এন্টিফিকশন:মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর (দ্বিতীয় কিস্তি) ।। শিমুল মাহমুদ ।।

এন্টিফিকশন:মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর
                                (দ্বিতীয় কিস্তি)
                 শিমুল মাহমুদ

                      এন্টিফিকশন এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে যদি আপনি মনে করেন এই লেখায় নির্দিষ্ট একটি চরিত্র থাকবে আর সেই চরিত্রের থাকবে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম, নির্দিষ্ট ঠিকানা; চরিত্রটির থাকবে নির্দিষ্ট একজন পিতা অথবা মাতা; অথবা আপনি যদি ভেবে থাকেন চরিত্রটি একটি বিশেষ সময়ের ভেতর আটকে থাকবে, তা হলে আপনি ভুল করবেন। মানব জীবন আমার অথবা আপনার একার নয়। এই জীবন আমাদের লাভ করতে হয়েছে সারে চারশো কোটি বছরের ধারাবাহিকতায় ক্রমবিবর্তনের পথে লড়াই করে। সুতরাং আপনি যদি আপনাকে দেখতে চান তাহলে এই সারে চারশো বছরের ভেতর থেকে বহুকে দেখুন; শুধুমাত্র নিজেকে নয়।

                      আমাকে প্রচল প্রথা ভেঙে এন্টিফিকশন লিখতে হচ্ছে। দান্তে তেরো শতকে ভিটা নোভা লেখার পর নিজের ভেতর থেকে বহুকে দেখার তাড়নায় আতঙ্কগ্রস্থ। সুতরাং তিনি সময়ের ধারণাকে ভেঙে অতীত-বর্তমান এমনকি ভবিষ্য বরাবর পরিভ্রমণে হয়ে উঠলেন বহুসত্তা। এই বহুসত্তার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তাঁকে লিখতে হয়েছিল লা ডিভাইনা কমেডি অনিবার্যত তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্ল্যাসিক। চিরায়ত সত্যকে দেখার মহার্ঘ বাস্তবতা থেকে যে ক্ল্যাসিক চোখ তিনি অর্জন করেছিলেন সেই চোখের সন্ধানে যখন প্রচল পথে অগ্রসর হতে হয় তখন আমি সন্দেহ বাতিকে কেঁপে উঠি। স্পষ্টই আমি ক্ল্যাসিকের মীমাংসিত সামিয়ানাকে অমীমাংসিত মহাকাশে ঝুলে থাকতে দেখি। সুতরাং আমি সরে আসতে বাধ্য হই প্রচল পথ থেকে অপ্রচল পথে। এবং আমি লেখার সীমানাকে প্রচল আঙ্গিকের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করে ছেড়ে দিতে চাই মানবজীবনের সমান্তরালে বিরামহীন; অপ্রচল সীমানায়।

                       এন্টিফিকশন বলছি কেন? ফিকশন লিখলে চিরপরিচিত পথে নির্বিঘে হাঁটতে পারতাম। নিদৃষ্ট চরিত্রের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকতে পারতাম। প্রকৃত বাস্তবতায় এই সীমাবদ্ধতা এক ধরনের বিভ্রম। কেননা বাস্তবতা তো আমার আপনার একার নয়। এই বাস্তবতা সভ্যতার ধারাবাহিকতায় চিন্তার জগতের সারে তিন হাজার বছরের সাধনায় অর্জিত সংজ্ঞা হতে পারে তা প্রাচ্যের অথবা পাশ্চাত্যের। আর যদি মানব প্রজন্মের যৌথ ধারাবাহিকতার কথা বলি তাহলে আমার অথবা আপনার জন্য থাকা উচিত নয় খণ্ডিত কোন ধর্ম। বরং খণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে সার্বিক যা সার্বিক তা হয়ে উঠতে পারে মানবিক। আমাদের ধর্ম মানবিকতা। চিরায়ত মানবিকতা। যদিও এখনও সভ্যতার যাত্রাপথে এটি একটি যৌথ মনোসামাজিক স্বপ্ন মাত্র। তারপরও এ-কথা ঠিক প্রাণকুলে মানুষই একমাত্র জীব যে স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা রাখে এবং তা বাস্তবায়ন করার পথ ধরে অগ্রসর হয়। মানুষই একমাত্র জীব, যে স্পর্শের ভাষা বুঝে নিতে জানে। মানুষই একমাত্র জীব, যে ভালোবাসতে জানে এবং ভালোবাসতে শেখায়। মানুষই কাঁদে এবং কাঁদায়।

                      সর্বকালের সর্বভূগোলের জীবজগতের মানবিক আকাঙ্ক্ষা অর্জন করতে ইচ্ছুক এই মানবিক ধর্ম। ফলে নির্দিষ্ট ঠিকানায় এন্টিফিকশনের কথককে আটকে থাকা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় নির্দিষ্ট পারিবারিক অভিজ্ঞতায় সীমাবদ্ধ থাকা। সুতরাং আমার অথবা আপনার পিতার কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়, নাম, সাকিন অথবা ব্যক্তিচরিত্র থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীর তাবৎ পথের পথ-প্রদর্শক আমাদের পিতা। পৃথিবীর তাবৎ শান্তিকামী রমণী আমাদের মাতা। মায়াকাতর ফুলেরা আমার বোন। হরিণেরা আমার ভাই। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ প্রান্তর, ভেড়ার পশমের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উষ্ণতা... বলছি আবার, পৃথিবী আমার মা। আমরা এই মায়ের সন্তান।

                         ‘এন্টিফিকেশন-প্রথম কিস্তি প্রকাশের পর যারা এটিকে নিছক পারিবারিক অভিজ্ঞতার  বয়ান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সীমানায় আটকে রেখে তর্কে নেমেছেন, তারা সহ সবাইকে বলছি, আসুন না একবার আমরা নিজের ভেতর থেকে বাইরে এসে গোটা পৃথিবীটাতে ছুঁয়ে দিতে শিখি। যে পৃথিবী শুধু আমার অথবা আপনার নয়। যে পৃথিবী শুধুমাত্র অতীত অথবা বর্তমানের নয়। যে পৃথিবী প্রকৃত বাস্তবতায় অনন্তের। এই অনন্তের পৃথিবীতে আমি অথবা আপনি চিরায়ত যৌথসত্তা মাত্র। আমি অথবা আমরা খণ্ডিত নই। আংশিক নই। আমরা অর্জন করতে চাই যৌথের চেতনা। যৌথের চোখ।

