একটি ছোটগল্প কিংবা মুক্তগদ্য ।। পিন্টু রহমান ।।


                            রাতের অদ্ভুত একটি শিমুলগাছ
                                             পিন্টু রহমান

               মুখের প্রাস্তদেশে লেগে থাকা রক্ত যেন শুধু রক্ত নয়, পাতাহীন শিমুলকাণ্ডে ফুটে থাকা থোকা-থোকা শিমুলেরই প্রতিচ্ছবি মৃত্যু নয়, মায়ার কাজল পরে সোনাভানু যেন ঘুমপরীদের দেশে! দেখে মনে হয় মেয়েটি সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন কিংবা খানিকবাদেই হয়তো আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবে! ফোলা ফোলা চোখে প্রতিবেশীদের পানে তাকাবে কিন্তু বাস্তবে তা হয় না অসংখ্য চিৎকার চেঁচামেচি সত্ত্বেও সে আজ বোধহীন ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই খাঁচা শূন্য করে তার পরাণপাখি উড়াল দিয়েছে!

             রফি মুন্সি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না নান্দনিক কান্নার বিধি-বিধান ভুলে কেবলই কাঁদেন, ভেবড়িয়ে ছেবড়িয়ে কাঁদতে থাকেন বুক চাপড়ানো ওই কান্নার রেশ উপস্থিত জনতার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তথাপি কারো মুথে রা নেই মৃত্যুর বিষয়টি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল যেন-বা! মাঝে মাঝে মুন্সিরও তা মনে হয় মনে হয়, জমিতে লাঙল চালাবার পূর্বেই স্ত্রী সোনাভানু বোধহয় তার ভবিষ্য আঁচ করতে পেরেছিল জমি বিষয়ক কথা কানে আসতেই সে আপত্তি তুলেছে লাঙল জোয়লা থামিয়ে স্বামীকে অনুনয়-বিনয় করে বলেছে, ফুলির বাপ, আমার কথা একটু শোন দিনি ওই জমিত তুমি আবাদ কত্তি জায়ু না স্ত্রীর কথায় মুন্সির মন ভরেনি মনে হয়েছে, চাষীর ছেলে হয়ে চাষ না করলে কি চলে! নাকি, মানায়! আর কিছু না হোক সারাবছর ঘরের ধানের ভাত খাওয়ার মজাই যে আলাদা! হতাশার স্বরে বলেছে, চিন্তা করতি নিষেধ করলিও তো মন মানেনা আমার মনের মধ্যে কু-ডাক ডাকি যাচ্ছে মনে হচ্চে, কপালো কুনু গেরো আসতি পারে

                সোনাভানু একা না, চেনাজানা আরো অনেকেই গেরোর বিষয়ে অবহিত করেছে, ওয়াজ নছিহত করেছে কিন্তু ওই গেরোর কথা সে কিছুতেই মুখে আনতে চায় না তা ছাড়া কতিপয় বিশ্বাসে তার সীমাহীন দ্বীধা, কাকতালিয় মনে হয় স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলে, আজুড়ি কতায় কান দিয়ুনা তো, এসব সত্যি না আল্লার উপর ভরসা রাকো তার ইশারা ছাড়া দুনিয়ায় কোন কিচু হয়না, গাচের পাতাও নড়ে না  
কিন্তু সোনাভানুর মুখে অন্যকথা, তালি উরা সব মিত্যি কতা বলচে নাকি?
-ক্যান, কী বলচে উরা ?
-ওই জমিতে যে আবাদ করে তারই নাকি মরি যায়!

                  শুধু সোনাভানু কেন, গ্রামের আর সবার মধ্যেও এমন একটি বিশ্বাস শিকড় গেঁড়েছে মুন্সি যেন হঠাৎই গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয় বিষণ্ন মুখে গাল চুলকায় দীর্ঘশ্বাস ঝরায় আইজউদ্দি বিশ্বাসের ওই জমি নিয়ে অন্তহীন কল্পকাহিনী (কারো কারে মতে বাস্তব ঘটনা) এর স্বপক্ষে নজিরেরও অভাব নেই নিকট অতীতে জদালী মন্ডলের স্ত্রীকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে অবশ্য নবীন মাঝির ক্ষেত্রে বিপরীতমুখি ঘটনা বিনোদপুর মাঠের ওই জমি আবাদ করতে গিয়ে সে নিজেই লাশ হয়ে ফিরেছে ভাবনার প্রখরতায় বিষয়টি বিবেচনা করলে অবাক না হয়ে উপায় কি! প্রতিটি মৃত্যুই যে স্বাভাবিক ছিল না!

