অমিতকুমার বিশ্বাস
দুর্গানগর
ছাড়তেই অন্ধকার নেমে এল। ভয়ে সিঁটিয়ে নুনি। ভাবছে কেউ
চটকে খাবে। খুবলে খাবে। ঘামছে। দর দর করে।
হাতের রুমালটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। নাকটা
দিব্বি ফুলে
যাচ্ছে। এবার হয়তো মাথাঘুরে পড়ে যাবে...
সবাইকে চমকে দিয়ে আলো এল কামরায়।
মুখগুলো ভেসে ওঠে। সব। একে একে। পাশের
কাঁচাপাকা দাড়িমুখো, পিছনের টাকমাথাওয়ালা। এরকম আরও। লোকগুলো
কত কাছে আবার কতদূরে। একদম ছবির মতো দেখতে পাচ্ছে সে।
ছবিটা দেখতে দেখতে শান্ত হল মন। পরিচিত ছবি। একজন শুভানুধ্যায়ী ছবি থেকে উঠে এসে
বললেন, দিদিভাই লেডিসে আসতে পারেন
কিন্তু! মনে মনে নুনি বলে উঠল, আর
লেডিস! এদিকে ঘাম শুকিয়ে এসেছে। বুকের ধড়ফড়ানিও। থোকায়
থোয়ায় ঝুলে থাকা একঘেয়ে আম আদমি। এইসব কার্বাইটে পরিপক্ক আম
আদমির গন্ধ মাখতে মাখেতে নুনি চলে এসেছে বনগাঁয়।
রাত। নুনি শুয়ে
আছে বিছানায়। সবে রান্নাবানা
খাওয়াদাওয়া সারল। ঘরে জিরো জ্বলছে। পাশে বছর সাতের বিটু
ঘুমিয়ে কাঁদা। বিটুকে জড়িয়ে ধরে হামি খায়। সত্যি, শিশুদের এই মুখখানা কী যে
ভালোলাগে! মনে হয় সাক্ষাৎ ঈশ্বর শুয়ে আছেন। এই ঈশ্বরকে ঘিরেই মানুষের
সাজানো বাগান। বাগানের ফুল। ঘ্রাণ। অলৌকিক স্বপ্নবিহার।
.jpg)
.jpg)
হঠাৎ আধাঁর! সারা ঘরে আততায়ীর মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উঠে বসে নুনি। অন্ধকার
তাকে একটু একটু করে গ্রাস করে নেয়। আর অমনি সে ডুব দেয়। অতীতে। হারিয়ে যায় ভূতের দেশে।
মেছো ভূত। গেছো ভূত। মামদো ভূত। জামদো ভূত। শাঁকচুন্নি।
ব্রক্ষ্মদত্যি। সব। সব গাছে বসে আছে। অন্ধকার রাতে সাদা
সাদা দাঁত বের করে সবে শুরু হল তাদের গপ্পসপ্প।
আর সেই গপ্পের দেশেই কীভাবে তলিয়ে গেল
নুনি!
দুই
গ্রামে
ভূত এসেছে। বাজে ভূত। তখন তাঁর সবে এগারো।
রাতে শুয়ে আছে। বাবা-মা দুই দাদা, এক বোন ও এক ভাই। সদ্য
বাংলাদেশ থেকে এসেছে। সুভাষপল্লি। রানাঘাট রেললাইনের পাশে জায়গা পেয়ে গেল। একটা
ছোট্ট ঘর। ঝুপড়ি বলা চলে। তার মধ্যে সাত-সাতজন। দুটো তক্তাপোশ
পাশাপাশি লাগানো। দুটো মশারি এক সাথে সেলাই করে তাঁবুর মতো টাঙানো। সালটা ১৯৯৩।
ঘরে কেরোসিনের ল্যাম্প টিম টিম করে জ্বলছে। এখন নেভানো। পুবকোণে একটা ছবির সামনে বিষণ্ণ প্রদীপ কোনওমতে জ্বলছে।
আস্তে আস্তে তার শিখাটাও হারিয়ে যায় লাল আভা আর
ভৌতিক ধোঁয়ার মধ্যেই। সবেমাত্র
চোখের দু-পলক শান্ত হল। ক্ষতটা সবে শুকিয়ে
এসেছে। এতদিন রক্ত ঝরেছে রোজ। হাত-মুখ বেঁধে মা ও মেয়েকে ভূতে টেনে নিয়ে যায়। গাছে গাছে ওই সব
ভূত সাদা সাদা দাঁত বার করে নাচনকোঁদন করে। খুব ভোরে ভূতগুলো হারিয়ে যায়। আপাত
ভূতমুক্ত মানুষদুটো দিনের আলোয় হামাগুড়ি দিতে দিতে বাড়ি ফেরে।
পোড়া বাড়ি। অন্ধকারে যখন ভূতগুলো মা-মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় তখনও বাড়িটা
ঠিকঠাক ছিল। আটচালা ঘর। কারো শোবার অসুবিধা ছিল না। খাওয়ারও। কিন্তু এখন?