                   অনন্তের রহস্যকে স্পর্শ করতে গিয়ে আমরা ফিরে যেতে চাই। ফিরে যেতে চাই আমাদের ফেলে আসা অতীতে। আদতে এই ফিরে দেখার তাড়না এক ধরনের মনোদৈহিক অনিবার্য প্রক্রিয়া। যা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। এই ফিরে দেখার ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের জাস্টিফাই করি। যেমনটা করেছিলেন আহমদ রফিক ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাকুমার নবীনগর থানার শাহবাজপুরে ফিরে গিয়ে। তখন তাঁর বয়স ১৮ তারপর ৮০ বছর পার করে তাঁকে ফিরে দেখতে হয়েছিল দেশবিভাগ। জীবনের অনিবার্য তাড়নায় তাঁকে লিখতে হয়েছে, দেশবিভাগ: ফিরে দেখা (২০১৪)। অথবা বিংশ শতকের ওপর দাঁড়িয়ে ড. অতুল সুরকে লিখতে হয়েছিল চোদ্দ শতকের বাঙালী (১৯৯৪)। অথবা একুশ শতকের ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো আমাদেরকেও ভাবতে হচ্ছে বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’(২০০০), দ্বি-জাতি তত্ত্বের সত্য-মিথ্যা অথবা রাষ্ট্রের মালিকানা (১৯৯৭) নিয়ে। এভাবেই আমাদের ভেতর কেউ কেউ আছেন এখনও ফেলে আসা জীবনের যৌথ-বিরম্বনার ওপর গতিময় তাৎপর্য আরোপ করার চেষ্টা করে চলেছেন। এই যে তাৎপর্য আরোপের চেষ্টা, এই যে সভ্যতার সূচক-বিন্দুসমূহ নিজের ভেতর থেকে শুধু নয়, বরং বহুর ভেতর থেকে দেখার প্রচেষ্টা, এই চেষ্টার নামই অহম্। অহমের অপর নাম জীবন। জীবনের আরেক নাম মানুষ মানুষ অর্থ যৌথের যোগফল।

                         আলমডাঙার আকাশে আলো। আলোর প্রতিভা। সন্ধ্যাতারার শরীরী সংকেত। ঘষা খাওয়া চাঁদ ভাসছে নিথর নীরব। এক ঝাঁক রাতগন্ধ ডাকছে। শিশুকালকে ডাকছে। মাথার গভীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে শিশিরপাতের মিহি শব্দ। চালের ওপর রাতশিশির ঝরছে। কেউ সেই পার্থিব শিশির ঝরার শব্দ শুনতে পায় না। অন্ধকারের শরীরে আঁধার-কালো বাতাস ঝুলে আছে নিরিবিলি। এক টুকরো সন্ধ্যাতারা এক আকাশ সমান শূন্যতা বুকে নিয়ে কুমার নদীর ওপারে খসে পড়তেই সাতটা সাদা ঘোড়া হ্রেষারবে উড়াল দেয়। পরিরাণীর পাখায় ভাসতে থাকি। চারিধার মেঘ। পরিচিত মেঘেদের দেশ। পরিরাণী আমাকে ছায়াপথের ওপর বসিয়ে একটা এক চোখওয়ালা তারা খসিয়ে আনতে সেই যে গেল, আর ফিরে এল না।

                        আমি কাঁদছি, ঘুমের ভেতর। ফেলে আসা কৈশোরে শুকতারা হাতে পরিকন্যার চোখ ছুঁতে চেয়েছিলাম আমি। বাজিতপুরের আকাশে এখন কোনও পরি নেই। কুমার নদ। প্রশান্ত। নীরব বাঁশঝাড়। ওপারে ঝাউবন। তিনটি শাদা বক উড়ছে। লম্বা গলা বাড়িয়ে ভূমি খুঁজছে। কাদাজলের ওপর স্বচ্ছ জল। শিরশির বয়ে চলেছে সেই জল। সেই জলের গায়ে গা এলিয়ে দলছুট পুঁটি ভেসে চলেছে। তিনটি বক পাখির একজন দেখতে পেয়েছে অলস জলেভাসা পুঁটি। আমি শুয়ে আছি রূপকথার ভেতর। শতাব্দীর ওপার থেকে জেগে ওঠা উপন্যাসের পাতায় শুয়ে আছি আমি। কুমার নদের গভীর থেকে ক্রমশ ভেসে উঠতে শুরু করেছে জলে ভেসে যাওয়া মহিষের দীর্ঘশ্বাস। আমাদের বাবা তখনও যুদ্ধে যায়নি। কোন যুদ্ধে, কবে, কেন গিয়েছিল বাবা? এতগুলো প্রশ্নের জবাব আমি এখনও খুঁজছি। সবকিছু ঠিকঠাক মতো বুঝতে শিখিনি আজও। অনন্ত সৃষ্টিজগতের ভেতর আমি এক খণ্ডিত সত্তা। তারপরও ছুঁতে চাই যৌথের বস্তুজগত। বস্তুর অতিরিক্ত ধারণা শূন্যতা মাত্র। শূন্যতার অর্থ অজ্ঞতা। অবিদ্যা। অবিদ্যাকে অস্বীকারের অর্থ ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠা।

                         বাবা যখন যুদ্ধে যায়নি তখন আমাদের তিনটা মহিষ ছিল। মা মহিষটার একখানা স্বাস্থবান বাছুর ছিল। আমার চেয়ে বেশ উঁচু। খয়েরি আর কালোতে মেশানো সেই মহিষের বাচ্চাটার চোখে কাজল; কানের ডগায় যেন বা নিশি ডাকছে; পিঠের ওপর কুমার-জলের পরশ। ভর দুপুরে আমি হাঁটতে থাকতাম মহিষবাছুরের সাথে। তাবিজ করেছিল আমাকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম ওর বুকের পশমে। অবাক কাঁপিয়ে নিয়ে কালো চামড়া, তাড়িয়ে দিতো নিশিপোকা। ওর মা ছিল আমারও মা। ও যত দিন ওর মায়ের দুধ খেয়েছে তার চেয়েও বেশি দিন ওর মায়ের দুধ খেয়েছি আমি। সে ছিল আমার মহিষ-ভাই; দুধ ভাই। মেজো কাকা ওর নাম দিয়েছিল হাড়িয়া। কেন এই নাম? জানি না। বোঝার চেষ্টাও করি নাই কোনোদিন। তবে একথা ঠিক হাড়িয়ার বাবা আর হাড়িয়ার ধাঙ্গর ভাইকে নিয়ে আমাদের বাবা মাঠে যেতো। তখনও আমরা ঠিক যুদ্ধ বুঝতাম না। সকাল-সন্ধ্যা হালচাষ শেষে বাবা নেমে যেতো কুমার নদের প্রশান্ত বুকে। মহিষ দুটোকে পয়পরিষ্কার করিয়ে সন্ধ্যার আগ দিয়ে মহিষের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে আসতো বাবা। মহিষ দুটো বাবাকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিতো। সারাদিন মাঠে হাল বওয়া শেষে বাবার শরীরে আর কোনো সঙ্গীত অথবা ক্রোধ অবশিষ্ট থাকতো না। অথচ মহিষ দুটো জল থেকে উঠতে চাইতো না। নাক উঁচু করে সমস্ত শরীর জলের নীচে ডুবিয়ে যেন বা ধ্যানে বসতো ওরা। সেইদিন বাবা সন্ধ্যার বেশ কিছুটা আগ দিয়ে মহিষ দুটো নিয়ে কুমারের তীরে দাঁড়িয়ে।