                শিমুলগাছ কেন্দ্রিক এক একটি মৃত্যু অসংখ্য কল্পকাহিনি জন্ম দিয়েছে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে  বহুমাত্রিক আতঙ্ক রাতের গভীরতায় শিমুল গাছে হঠাৎ হঠাৎ ঝড় ওঠে কেন, ঝড়ের তাপ-উত্তাপ পার্শ্ববর্তী গাছে পৌঁছায় না কেন, বৃদ্ধ বয়সে নবীন মাঝি কীভাবে শিমুল গাছে উঠল? কেমন করেই বা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে ফাঁস লাগাল? মুক্তিযোদ্ধা বিশারত আলী কেন লাশ হয়ে শিমুলের তলে পড়ে ছিল, মৃত্যুর পর জাহানারা বেগমের জিহ্বাটা কেন একহাত লম্বা হয়ে ঝুলে ছিল- এতসব প্রশ্নের কোনো আদি নে, কোনো অন্ত নেই মৃত্যুর আবহ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত গ্রামের পথ-ঘাট খাঁখাঁ করতো বাতাসের বুকে কান পাতলে শোনা যেন কানকথার ফিসফিসানি সাশ্রয়ী মানুষগুলো অশরীরী আত্মাদের ( জীন-পরি) প্রশ্রয় না দিয়ে অভাবের মধ্যেও সারারাত হ্যারিকেন ধরিয়ে রাখত যেসব গৃহস্থের কেরোসিন কেনার সক্ষমতা থাকতো না, তারা নাড়ার আগুনে সারারাত সাজাল ধরিয়ে রখতো সন্ধার আগেই যে যার মতো ঘরে ফিরতো বিশেষ কারণে পরিবারের কোনো সদস্য দেরি করে ঘরে ফিরলে ঘুটোর আগুনে শরীর ছ্যাঁকতে হতো মানুষের ধারণা জিন-পরিদের আঁচড় থাকলে আগুনের তাপে তারা পালিয়ে যায় -দৃশ্য শুধু বিনোদপুর গ্রামের না, চিরায়িত বাংলার প্রতিচ্ছবি এভাবেই যাপিত হয়েছে আমাদের জীবনাচার বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে আমাদের বৃদ্ধ স্বজনগুলোও আজ উপায়হীন অবহেলা-অনাদরে তিল তিল করে ক্ষয়ে যাচ্ছে কারো কারো ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম অথচ কিছুকাল আগেও প্রতিটি যৌথ পরিবারের বৈঠকখানায় একজন করে মুরুব্বির স্বরব উপস্থিতি ছিল ওই মানুষগুলো ছিল আমাদের কাছে বটবৃক্ষের ছায়া, ভরসার সারাৎসার পরিবারের আর সবার ভয় তাড়াতে ইচ্ছে করে তারা তাদের কাঁশি থামাতো না নিয়মিত বিরতিতে আকাশের পানে মুখ তুলে খক-খক আওয়াজ করতো হুকার আগুনে তামাক দিয়ে গড়গড় শব্দ তুলতো কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলে গলা চড়িয়ে হাক ছাড়তো- কিডা, কিডা ওকেনে? আন্দারের মদ্দি কিডা হাঁটি যাচ্চু গো?

                    আইজদ্দি বিশ্বাস ছিল মেজাজি মানুষ ভূত-প্রেতে তার সীমাহীন অবিশ্বাস তথাপি এক একটি মৃত্যু দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে গাছটিকে নিয়ে ভেবে ভেবে কোনো কূল-কিনারা পে না চোখের সামনেই গাছটি একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে, শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে অথচ তখনও জানতো না একদিন গাছটিই তার জীবনের কাল হবে জানতো না শিকড় কাটা বৃক্ষের পাতার মতো তার সংসারটি নেতিয়ে পড়বে মমিনের প্রাণপাখি খাঁচা শূন্য করে উড়াল দেবে ধরণীর জনারণ্যে শিহাব হারিয়ে যাবে কিংবা নয়নের চোখের আলোয় অন্য কেউ ভাগ বসাবে আইজদ্দি বিশ্বাসের চোখের আলোও ঝাপসাপ্রায়, চলাচলের ক্ষমতা লুপ্তপ্রায় মুত্যুর জন্য অপেক্ষা করায় যেন তার নিয়তি!



