র একটা সাধারণ মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ-জন্য কেউ কেউ তাকে 'পাইপগান' বলে ডাকে।
কিন্তু হরিপদ
এ-সবে বড্ড উদাসীন। সারা
জীবন অবলীলাক্রমে এই সব লীলা করে এসেছে, আর করে আসবেও, এতে তার কোনও লজ্জা নেই, ঘেন্নাও নেই।
হরিপদ-র বাড়িটা বাজারের কাছেই। আর সময় পেলে সে বাজার করতে যায়। তবে তা ঠিক বন্ধ হবার একটু আগে। সস্তায় কিছু নিয়ে আসে। মুরগীর গিলে-মেটে-চামড়া পলিথিনের প্যাকে নিয়ে টুক করে ব্যাগে চালান হয়। কেউ দেখে ফেললে সে কী উত্তম হাসি! বলেন, 'আরে মশাই, এতেই তো আসল শক্তি।
মাইটোকন্ড্রিয়া। কোশের শক্তিঘর! হা হা!’ এহেন
হরিপদকে যে-সব নিন্দুকেরা ইতিমধ্যে কিপ্টে ঠাওরেছেন,
তাদের সেই নিরঙ্কুশ অহংকারে সে মুত্রবিসর্জন
করে দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের বিজয়ার খাওয়াদাওয়া দিয়ে। বিরিয়ানি, কোকাকোলা, চোকোবার, আর কী কী সব আইটেম ছিল ছেলেপুলেদের জন্য!
হরিপদ জানে টিউশানির
ব্যাপারে বাড়ির মহিলারাই মোড়ল। তাই
হ্যান্ডসামরা অগ্রাধিকার পান। সে-জন্যে ইয়াং ছেলেপুলেরা সুপারহিট।
আসলে তার ধারনা, এ-এক প্রকার লিবিডোর
সামারসল্ট! বিশেষ করে চল্লিশের পর। দ্বিতীয় ইনিংসের মজা। তাই নতুনদের টক্করদিতে পার্লারে যায়। ফেসিয়াল করে। চুলে হেনা,রঙ আরো কী কী সব করে। আর মা-মেয়ে উভয়েই হয়তো হাবুডুবু খায়। নীরবে। লিবিডোর নির্বাক ছায়াছবি টাঙান থাকে দেওয়াল জুড়ে।
হরিপদ জানে ভালো টিউটর হওয়া মানে ভালো শ্রমিক হওয়া, তবে এক্ষেত্রে সম্মান বাড়ির কাজের মাসির থেকে একটু বেশি। কারণ ওই পেটে বিদ্যে। তাই অকারণে দাঁতখিঁচুনি দর্শন হয় না । সে খুব খাটে। নোটবই দেখে নোট করে। নোট লেখায়। আবার নোট গুনে নেয়। কাটা-ছেঁড়া ফেরত দেয়। টাইম টাইম পড়ায়। পড়ানোর সময় মাঝেমাঝেই তার মুখ দিয়ে কেবল 'হোপহোপ' শব্দ হয়, বিশেষকরে সামান্য রেগে গেলে।
তাই ছাত্রছাত্রীরা টয়লেটের দেওয়ালে, মুতের বেসিনে, টেবিল-বেঞ্চে, নিজেদের খাতায় এমনকি স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নে লিখে রাখে 'হরিহোপ হরি... হরিহোপ হরি... জু জু জু উ উ উ...!’