                      নদীর ঢালুতে আসতেই মহিষ দুটো অপার্থিব ভাষায় চিৎকার করে ছুটে গেল দূরে। অথচ তখন দুর্বোধ্য উচ্চারণে গোপালকৃষ্ণ গোখলে ঘোষণা করছেন, হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো বাঙালি মহিষজাতি তখন নবজাগৃতির তাৎপর্য উদ্ধারের পরিবর্তে জলের গভীরে দেখতে শুরু করেছে অশুভ দৈত্যের ছায়া। অথচ আমাদের নির্বোধ আহম্মক বাবা সেই অশুভ দৈত্য দেখতে পেল না; অবলা পশুই শুধু বুঝতে পারল কী সেই সংকট। গভীর কালো অন্ধকার জলের নীচে লুকিয়ে রয়েছে রাক্ষসরাজ। বাবা ছুটে গিয়ে লাঠির আঘাতে হাড়িয়ার বড় ভাইটিকে জলে নামিয়ে দিতেই খুব জোরেসোরে একটা আলোড়ন তুলে সেই যে জলের গভীরে তলিয়ে গেল তারপর এক ঘণ্টা যায় দু-ঘণ্টা যায়; অন্ধকার ধেয়ে আসতে থাকে দূর-বৃটিশ বন্দর থেকে; আর এই ফাঁকে অন্ধকারের কবর থেকে মাথা বেড় করে ১৯০৩ এর ধুলোরাশির ওপর দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রদেশের চিফ কমিশনার স্যার অ্যান্ড্রু ফ্লেজার নীরব চিৎকারে কাঁপিয়ে দিল গোটা বঙ্গদেশকে, বাংলাকে কেটে দু- খণ্ড করে ফেলো দু-খণ্ড

                    তারপর তিনদিন পর সন্ধ্যার আগ দিয়ে হাঁট থেকে তখন আমরা বাজিতপুরবাসী ফিরছিলাম। বৃটিশ ক্যানেলের উত্তর সিঁথানে ভেসে উঠতে দেখলাম আমরা আমাদের সেই জলেডোবা কালো মহিষটির দেহের পেছন অংশ। নিকশ কালো, ফোলা ফোলা থকথকে দৈত্য-দংশিত। তারপর তারও অনেক দিন পর ১৯০৫ এর ১৭ অক্টোবরে আমাদের বাজিতপুরের পেছনে কুমার নদের দক্ষিণ সিথানে আমাদের সেই কালো মহিষের সম্মুখ অংশ; খণ্ডিত কালো জলের গভীর থেকে উঁকি দিচ্ছে। ততদিনে কুমারের জল ভারি গভীর আর কৃষ্ণকায়। আমরা ভয়ে অন্ধকার জলে নামি না। আর এই সুযোগে সাহেবদের রেকর্ডে টাইপরাইটারে টাইপ হয়ে গেল, ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত ১১২ জায়গায় ডাকাতির বিবরণ। স্বদেশি ডাকাতরা সংগ্রহ করে ফেলে সাত লক্ষ মুদ্রা। আমরা তখন রামচরণ মশাইয়ের গ্রামফোনে রাতের অন্ধকারে শুনতে থাকি, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি; আসি আসি পড়বো ফাঁসি...

                    এই ঘটনার অনেক আগেই ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়ে যায়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেড কিংসফোর্ডের পরিবর্তে আইনবিদ কেনেডির স্ত্রী-কন্যার গাড়িতে নিজেদের তৈরি বোমা ছুঁড়ে মারার সময় ক্ষুদিরামের সাথে থাকা প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ে। অথচ লড়াকু প্রফুল্ল চাকী অন্ধকার দৈত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের দেহকে অকেজো প্রাণহীন করে অমীমাংসিত সংকেত ছুড়ে মারে গোটা বৃটিশ-ভারতের আকাশে। আজ এতদিন পর আমি কেন বুঝতে পারছি না সেই আত্মহুতির ভাষা; কী সেই সংকেত? এই যে রক্তপাত, এই রক্তপাতের সাথে আমাদের বাবার ধানচাষের গোপন তাৎপর্য অথবা শ্রমজীবী মহিষের সাথে জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা কালো রাক্ষসটির প্রতিহিংসার যাত্রাপথ আরও কত দীর্ঘ হবে? যদিও ততদিনে যেখানে আমাদের কালো মহিষের খণ্ডিত পেছনদেহ ভেসে উঠেছিল সেই স্থানটির নাম হয়ে গিয়েছে মহিষবাথান। অথচ আলমডাঙা-চুয়াডাঙা-কুষ্টিয়ার কেউ কোনদিন শোনেনি সেখানে কখনো কোনো মহিষের খামার ছিল কিনা অথবা আমাদের পুরোনো পিতাগণ যখন জীবীত ছিলেন তখনও ঠিক শোনা যায়নি আমাদের অঞ্চলের কোনো মহিষখামারের গল্প।

                       তখন আমাদের দোচালার ছাপড়া ঘর। দাদিমার একমাত্র পুত্র আমার বাবা। বাবা যখন দাদিমার পেটে, তিন মাসের; তখন আমার দাদার হয়েছিল কালাজ্বর। আগস্ট বিপ্লব তখনও শুরু হয়নি। জিন্নার সাম্প্রদায়িক জাহাজে একে একে সবাই জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কামরুদ্দিন আহমদ, যুবক শেখ মুজিবুর রহমান কেউ বাদ যায় না। আসাম পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ অনেক আগেই দু-টুকরো। পূর্ববঙ্গ এবং পাঞ্জাবের ওপর মুসলিম লীগের ধর্মের জাদু ক্রমশ ধুলো ওড়াতে শুরু করেছে। যদিও ১৯৩৭ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমান আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও আমাদের সেই বাজিতপুরের দ্বিখণ্ডিত মহিষের কালো চামড়া কেটে কায়েদে আজম জিন্না পোশাক পাল্টিয়ে অসাম্প্রদায়িক কৃষক প্রজা পার্টির বাঘের পেছনে গেঁথে থাকল বাংলায় তখন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নিয়ন্ত্রণে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন ফ্রন্টের সরকার।

