পাখিদের আত্মহনন
মাসুদার রহমান
মাসুদার রহমান
সবুজঘেরা ছোট্ট বাড়িতে
প্রতিভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। আর
ডাহুক পাখিটির কথা মনে পড়ে যায়। তখন বয়স কতই হবে, বারো তেরো। সপ্তমে পড়ি। সেই
বয়সটাতে কেন জানি পাখির নেশায় পেয়ে বসে অনেক গ্রাম্য বালকের, আমারও বসেছিল। সেদিন
দুপুরে জানালায় তাকিয়েছি ধানখেত ঘেষাঘেষি আলোছায়ামাখা কলাবাগানের ভেতরে। চোখ পড়ে একটি চঞ্চল ডাহুকের দিকে। মাথায় তখন দুষ্টবুদ্ধি।
পাখিটিকে ধরবার জন্য তাড়া করলাম আমি আর আমার বাল্যবন্ধু সোহেল মিলে। ডাহুক বলে কথা, সে লুকিয়ে পড়ল কলাগাবান ধানবাড়ির সবুজে। আমরাও নাছোড় দু’জন লেগে থাকলাম সেই পাখির পেছনে।
রাতে বিছানায় শুয়ে সেই ডাহুকের ডাক শুনি। দিনে স্কুল থেকে ফিরে ওর গতিবিধির উপরে আমাদের কড়া নজরদারি। কয়েক দিন পরেই
এক বিকেলে মোক্ষম সুযোগটিও পেয়ে গেলাম। ধানবাড়ি আর কলাবাগানের ভেতর থেকে ওকে
তাড়িয়ে নিয়ে এলাম মানুষের বসতভিটের দিকে। এবার আর পাখিটির সুযোগ রইল না ধানবাড়ি
কিংবা কলাঝোপের সমুদ্রে লুকিয়ে পড়ার। ডাহুক, খুব বেশি উড়তে না-পারা পাখিটি, তবে
দৌড়-প্রতিভায় ও গেরিলার মতো গা বাঁচিয়ে লুকিয়ে পড়ায় অসামান্য। তার চেয়েও অসামান্য
আমাদের দৌড় এবং তাড়া খেয়ে পাখিটি এসে পড়ল একটি ঝুপরি মাটির ঘরের দেওয়ালের পাশে।
তারপরে একেবারে অদৃশ্য। আমরা তো প্রায় বোকা বনে যাবার যোগাড়। হঠাৎ খেয়ালে এল
দেওয়ালের গর্তে পাখিটির আত্মগোপন কৌশল। এবং তারপরেই
কিশোরের শীর্ণ হাতে টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনা
পাখিটির ছটফট করতে থাকা দেহটি। দেখছি লম্বা লম্বা পা ছুড়ে ছুড়ে মুক্ত হতে চাইছে
সেই পাখি। বঁড়শির মতো নখ দিয়ে আঁচড়িয়েও দিল ওকে ধরে থাকা হাতের অনেকটা। এর পরেই যা
ঘটলো তা একেবারে তম্ভিত করে দেবার মতো। পাখিটি তার
তীক্ষ্ন নখ দিয়ে তার গলানালীটি ছিঁড়ে ফেলছে।
হাতে ধরা অবস্থায় পাখিটি এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যু নিল!
আজ যখন কোন কবির
স্বেচ্ছামৃত্যু সংবাদ শুনি প্রশ্ন জাগে, কেন কবিকেও স্বেচ্ছামৃত্যু নিতে হয়? সুনীল
সাইফুল্লাহ, শামীম কবির, তাপসকুমার লায়েক, চঞ্চল জানা, শামশের আনোয়ার, সিলভিয়া
প্লাথ, মায়াকোভস্কি -কেন এই নামের তালিকাটি দিন দিন দীর্ঘ হয়ে পড়ে? কেন জীবনের এই
অবক্ষয় থামান যায় না! কবি ফালগুনী রায় কেন উদ্ভ্রান্তের জীবন নিয়ে প্রায়
স্বেচ্ছামৃত্যুতে জড়িয়ে যান?
