সম্পাদকীয়

                ঠোঁটকাটা ভোটকাঁটা 

              ভোট হল। ‘বন্ধ’ হল। শান্তি বজায় রইল, অশান্তিও। বজায় রইল শ্রমিকের অধিকার। কিন্তু আখেরে লাভ হল কাদের? দু-একজন এখনও হেদিয়ে মরছেন শ্রমিক শ্রমিক করে, মেহনতি মানুষ করে! আর এদিকে বন্ধের দিন-ই শ্রমিকগুলোর দশাই পোড়া ভাতের মতো। বিরিয়ানিখোর বন্ধবাজদের যুক্তি বিবিধ, যুক্তির পিঠে ‘৯’-কারের মতো ঝুলে আছে যুক্তি। যুক্তির কচকচিতে এঁটে ওঠা দায়। কিন্তু আসল কথাটা হল সেই ‘কিন্তু’! এর মধ্যে এইসব মহাযুক্তিবাদীরা ছাড় দিয়ে বসেন আইপিএল-এর মতো স্রেফ এক বহুজাতিক ব্যাবসায়িক খেল অ্যান্ড বিনোদন কোং- দের। কেন? যেখানে বন্ধ-পালন না-করতে চাওয়া শ্রমিকদের ঘাড় ধরে বন্ধ করানো হচ্ছে, সেখানে আইপিএল-কে ছাড় কেন? জানি, এরও যুক্তি আছে। থাকবেও। এক জন হত্যাকারী কিংবা সন্ত্রাসবাদীরও নানাবিধ যুক্তি থাকে। প্রতিবাদের বিকল্প ভাষা কি জানা নেই আমাদের, না ভুলে গেছি? জনজীবন ব্যাহত করে এ কোন প্রতিবাদ? মুমূর্ষুরোগী, চাকুরিপদপ্রার্থী- এঁদের কথাও ভাবুন, প্রতিটি ‘বন্ধ’-এ যাঁরা প্রাণ হারাচ্ছেন, তাদের কথা ভেবেছেন? এখানেও যুক্তি! চাকুরি পাবার আশায় আপনারাই তো রড মেরে লাফাচ্ছেন! এরকম ভূরিভূরি উদাহরণ আছে। মুখোমুখি বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। তখন আপনিই হয়তো ‘বন্ধ’ ডেকে বসবেন।

                  এদিকে গোলেমেলে ভোটের ফাঁকেই সিধু পাগল প্রাণ হারাল। কেন? জানা যায়নি। জানায় কোনও চেষ্টা করা হয়নি বোধহয়। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে খুন সিধু! সে পাগল। কারো ক্ষতি না-করা পাগল। শান্ত ভদ্র পাগল। রাস্তার পাশে আড়াই দশক শুয়ে থাকা পাগল। ভোটাধিকার না-থাকা পাগল। ভোটের দিন ভোর বেলা দত্তপাড়ায় একটি নর্দমার পাশে তাঁকে পাওয়া গেল। রক্তের মধ্যে শুয়ে ছিল সিধু। ঘিলু উড়ে গেছে। পুলিশ এসেছে। কাজ করেছে। গণতন্ত্রে ভোট খুব দরকারি। তাই মানুষ দলে দলে শান্তিতে ভোট দিয়েছেন। সিধুর রক্ত লেগেছে ভোটদাতাদের চটি-জুতোয়। সুশীল সমাজ নড়েনি একটুও। এখনও। বরং রক্ত মুছে এগিয়ে গেছে চায়ের ঠেকে, শাড়ির দোকানে। সুশীল সমাজ রবিপক্ষের কার্ড বিলি করার আনন্দে মেতে আছে। সুশীল সমাজ এতে তেমন কোনো ইস্যু খুঁজে পাচ্ছে না। ভিক্টিম সিধু গপণতন্ত্রের কেউ না। তাই ‘সেফ’ খেলে যাচ্ছে। ঢ্যামনাবাজ ন্যাকাবাজদের হাতে এখন বাঁশের বাশি। কোনো প্রথম শ্রেণির খবরের কাগজেও তাঁর খবর মেলে না! শেষে একটা সাপ্তাহিকে তাঁর খবর! নিজেকে হাইলাইট করার ‘সেফ’ খেলা এবারে খেলা যাবে না। মোমবাতি হাতেও! ঘাতকের ভয়ে না পাগলের প্রতি চরমতম অমানবিকতায়? বড় বেড়ি ঘুণ লেগেছে শিরদাঁড়ায়।
 

             গুন্টার চলে গেলেন। রেখে গেলেন তাঁর প্রিয় টিনের বাদ্যি। কাজ-কাম নাই, তাই বাজাই। কারণে অকারণে। নিজেকে লুকিয়ে রাখা প্রিয় কবি গৌতম বসু ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পাচ্ছেন। আমরা আপ্লুত। সঙ্গে স্বপ্নময়ের (কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী) ‘আনন্দ’ও আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে আমাদের। অভিনন্দন উভয়কে।

