নিজেকে হত্যার গন্ধ
বিভাস রায়চৌধুরী
কুকথায় পঞ্চমুখ
কণ্ঠভরা বিষ
কেবল আমার সঙ্গে
দ্বন্দ অহর্নিশ
১
একদিন জেগে উঠে আমারও বিষাদ যায় যে-মৃত্যু
অতীত অন্ধকার,
তার নীচে রেখে যাওয়া গানে
একদিন মাথা নিচু করে
ঘুমোচ্ছিলাম দু-জনে
শুয়ে ছিল নির্জনতা, চর্যাপদ, আর যা যা
ভেবেছি
চূড়ান্ত ঋতুর আলোকালোদুনিয়ায়
কী ভালো নিজেকে
ব্যর্থ টের পেয়ে যাওয়া
কী ভালো অস্তের দিকে ডানা মেলে দেওয়া অন্ধকারে
একদিন এভাবেই
পেয়ে গেছি মেঘের পোশাক
একদিন তীব্র রাগে জ্বলতে জ্বলতে
বলেছি, বৃষ্টির মৃত্যু হোক
বলে হাউমাউ করে কেঁদেছি, কবিতা
আমাকে কখনও ক্ষমা
দেয়নি
টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বাইরে ফেলে দিয়েছে প্রচুর
মাটিতে শুইয়ে ফেলে জিভ টেনে ছিঁড়ছে আওয়াজ
গুঙিয়ে উঠতেই মুখে হড়হড় করে বমি
করেছে পয়ার
তাকাতে পারি না, তবু রক্তমাখা চোখ তুলে
ছেঁড়াখোঁড়া ঠোঁটে বলতে গেছি বারবার
আমিও আমিও ভালোবাসি, কিন্তু হে জীবন,
সবার জীবনে বৃষ্টি সহ্য
না-ও হতে পারে
অপূর্ব তৃষ্ণার
ঠোঁট আমারও ঘাসের বনে আছে।
কে শোনে? আমার ভাষা পড়ে আছে বনগাঁ লোকালের
নীচে
ঝড়ে
উপড়ে যাওয়া কত গাছের শিকড়ে
পুরোনো
বাড়ির কলতলায়
ধরা
পড়ে যাওয়া পকেটমারের ভাঙা দাঁতে
বাতিল
ট্রামলাইনে
সম্পাদকের
পায়ের তলার ঝুড়িতে...
একদিন মৃত্যুর ভেতর এইসব ধ্বংস জেগে উঠে
আমাকে জ্বালায়, ফের ফেলে দেয় আগুনে আগুনে
চড়চড় করে চুল পোড়ে
শব্দ
করে খুলি ফাটে
কখনও
শরীর পুরো ধনুকের মতো বেঁকে যায়
চিতার আগুন যদি বলে ওঠে ‘আমাকে রেহাই
দাও,
আর লিখব না’
ডোমের
হাসিতে কেঁপে ওঠে পূর্ব দিক
অমর
কবিতাগুলো মুখস্ত করেনি যারা, এমন একটা বটপাতা
বলে ওঠে আচমকাই
‘বিপ্লবীকে
বন্ধ ঘরে রেখে দিলে সে
দার্শনিক
হতে বাধ্য...’
অন্ধের দৃষ্টির মতো নগ্ন কিন্তু আমি
আমার নিকটে নেই কোনো প্রকরণ
কবিতার ভয়ে আজ যে-কোনো বন্ধুর মুখ মৃত
আমিও বিকারগ্রস্ত
মার খেতে খেতে নানারকম ব্যাধিতে ভরে গেছি
একদিন অভশপ্ত একদিন পুণ্যতোয়া একদিন আগেকার
তেজে
টুঁটি টিপে ধরছি সব
সার্থক কবিতার...