কৈশোরে আমার হাতে
স্বেচ্ছামৃত্যু নেওয়া পাখিটি সবুজ সমুদ্রে তার ওড়ার স্বাধীনতা হারাতে চায়নি; তার
চেয়ে হয়তো মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেছিল। কিন্তু ওইসব প্রিয় কবিরা? শামীম কবির
মৃত্যুর পূর্বেই লিখে গিয়েছিলেন ‘করাত দিয়ে পা কাটার দৃশ্য’। সুনীল সাইফুল্লাহ জানালেন তার ‘মৃত্যু ঘোষণা’ স্বেচ্ছামৃত্যু নেবার বেশ
আগেই। তাপসকুমার লায়েক, চঞ্চল জানা তাদের কবিতায় আভাস দিয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যুর
ইচ্ছা। ফালগুনী রায় তার কবিতায় দেখিয়ে
ছিলেন রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থা পারিপার্শ্বিকতা সকল কিছুর উপরে প্রবলতম ঘৃণা। প্রকৃতপক্ষে
একজন কবি বা শিল্পী সকল অবক্ষয়কেই থোড়াই কেয়ার করে,
বাংলামদ কিংবা রামের বোতল খুলে গ্লাস ভর্তি অবক্ষয় পান করেও। সে কারণেই ফালগুনী রায় লিখতে
পারেন,
‘গাঁজা খেলেই আমার খুব দাবা
খেলতে ইচ্ছে করে- ইচ্ছে করে
আমি হতে চাই না ফিশার বা
ফাউলার’
( কৃত্রিম সাপ ।। ফালগুনী রায়)।
মেটাফর মোড়ান এই কবিতাটির দু’টি লাইনে তোসে ইঙ্গিতই রেখেছেন কবি! অবক্ষয়কে
গলাধঃকরণ করেও তাকে উৎরিয়ে যাওয়া। ফালগুনী রায়ের অন্য একটি কবিতায় লেখেন,
‘আমি সোনার তরীর সব ধান লুট
করে বিলিয়ে দেব
শন্তিনিকেতনের ভিখিরীদের ভেতর
তারপর খালি নৌকায় চেপে গান
গাইবো বাইশে শ্রাবণের’
(ক্রিয়াপদের কাছে ফিরে আসছি ।। ফালগুনী রায়)।
বেশ তো, সোনার তরীর সব
ধান লুট করে বিলিয়ে তিনি সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চান! ভালো। কিন্তু তারপরেও
কবির জীবনে এই বিপর্যয় কেন? মৃত্যুর পূর্ব দিনগুলো কবি ফালগুনী রায়ের কেটেছে বন্ধু
পরিজন ছাড়া। নিঃসঙ্গ। গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে থাকা কবি। উস্কোখুস্কো শরীর চুলে ও চোখের পাতায় থিকথিক করছে উকুন। পরিচিত
কাউকে প্রায় চিনতেই পারেন না। এমন অবস্থায় মৃত্যু হল ফালগুনীর। মাত্র কয়েকজন মানুষ
তার শবযাত্রায় হাঁটলেন। ওই ক’জন মাত্র শ্মশানবন্ধু হলেন ফাল্গুনীর, যেন একদম দায়ে
পড়ে। একটি মৃতদেহ সৎকারের নূন্যতম যে দায়। তার বেশি যেন একবিন্দুও নয়। ফালগুনী একটি
কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি নারীদের মুখ দেখব বলে মাইল মাইল হেঁটে এসে/ দেখি শুধু মাগীদের ভীড়’। এখানেও
রয়েছে ফালগুনীর জীবন বিপর্যয় ভাবনার সূত্রমুখ। একজন প্রিয়
নারীই হয়তো কবিকে জীবনের এই গভীর খাদ থেকে টেনে তুলতে পারতেন। সকল অসাম্যের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করা ফালগুনী রায়ের হয়তো প্রয়োজন ছিল একজন
প্রিয় নারীর অনুপ্রেরণা। শশ্রুষা। শিল্পীর জীবন তার সৃষ্ট শিল্পের চেয়েও অনেক অনেক