                       আমার ঠাকুরদা যখন কালাজ্বরে মারা যান জিন্নার মুসলিম লীগ আমার ঠাকুরদার শশ্মানভষ্ম পায়ে ঠেলে কালাজ্বরের বিপরীতে, কংগ্রেসের বিপরীতে বৃটিশ রাজের ভাগ করো শাসন করো ফরমুলায় জল ঢালতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ। আমার বাবা শুয়ে আছেন আমার দাদিঠাকুরণের পেটের ভেতর। এই সেই বাঁশবাগান যার নীচে শুয়ে ছিলেন আমার দাদিঠাকুরণ। এই সেই বাঁশঝাড় যার নীচে শুয়ে আছি আমি। শুয়ে রয়েছে আমার শিশুকাল। পরিকন্যাদের মিহি কথার মৃদু-শীতল হাওয়া আমার মুখ জুড়ে মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেমন এক সম্মোহনী জাদুর ছোঁয়ায় তাকিয়ে আছি আমি ঝাঁকঝাঁক মায়াপরির দিকে। বাবলা গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, পাহারা দেয়, যাতে দিনের আলো এসে রাতের মায়াকে তাড়িয়ে না দেয়। গঙ্গাদের বাড়ির লজ্জা পাওয়া ছোট্ট প্রদীপটা অধৈর্য বুকে চেপে নিবে যায় এক সময়


                            অনেকদিন আগে। তখন আলমডাঙ্গার একমাত্র রাস্তাটা পাকা হয়নি। খোয়া বিছানো। বটতলাকে ঘিরে প্রতি বিকেলেই মেলা বসতো। বুড়ো পাকন গাছটার গুড়িতে প্রতি সকালে বাজিতপুরের বউয়েরা খালি পায়ে হেঁটে এসে সিঁদুর দিয়ে যেতো। কুমারী ইউনিয়নের রায়বাড়ির বৃদ্ধা নর্তকী তখনো বেঁচে ছিল। কুমার নদের ওপর কেবলই ব্রিজ বাঁধবার আয়োজন। বসে আছি কুমারের উঁচু পাড় ঘেঁষে। দু-একটা করে আকাশের তারা খসে পড়ছে। কুয়াশারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে এসে সব কিছু ভিজিয়ে দেয়। চাঁদটা ঝাপসা হয়ে আড়াল নিতে থাকে। চোখের পাপড়িতে বাতাস এসে চুমু খায়। পায়ের পাতায় ভেজা ঘাসেরা কেঁপে কেঁপে ওঠে।  

                          দূরতম মেঘের দেশ থেকে এক দিন একটা চিঠি ভেসে আসে। গঙ্গাদির চিঠি। আমি তখন নর্থব্যাঙ্গল ইউনিভারসিটির ছাত্র। গঙ্গাদিরা কুচবিহারের মাথাভাঙায় থাকে। চিঠির অক্ষরগুলো শরীরী চিৎকারে কেবলই ডাকতে থাকে আমাকে। তারপর এতদিন পর মাঝ বয়সে এসে বুঝলাম কান্নার সৌন্দর্য তুলনাহীন। গোপনচারি কান্নাগুলো যদি দেখে ফেলে আপনজন। মনে হয় ছুঁয়ে দেব অথচ অক্ষম আমি। ভাষা দেবার কী দুর্মর আকাঙ্ক্ষা আজ এতগুলো বছর পর কেন ফিরে এলাম দাদাঠাকুরণের পোড়াভিটের ওপর? একটা রাতজাগা পোকা কেবলই ঘুরে ফিরে আগুনের উষ্ণতায় ফিরে আসে। হয়তো পুড়ে যেতে চায়। আগুনের আলোয় আলোকিত হতে চায়।

                          গঙ্গার কেবলই মনে হতে থাকে জীবনটা ভীষণ ভালোলাগার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই মনে হল, হাঁটবে। তারপর গঙ্গা হাঁটতে থাকে। বাবলা গাছের নীচে, ভেজা ঘাস আর হলুদ নিম পাতার শরীরের ওপর গঙ্গা হাঁটছে। সব কেমন যেন একেবারে নির্জন। কেমন একটা ঘুম ঘুম আমেজ। অথচ কড়কড়ে রোদ। তবুও মনে হয় পেলব পিচ্ছিল। চকচকে তরতাজা আকাশ। মাথার গভীরে পুরোনো ছবিগুলো কেবলই নড়েচড়ে ওঠে। কৈশোরের পায়রা ডাকছে কোথাও।
                            বিশাল গাঢ় একটা আকাশ। আকাশের শরীরী শরীরে মেঘেদের গায়ে লেখা আছে, নিজেকে অন্যের ভেতর বিম্বিত দেখার আনন্দ ভিন্ন রকম। পড়তে থাকি মেঘেদের শরীরে ভেসে ওঠা সেই মায়াবি অক্ষর। তারপর আকাশের মেঘগুলো ক্রমাগত একটা সাদা হাতির দেহে পালটে যেতে থাকলে মেঘেদের গতিশীল দেহের ভেতর কুমার নদের সাথে মাথাভাঙা আর ভৈরব নদী মিলেমিশে একাকার। নদী তিনটিকে ঘিরে অনেকগুলো মাটির ঢিবি। ঢিবিগুলোকে মনে হচ্ছে যেন এক একটা চলমান পাহাড়। হয়তো কোন এক ভবিষ্য প্রত্নবিদ খনন কাজ শেষে পেয়ে যাবেন আমাদের ঠাকুরদার বাজিতপুর। ভিটে পাহাড়ের পেছনে এক জোড়া সার্কাসের ক্লাউন কেবলই নাচতে থাকে। আকাশের পর্দায় সাদাকালো সিনেমা দেখছি।