হরিপদ'র কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু বলতে একমাত্র মদন, যার সাথে তার পরিচয় কীকরে হল সে নিজেও জানে না। মদনের সাথে মাঝে মাঝে মাল খেত, কিন্তু সেই মদন একদিন টাকা পয়সা নিয়ে চম্পট দিল। তারপর থেকে একাই মদ খায়। কেন খায়? সে জানে না।
আশেপাশে সবকটি ব্যাঙ্কে ও পোস্ট অফিসে তার অ্যাকাউন্ট আছে। সে টাকা সুদে খাটায়। গরুপাচারের সিন্ডিকেটে
তার টাকা খাটে। এতে নাকি লাভ হয় বেশি। এছাড়া শেয়ার বাজারেও
কিছু টাকা খাটিয়েছে। তবে চিটফান্ডে
টাকা রাখতে গিয়ে প্রচুর টাকা জলেও গেছে ।
সারাদিন তার মাথায় টিউশানি টিউশানি আর টিউশানি। তাই সে দল পাকায়। টিউশানির সিন্ডিকেট করে। এ ওকে প্রোমোট করে, ও ওকে বা তাকে। বেশ চলে। 'আমার কাছে পড়তে গেলে ওদের দু’জনের কাছেও পড়তে হবে।' এইসব ফতোয়া। স্কুল ছাত্রছাত্রীরা পড়লে তাদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, প্রশ্ন বলেদেওয়া চলে। অন্য স্কুলে পড়লে সেই স্কুলের
উপযুক্ত লোকেদের কাছে প্রশ্ন শুনে নেয় ও তাদের বাড়ি যথাসময়ে উপঢৌকন পৌঁছে যায়।
দোষের মধ্যে দোষ, হরিপদ মাঝে মাঝে সোনাগাছি যায়। কামনা-বাসনা মেটে। মাঝে যখন স্কুল-শিক্ষকদের
টিউশানি বন্ধ হয়ে গেল, তখন সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াত। 'একবারে সবাই আসতে পারবে না, কেউ সাইকেল আনতে পারবে না, চটি
বাড়ির একটি নির্দিষ্ট জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে, টাকা বাড়ির কেউ কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে দিয়ে যাবে।' এত কিছু করেও যখন হুহু করে জল ঢুলে যাচ্ছে, তখন 'বাঞ্চোৎ পার্টি' বলে খিস্তিখেউড় করতে লাগল। এতে পার্টির একজন খুব
রেগে গেল, কিন্তু অপরজন একটুও রাগল না, বরং সে দু-পাটি বার করে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলে গেল, কারণ দু-মাস হল সে বিরোধী শিবিরে যোগদান করেছে।
হরিপদ'র অন্তত একটা মেয়ে থাকবে, যদি পাশের বাড়ির মাতাল ছেলেটার সাথে ভেগে না গিয়ে থাকে, অন্তত একটা ছেলে থাকবে, যদি এতদিনে সত্যিই সে বড়ো হয়ে থাকে। তার নাতিপুতিও থাকলেও
থাকতে পারে...। বৌ থাকলে বৌয়ের সাথে তার কেমন সম্পর্ক, বিয়ের পরেও সে সোনাগাছি যায় কেন, জানা নেই। আবার হরিপদ'র ভাই কিংবা বন্ধুর সাথে বৌটার কোনো সম্পর্ক আছে কি না তাও জানা নেই। এমনকি মদনের সাথে কোনো
সম্পর্ক আছে কি না, তাও...। ছেলে বা মেয়ে
থাকলে তারা কার ঔরসে হয়েছিল কে জানে, কারণ বিয়ে করে থাকলে সে তো কোনো দিন রাত বারোটার আগে ফিরত না, কারণ শেষ ব্যাচটা শুরু হত রাত দশটা থেকে। তারপর এসে খাওয়া দাওয়া। ক্লান্তি। শুয়ে পড়া । সকালে আবার দু-ব্যাচ।
শেষবেলায় হরিপদ বেশ চাপে ছিল। এলাকার কয়েকজন বেকার
যুবক 'গৃহশিক্ষক আন্দোলন' করে টিউশানি-করা স্কুল-শিক্ষকদের বেকায়দায় ফেলে দিল। কেউ কেউ শো-কজ খেল। 'কালো টাকা আয় করে শিক্ষকেরা- আপনারা তাদের কি সেখানেই পাঠাবেন?' পাবলিক হেব্বি খেল । কিন্তু সেই কালো কারবারীদের কাছেই নিজের ছেলেমেয়েদের
পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করল সবাই। যেমন এই মাত্র এক পাঠক স্বভাবদোষে এক শিক্ষককে গালি দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু যখনই মনে পড়ল তার বড় জামাই স্কুল-শিক্ষক, তখনই ব্রেকে পা দিলেন। এখন আপনি হয়তো
ভাবছেন সে-ই কি হরিপদ!