রহস্যময়।
আবারও পাখি-আত্নহত্যার কথা
ফিরে আসে। আসামের একটি গ্রামে আগুনের কুণ্ডলির মধ্যে ঝাঁক ঝাঁক পাখির
স্বেচ্ছামৃত্যু। এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? পক্ষিবিশাদের নোটেশনে কি তার কোন উত্তর
লেখা আছে? কবি শামশের আনোয়ার এক সশস্ত্র
কবি। তার একটি কবিতা,
‘আমি দেয়ালে কখনো পাখি আঁকি না
বা ফুল
আঁকি শাণিত হাঙর বা করাল তিমি,
আমি উনুন আঁকি
গরম জল ফুটছে উনুনের উপর, সাঁড়াশি
আঁকি
আঁকি একটি পুরুষ বাঁদর অপর
একটি স্ত্রী বাঁদরকে দমন করছে
নাভির যে ঘা আছে নক্ষত্র আছে
জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে সেই ঘা সেই
নক্ষত্র আঁকি’।
এমন বারুদময় একজন কবিও ইচ্ছামৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়েন! এতো কিছু দেখে মনে হয়
কবিরা যেন আগুনের কুপে স্বেচ্ছামৃত্যু নেওয়া ঝাঁক ঝাঁক পাখি। তবে যুক্তিমতে,
আগুনের উজ্জ্বলতা হয়তো পাখিদের আর্কষণ করেছিল, আর পাখির পরিণতিহীনতার ফলাফল
মৃত্যু, যা স্বেচ্ছামৃত্যু নামে প্রকাশিত হল। কবিদের ক্ষেত্রে তার কি ব্যখ্যা আছে?
সিলভিয়া প্লাথ ইংরেজি
ভাষার খুব গুরুত্বপূর্ণ কবি, ভালোবেসে বিবাহ করেছিলেন আরও এক খ্যাতিমান কবি ট্রেড
হিউজকে। আমরা জানি তাঁর পরবর্তী জীবনের কী ঘটেছিল। জীবনের
প্রতি চরম বিতৃষ্ণা তাকে ঠেলে দিয়েছিল চরম পরিণতির দিকে।
অনেক সন্তানের মা আর স্বামী হিউজের পরনারীতে আসক্তি প্রণয় পরবর্তি বিবাহিত জীবনে
সিলভিয়া প্লাথ স্টোভের উপর মাথা রেখে আত্নহননের পথে ঠেলে দিলেন নিজেকে। প্রিয়জনের
উপেক্ষা সইবার ক্ষমতা সব মানুষের সব সময় থাকে না। কবিদের
ক্ষেত্রে এই উপেক্ষা সইবার ক্ষমতা আরও অনেক কম। তাঁরা
সংবেদনশীল মানুষ বলেই হয়তো। রুশ কবি মায়াকোভস্কি আত্নঘাতী হয়েছিলেন। নিজের বুকে
পিস্তল ঠেকিয়ে নিজেই টেনে দিয়েছিলেন তার ট্রিগার। বিষয়টির সূত্রমুখও প্রেম ঘটিত।
ভেরোনিকা পেলেনস্কায়া রুশ এই নাট্য অভিনেত্রীর গভীর প্রেমে জড়িয়ে যান মায়াকোভস্কি।
ভেরোনিকাও কবির প্রেমের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ভেরোনিকার বিবাহিত জীবনে
স্বামী সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতাও এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। কবির অভিমানে আকাশ
ভেঙে পড়ে। মায়াকোভস্কির আঙুল টেনে দিল গানট্রিগার।
পাখি ও কবিদের এই আত্মহনন
যত রহস্যময় হোক কেউ তা আশা করি না। আর তাদের ভালোবেসেই বাঁচিয়ে নিতে হবে আমাদের।
হে কিশোর, তোমার হাতের পাখিটি উড়িয়ে দাও স্বাধীন সবুজে। প্রিয় নারী যে তুমি কবির
প্রেমিকা, প্রিয় যুবক যে তুমি কবির প্রেমিক তোমার কবিকে ধরে রাখ ভালোবাসায়, যে
ঝুঁকে গেছে অন্ধকার খাদের কিনারে!
মন্তব্যসমূহ