তারাপিসির সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। আলমডাঙা টকিজ সিনেমা হল। তখন সিনেমা বলতে সাদাকালো সিনেমাই ছিল। গরুর গাড়িতে চেপে। অথচ আজ আকাশের পর্দায় মেঘেদের শরীরে নিজেই একটা সাদাকালো সিনেমার গল্প বুনে চলেছি। সিনেমার গল্পের ভেতর গঙ্গা আমাকে পিছে ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছি একা। গঙ্গা নিজেকে ছুঁয়ে দেখে। সেই পার্থিব ছুঁয়ে দেখার ভাষা খুব গোপনে আমার ভেতরও বেড়ে উঠতে থাকে। এক ঝাঁক বাতাস ঢুকে পড়ে সমস্ত দেহে। দেহের কপাট কাঁপিয়ে মেঘেরা কেবলই ছিঁড়ে যেতে থাকে। ভেসে আসতে থাকে পাগলা কানাইয়ের কণ্ঠ, আমার এই দেহ-নদী চলতে ভারি/ বাঁধলে নদীর বাঁধ মানে না/ আমার এই দেহ-নদী।
                        মাঝে মাঝে মনে হয় গঙ্গা এক দূরতম দেশের বাসিন্দা। কিছুতেই মনে করতে পারি না ওর মুখ। ছাড়া ছাড়া ভাবে শুধু ওর চোখ অথবা ভুরুর রেখা ভেসে ওঠে। নিজেকে বুঝতে পারি না ভালো অথচ লুকিয়ে কি লাভ! আর লুকানোরই বা কী আছে। নিজের অবস্থানটা সর্বদা নেচে বেড়াতে চায় বুকের ভেতর। তাই ভুলে থাকার কত টালবাহানা। নিজেরই চোখ বেঁধে কানামাছি ভো ভো। আগে বুঝতাম না ভালো তারপর দেখি ভয়ানক তৃষিত আমি। ভেতরটা বারবার ভবঘুরে হয়ে যায়। গঙ্গাদি, তুমি কি কষ্ট পাও এখনও? পরবাসী হতে চায় ভেতরের সব কিছু। জলের ভেতর হাঁটছি। অনেকক্ষণ। এলোমেলো। উঠে আসি কাঁচা ঘাসে। ওভাবে এলোমেলো হেঁটে কিছু হয় না।

                     দুপুরের চাঁদ। নিষ্প্রভ। সূর্যের আলোর আড়ালে রঙহীন। মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। অনেক দিন পর আশ্বিনের আকাশ ঝলমল। মাঠ পাড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠতে গিয়ে দেখি দূরের পোড়ো বাড়িটার পাঁচিল ঘেঁষে ছড়িয়ে আছে আকাশ। ঝকঝকে। ফুলকপির মতো এক গোছা সাদা বিষণ্নতা যেন গাঢ় নীলের পটভূমিতে সাদা মেঘ; শান্ত ধীর মঠের চূড়ার মত তাকিয়ে আছে। কেবলই তাকায়। পা আটকে গেছে ঘাসের নিঃশ্বাসে। অকস্মাৎ মনে উঁকি দেয় সেই পরিচিত অনুভূতি। বন বাদাড় মাঠ ডোবা, কোথায় সে! কত পথ চলে গেছে কত দেশ দেশান্তর। শুধুই তাকিয়ে থাকি।

                    কুমারের তীর ধরে হাঁটছি। ঠাকুরদার আমলের সেই কানা বক তিনটির একটি। কানা বক-পক্ষী আমাকে দেখতে পায় না। একটা ভীষণ উঁচু দেবদারু গাছ শুধু দাঁড়িয়েই থাকে। আমার দিকে ভুলেও তাকায় না। যেন নিষেধ আছে দেবতার। শান বাঁধানো ভাঙা ঘাট। ভীষণ পুরাতন ওর পাথরগুলো। চণ্ডী দেউলের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। দেউলের দুয়ার খোলা। জনহীন কুমারের পুরোনো, ভীষণ পুরোনো বাঁকে এই নীরব মন্দির। সেই মন্দিরের ভেতর পাথরে খোদাই দেবী মূর্তি। প্রাচীন মূর্তিকে ঘিরে কেবলই রহস্য দুলে ওঠে কোনো এক অমাবস্যার রাত। আমাদের বাড়ির সবাই পূজা দিতে এসেছে। টিপটিপ প্রদীপের আলোয় দেবীর মুখ জ্বলছে। হঠাৎই সবাই দেখতে পায়, রক্ত লেগে আছে দেবীর মুখে। মুহূর্তেই দেবী চণ্ডী হেসে ওঠে।

                          দিনের আলোয় খেলা করছে কুমার নদের জল। কুমারের বুকের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে বাতাস। সেই বাতাসে দেউল দ্বারের শিকল বেজে ওঠে টুং টাং মিষ্টি শব্দে। ঠাকুরমার কাছে শোনা গল্পের মত কেবলই মনে হতে থাকে দেবী হাসছে। এখনই হয়তো মুখ দিয়ে গলগল রক্ত বের হয়ে আসবে। দুপুরের রোদে শালবনের ছায়া গরম হয়ে ওঠে। চণ্ডী দেউলের দরজার ছায়া নীরব শীতল। কুমারের জল-বাতাসে ঘুম আসে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গঙ্গার সাথে কথা বলছি। ছুঁয়ে দেই গঙ্গার চোখ। গঙ্গা খুব জোরে বুকের সাথে ঠেসে ধরে তারপর হঠাৎই ছেড়ে দেয় আমাকে। ঘুমভাঙা চোখে সন্ধ্যাকাতর কুমারের জলে তাকিয়ে থাকি। একটা বাস্তুসাপ মন্দিরের ভিটে ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। সাপটা হারিয়ে গেলে ফিরতে শুরু করি গঙ্গাদের গাঁয়ে। ঠাকুরদার গাঁয়ে।

                       ঠাকুরদার গদিঘরে এক দিন এক সাধুবাবা এসে হাজির। বাবাজি একখানা তালাআঁটা ছোট্ট টিনের তোরঙ ঠাকুরদার কাছে গচ্ছিত রেখে বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগ দিয়ে ঠাকুরদার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন, বাক্সটা যেন সিন্ধুকের ভেতর তুলে রাখা হয়। বাক্সের ভেতর তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় লুকানো আছে। সাধুবাবা গেলেন। তারপর আর ফিরলেন না। আমার ভেতর কেবলই সাধুবাবার চোখ ভেসে ওঠে। লাল ফোলা ফোলা চোখ। কী তার চাহনি আর কী তার গমগমে কণ্ঠ। এক দিন বাবাজি ফিরে এলেন। আবার চলেও গেলেন। যাওয়ার সময় আমাকে সাথে নিয়ে কুমার নদ বরাবর হাঁটলেন অনেকক্ষণ। তিনবার একই কথা বললেন, হাম জান দে দেংগে, লেকিন ইমান কা সাওদা নেহি করেংগে তারপর সাধুবাবার রহস্য আর উদ্ধার হয় নি। হয়তো বা সেই রহস্যে ঘেরা বাক্সটার জন্যই এতগুলো বছর পর বাজিতপুরে ফিরে এসেছি। পাঁজরের কোথায় যেন একটা দমচাপা বাতাস কেবলই অস্থির আলোড়ন তোলে। জলপাইগুড়িতে ঘুমিয়েও সাধুবাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। ঠাকুরদা আর সাধুবাবা চণ্ডী দেউলের ভেতর বসে আছেন। সাধুবাবার শরীরের আলোতে দেউলের চত্ত্বরটা আলোকিত। সেই আলোর সামনে ঠাকুরদা যেন কেমন মিইয়ে যাচ্ছেন। ঠাকুরদা সাধুবাবাকে নিয়ে পাঁচালী গাইছেন।