                                                                      দুই
                 পৈত্রিক পেশা ফেলে গণি মাঝি কবে, কখন, কেমন করে গুনি হল এই নিয়ে অন্তহীন সমালোচনা আর আমার মধ্যে কৌতূহলের পারদ সারাক্ষণ বুদবুদ করে দিনান্তের কর্মযজ্ঞ শেষ হলে, কাজের ফাঁকে একচিলতি অবসর মিললে, রাতের প্রথম প্রহরে যখন গণি কবিরাজের আস্তানায় হাজির হই লোকটি তখন মাথা দুলিয়ে, মুখ টিপে হাসে আর বলে, কবি ভাই আপনি যে একুন আসপেন আমি আগেই তা বুজতি পাচ্চালাম রাস্তার মদি দুজন লোকউ পাটাচালাম আপনি কি টের পাচিলেন?
আমি কিছু বলার পূর্বেই উপস্থিত স্যাগরেদগণ কৌতূহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে, বলেন কী উস্তাদ! ক্যারাম করি বুজলেন?

               এত ঠুনকো বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে না ধূপগন্ধের ঘ্রাণ নিতে নিতে বরং তন্ত্র সাধণ লক্ষ্য করি জট-পাকানো চুলের পানে তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকি এই চুল নিয়েও নানাজনের নানা প্রসঙ্গের অবতারণা ছেলে-ছোকরারা আড়ালে আবডালে আপত্তিকর প্রশ্ন তোলে কবিরাজি পেশা চুকিয়ে বাপ-দাদার পেশায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে অন্যের কথা আমি গায়ে মাখি না, বাহুল্য বলে মনে হয় আর যাই হোক লোকটি কারো বাড়াভাতে ছাঁই কিংবা কারো মাথায় লাঠি তো মারতে যাচ্ছে না! মাথার উপরে টাঙানো লাল ঝালরের পানে তাকিয়ে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি- প্রথমদিনও উঠেছিলাম কবিবন্ধু আসিফ জাহানের সাথে প্রথম যেদিন কবিরাজের আস্তানায় হাজির হয়েছিলাম সেদিন যুগপৎ ভয়, কৌতূহল, আবেগ এবং সংশয় আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল আচ্ছা, একটা মানুষ আর একটা মানুষের মনের কতা হুবুহু বলতে পারে, আর পারেই বা কীভাবে!

              আসিফ জাহানকে উদ্দেশ্য করে কবিরাজ তার নিজের বুকে থাপ্প মেরে উচ্চারণ করেছিল, পপিছার (প্রফেসর-এর আঞ্চলিক উচ্চারণ) সায়েব আর এক পা আগাবেন না, ওকেনেই দাড়ান!
যেন দরাজ গলায় গায়েবি কন্ঠস্বর!
আমার মতো আসিফ জাহানও সেদিন মনে মনে হোঁচট খেয়েছিল রাগে, ক্ষোভে আমি উত্তেজিত হতে পারি এই আশঙ্কায় নিচু গলায় কবিরাজকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন ভাই সাহেব, আমাদের কারণে আপনার কোন ক্ষতি হল নাকি ?

             কবিরাজের কন্ঠস্বরে একটুও হেরফের ছিল না- ওই কার ক্ষতি কিডা করে, যার ক্ষতি সে করে আমি গণি কার কিডা, মরার আগে মরি গিচি বাঁচি থাকি লাব কি!

