স্বর্ণগরুড়চূড়া
গৌতম বসু
প্রশ্নের একটা উত্তর আমি দিয়েছিলাম
যদিও পাহাড়ের কোল, অনুপস্থিত শব্দশৃঙ্খল,
শতসহস্র বায়ুস্তর
মনে রাখে নাই কিছু; তাঁরা জানে, সব উত্তর
ক্ষণকালের,
কেবলমাত্র প্রশ্নসকল সুদীর্ঘ আয়ুষ্কালের
অধিকারী।
হাঁটতে হাঁটতে স্বর্ণগরুড়চূড়ার কাছে এসে
পড়েছি, বাকি পথ দেবতাদের-
আগুন পোহাবার সময় এখন, বোঝা নামিয়ে
ভাঙা ডাল, শুকিয়ে-যাওয়া পাতা সংগ্রহ করছি,
দেখি
দুই ঝরাপাতার ফাঁকে আরও একটি ঝরাপাতা, সেইখানে
আরও একখানা প্রশ্ন:
‘এত যে শপথগ্রহণ করিলে ইহ জীবনে, কী পরিণতি
হইল তাহার?’
তড়িৎ প্রবাহের চাবুক খেয়ে, ডালপালা নিয়েইও
মাটিতে বসে পড়লয়াম
সহসা ডালপালা তোর উতলা যে, ও চাঁপা ও করবী।
সপ্তশোকসঞ্জাত পৃথিবী
এই কন্টকমুকুট কেবল তোমার জন্য
এই একযানে প্রবেশ করবার অধিকার, একমাত্র তোমার
আমি একা: পাহাড়ের কোল
এত যে প্রহার করেছে আমায়
চন্দ্রালোকের প্রহার, সূর্যস্তরের প্রহার,
মেঘবসনের, বৃষ্টিদিনের প্রহার,
প্রহারে–প্রহারে ঘনঘোর সংঘর্ষ বেধেছে
এই কাঁটার মুকুট সেই সংঘর্ষের সব ক্ষতচিহ্ন
বহন করুক।
আমার ভাষা মেঘাবৃত, কথা বুঝতে পারে না কেউ,
তাই বড়রাস্তার মতো
সংখ্যাহীন চিহ্ন কাঁধে বহন করি সর্বদা, এভাবেই
পথ চলি আজকাল,
সেই বহু পথচিহ্নগুলির একটি
মেঘপ্রদেশ থেকে, মৃত্যুমথিত কীটলোক থেকে
মাথা নত করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলাম-
মেঘ ঢেকে রেখেছে পাহাড়, পাহাড় ঢেকে রেখেছে মেঘ
অরক্ষিত, ফেলে–আসা শপথগুলি আমার
এক আঁজলা তৃষ্ণা মেটাবার তরে কোথায় কোথায়
ফিরেছে।
মেঘ ঢেকে রেখেছে পাহাড়
তিন সহস্র ভুবন
পাহাড়ের কোল থেকে নীচে, বহু নীচে, তাকালাম-
আমার সমস্ত স্নায়ু ঢাকঢোল সহযোগে বিকট
গানবাজনা শুরু করে দিল,
ভয়ানক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছি, পারছি না
চোখে পাতা বন্ধ করবার অনুমতি চাইছি, নাই
অনুমতি নাই
পাহাড়ের কোল থেকে গড়িয়ে পড়বার অনুমতি চাইলাম,
নাই অনুমতি নাই
আমি বললাম, হে স্বর্ণগরুড়চূড়া,
হে জগৎসংসারবন্ধন,
এ কেমন ঘণ্টাধ্বনি শুনি
শরীরখানা কী–এক পাগল রঙে রাঙালে
দেখতে–পাওয়ার অভিশাপে আমার সর্বশরীর জ্বলছে
দেখতে পাচ্ছি ওই নীচে, ঘামে, রক্তে ভিজে–যাওয়া
মাটি,
সেখানে এতক্ষণ ফুটে ছিল আকাশের চুম্বনরাশি
এবার তাঁরা নিভে আসছে একে-একে
যেভাবে যুদ্ধসন্ধির পতাকা মিলিয়ে যায় সুদূরে,
সুদিন যেভাবে ফুরায়।
আমার শপথবাক্যগুলিকেও দেখতে পেলাম দূরে
মেঘ ঢেকে রেখেছে পাহাড়, পাহাড় ঢেকে রেখেছে মেঘ
বলো, বাক্যস্রোত, কোন্ অন্ধকার ধুয়ে পরিচ্ছন্ন
করবে তোমাদের
তোমাদের ম্লানতা শুধু যে আভার মতো ছড়িয়ে পড়ছে
তা নয়
তোমাদের ম্লানতা, ত্বক ভেদ করে, রক্তপ্রবাহ
পার হয়ে
অস্তিসকল চূর্ণ বিচূর্ণ করে, প্রবেশ করেছে
ঘামে, রক্তে-ভেজা মাটির ভিতর
তোমাদের ম্লানতা তুলনারহিত, কারণ তা
উজ্জ্বলতার নিকটস্ত।
মেঘ ঢেকে রেখেছে পাহাড়, পাহাড় ঢেকে রেখেছে মেঘ
বাক্যরাশি ও দৃশ্যজগৎ আজ আমার চেয়েও অসহায়
পাহাড়ের কোল, তুমি কি এইভাবে ফিরিয়ে আনলে আমায়
পরাজয়ে, স্বর্ণগরুড়চূড়ায়?