                  জ্যৈষ্ঠের মঙ্গলবার। আমার পাশে সেদিন গঙ্গাদি ছিল। দুর্গাপিসি ষোলোটি কাঁঠাল পাতা, ষোলোটি সুপারি, আম, আতপ, তণ্ডুল, দূর্বা, আম্রপল্লব, শিকডাব সমস্ত কিছু ঘটের পাশে সাজিয়ে রেখেছে। ঠাকুরদা শুদ্ধাসনে উত্তরমুখে বসে আচমন শেষে বিষ্ণুস্মরণে মন দিলেন। এর পর ডান হাতের অঞ্জলিতে গরুর কানের আকৃতিতে তুলে ধরে মাষমগ্ন পরিমাণ জল পান করলেন। হাত ধোয়ার পর শুরু হল মন্ত্রপাঠ, ওঁ তদ্বিষ্ণো পরমং পদম্ যদা পশ্যন্তি সূরয়, দিবীব চক্ষুরাততম্।। ওঁ মাধবো মাধবো বাচি মাধবো মাধবো হৃদি।

                         ঠাকুরদা ইতিমধ্যেই সঙ্কল্পসূক্ত পাঠ শেষে সামান্যার্ঘ স্থাপন কাজে মন দিয়েছেন। এর পর শুরু করলেন দ্বারপূজা। গঙ্গাদি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। এর মধ্যে দুর্গাপিসি কখন যে আমার কোল ঘেঁষে বসেছে বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম তখন চোখ উঁচিয়ে দুর্গার চিবুকের নীচে ভেসে থাকা ছোট্ট তিলটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখা শুরু করেছি। চিবুক থেকে চোখ আরও নীচে একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়ানো উঁচু বুকের ভাঁজে এসে থেমে থাকল দূর্গাপিসিকে খুব আস্তে একটা চিমটি কাটতেই কীর্তন শুরু হল। ধূপের গন্ধে গলা জড়িয়ে আসছে। রাতে চণ্ডী মন্দির থেকে ফেরার সময় ভয়ের ভান করে কেবলই দুর্গার শাড়ির সাথে সেঁটে যেতে থাকলাম। সেই রাতেই দুর্গাপিসির কাছে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের ভেতর চেঁচিয়ে উঠলে বিধবা দুর্গাপিসি আমাকে বুকের সাথে আকড়ে ধরে। আমি স্বপ্নে পাওয়া পরিকন্যাকে কেবলই জড়িয়ে ধরতে থাকি আর তার পরই দুর্গাপিসির ওপর সমস্ত শরীরটা তুলে ঘুম থেকে জেগে ওঠা উনিশ বছরের পিসির মুখ চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দেই।

                     সেদ্ধ ধানের ভাপ উঠছে উঠান জুড়ে। গরুর গোবর আর চোনার গন্ধ ভারি করে রেখেছে পরিবেশটা। রজবালির তিনমাসের বিয়ে করা বউ শেফালিকে পাগলা কুকুরে কামড়েছে। দুর্গার হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে শেফালির ভয়কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এক জন বৃদ্ধা বেদেনী শঙ্খ মাছের কাঁটা দিয়ে বিষ ঝাড়তে ঝাড়তে মুখে খিস্তি উগলাচ্ছে। বহু চেষ্টায় লিঙ্গ শব্দটা উদ্ধার করতে পেরে মুখ টিপে হেসে উঠি। বেদেনী একটা গরম পিতলের বদনা শেফালির কুকুরে কামড়ানো ঘায়ের ওপর ঠেসে ধরতেই নাকিকণ্ঠের তীব্র চিৎকারে ভিড়টা একটু দূরে সরে এল ভয়ে মুখ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করছে শেফালির। একটা দাড়কাক কাঁঠাল গাছটার ডাল থেকে হঠাৎই উড়ে এসে একেবারে শেফালির সামনে কাপড় মেলা তারে গিয়ে কা কা চিৎকারে ভিড়টাকে কাঁপিয়ে দিল।

                      
                    চারিধার সন্ধ্যা। চারিধার তরতাজা মাটির গন্ধ। বেদেনীর চারিধার ছিটিয়ে থাকা পান-তামাকের গন্ধ নাক থেকে কিছুতেই মুছতে  চায় না। শেখপাড়ার উঠোন ধরে দুর্গার সাথে হাঁটছি। একটা ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারতেই চারিধার খড়কুটো উড়ে উঠল গাছের ডালে বসা পায়রাগুলো খানিকটা যেন ভয় পেল। শেষ দুপুরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও খড়ের পালা থেকে সাদা ধোঁয়ার মতো ভাপ উঠছে। একটা লাল বেয়ারা রকমের মোরগ এই হুটোপুটি বাতাসের মধ্যে একটা ডেকি মুরগীর টুটি চেপে ধরে পিঠের ওপর চড়ে বসলো। দুর্গার চোখে বৃষ্টির একটা ছোট্ট ছিটে এসে লাগল। শেখ বাড়ির মেয়েরা মেতে উঠল উঠোনে ছড়িয়ে থাকা সিদ্ধ ধান তোলার আয়োজনে।

                       আজ কার্তিকসংক্রান্তি। গঙ্গাদের বাড়িতে ইতু পূজা হচ্ছে। আমি আসতে চাইনি। দুর্গা জোর করে নিয়ে এসেছে। ইতু পূজায় পুরুষ মানুষের থাকার কথা না থাকলেও আমি দুর্গার সাথে কুমারী, সধবা, পুত্রবতী আর বিধবাদের সারিতে মিশে গেলাম। গঙ্গার দিদিঠাকুরণ গুণগুণ স্বরে গাইতে শুরু করলে নবারুণের মা আর উত্তমের বোনও গলা মেলায়,
                    অষ্ট চাল, অষ্ট দূর্বা কলস মধ্যে থুইয়া
                         ইতু কথা শুন সবে পূজা ঘরে যাইয়া।।
                         ইতু দানে বর, ধন ধান্যে পূর্ণ হবে ঘর।
                          পুনঃ দেয় বর, পুত্র পৌত্রে গৃহ ভরিবে সত্বর।।