এবারে ‘এন্টিফিকশন’-এর দ্বিতীয় কিস্তি লিখেছেন শিমুল মাহমুদ। এ-এক অনবদ্য লেখা। লেখাটি  আপনাকে ভাবাবে, মুগ্ধ করবে এবং আরো কিছু করবে যা না-পড়লে ঠিক বোঝানো যাবে না। তাই লেখাটি নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। স্রেফ পড়ুন।  মাসুদার রহমান ও পিন্টু রহমানের দুটি মুক্তগদ্য অসামান্য। কবিদের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে মাসুদার তুলে ধরেছেন তাঁদের ছায়া–উপছায়াময় যাপনচিত্র। পিন্টু রহমান আমার প্রিয় গল্পকার। তিনি গল্প হিসেবে লেখাটি পাঠালেও ‘মুক্তগদ্য’ বিভাগে লেখাটি  প্রকাশ করেছি। আবেদনে এটা মুক্তগদ্যই। তবে শেষমেশ এই সিদ্ধান্ত পাঠকদের  হাতেই ছেড়ে দিতে চাই, তাঁরাই ঠিক করুন। প্রয়োজনে আমাকে বকাবকি করুন। খুব। মেনে নেব। তাই এর শিরোনাম করেছি, ‘একটি ছোটগল্প কিংবা মুক্তগদ্য’।

             প্রিয় পাঠকবন্ধুরা, রুপাই পান্তির ‘সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল’ সত্যিই জমে উঠেছে। সম্ব অনেক কষ্টে ভোট করাতে পারছে তাহলে! যাঁরা নভলেটটি এখনও শুরু করেননি, ঝটপট পড়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করছি তাঁদের। কথা দিচ্ছি, ভালো লাগবেই। এই সংখ্যায় শুরু হচ্ছে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন মলয় গোস্বামী। সত্তরের সাড়া জাগানো কবি-প্রতিভা গল্প-উপন্যাসেও মান ভাবে সিদ্ধহস্ত। উপন্যাসটি সাত-আট বছর আগে একটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেটিকে নতুন করে লিখছেন মলয়দা। এই সংখ্যা থেকে চালু হচ্ছে ‘দশে দশ’। একটি সাক্ষাৎকার কিংবা সাক্ষাৎকারের মতো। দশ জনের কাছে দশটি করে প্রশ্ন রাখা হবে। প্রশ্নকর্তা কবি তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দশজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা মুদ্রিত বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। শুরু করছি মলয়দাকে দিয়েই। ‘মেঘবৃষ্টির শামিয়ানা’–এর দ্বিতীয় পর্ব আজ প্রকাশ পাচ্ছে না। বিশেষ কারণেই। পাঠকবন্ধুরা আমাদের ক্ষমা করবেন। আগামী রবিবার লেখাটি আপনারা পড়তে পারবেন।

               এই সংখ্যায় তিনটি বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করা হয়েছে। গৌতম বসুর ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’, বিভাস রায়চৌধুধীর ‘নিজেকে হত্যার গন্ধ’ ও অর্ঘ্য মণ্ডলের ‘দূরের লোক’। কবিতাগুলোকে ‘মহাকবিতার মহাফেজখানা’-য় রাখছি। কবিতা তিনটিকে আমার আন্তরিক প্রণাম।

           এবারে পাঠানো অনেক লেখাই বেশ দুর্বল ছিল। এমনকি আমন্ত্রিতদের লেখাও। সেগুলো প্রকাশ করতে পারিনি। আমন্ত্রিত কবি-সাহিত্যিকদের কাছে মাফ চাইছি। পত্রিকার স্বার্থে এটা করতেই হল।   

           দেড় বছর আগে একটি ছোটগল্প লিখেছিলাম ‘অচেনা যাত্রী’র জন্য। নাম ‘দৃষ্টি’। এক নারীর অপূর্ব নিতম্বে মোহিত হয়ে পড়ি। আর সেটি নিয়ে গল্প লেখার অদম্য বাসনাও তাঁকে জানাই। গল্পটি গল্প আর নি-গল্পের মধ্যবর্তী স্থানে খাবি খাচ্ছে আজও। পরে সেটিকে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থে রাখি। কিন্তু এর মধ্যে আমার আর কোনো ছোটগল্প এখানে প্রকাশ করা হয়নি। এবারে হচ্ছে। গল্পটি ‘ভূত, ভগবান এবং...’ । নামটা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ভিডিও, ভগবান, নকুলদানা’-র  মতো শোনালেও এটা একটা মনোবৈজ্ঞানিক ভাবনাপ্রসূত গল্প। একেবারেই ভিন্ন। যদিও এটা গল্প কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে হাজার। কারণ ইতিমধ্যে তিনজন সম্পাদকের টেবিলে ঘুরপাক খেয়েছে গল্পটি। গত মে-তে লেখা। প্রথম সম্পাদক চাইলেন। দিলাম। কিন্তু তার পত্রিকা ভূমিষ্ট হল না। আজও। দ্বিতীয় জন থাকেন বাংলাদেশ। পাঠালাম। বোধহয় পছন্দ হয়নি। তৃতীয় জন ছাপবেন কি ছাপবেন না ঠিক করতে পারছেন না এখনও। গল্পটিকে আমার নতুন গল্পগ্রন্থে রাখব ঠিক করেছি, আর তাই নির্লজ্জ ভাবে এখানে প্রকাশ করছি। তবে হ্যাঁ, ‘একটি ল্যাদ খাওয়া গল্প’ বিভাগে। বিভাগটা নতুন। আপনারাই বিচার করুন আদৌ গল্পটি গল্পগ্রন্থে রাখা যায় কিনা, কিংবা এখানেও।
               শেষপাতে থাকছে প্রিয় গল্পকার দেবাশিস রায়চৌধুরীর একটি চমৎকার অণুগল্প। ভোট নিয়েই। পৌরভোটে যা হয়ে গেল বাংলায়, তারই ছায়া। পড়ুন। দেবাশিসদার শ্লেষ ভালো লাগবেই।