আমার মস্তিষ্ক মেঘাচ্ছন্ন, চারপাশে ঘোর
অন্ধকার।
আমার মনে হল অচেনা এক নদীতীরে দীর্ঘকাল
দাঁড়িয়ে রয়েছি
দাঁড়ের শব্দ থেকে বুঝলাম, এইমাত্র একটা নৌকো
এসে দাঁড়িয়েছে ঘাটে,
এত ঘন অন্ধকারেও আলো আছে কোথাও, না হলে ওই
অস্থির জলস্তর,
নৌকার ক্ষুদ্র পরিসর, নৌকাচালকের নীরবতা,
এতকিছুর আভাস পেলাম কীভাবে?
নৌকা অল্প দুলছে, মাঝির কাঁধে ভর দিয়ে উঠে
বসলাম
তার কাঁধে হাত রেখে মনে হল এটা একটা ঠাণ্ডা, ভিজে
গুহার দেওয়াল।
নৌকা চলতে শুরু করল, আকাশে একটিও তারকা দেখছি
না।
‘এই দুর্গম স্থানে আসিবার কারণ স্মরণ করিতে
পারিতেছ?’
ঠাণ্ডা ভিজে গুহার দেওয়ালের মতো মাঝির
পৃষ্ঠদেশ আমার সামনে, আমি নীরব
কী বলি, আমি কি এই প্রশ্নের উত্তর জানি?
সহসা, কাদামাখা, ঋজু একটা নরমুণ্ড জল থেকে
খাড়া উঠে এল
‘নৌকাযাত্রী, কে তুমি? এখনও আসে নাই তোমার
অন্তিমকাল।’
আমি প্রাণভয়ে মাঝির চওড়া কাঁধ ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে
কেঁদে বললাম,
‘ফ্লেগয়াস! ফ্লেগয়াস! রক্ষা করো!’
ঠাণ্ডা, ভিজে গুহার দেওয়ালের মতো কাঁধ,
নিরুত্তর
নৌকা, নদীবক্ষে ফুলের পাপড়ির মতো দুলছে।
‘আমার নাম জানিলে কী করিয়া?’ , আবার একটি
প্রশ্ন।
আমার সর্বশরীর তখনও বাঁশপাতার মতো কম্পমান
কণ্ঠস্বর নাই, হৃৎপিণ্ড, দেহ থেকে মুক্ত হয়ে
বাছুরের মতো লাফাচ্ছে।
ভাবলাম, মাঝি আমার উদ্ধারকর্তা, তার প্রশ্নের
উত্তর না দিয়ে উপায় নাই,
জল থেকে উঠে-আসা নরমুণ্ড জলে ফিরে গেছে,
আমার স্নায়ুর অরণ্যে মলয় বাতাস বইছে,
শান্তকণ্ঠে বললাম:
‘তোমার নাম ও পরিচয় বই-তে পেয়েছি।’
মাঝি মুখ ফিরাল, পার্শ্বমুখ দেখেই বুঝলাম
সে আমার ’পরে রুষ্ঠ। আমি তখন অন্য কথা ভাবছি।
আচ্ছা, পরস্পরের ভাষা আমরা বুঝছি কীভাবে?
আবার প্রশ্ন, মস্তিষ্কে আবার মেঘের ঘনঘটা।
ক্রমে অনুভব করলাম, আমার ভিতর থেকে ভাবনা ও
ভাষা শুষে নিচ্ছে কেউ,
ভাবলাম, এমনও হতে পারে, যাকে উদ্ধারকর্তা
ভাবছি, সে আসলে ঘাতক।
মাঝি হেসে উঠল। ‘ভুল ভাবিলে। আমি ঘাতক নই,
ত্রাণকর্তাও নই।
তুমি এখন গ্রন্থের জগৎ বহন করিয়া এতদূর চলিয়া
আসিলে,
এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলে না কীসের মূল্য
কতটুকু,
তুমি মূর্খ ও দাম্ভিক।’
সামান্য কয়েকটি কথা; আমার মনের, মস্তিষ্কের, দেহের
সমস্ত বর্ম ভেঙে পড়ল, মাঝি পরম-বন্ধু আমার,
তার পিঠে মাথা রেখে শুরু হল আমার অশ্রুমোচন
সে এক অমোঘ, দীর্ঘস্থায়ী, অপূর্ব ভূকম্পন!