              কবিরাজের এমন উদ্ভট কথায় আমি বিরক্ত হই, তির তির করে মেজাজটা গরম হতে শুরু করে ফিরে আসার জন্য উদ্যত হতেই আসিফ জাহান খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে জোরে জোরে বার কয়েক শ্বাস টেনে কবিরাজ পুনরায় হাঁক ছাড়ে, হক মওলা পপিছার সায়েব, আপনির সাতের ছেলিড়ার জব্বর বুকির পাটা! তবে যে আশা নি সে একেনে আয়িছে তা পুরন হতি সুমায় লাগবে কি যা তা কাজ, মদুর চাঁকে ঢেল মারা যে!
আমার দিধান্বিত মানষিকতা মুহূর্তের মধ্যে কবিরাজের অভিমুখে হেলে পড়ে বিরক্তির পরিবর্তে অন্তরে ভক্তির ভাব উদয় হয় মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সত্য বাসনা যাচায় করে নিতে চাই খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলি, কী আশা ভাইজান?

              কবিরাজ আমার পানে চোক মেলে তাকায় অস্তগামি সূর্যের মতো লাল টুকটুকে দুটি চোখ দেখে মনে হয় ওই চোখেই যেন রাজ্যের বিষ্ময়! পুনরায় বলি, কী হল ভাইজান, ওভাবে কী দেখছেন ?
দৃষ্টির গভিরতায় মানুষটা আমাকে নিরিক্ষণ করে আমার ভিতর-বাইরে মুখস্ত করে চোখের সামনে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না কবিরাজ নয়, মনে হয় সম্মুখে অন্য কোনো মানুষ বসা- যে মানুষ আধিভৗতিক ক্ষমতার অধিকারী হাতের ইশারায় কবিরা আমাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আমার মুকিই তালি শনবেন
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়

                    কয়েকমুহূর্ত চিন্তা করে আমার পানে ঝুঁকে এসে কবিরাজ ধীরলয়ে বলে, পাকড়াগাছের
(শিমুলগাছের স্থানীয় নাম) সাতে আপনির কিসির সম্পক্ক? ওকেনে আর যায়েন না, গেলি খুব ক্ষতি হবে
ক্ষতির কথা জিজ্ঞেস করতেই কবিরাজ খানিকটা ক্ষুব্ধ হয় তাচ্ছিল্লের স্বরে বলে, এত খবর জানি আপনির  কী দরকার? যা বুল্লাম তাই করেন তাছাড়া আজুড়ি কারুক নাড়তি নি
বস্তুত দিনের পর থেকে গাছটির প্রতি আমার কৌতূহলের মাত্রা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কবিরাজের আস্তানায় যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল দিনের আলো রাতের শরীরে হারাতে না-হারাতে এরশাদপুর চাতাল মোড়ে পৌঁছে যেতাম আশরাফুলের দোকানের চা-পর্ব শেষে শুরু হতো রাতের জলসা জীন-রি বিষয়ক গল্পে-গল্পে অনেকটা পথ পাড়ি জমাতাম শনি মঙ্গলবারের রাতগুলো ছিল অন্যরকম রাতের অস্তিত্ব মগ্নতার গভীরে পৌঁছালে জীন-রিরা কবিরাজের শরীরে ভর হয়ে কথা বলতো! সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! শরীরের লোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠতো নিজেই নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখতাম, ঠিক আছি কিনা! আমি জানি আমার পাঠকেরা ভাবতে পারেন, আমি বোধহয় কল্পকাহিনি লিখছি! না, আমার জীবনের -এক চরম সত্য অনেকদিন অনেক রকমভাবে নিরীক্ষণ করে দেখেছি, কবিরাজের শরীরে তারা ভর হলে তার কণ্ঠস্বর বদলে যেত এমনকি শরীরে ভর হওয়ার খানিক আগেই বুঝতে পারতাম-কেউ একজন আসবে কবিরাজের মুখে তখন কথা সরতো না চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপতো শরীরটা দুলে উঠতো আর ভর হওয়ামাত্র অজ্ঞান হয়ে বিছানার ওপর পড়ে যেত প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম মনে হতো, এই বুঝি লোকটি মারা গেল! অথচ কিছুক্ষণ পর আড়মোড়া ছেড়ে বিছানার উপর উঠে বসতো মার্জিত ভাষায় সালাম বিনিময় করতো কুশল জিজ্ঞেস করতো উপস্থিত জীনটি যদি হিন্দু ধর্মের অনুসারী হতো তবে কপাল বরাবর দু-হাত তুলে নমষ্কার জানাতো বলতে দ্বিধা নেই, এভাবেই এক জীনকন্যার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল খুব বেশি কথা বলেছি তার সাথে রি-মেয়েটির মুখে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনাসমূহ শুনে বিচলিত না হয়ে পারিনি! তাকে দিয়ে ছোটোখাটো কিছু কাজও করিয়েছি