তাই এক রাতে 'ধুর' হয়েই
চলে এল এপাশে। আর থাকায় জায়গাও জুটেগেল। ক'দিন বনগাঁ রেলপ্লাটফর্ম। তারপর ওদের এক পরিচিত খবর দিল, এখানে আয়। এখানে মানে সুভাষপল্লি। বনগাঁ-রানাঘাট রেললাইনের ধারে। তাদের পাশেই। এখানে ভূতের খুব একটা উপদ্রব নেই।
কারণ এক কড়া ওঝা আছে এখানে। ভূতকে গাছের সাথে বেঁধে রাখার সকল দাওয়াই জানা তার। ক'দিন প্লাটফর্মে ভূত ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু কারো ঘাড় মটকাতে পারিনি। তবু
একটা ভয় ছিলই।
এভাবে
তার এগারো থেকে তেরো হয়ে এল। কাননে এক
এক করে নানান ফুল ফুটে উঠছে। ফুলের ঘ্রাণে
ক্ষতের বিষণ্ণতা মুছে আসতে লাগল। তবু ভূতের
ভয় গেল না। সুভাষপল্লি তখন আজকের সুভাষনগর হয়ে ওঠেনি। ঘরে ঘরে ইলেকট্রিক বাল্ব, পি এল, কালার টিভি, ডিশ,
ফ্রিজ-এসবের
অস্তিত্ব স্বপ্নেও ছিল না।
মোবাইল ফোন তখন বাংলার জঠরে। হ্যারিকেন ছিল আলোর দেবী। দেবী নিভে গেলেই ভূত ঘুরে
বেড়াতো সারাঘরময়। তবে
তাকে ছুঁতে পারতো না। কারণ তার হাতে বাঁধা ছিল কানাগাছির শিকড়-বাকড়।
তবু হুড়মুড়িয়ে উঠল সে। রাতের বেলা একটা কিছু তার শরীরে ঢুকে পড়েছে! ভূত ভূত! শাঁকচুন্নি! বাঁ হাতের শিকড়টা নেই! কী আশ্চর্য।
ভূত তবে আজ তাকেই ধরল? ভয় পেল সে। ভীষণ! ঘামতে
লাগল। পায়খানা পাচ্ছে। পেচ্ছাব কিংবা বমিও।
চিৎকার করল। কিন্তু আওয়াজ বের হল না। মনে হল তার মুখটা কে যেন চেপে
রেখে দিয়েছে! মায়ের ঘুম ভেঙে
গেল। মাথার কাছের টর্চটা নিয়েই মারল। দেখে সবাই
ঘুমিয়ে কাঁদা। কেউ নেই ! কিছু নেই! সব মনের
ভুল । স-ব। স-ব। মা তাকে জড়িয়ে ধরল।
নুনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলে একে একে সবাই উঠে পড়ে। সবার মুখে একই প্রশ্ন, কী
হল? একটা মালগাড়ি সুতীব্র
আলোর শরীর নিয়ে কর্ণকুহরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে
ঢুকে পড়ল ট্রাকে। চলেও গেল। তবু তার পলাতক শব্দগুচ্ছ বুকের ধড়ফড়ানির মতো এখনও কানে বেজে চলেছে। নুনিকে আজ ভূতে
ধরেছে। কাল ওঝা ডাকতে হবে।
ওঝা এল। হিং টিং ছট্ হল। ঝাঁটা, মড়ার খুলি, ধূপধুনো নিয়ে লাফালাফি হল। লোকজন জড়ো হল। হুঙ্কার ছেড়ে ওঝা ভূত ছাড়িয়ে চলে
গেল। আর ছোট্ট ফুলের পাপড়ির থেকেও কোমল মেয়েটি
সিঁটিয়ে পড়ে থাকল ঘরের এক কোণে।
এরকম
মাঝে মাঝেই হয়। অন্ধকার নেমে এলে ভূত আসে। একদিন নুনির মা ভূত ধরে ফেলল। হাতে নাতে।
তারপর অন্ধকার রাতেই ভূতটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল লাইনের ওপারে। গাছের সাথে বেঁধে রাখল। ওঝার ফুঁকফাক