                     গঙ্গা হাত জোড়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ওকে বেশ ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে যেন একটা পবিত্র গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে ওর শরীর থেকে। কেন যেন প্রসঙ্গহীন ভাবেই বৃদ্ধা বেদেনীর মুখ ভেসে উঠল মাথার ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে বেদেনীর শরীরে পান তামাকের গন্ধে মেশা একটা ময়লা বাতাসের অনুভূতি। গত রাতে একটা বাচ্চা নষ্ট হয়েছে শেফালি মাসির। বাচ্চাটা নাকি কুকুরের ছিল। সব কিছু কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়। কেবলি মনে হতে থাকে শেফালি মাসিদের পাড়ায় অনেক দিন যাওয়া হয়নি। শেখপাড়ার দিকে এগুতে থাকি। শেফালিদের উঠোনটা ঠিক চেনা যায় না। তারপর আকাশটা কেন যেন কেবলই ফুঁসতে শুরু করল। শেখপাড়াটা কি উঠে গেল! দুর্গাপিসি এখন কী করছে। শেফালি মাসি কি পাগল জীবনেই থেমে আছে? চোখ বন্ধ করে রাখি। তারপর অনেকক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে থাকি।

                     দরিদ্র ব্রাহ্মণ। অবন্তী ধামে তার বাস। প্রতিদিন ভিক্ষে করে যা পায়, তা দিয়ে তার সংসার চলে। ব্রাহ্মণের দুই কন্যা। অনাহারে বৃদ্ধি পায় তাদের লতার মতো ক্ষীণ দেহ। এক দিন ব্রাহ্মণ ভিক্ষে করতে করতে অনেক দূর পল্লীতে চলে যায়। এক কায়স্থের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ব্রাহ্মণের নাকে ভেসে আসে পিঠা ভাজার গন্ধ। কায়স্থ বাড়ির গিন্নিমা পিঠা ভাজছে। ব্রাহ্মণের ইন্দ্রিয় তাতিয়ে উঠতে থাকে। এর পর ব্রাহ্মণ আরও দু-দিন ঘুরে ঘুরে পিঠা বানাবার সাজ সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অবন্তী ধামের দিকে যাত্রা শুরু করে। আমি চট করে প্রশ্ন করি, অবন্তী ধাম কোথায়? দুর্গা কোনো জবাব দিতে পারে না। আমার কানে চিমটি কেটে হেসে ওঠে। এবারে আমি ব্রাহ্মণ কন্যাদের নাম জানতে চাই। দুর্গা মনে মনে নাম খুঁজতে শুরু করে। পরিচিত অপরিচিত কোনো নামই তার ভালো লাগে না। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে বড়টার নাম দুর্গা আর ছোটোটার নাম গঙ্গা। চেচিয়ে উঠি আমি, মিথ্যে কথা।

                       জানালার পাশে বসে আছে গঙ্গা। গায়ের হলুদ ওড়নাটা জানালার গরাদে ঝুলানো। একটা কাসার বাটিতে গঙ্গা কী যেন চটকাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝতে পারি কাচা আম আর তেঁতুল। জিহ্বায় পানি আসতে শুরু করেছে। মাথায় ব্রাহ্মণের মেয়ে দুটোর ফর্সা মুখ কেবলই ঘুরে ফিরে উঁকি দিচ্ছে। ওদের মাথার চুল লম্বা। বেশ লম্বা। একেবারে মাজার কাছে এসে এলিয়ে পড়েছে। চোখগুলো কেমন ছলছল। ওরা যেন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দুর্গা আঙুলের চিমটিতে তেঁতুল চটকানো মুখে দিয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিসিয়ে ওঠে, দেখ, খুব মজা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠোঁটের ওপর দুর্গা নিজের ঠোঁট ঠেসে ধরে জিহ্বায় ঠেলে দেয় তেঁতুল চটকানো। দুর্গার চোখ নাক আর নাকের নিঃশ্বাসের আলাদা একটা স্বাদ পেতে থাকি।  কোনো কিছু না ভেবেই দুর্গার ঠোঁটের ওপর কামড়ে দেই। দুর্গা চেঁচিয়ে উঠে ঝাপটে ধরে। গঙ্গা দুর্গার দিকে বিদ্যুৎচোখে তাকায়, দুর্গাপিসি কী করছিস এসব? দুর্গা হেসে ফেলে। গঙ্গার মুখের কাছে মুখ এনে বলে ওঠে, তুই ইতুদেবীর গল্পটা বল। আমি গঙ্গাদির আরও কাছে সরে আসি। গঙ্গা গরাদ থেকে ওড়নাটা তুলে নিয়ে গলায় জড়াতে থাকে।

                      ব্রাহ্মণ পিঠা তৈরির জন্য খেজুরের গুড়, চাউলের গুড়ো আর সরের ঘি নিয়ে তিন দিন পর গৃহে ফিরে গিন্নিকে পিঠা বানাতে বলে পাশের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে পিঠা ভাজার শব্দগুলো গুনতে শুরু করে। একটা করে পিঠা ভাজা হয় আর এক বার করে ছ্যাঁক শব্দ হয়। অমনি ব্রাহ্মণ দড়িতে একটা গিঁট দিয়ে রাখে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণের দুই কন্যা এসে মায়ের কাছে পিঠা খাবার জন্য বায়না ধরে। ব্রাহ্মণ গিন্নির মুখ ভয়ে সাদা হয়ে আসে। মেয়েদের পরির মত মুখের দিকে তাকিয়ে ব্রাহ্মণ গিন্নির বুকটা একেবারে হু হু করে উঠল। ব্রাহ্মণগিন্নি কন্যাদুটোকে পিঠা খাওয়ায়, জল খাওয়ায়। তারপর আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে বাগানে পাঠিয়ে দেয়। আর ব্রাহ্মণ পিঠা খাওয়ার সময় যখন পিঠা কম হবার কারণ জানতে চাইল তখন সতী ব্রাহ্মণগিন্নি ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাটাই বলে ফেলল ব্রাহ্মণের ভেতরটা রাগে কেবলই ফুঁসছে। মনে মনে বুদ্ধি আঁটে এর প্রতিশোধ নেবে। তারপর এক দিন ব্রাহ্মণ মেয়ে দুটোকে সাজিয়ে দিতে বলল ওদেরকে পিসির বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেখানে ওরা সুখে থাকবে। অন্ন-ভোগ-অলঙ্কার-কলাপেড়ে শাড়ি কিছুরই কষ্ট থাকবে না ওদের। ওরা ময়ূরের গানে ঘুমাবে আর ডাহুকের ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠে কাননে মালা গাঁথবে। তারপর এক দিন কোনো সদ্বংশজাত কুমার এসে ওদের রথে করে নিয়ে যাবে। ব্রাহ্মণী বিশ্বাস করে না স্বামীর কথা। কন্যাদ্বয়ের কচি বুকে আনন্দ। কচি বুকে স্বপ্ন। বুকজোড়া কেবলই ঢিপঢিপ করতে থাকে।
স্বামীর আদেশ বলে কথা। ব্রাহ্মণী সাজাতে থাকে মেয়েদের। তোরঙ্গ খুলে একে একে বের করে নিজের বিয়ের সময় মায়ের দেওয়া গয়না-ওড়না-হাওয়াই লাল চপ্পল। ব্রাহ্মণ দিন ক্ষণ দেখে কন্যাদের নিয়ে যাত্রা করে। তারপর হাঁটছে তো হাঁটছেই। এক দিন ওরা ক্লান্ত হয়। তারপর, বটবৃক্ষের তলে পিতা-কন্যায় বসিল। মৃদু বাতাসে নিদ্রাদেবী চোখে আসিল।