২
কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেল, অশ্রু
ল্যাম্পপোস্টের নীচে আমি
ঘুমিয়ে পড়েছি বহুদিন
বাঁকাচাদ
উদাসীন, ফেন্সিডিল ঘাড়ে নিয়ে আমি
সীমান্তে
পৌঁছেছি , ওই লুঙ্গি পরা দিলুভাই আসে
ডিউটি
শেষ হাঁফ ছাড়ে কোম্পানির মোটরবাইক
হাওয়া
হাওয়া হাওয়া হাওয়া এই রাত্রি তুমি জানো সীমান্তশহর
জাতিস্মর মৃত্যু লিখি মনে পড়ছে সব পরপর
বাদলাপোকার দল আমাকে জড়িয়ে ধরে মরে গেছে ঝাঁকে
ঝাঁকে কত
চাঁদ এসে লটকে গেছে তারে
আচমকা ঘুম ভেঙে দেখছি চাঁদের তীব্র চুম্বনে
ফুরিয়ে যাচ্ছে বাল্ব
সেই নেশা চেপে বসে আমার মাথায়
বোতামহীন কালো জামা খুলে আগুন ধরাই
রাংতায় জড়িয়ে একটিপ
বাদামি
চিনির ধোঁয়া টপ করে গিলে নিই, আর
পাগল দোকানদার ভেসে যায়, মহাপাগলামি
রক্ত
কামড়ে ধরে বাঁচে, ঢেউ
দুলছি...দোলায় শূন্য... যার-তার নাম ধরে ডাকি
ভাবি,
বাড়ি ফিরব কেন? ওখানে লাশের স্তূপ... ঠেলে
ঢুকতে
ভোর হয়ে যাবে
বারান্দায়
বসে থাকবে রাতজাগা বিচ্ছিরি বাবারা
কাশে আর রক্ত উঠে আসে
ব্যর্থতা
ব্যর্থতা দূরে বাড়ি থেকে কত দূরে যাব?
আমার
গোধূলি থেকে বিষণ্ণ নিষ্ফল পাতা ঝড়ে
পাশে পাশে কাঁদে ছায়া... মাঝরাত... একমুঠো
বড়ি
রবীন্দ্রপার্কের
পাশে ভিখিরি শোবার বারান্দায়
আমার
অতল ঘুম হে পাঠক তোমাকে ভাবায়?
পাগলের মতো এক
মা এসে সংসার ছুঁড়ে ফেলবে ওগো মা’র কোনো দোষ
নেই
মা’র কোনো দোষ নেই
বাজ পড়ে মরে গেছে আমার বকুল গাছ
তার শুকনো দেহ আমি কাটতে দিইনি
ভাবি, বাড়ি ফিরিব কেন?
পৃথিবীতে ব্লেড কমে যাচ্ছে?
আমার হাতের শিরা মাটিতে রাত্রির মতো পেতে
কী
পেয়েছি আমি?
পাশ-টাশ করে বসে আছি
অতগুলো দিন গেল, এই বয়স, কিছুই ছিঁড়িনি
বাংলাভাষা, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি, শালা কেউ
আমাকে খাবার দেয়নি! পাশ-টাশ মুঠো করে হুম
রাস্তায় রাস্তায় আমি খিস্তি দিয়ে বেড়াচ্ছি , হালুম
মাঠে মাঠে বজ্র খেয়ে বেরাচ্ছি, হালুম...
দিগন্ত মূর্ছিত , তার রুদ্ধশ্বাস কষ্টের
কাহিনি
টের পেয়ে গাঁজার কল্কেকে
চিৎকার করে বলি—
আমাকে অ্যামিবা বলে ডাক
আমাকে
অ্যামিবা বলে মেরে ফ্যাল তুই
আমাকে অ্যামিবা বলে মহাপাগলের কাছ থেকে
উদ্ধার করে
নে...
এতকাল পর আজ সূর্যের শরীর থেকে শুনি
অজানা শিখার দল বেরিয়ে এসেছে
প্রচণ্ড গতিতে
যখন–তখন ধাক্কা লেগে
শেষ হয়ে যাব
যেতে পারি, কিন্তু রাত্রি শেষ হয়ে যায়
নিজেকে হত্যার গন্ধ হাওয়ায় হাওয়ায়
শিখারা ছাইয়ের গুঁড়ো হয়ে ঝড়ে পড়েছে বো ও ম্ শং ক র...