দেওয়া কঞ্চি দিয়ে বেদম পেটাল। শেষে ছেড়ে
দিল। মা বলল, ভূতডা এহন বনে চোলি গেছে, বুঝলি। এমন পেঁদানি দিছি না ! যাক বাড়ি থেকে ভূত
বিদায় নিল তবে। বাঁচা গেল।
তিন
আবার ট্রেন । শেয়ালদহ ঢোকার মুখেই। কে পেছনে হাত চালিয়েছে! ধরতে পারল না। ওৎ পেতে আছে। নেমে গেল। চড়া
লিপস্টিক মেখে বেড়িয়ে পড়ল ময়দানে।
চার
নুনির বিয়ে হয়েছিল বছর তেইশের যুবকের সাথে। ছেলেটি পেশায় ভ্যানচালক। বক্সিপল্লি। পাশের গ্রাম। এবার রানাঘাট
লাইন ছেড়ে কলকাতার লাইনে এল। কিন্তু
ছেলেটি তার থেকে বয়সে বড় বৌদির সাথে থাকে।
দাদা পঙ্গু। এক মেয়ে। তাই রাতে পাওয়া
যায় না তাকে। তাই শাশুড়িকে নিয়ে শোওয়া। সাথে ভাসুর ঝি। পিঙ্কি। তার থেকে বছর তিনেক
ছোটো হবে। ছোটো ঘর। স্বামী পাশে ছিল না। তবু ভালো ছিল। স্বামী যেদিন আসতো সেদিন তাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে যা
ইচ্ছা তাই করত। তার এসব ভালোলাগে না। সে চাইতো কোনো শাহাজাদা তার সামনে হাঁটু গেড়ে
বসবে। হাতে থাকবে গোলাপ ফুল। কিছুদিন আগে বনশ্রীতে এরকমই একটা সিনেমা পিঙ্কির সাথে
দেখে এসেছে। স্বামী, শত হলেও স্বামী। তাই কিছু বলা যাবে
না। মা বলে দিয়েছেন, মুক বুজি সব সজ্জ কোরবি কলাম। কারো কোনো
কতার উত্তুর দিবিনে! সেও মায়ের কথা মেনে চলে। তবু ভালোই ছিল।
স্বামীর উপেক্ষা আর অত্যাচারে। শাশুড়ি আর
ভাসুর ঝির ভালোবাসায়। এভাবে গোলেমালে কেটে যায় দিন। কাটে কি সত্যিই?
আবার ভূত! এবারও সে ধরতে পারল না। তাঁর মা বেঁচে নেই। থাকলে আজ
ঠিক ধরতে পারতো। সেবার যেমন হাতে নাতে ধরে ফেলেছিল! এ -বাড়িতে আলোর ব্যবস্তা আছে। আলো জ্বালল। দেখল পাশে দুজন ঘুমিয়ে
কাঁদা। পিঙ্কি ওপাশে ফিরে। আর শাশুড়ি
একটু ডানদিকে হেলে। গ্রীষ্মকাল। ব্লাউজহীন শরীরের আঁচলখানি ঈষৎ সরে এসেছে। আর সে
নারী হয়ে দেখছে নারীর বর্ণময় শোভা। শেষ বেলায় সূর্যমুখীর কিরণে ভরে উঠেছে বসন্ত-কানন। আস্তে আস্তে ছোঁয়। পাপড়ির ঈষৎ ছোঁয়াতেই শিহরণ জাগে । মনে হয়ে
ভালোলাগার নৌকোখানি ক্রমশ ডুবে যায়
স্বপ্নের সরোবরে। আলো নিভে
আসে।
শাশুড়ি
ভালোবাসলেও জা তাকে অত্যাচার করতো। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ। মারতও। অনুষঙ্গে
স্বামীর ইন্ধন। বাড়ির সব কাজ তাকে দাসীর মতোই করতে হত। পিঙ্কি পড়াশুনো করে। তাই সে
কোনো কাজ করতে পারবে না। করতে চাইলেও তার মা তাকে মারতে মারতে নিয়ে যাবে। এভাবে
চলে না। তবু চালাতে হয়। হাজার হাজার কোটি কোটি বাড়ি প্রতিদিন এভাবেই চলে। আর সীমা