            ফেসবুকের মাধ্যমে রুপকথা নামে এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম, একসাথে পথচলার স্বপ্ন দেখেছিলাম মাঝে মাঝেই আমরা চ্যাটিং করতাম কিন্তু মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলতো না সারাক্ষণ কৌতূহলের মধ্যে রাখতো শেষ পর্যন্ত ওই জীনকন্যার মাধ্যমেই রূপকথার জীবনের খুব গোপন তথ্যগুলো আমি জানতে পেরেছিলাম

                জীনদের মুখে যা শুনেছি- তাতে ওদের মধ্যে নানাবিধ গোত্র বিভাজন সাপা নামে একটি গোত্র আছে- যারা সাপের বেশ ধরে থাকতে পছন্দ করে জগতে দৃশ্যমান সকল সাপই যে সাপ না, তা ওদের মাধ্যমেই প্রথম বুঝেছি বড় বড় নদী সাগরে অবস্থান করে খাজিরিয়া ঘোড়ার বেশে চলে উল্কা জীনদের মধ্যে জটাধারীরা খুবই সম্মানীয় কালীদেবীর অনুসারীরা শাক্ত নামে  পরিচিত একদিন শৈলেন কালীর মুখে জেনেছি কোনো এক শাক্তের কারণেই নাকি রফি মুন্সির স্ত্রী সোনাভানু মারা গিয়েছিল সোনাভানু যেদিন মারা যায় তার পরের রাত্রে শিমুল গাছের মাথায় আগুন জ্বলেছিল যেনতেন আগুন নয়, সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখা! বিনোদপুর গ্রামের অনেক মানুষ আগুনের সাক্ষী চেনাজানা কয়েকজনের কাছে আগুনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি এমন আগুন তারা বেশ কদিন দেখেছে তাদের বর্ণনায় আমার চোখেও যেন আগুন দৃশ্যমান হয়ে ঠে- সে-এক বিরাট আগুনরে ভাই, গড়ের মতো জ্বলতি লাগলু মনে হলু দুনিয়া বোদহয় পুড়ি ছারখার হয়ি যাবেনে!

                বহুদিন পূর্বে জ্বলা আগুনের সূত্র ধরে আমি নিজেও একদিন আগুন দেখতে গিয়েছিলাম ভয়ার্ত মুখে কৃষ্ণপক্ষের রাতে বিনোদপুর মাঠের মধ্যে ঠাঁই বসেছিলাম সে এক দুর্যোগের রাত! শীতের মধ্যেও শরীরে ঘামের স্রোত বইছিল হৃদপিন্ডের ডিব-ডিব শব্দ স্পষ্টই কানে আসছিল হাত-পা সব অব হয়ে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল, কোনো দৈত্য যদি ঘাড় মটকিয়ে দেয়!
গুপ্তধনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে সাঁওতাল বিশালাকায় দৈত্য আমারা যারা কবিরাজের আস্তানায় যাতায়াত করতাম তাদের মধ্যে সোহেলের ছিল গুপ্তধনের প্রতি সীমাহীন আকর্ষণ ব্যবসার কল্যাণে লোকটির সম্পদের অভাব না-থাকলেও গুপ্তধনের প্রত্যাশায় হন্যে হয়ে ছুটেছে এক রাতে আমি নিজেও তার সঙ্গী হয়েছিলাম কুমার নদের পাড় ঘেসে যে সাতকপাট ব্রীজ আছে, সেখানে হাজির হয়েছিলাম আর কপাট সংলগ্ন রাতের শশ্মান ছিল নির্জনতায় ভরা চারদিকে সুনসান নীরবতা লোকচক্ষু আড়াল করতে কালীমন্দিরের সম্মুখের জ্বলন্ত প্রদীপটি নিভিয়ে দিয়েছিলাম অন্য সবার কথা জানি না, অজানা আশংকায় আমার বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল আর সোহেল বাবুর চোখে আলোর ঝলকানি কিন্তু মাটিতে কোদাল চালাতেই ওই আগুন নিভে গিয়েছিল ভয়ার্ত গর্জনে, ছোবল হানতে বিশালাকায় একটা সাপ ণা পেতে দাড়িয়েছিল!


