মহাকবিতার মহাফেজখানা-৩ ।। দূরের লোক।। অর্ঘ্য মণ্ডল ।।

দূরের লোক
অর্ঘ্য মণ্ডল

বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে তোমার অন্ধকার ইচ্ছা
বলো, তার অফুরন্ত মায়া একের পর এক ভাঙন পেরিয়ে
কী চেয়েছিল! আমাদের আধপাগলা ঈশ্বরের বদমেজাজ
আর আমার পাপকর্মের সাধ্যসীমানা ছাপিয়ে
অমানিশীথের শাসনসংক্রান্ত শ্রাবণে অঝোর ধারায়
তোমার কি ঝরে পড়ার কথা ছিল না!

ও দূরের লোক, তোমাকে কিশলয় বলবার মনের জোর
একরোখা এই মন থেকে কীভাবে হারিয়ে গেল, আর একটা
মোমবাতি কীভাবে উড়ে বেড়াতে লাগল! শেষরাত্রির ঘুমে
অগত্যা যারা হারিয়ে যেতে চায়, তাদের সন্ধিপ্রস্তাব
অসম্মত ফুলেদের কাছে, আমি তো
পাঠাতে চেয়েছিলাম পতঙ্গরূপে।
আজ অস্পষ্ট মৃত্যুর একটি উপত্যকায়
যোগ্যতম মৃত্যুর প্রতিনিধি, বলো,
সর্পকে কখনও স্বাগত জানিয়েছে এই মস্তিষ্ক
ময়ূরপাড়ায় বেদুইন মেঘের মতো না এসে
কারা ব্যস্ত থাকল শিকার অনুশীলনে,
টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে কারা উধাও করে দিল আমার পথঘাট...
আমার মাথায় রড়ের বাড়ি মেরে
ভুলিয়ে দিল বসন্তকালীন একাকীত্ব আর মনস্তাপআর
দিনের পর দিন, জন্মের পর জন্ম
সভ্যতার পর সভ্যতা ধরে
নীরবে তোমার দিকে তাকিয়ে দেখেছি একটি নদীর মৃত্য
পুনর্জন্ম ভাবনার আদিগন্ত বিস্ময়ে মোমবাতি নিভিয়ে
মুক্তি চাইছিলাম গঞ্জিকা সেবনে
বাংলা মদ আর বেশ্যাখানা থেকে অনেক দূরে দুস্কৃতির নিরালায়,
আত্মহত্যার মায়াঘোরে, -ও দূরের লোক!
কাদের দেখতে দেখতে বিলিয়ে যাচ্ছ উৎসাহে
ঠোঁট থেকে রক্ত মুছে নিজেকে ধর্ষক ভাবতে
ভালো লাগে, মাথার উপরে এখনও যারা
জ্বলজ্বল করে সারা জাগরণে, নিদ্রা মুহূর্তে
আকাশ থেকে নেমে এসে কুপ্রস্তাব দেয়, আমাকে
আলো ও উত্তাপ দেয়, আর আমি ফেরাই না কারো
অনুপায়ী, প্রবঞ্চকআজ অমানিশীথের
শাসনসংক্রান্ত বিধানে কি
            ঝরে পড়বার কথা ছিল না তোমারও!



           

সনির্বন্ধ এই সমর্পণ,
সনির্বন্ধ এই ঝড়ে পড়া, হত্যা আলো করে পুনর্জন্মের
ব্যবহার্য শরীর ক্ষমাপরায়ণ ইতিহাস
পাঠিয়ে দিচ্ছি না তোমার উদ্দেশ্যে, কিংবা যারা
শয্যাপ্রাঙ্গণ থেকে মুগ্ধতায় সাজাচ্ছে বয়স