হর হর মহাদেব তাণ্ডবের মুখে তবু আমাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে
শেষরাতে আত্মঘাতী যুবকের
তালিকায় তালিকায়...
৩
কিন্তু এই সেই রাত্রি, ব্যর্থ পাণ্ডুলিপি যার
ওষ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে
এই সেই রাত্রি, যার মাঠভরতি তারা আর
আকাশে রয়েছে
ধনধান্য
এই সেই রাত্রি, যার পাতায় পাতায়
খিস্তি অভিশাপ আর হেরে
যাওয়া যুবকযুবতী
আগামী জন্মের দিকে তীব্র
রাগে তাকিয়ে রয়েছে
কিন্তু
আমার মৃত্যুর ছিল নানান রকম
লুপ্তপ্রায় শৃগালীর মতো লোকালয় থেকে আমি
হাওয়া
যত প্রজাতির ধান মুছে গেছে সব
সব যেন আমার শরীর
আমাকে বুজিয়ে ফেলে বেকারভাতায়
ইমারত উঠেছে নগরে
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এই মুখ থেকে রক্ত তুলে লিখি
সমস্ত লেখাই যায় পাঠকের নিভৃত আত্মায়
আমি তাঁকে আত্মরতিগ্লানি থেকে সরিয়ে এনেছি
সরিয়ে আনাই
আমার
জীবনে কাজ
হে পাঠক , চিরকাল আমাদের সহ্য করেছেন
আপনার সামনে আমি নিজেকে ভেবেছি ব্যর্থ, আর
হাজির করেছি ফের নতুন নতুন লেখা
আপনার অভিযোগ আমার সম্পর্কে কেন এত
হতাশা আবেগ এত গ্লানি থুথু কফ?
কিন্তু কী করব? আমি এরকমভাবে বেঁচে আছি
ঝুলকালি ডানায় ডানায়
স্বপ্নের ভেতরে আমি ডুব মেরে দেখেছি প্রজন্ম
না-পাওয়ার বিষ নিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে আমার ঘিলুতে
আমি প্রেম ভাবি, দেখি ঝোপে ঝোপে আনন্দ রয়েছে
কিন্তু সেই আনন্দকে স্পর্শ করে আছে কাটা হাত
আমার লেখার দিকে ছুটে এসে চুমু খায় দুটি
ছিন্ন মুণ্ডু পরস্পর, এই
এই আমার নিয়তি
সুইসাইডাল নোট কুড়িয়ে কুড়িয়ে
দুঃখিত
পুরুষ এক ভোরের দিকে চলে যায়...
৪
একদিন আমাদেরো মনে হতে পারে
এ
জীবন ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়া নয়
অন্যের
বাগান থেকে চুরি করে পাইনি
বারবার
দেশ ভাগ হয়ে গেছে আর
ধর্ম
ভাগ হয়ে গেছে জমি ভাগ হয়ে গেছে
মানুষ কেবল রোজ নিজেকে সভ্যতা ভেবে
জ্বলে-পুড়ে
জ্বলে-পুড়ে খাক...
কিন্তু জেনো সেসবের বহু বহু বাইরে আমরা
জন্মেছি
ঘাসের মতো
আলো
আর আনন্দের দেখা হওয়ার মতো একদিন...
একদিন তীব্র রাগে জ্বলতে
বলেছি,
বৃষ্টির মতো মৃত্যু হোক
বলে
হাউমাউ করে কেঁদেছি...আবার
একদিন আমাদেরও মৃত্যুর সামান্য আগে লিখতে
ইচ্ছে করল
কী
লিখব জানি না, কিন্তু চকিতে কাগজ নিয়ে লিখি
এস
পোকা, এস সাপ, এস এস ভাম
এস
নদী, এস ঝরনা...এসেছ, সকাল?
আমার
মৃত্যুর জন্য তোমরা দায়ী নও
কে দায়ী? কে দায়ী, বলো?
সেকথা লিখেছে তুমি, ওগো কবি শতাব্দী নতুন?
মন্তব্যসমূহ