                                                                          তিন
                  মরা মানুষের হাড় চালানোর দক্ষতা দেখে কবিরাজ মশাই খুবই উৎফুল্ল হয় পিঠ চাপড়ে আমাকে বাহবা দেয় বহুমুখী সম্ভাবনার কথা শোনায় চেষ্টা করলে আমিও নাকি লাইনে ভালো করতে পারি ভালোমন্দ বুঝিনা, হাড়ের টুকরো হাতে থাকলে ভয়-ডর সব তুচ্ছ মনে হয় জীনদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে পারি- এমনকি ঝগড়াও! তন্ত্রমন্ত্রও কিছু শিখেছি বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে ঘুমাতে পারি না কবিরাজের পিছন পিছন দৌড়ঝাঁপ করি শিমুল গাছের পাশে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি
আমার এই পরিবর্তন নিয়ে বাতাসে কানকথা ওড়ে কেউ সহজভাবে নিতে পারে না কবিরাজের সাথে না-চলার পরামর্শ দেয় তাদের ধারণা শিমুলগাছ নিয়ে আমি যা করছি তা বাড়াবাড়ি এর খেসারত আমাকেই দিতে হবে আইজদ্দি বিশ্বাসের মতো আমার জীবনেও নাকি গাছটি কাল হবে

                    মৃত্যুভয় আমাকে আর বিচলিত করে না এতসব ভেবে কি হবে- শেষ পর্যন্ত তো মরতেই হবে! আইজদ্দি বিশ্বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আর সবার মতো আমিও অবাক হই বয়সের ভারে  নুয়েপড়া মানুষটাকে দেখে বুকের মধ্যে সাহস জন্মায় মনে হয়, ঠিক একদিন গাছটি কেটে ফেলব অভিশপ্ত গাছটি পুড়িয়ে ছারখার করে দেব কিন্তু জীন-পরিদের কথা মনে পড়তেই ইচ্ছেটা উবে যায়, সাহসে কুলায় না গাছটির শাখা-প্রশাখায় যে উনাদের অবাধ বিচরণ! তাছাড়া গাছ কাটলে তাদেরই বা কী দশা হবে! বসতভিটা হারিয়ে কোথায় আশ্রয় নেবে! গাছটিকে কেন্দ্র করে ঘটনাও তো কম ঘটেনি! বাদেমাজু, বকশিপুর, ডাউকী, বেলগাছিসহ এই দিগরে সবাই জানে, গাছের ডাল কেটে ইট পোড়ানোর অপরাধে আইজদ্দি বিশ্বাসের সোনার সংসার ভেঙে তছনছ হয়েছে  আঘাতের পর আঘাত এসে তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে ডাল কাটার ঠিক তেরো দিনের মাথায় বড় ছেলে মোমিন বিষ খেয়েছিল এতদিন পেরিয়ে গেলেও তার বিষপানের রহস্য আজ অজ্ঞাত  ঠুনকো অভিমানে মেজোছেলে শিহাব সেই যে বাড়ি ছেড়েছে তারপর আর ফিরে আসেনি ছোটো ছেলে নয়ন ছিল তার নয়নের মনি বড় সখ করে নামটি রেখেছিল ভেবেছিল ছেলের চোখের আলোয় বাবা পথ চলবে অথচ বাস্তবে তা হয়নি ডাকাতের ছোঁড়া গুলিতে নয়নের চোখ আজ অন্ধ

              আইজদ্দি বিশ্বাসের সব ক্ষোভ গাছটির প্রতি গাছটি কাটতে না পারার জন্য মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে, আহা! সুমুন্দির গাচটা যেদি গুড়া পাড়ি ঠাপাতি পাত্তাম, দেলডা তালি টালা হোতু, গোরে যায়িউ শান্তি পাতাম  
  