একটি দাঁড় তুলে, দূরে কয়েকটি ছায়ামূর্তির দিকে
মাঝি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, দেখলাম, ঠিক
ছায়ামূর্তি নয়
ওগুলি আসলে অন্ধকারের পৃথক-পৃথক যূথবদ্ধ
কুণ্ডলী যেন,
কুণ্ডলী হতে থেকে-থেকে ভেসেআসছে বিলাপ ও
অশ্রাব্য ক্রন্দনধ্বনি।
উদ্বেগ সংবরণ করতে না পেরে, বললাম: ‘ফ্লেগয়াস,
আমরা কি ওদের কাছে কিছু খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে
দিতে পারি না?’
ফ্লেগয়াসের সেই অট্টহাসি আমার বহুকাল মনে
থাকবে
হাসি থেমে আসবার মাঝে কিছু কথা, আবার হাসির
মাত্রাবৃদ্ধি
‘খাদ্য? পানীয়? পূর্বেই তোমার বুদ্ধিমত্তার
সহিত আমার পরিচয় হইয়াছে!
কেন, একটি-দু’টি গ্রন্থ পৌঁছাইয়া দিবার কথা
মনে হইল না কেন?
আহাম্মক, উহারা অহঙ্কারী, সেই কারণে দণ্ডভোগ
করিতেছে!’
আমি অধোমুখে বসে-বসে বুঝলাম, এই ভয়াবহতার যদি
বা শেষ থাকে কোথাও
সেই সমাপ্তিরেখা দেখবার সাধ্য আমার নাই।
ফ্লেগয়াসকে জানালাম সেই কথা;
ঠাণ্ডা, ভিজে গুহার দেওয়ালের মতো তার
পৃষ্ঠদেশ, আমার সম্মুখে
নৌকায় বসে আছি অধোমুখে, অনুভব করছি
ঈষৎ বাঁক নিয়ে নৌকা তীরের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এক পাহাড়ী মেষ, শিশির–ভেজা মুখ দিয়ে,
কৌতূহলভরে
নিথর শরীরটা স্পর্শ করছে বারবার, তাঁর ঘুম
ভেঙে গেল,
চোখের পাতার ঠিক সামনে ঘাসের ডগা, নিঃশ্বাস
পড়ছে ধীরে
অতিক্ষুদ্র সে-বাতাস, তাতেই দূর্বাদলের কোমল
ফলা দুলছে।
সে চিৎ হয়ে শুলো, দু-চোখ মেলে তাকাল সম্মুখে,
ভাবল, পাহাড়ী মেষটির ঘাস খাওয়া, শান্ত ঘোরাফেরা
দেখবে,
এমনকি ভয়ঙ্কর সেই নৈশ অভিযান, নৌকাচালকের
সঙ্গে আলাপের চিত্রসারি
ফিরে আসবে তার কাছে, কিন্তু এসব কিছুই, শুনতেও
পেল না, মনে পড়ল না কিছু,
না পাহাড়ের কোল, না স্বর্ণগরুড়চূড়া, না ঠাণ্ডা
ভিজে গুহার দেওয়ালে ফ্লেগয়াস
সে, এই প্রথম, আকাশ দেখতে পেল,
অপরাহ্ণের অনাবিল, উদার-গম্ভীর, বিরাট, বিরাট
আকাশ
ধূসরবর্ণ মেঘের কয়েকটি পুঞ্জ, খুব ধীরে-ধীরে
প্রায় শম্বুকগতিতে আকাশের প্রকাণ্ড প্রান্তর
পার হচ্ছে।
কী নৈঃশব্দ্য! কী প্রশান্তি! কী বিনম্র
গৌরবময়তা!
মানুষের মতো নয়, মানুষের শপথবাক্যের মতো
বিবিক্ত নয় কখনও
প্রতারক নয়, দম্ভযুক্ত নয়, নয়, নয়,
এই অবধি, এমন অমল, এমন প্রকাণ্ড আকাশ সে যে
কেন দেখে নাই!
(স্বর্ণগরুড়চূড়া ।। ২০১৩)
মন্তব্যসমূহ