কী বলব দূরের লোক-
একটা ধানগাছের সারাজীবনের ফলন,
আমার একবেলার খিদেও মেটায়নি

কী বলব দূরের লোক-
সন্ত্রস্ত গলাজলে দাঁড়িয়ে ভূতের ভয়ে
অবিরাম অবিরাম, রাম রাম আউড়ে যাচ্ছে—ও কি কোনও
প্রাধানমন্ত্রী না কি সেই গুনিন
যার ডাইনি নির্দেশে আমার ছোটোমাসিকে
পিটিয়ে মেরেছিল দেশের মস্তান-মাতব্বররা
লোলুপ শুভেচ্ছার রূপভেদে অট্টহাস্য করে উঠেছিলাম
-এই তো আমার মাথার অবস্থা
তবু গণতন্ত্র
ফুরফুর করছে আমন্ত্রণের আমিষ সম্ভাবনায়
আত্মহত্যার যথোপযুক্ত নির্জনতা, সংবিধানের
বহির্ভূত হলেই বা আমার কি আসে যায়!
ঘৃণা সাজানোর অস্ত্র প্রযোজনায় বাম ও দক্ষিনপন্থী গুণ্ডাদের
এলাকা দখলে লেলিয়ে দেওয়ার—কী আসে যায় তোমার!
সাইকেল ঘুরে বেড়াতে আমি প্রতি মুহূর্তে বড়ো বড়ো সব গাড়ি,
হোর্ডিং, পশুপাখির পাশ দিয়ে, কত ছ্যাবলামির পাশ দিয়ে
প্রতিদিন মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে আমি বেরিয়ে যাই।
তোমার স্বপ্ন ও উপস্থিতির পাশ কাটিয়ে, শূন্যতার সঙ্গে
অন্ধকারের সঙ্গে একমত হয়ে, কালক্ষেপ করি চোখে
-কথা বলছে গাছ।
প্রতিটি শাখাপ্রশাখা থেকে
অজস্র পাখিদের আর্তচিৎকারে কী আসে যায় তোমার!
আমি একটি নদীর মৃত্যু  দীর্ঘজীবন ধরে লক্ষ্য করেছি
শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে! ও দূরের লোক,
এত দূর থেকে কারুকার্য সম্বলিত ব্রতচারণের ঢেউ
পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখেছি, প্রতিটি রাত্রির মতো সত্য জলস্রোতে
আমরা ভাসিয়ে দিচ্ছি খুঁটিনাটি সব রাষ্ট্রিক সঞ্চয়
অসম্ভব ধুলোবালিতে নষ্ট চোখের জিঘাংসায়
একে একে ছড়িয়ে ফেলছি অর্ধ নিমীলিত ক্ষুধা
সম্ভ্রান্ত প্রণাম
মানস-জঙ্গলের ভেতরকার অভিসার
ছড়িয়ে ফেলছি স্তন, সন্তানবাসনা থেকে নদীর ওপারের
দোতলা বাস অবধি ছড়িয়ে ফেলছি তোমাকে
-তাতে কী আসে যায় তোমার!
অবিশ্রান্ত রক্ত-ঝড়ের মধ্যে হতবাক শৃগাল
তাকিয়ে রয়েছে স্মৃতির দিকে।
এলোমেলো পোশাকের জ্যোৎস্না মেয়েকে দেখাচ্ছে
-সীমান্তের ওপার, অহরহ
ম্যাজিক-বাঘের আক্রোশ। আমি পথ ও পথের
সংযোগস্থল থেকে ভাবি- কী করা যায় আজ!