ছাড়ালে কিছু একটা ঘটে যায়।
চরম কিছু না-ঘটালেও শাশুড়ির আচমকা মৃত্যুর পর চরম
সিদ্ধান্তটা নিতে আর ভুল করল না নুনি। একদিন বাড়ি
ছেড়ে চলেই গেল। অন্তঃসত্বা। দাদারা তাই
জায়গা দিল। সন্তান হল। ফুটফুটে একটা ছেলে। বিটু। কিন্তু একদিন তাকে সে-বাড়িও ছাড়তে হল। কারণ সে বাড়িতে নতুন নতুন শাসক এসেছে।
ক্ষমতা যে কীভাবে পাল্টে যায়! এক বছর এসেই 'এলাম দেখলাম জয় করলাম'। তাই নুনি বেড়িয়ে পড়ে কাজের খোঁজে । কাজও
মেলে। ঝিয়ের কাজ। ছেলেকে নিয়ে
বারান্দায় শুয়ে থাকে সেই বাড়ি। কোনও এক
রাতে তার দুধ উথলে পড়ে যায়। আর সাথে সাথেই তা ভূতে চেটেপুটে খেয়ে যায়! সজাগ হতেই উধাও!
ভূতের ভয়েই ছেড়ে দিল সে-বাড়ি। খোঁজ আর এক বাড়ির। সেখানেও মনে হল ভূত আছে। চিলেকোঠা
কিংবা আম গাছের মগডালে। চালতা তলায়। কলপাড়ে। ছেড়ে দিল নতুন
বাড়ি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথেই অদ্ভুতভাবে ভূত আর ভগবানদের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
ভগবান সব জায়গায়। গাছের নীচে।
বাথরুমের পাশে। পাঁচিলের গায়ে। ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে। শুধু মানুষের মন থেকে নেমে গেছে
ভগবান। বহুদূর।
পাঁচ
আবার কাজের খোঁজ। দেখা হল চন্দ্রার সাথে। তার
পরিচিত। এক সময় চন্দ্রার সাথে মিত্তিরদের বাড়ি কাজ করত।
এখন চন্দ্রা আর এসব তালে নেই।
-কাজ কোরবি? ভালো পয়সা
আছে।
--করব।
--কাল তালি আমার সাথে চল।
চন্দ্রার সাথে শুরু হল কাজ। বুঝিয়ে দিয়েছিল কাজের
ধরন, আয়পত্তর ইত্যাদি। সেই সাড়ে ছ-বছর বছর আগে। বিটু তখন সারাদিন ঘুমিয়েই কাটায়। আর মাঝে মাঝে
কাঁদে। নুনি পরম আদরে তাকে খাওয়ায়। যত্ন করে। যেন স্বয়ং ঈশ্বরের সেবা করছে সে।
.jpg)
.jpg)
ছয়
আজ সাত। ভাবে এভাবে আর কত দিন! একটা মিশনের সাথে
কথা চলছে। সেখানেই পাঠাতে হবে। পড়াশোনার
মাথাটা নেহাত খারাপ না। নীরদ মাস্টার বলে গেল, এ-মাসেই তাঁর রিটায়ারমেন্ট। উফ্, ছেলেটাকে এবারে কে দেখবে? উৎকণ্ঠায় দিন কাটে তার। এদিকে
চন্দ্রার মা মারা গেছে অনেক ভোগান্তির পর। কাল তার কিছু পরলৌকিক কাজকর্ম বাকি। তাই
চন্দ্রার হয়ে তাকেই প্রক্সি দিতে যেতে হবে।
সাত
-আজ তুমি?
-হুম্।
-এবার থেকে তুমিই থাকো।
--না। এটা অন্যের।
--হা হা হা! প্রফেশনাল এথিকস্।
কিয়া বাত কিয়া বাত! ওকে। দেন
স্টার্ট। টার্ন অফ্ দ্য লাইট।
-অ্যাঁ?
--টার্ন অফ্ দ্য লাইট। আরে আলোটা নেভাও।
--না। আলো
জ্বলবে!
মন্তব্যসমূহ