                           বাবার পায়ে মাথা রেখে গঙ্গা আর দুর্গা ঘুম যায়। ঘুমের ভেতর রাজকুমার এসে ওদের ডাকতে থাকে। রাজকুমারের পঙ্খিরাজ কেবলি উড়াল দিতে চায়। আর পাষণ্ড পিতা এই ফাঁকে ওদেরকে রেখে পালিয়ে আসে। ব্রাহ্মণ ফিরে আসে নিজ নিলয়ে। গঙ্গা-দুর্গার মাথা বাবার চরণ থেকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে। রাত গভীরে সিংহ ডেকে উঠলে ওদের ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে দেখে রাজকুমার নেই। রাজকুমারের পঙ্খিরাজ নেই। ওদের কান্নায় বটগাছের ঘুম ভাঙে। গঙ্গা-দুর্গা বটবৃক্ষের দিকে তাকায়। বাপুজির কথা জিঙ্গাসা করে। নেহেরুর কথা জিজ্ঞেস করে। গান্ধিজির কথা জিজ্ঞেস করে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কথা জিজ্ঞেস করে। সুভাষ বসুর কথা জিজ্ঞেস করে। চিত্তরঞ্জনের কথা জিজ্ঞেস করে। বটবৃক্ষ নির্বাক। আমি নির্বাক। আমার চোখ কেবলই ঝাপসা হতে থাকে। গঙ্গাদি আমার চোখের দিকে তাকায়, ইশারায় দুর্গাকে দেখায়। তারপর গঙ্গা-দুর্গা শব্দ করে হেসে উঠলে আমি আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে কেবলই পেছাতে থাকি। পেছাতে পেছাতে আজকে কত শত পথ দূরে সরে এসেছি তা আর মেলাতে পারি না।

                             মাথার ভেতর গঙ্গা আর দুর্গার ছবিটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। খানিক পর যেন গঙ্গাকে ছুঁয়ে দেই। বুঝতে পারি না কত যুগ ধরে আমি এখানে বসে আছি। দূরে কুমার নদের ওপারে বাবলা বন। শৈশবের সেই বাবলা বনের সবটুকুই এখন ইটের ভাটা। অনেক উঁচু লম্বা চিমনিটা দিয়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অন্ধকার আকাশটা আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন আকাশের সবগুলো অন্ধকার আর সবগুলো কালো ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। উঠে দাঁড়াই। চারিধার কাটাতার। শৃঙ্খলাবদ্ধ। বিএসএফ। বিজেপি। উদ্দেশ্যঘন।

                      সামনেই সাত কপাট স্লুইস গেইট। দুটো বিশাল শকুনরূপী হেলিকপ্টার যখন নেমে এসেছিল এখানটায় তখন মানুষের ঢেউ কেবলই গর্জন করে উঠেছিল আর হেলিকপ্টার দুটো ফিরে যাবার সময় চারিধারের সবুজ বাবলা বন যেন প্রতিবাদে দুলে উঠে কেবলি মাটির সাথে মিশে যেতে চেয়েছিল। বিশাল জনসভা। শুভ্র উলের শাল শরীরে জড়িয়ে পিতাগণ দেবলোক থেকে নেমে এসে চিৎকারে চিৎকারে জনস্রোতে ঢেউ জাগিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন ধর্মীয় চাদরে মোড়ানো তিন টুকরো ভূমির আড়ালে। জনস্রোতে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। বাজিতপুরের পথ খুঁজতে খুঁজতে প্রতীমা বিসর্জনের ঘাটে গিয়ে বেশ খানিকটা রাত শুধু বসেই থাকি। আজ আবারও সেই প্রতীমা বিসর্জনের ঘাটপাড়ে এসে থমকে আছি। স্থবির। তারপর থেকে বসে আছি আজও। ভিটেহারা গতিহীন এক টুকরো বিষাক্ত মাটি। ওপাড়ে শ্মশান। অন্ধকার। একটা কবরখেকো শেয়াল ডাকছে।

                      মড়ার হাড় সংগ্রহের জন্য সত্যিই এক দিন শ্মশানে গিয়েছিলাম আমি। সেটা ছিল ঘোর অমাবস্যার রাত। কোন অপদেবতা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তখন আমার শরীর ছিল জাদুশক্তিতে টইটম্বুর। শিবু ডোমের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে সব কিছু একেবারে পণ্ড হয়ে গিয়েছিল। শিবু ডোম আমাকে চিনতে পেরে হা হা গলায় চিৎকার করে উঠেছিল। অথচ আমার একটা জাদুর হাড় খুবই দরকার। এর পর শ্মশান ঘাটের সবগুলো হাড় হাড্ডি জাদুমন্ত্রে পালটে গেল। সুযোগ সন্ধানী মানুষেরা এসে জাদুর হাড় হাড্ডিগুলো চুরি করল তারপর ওরা বাজিতপুরটাকে হাড়ের ছোঁয়ায় পালটে দিল। আমার একটাও জাদুর হাড় নেই। ছিল না কোনো দিন। সেই অমাবস্যা রাতে একটা বিশাল আক্রোশ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম দুর্গার কাছে। তারপর থেকে চারিধার শুধু জাদুকরেরা হাড় হাড্ডি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল জাদুর কাঠির ভয়ে ঠাকুরদা ভেতরে ভেতরে পোড়াদহ নাটোর রংপুর তিস্তা তুষভাণ্ডার বুড়িমারি চ্যাংরাবান্ধা পাড় হয়ে মাথাভাঙা, চালসা, হাতিডোবা অতিক্রম করে জলপাইগুড়িতে পালিয়ে যাবার আয়োজন করতে থাকে। কিছুই বুঝে উঠতে পারি না আমি। শেখপাড়ার ছেলেগুলো এক দিন সন্ধ্যাপুজোয় আমাদের বাগানের সারসার একতলা দোতলা তিনতলা চারতলা পাঁচতলা এমনকি ছয়তলা কবুতরের বাসাগুলো জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। ১৯৪৬ টি কবুতর ওদের বাপদাদার ভিটে ছেড়ে উড়াল দেয়। ওরা উড়তেই থাকে। তারপর থেকে আর একটাও সবুজ বৃক্ষ পায় না দুদণ্ড বিশ্রাম নেবার স্বপ্নে।



মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
Excellent sir
Very nice