                 এক-একদিন আমার দু-হাত জড়িয়ে অনুনয়-বিনয় করে, বাপরে, বাপ, তুই আমার ধম্মের বাপ তোর পা দুকুনি পড়চি, সগলে মিলি ন্যাটা ছাপ করি ফেল দিনি!
কথার মাঝে কিছুক্ষণ দম নিয়ে পুনরায় বলে, তোগের নাকাল দুদির ছেলি যুজ্জু করি দ্যাশটা স্বাদিন করি ফেল্লু, আর এট্টা গাছের ফল্লা কাটতি পাচ্চিনি!
আচ্ছা, গাছের সাথে যুদ্ধের কী সম্পর্ক! কিংবা যুদ্ধের সময় গাছটির ভুমিকাই বা কী ছিল! না, ঠিকঠাক বুঝি না! দিনের আলোয় শিমুল গাছের পানে তাকালে চোখ ফেরানো দায়! সবুজ গালিচার উপর গাছটি যেন সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি! থোকাথোকা ফুলগুলো যেন চাপচাপ রক্ত! মনে পড়ে-৭১ কথা লাল-সবুজের পতাকার কথা একসাগর রক্তের কথা ৩০ লক্ষ শহীদের কথা। রাজাকারের দৌরাত্মের কথা অথচ রাতের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ডালে-ডালে সংঘর্ষে যেন আগুন জ্বলে! বাতাসের ডানায় ডানায় করুণ হাহাকার, নারীকণ্ঠের বিলাপধ্বনি ভরা পূর্ণিমায় শাদা শাড়ি পরে অপশরীদের নৃত্যকলায় মেতে ওঠে কবিরাজের মতে এমন রাতে জীন-রিদের বিয়ে হয়! বিয়ে দেখার লোভে রাতের পর রাত আমি নিজেও শিমুল তলায় ছুটে গেছি ভোর রাত অবধি হাঁটাহাঁটি করেছি শিমুলের পাতা ছুঁয়ে টুপটাপ শিশিরের পদধ্বনি শুনেছি কিন্তু কখনো বিয়ের গীত কিংবা অপশরীদের নৃত্যকলা চোখে পড়েনি -বিষয়ে কবিরাজ নিজেও খুব হতাশ আশাহতের মতো আমাকে বার বার শুনিয়েছে, কবি, আপনির বদনছীব তা না হলি তো এরাম হওয়ার কতা না!

        আমার নিজেরও তাই মনে হয় সবই কপাল! কপালের উপর দায় চাপিয়ে মিথ্যে শান্তনা খুঁজে বেড়াই তবে জীন-রিদের স্বচক্ষে দেখতে না-পাওয়াটা আমর জন্য ছিল চরম হতাশার


                                                                           চার

সময়ের চাকা অহর্ণিশ বয়ে চলে
নদীর জলে ভাটীর টান
কতিপয় বিশ্বাসে অবিশ্বাস
তন্ত্র সাধনায় অমনোযোগ
পূর্ণিমা শেষে কৃষ্ণপক্ষের রাত
ঠিক এমন এক রাতে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটে আজন্মের সাধ পূরণ হয়, অপশরীদের দেখা পাই না, আমি তাকে ছুঁয়ে দেখিনি কপালের লাল টিপ দেখে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম মাত্র অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলাম জীনকন্যার বুকেও যেন-বা বিরহ- ব্যঞ্জনা! মায়ার কাজল পরে উদাস নয়নে আমায় বলেছিল, একটা কথা বলব, শুনবে তো!
অবোধ শিশুর মতো আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম মেয়েটি খুশি হয়েছিল জানালার ওপারে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে জানিয়েছিল, আজকের পর থেকে গাছের কাছে আর যেও না; কোনোদিন না

শুধু শিমুলগাছ না, কবিরাজের সংস্পর্ষও আমাকে ত্যাগ করতে বলেছিল
আমি কথা রেখেছি অনেকের অনেক কথা রাখতে না পারলেও মেয়েটির কথাগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি শিমুলগাছ বিষয়ক কৌতূহলও কেটে গেছে এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি ফিরে যাওয়ার কালে মেয়েটি আমায় বলে গেছে, যদি সম্ভব হয় মৃত্যুর পরে...

মেয়েটির বলে যাওয়া শেষ কথাটি এখনো আমার হৃদয়ের অন্তপুরে প্রতিধ্বনিত হয়-
গাছের নীচে আইজদ্দি বিশ্বাসের কবর দিও
গাছের নীচে আইজদ্দি বিশ্বাসের কবর দিও... কবর দিও ...


মন্তব্যসমূহ