           এটাকে কি আদৌ সম্পাদকীয় বলা যায়? এই প্রথম সম্পাদকীয়তে এত বললাম, ‘অচেনা যাত্রী’তে তো বটেই। এটাকেও ‘ল্যাদ খাওয়া’ দলে ফেলতে পারেন।
মতামত দিন। জানি আমাদের ব্লগে একটু অসুবিধা আছে। মতামত বিভাগ আপনার ই-মেল ও পাসওয়ার্ড চায়। আপনি দিতে সংকোচবোধ করেন। স্বাভাবিক। কিন্তু সংকোচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। গুগল আপনাকে চিনে নিতে চায়, আমরা নই। তো অনুগ্রহ করে ইমেল-পাসওয়ার্ড দিন, তারপর মতামত লিখুন। এই বিভাগটা আরো পাঠকবান্ধব হওয়া উচিত ছিল। জানি। কিন্তু কি করব বলুন? পত্রিকা সাজানো গোছানো সব আমার হাতে, যদিও জীবনে এ-সব কিছুই শেখা হয়নি, কেবল ইচ্ছের উপর ভর করেই এগোনো, অন্য অনলাইন পত্রিকাতে দেখি কেউ না কেউ সাজিয়ে দেয়, আমাদের সে সৌভাগ্য হয়নি এখনও। হবে কিনা আদৌ জানি না। অতএব একটু মানিয়ে নিন বন্ধু।   

            আর একটি কথা, অনলাইন পত্রিকা বলে ‘অচেনা যাত্রী’কে ভুলেও তাচ্ছিল্য করবেন না। অনেক তাবড় তাবড় মুদ্রিত পত্রিকাকেও লজ্জায় ফেলে দেবে ‘অচেনা যাত্রী’। হ্যাঁ। হক কথাই বলছি। কাউকে খুশি করার জন্য ‘অচেনা যাত্রী’ নয়। বাজে লেখা ছাপানোর জন্যও ( অবশ্য ‘ল্যাদ খাওয়া’ বিভাগ বাদে) ‘অচেনা যাত্রী’ নয়। পুরোনো লেখা বার বার প্রকাশ করব, তবু খারাপ লেখা নয়। বন্ধুত্ব থাকল না পানাপুকুরে ডুবে মরল দেখব না। আর না হয় বন্ধই করে দেব পত্রিকাটি। মৃতকে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ?
অতএব... চলুন... শুরু করি...

পুনশ্চ: সেপ্টেম্বর, ২০১৫-এর সংখ্যাটি প্রকাশিত হলেই ‘অচেনা যাত্রী’ দু-বছর পূর্ণ করবে। তারপর পত্রিকাটি এক বছরের জন্য বন্ধ রাখব। প্রথম পর্বে আর মাত্র চারটি সংখ্যা প্রকাশ পাবে। আসলে ‘অচেনা যাত্রী’ আজ যে মানে পৌঁছে গেছে, তাতে প্রতিমাসে নিয়ম করে প্রকাশ করা খুব মুশকিল। প্রকাশ করতেই পারি। তাতে পত্রিকার মান পড়ে যাবে। আমরা চাই না সেটা হোক। তবে ‘অচেনা যাত্রী’-তে বিভিন্ন ই-বুক প্রকাশ করা বজায় থাকবে। আমরা মুদ্রিত বই এর পাশাপাশি ই-বই প্রকাশে বিশ্বাসী। ‘অচেনা যাত্রী’র ঠিকানায় খুঁজে পাবেন ‘অচেনা যাত্রী’কে। ফিরে আসব ২০১৬-এর ১ অক্টোবর। হ্যাঁ, আসবই। আর এই কারণে মলয় গোস্বামীর উপন্যাসটি প্রকাশ করা হচ্ছে না। আগামী চারটি সংখ্যায় উপন্যাসটি শেষ করতে পারব না। 


মন্তব্যসমূহ