আজ আমার গরম মাথা ঠাণ্ডা করে
রাত্রিকালীন পটচিত্রে ব্যবহৃত তুলিটিকে পরীক্ষার নামে
বিশ্রামে প্রশমন করছি উত্তেজনা। নিরুপায় ভেসে থাকা
নৌকার উপর থেকে যে পথ বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে
অন্ধকার ব্যালটের গোপনাঙ্গে, সে পথ ধরেই
ব্রিজের ওপারে চলে যাচ্ছে সেই কমলালেবু গাছ
তার দেহ বিভঙ্গে আটকে থাকা প্রত্যেক রাত্রিকে
আলোকরশ্মির অচঞ্চল মিশে যেতে দেখে
আমি এই সুধন্য প্রাঙ্গণের ইতিহাসের
আলপথে পুটুলি খুলে বের করছি পান্তা আর আলুভাতে
গাঁটি থেকে কাগজে মোড়া নুন, বের করেছি খাদ্য, আমি
রাক্ষসের মতো বের করছি তোমাকে- কী রোমান্টিকতায়
শরীর বদলে তরুণ বনস্পতি! ডালে বসা চামচিকি-বাদুড়ের সঙ্গে
বলছি সন্ন্যাস, হ্যাঁ গো, বলছি পরান্ন নয়
স্বপ্নস্ত আত্মহত্যা কলায়
শাকক্ষেত কেন দেখালে গিয়ে এই কাঙালকে,
শেখাতে গেলে, এপার ওপার, আজ যার কোনও
কূলকিনারা করতে পারছি না, নাসরিন মণ্ডল। শুধু
একটা শূন্য নৌকা পাক খেতে শুরু করেছে
যা কোনোদিন থামবে না।
তুমিই বিচার করো দয়াল
যে সুসভ্য মনস্তাপ ভুলে চলে এসেছি
চেনা অচেনা পরাজয় প্রতি কশাঘাতে
ঝরে পড়ছে মেদমাংস
ভুলভাল নিশ্বাস, বেরিয়ে পড়ছে শরীরের
ভেতরকার গাছ। আর বেরিয়ে পড়া মাত্রই
এসে হাত ধরছে পথ- না বলছে না সে

না বলছি দয়াল।
উঠোন থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীর ম্যাপের দিকে
তাকিয়ে দেখছি, কোনও মাতব্বরই
-না বলছে না আমাকেতাই শেকড়ের অভিশম্পাতে
কেঁপে ওঠা মাটির উপরে
কোথায় যাচ্ছি জানি না, ভালো লাগছে মধ্যরাত্রির
এই বাহন, ডানায় অস্থির শব্দে ঝড়ের চুম্বন, মধ্যপথে
দূর দিগন্তব্যাপী সাঁতরে বসতি ভাসিয়ে দেওয়া চোখের জল
এসেছে তোমার নিকট পর্যন্ত, কোথায় গন্তব্য তার
বলতে পারবে না মেঘ, বলতে পারবে না
পথ ভুলে যাওয়া মৃত্যুকল্পনা। শুধু
একটু দূরকে বিশ্বস্ত রেখে ঝলসে যাচ্ছি
বাহনটির অতীব দীপ্তিতে।
যাকে একদিন মা বিষহরির নির্দেশে
দংশন করেছিলাম। কথা বলেছিলাম ডিম ও বারুদ বিষয়ে।
বলছিলাম- হ্যাঁ, বন্ধ চোখের উপর
আলো পড়বার মতো- তোমার সন্ধ্যার নাম রাখলাম উপহার।
বৃষ্টি স্বভাবের ডানা ঝটপট অবসন্ন হয়ে আসবাব মহড়া থেকে
কোন পাহাড়চূড়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে
আমার চোখের জল।
সবাই ভাবল নদী। প্রেম ও অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে
লাগাতে চাইছিলাম তাঁকে খুব চাইছিলাম
যে দাহ দেবে বীজ
হীনদেহময়তায় টুকরো টুকরো মৃত্যু-উপাদান
আজ এই পৃথুলা-স্বপনে এই কুসুমিত গ্রামান্তর...
এসেছি তোমার কাছে সদ্যপ্রসূত কোনও
তারকার মতোই বিনীত।
সম্ভাবনার ভারে নত হয়ে
দেখেছি শাসন মানে- জল ঢুকে পড়েছে কুটিরে
বহিরাবরণ জ্ঞান ছবি থেকে রঙ মুছে
তোমার স্থিতির কষ
      আমার অস্থির সফলতা।

( লোকায়ত নানান সাহস ।। ২০১৫) 

মন্তব্যসমূহ