যাক, এত ঝামেলাতেও সে পড়ানো বন্ধ করেনি, বরং লিস্ট থেকে নিজের নাম বাদ দেবার জন্য নতুন পার্টিতে একটু হাঁটল, চাঁদা দিল। ব্যাস্। এহেন হরিপদ সফল না
ব্যর্থ --এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন কেউ কেউ, কিন্তু তুলে কোনো লাভ হবে না, কারণ হরিপদ নিজে এসে সেখানেও হিসি করে দিয়ে যাবে।
যাই হোক, হরিপদ ভাবল, অনেক হয়েছে, এবার ক্ষান্ত দি। ছেলেটা কথা বলে না, মেয়েটা ( কিংবা মেয়েগুলো) পালিয়ে গেছে, বৌটা-বা গেল কোথায়? নাতিপুতি, সোনাগাছির মেয়েগুলিই-বা কোথায় গেল? কিংবা সেই ছেলেটা, যার বীর্য সটান গ্রেনেডের মতো এসে লাগল রঙিন পর্দায়, সে?
ছাতে এল হরিপদ। আজ মনটা খুব খারাপ। কেন? জানে না। আজ
খুব মদ খেল। একটা আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে তারা গুনতে লাগল। পুবাকাশের উজ্জ্বল তারাটাকে অবিকল সুলেখার মতো দেখতে, কিশোর বয়সে যাকে দেখে তার ইয়ে হয়ে যেত। পাশেরটা কবিতার মতো, যার বুকে হাত দিয়ে মনে হয়েছিল বুকটা কলের চাতালের মতো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বোধহয় কৃত্তিম। জানা নেই। পাশেরটা রূপার মতো, যার স্তনবিভাজিকা দেখার জন্য নির্মলেন্দু স্যারের কাছে পড়তে যেত হরি। পাশেরটা সবিতামাসি, মানে কাজেরমাসি,
তার পাশে দুঃসম্পর্কের বৌদি,
যাদের সে দড়মার ফাঁক দিয়ে ইয়ে দেখত । ভাবতে ভাবতে মনে হল আরাম কেদারার নেটটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আর সে পড়ে যাচ্ছে মহাশূন্যে। শরীরটাকে
খুব শূন্য লাগছে। আকাশের
তারাগুলো নির্বিকার। বাতাস বইছে মনখারাপ করা প্রেমিকার
মতো। গাছের পাতাগুলো নীরব।
রাস্তার আলোগুলো ঐ বীর্য নিক্ষেপ করা ছেলেটার মতো দাঁড়িয়ে। আর সে পড়ে যাচ্ছে। নীচের দিকে। পড়ছে।
পড়ছে। এখুনি তার শরীর একান্নটা টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে
একান্নটি জায়গায়। সেইসব জায়গায় গড়ে উঠবে মাল্টি-সাবজেক্ট টিচিং সেন্টার, জয়েন্ট এন্ট্রাস কোচিং
সেন্টার, স্পোকেন
ইংলিশ গাইড, কম্পিটিটিভ এক্সাম কোচিং সেন্টার, কল সেন্টার ট্রেনিং ইত্যাদি। হরিপদ নামছে... নীচে... ক্রমশ আরো নীচে । শূন্যে মহাশূন্যে । চোখ বন্ধ হয়ে এল হরিপদ'র। ঠোঁটে তবু মৃদু হাসি। অবিকল মোনালিসার মতো।
মন্তব্যসমূহ