গল্প:১ ।। বজলুল পাই যে সন্ধ্যায় খুন হলেন ।। আইরিন সুলতানা ।।

               বজলুল পাই যে সন্ধ্যায় খুন হলেন
                               আইরিন সুলতানা
          বজলুল সাহেবের সর্বভূক ক্ষুধা পেয়েছে। যেন তিনি ইতিপূর্বে কোনোদিন আহার করেননি। গত দুদশক ধরে  কী দিন কী রাত সর্বগ্রাসি ক্ষুধা পায় তার। রাতদুপুরের খিদেয় নিজের লেখা উপন্যাস বইয়ের গোটা সাতেক পাতাও খেয়েছেন। খিদে পেলে তার হ্যালুসিনেশন হয়। সেই ঘোরগ্রস্ততায় তিনি দেখেন রবীন্দ্রনাথ তার সামনে কাঁসার থালায় গীতাঞ্জলি সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি গীতাঞ্জলি হাতে নেন।  তারপর গপগপ করে গীতাঞ্জলি খেয়ে ফেলেন।      
          পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক বজলুল সাহেব লেখক পরিচয়ে গত দুদশকে নিজেকে পোক্ত করেছেন।  পোক্ত কথাটা বজলুল সাহেবের বেলায় বহুমাত্রিক। তিনি গোড়াতেই বিতর্কিত হয়ে গেলেন। তাতে আবার জনপ্রিয়তা পেলেন। তারপর অলিখিত অর্ধ নিষিদ্ধতা জারি হল। আবার সেই অলিখিত সমন তাকে অধিক বিতর্কিত করল ও ততোধিক জনপ্রিয় করল।  তাকে ঘিরে ঘন হওয়া আলাপসালাপ ফুঁড়ে তিনি অবশেষে দার্শনিক রূপে আসন গাড়লেন। কেরিয়ারের এই অধ্যায়গুলোতে তাকে নিয়ে যার যার ভাবনাগুলো ভেঙ্গেগড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে পোক্ত হয়েছে। বজলুল সাহেবের বেলায় অবশ্য পোক্ত হয়েছে তার ক্ষুধাবৃত্তি।

          বজলুল সাহেব একটা গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির আসনে বসে আছেন। অতিথিরা মঞ্চের আসনে আসীন। সামনে লম্বা টেবিল। টেবিল সম্মুখ হরেক রকম বিদেশি ফুলে সজ্জিত। এইসব ফুল দেশেও চাষ হতে পারে। হয়তো এই ফুলগুলোকে লালনপালন করেছে মোইস্তাপাড়ার কোন এক চাষী। মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগে তার। ফুলগুলো চিবিয়ে খেতে নিশ্চয়ই সুস্বাদু হবে! বজলুল সাহেব পানির বোতলটা কাছে টানেন। ছিপি খুলে ঢক ঢক করে কিছুটা পানি খান। টেবিলে পানির বোতলটা রাখার সময় খেয়াল করলেন বোতলের ভেতরে ঢেউ উছলে উঠছে। পাঁচশ এমএল পানির বোতলের আধা বোতল পান করেছেন। বোতলের বাকি আড়াইশ এমএল পানির ঢেউ গভীর চোখে তাকিয়ে দেখেন তিনি।  তার মনে হল এই ঢেউ তিনি কিছুদিন আগেও দেখেছেন। এই ঢেউ তো লিবিয়ান সাগর তীরের ঢেউ! বোতলের বর্ণহীন পানি রঙ পালটে লাল হয়ে উঠল। এমন লালই তো হয়েছিল লিবিয়ান সাগর! টিভিতে দেখাচ্ছিল। ওই সময় তিনি হাপুশহুপুশ করে ভাত খাচ্ছিলেন। লিবিয়ান সাগর আর ডালের বাটির মধ্যে কোন দৈবযোগাযোগ নেই। তবুও খবরে ঢেউ দেখে তার ডালের বাটির কথা মনে হল। তিনি দেখলেন সোনালি রঙের ঘন ডাল থকথকে লাল হয়ে উঠল। তিনি ভাতের মাঝে ডাল ঢেলে চটকে চটকে  মাখলেন। ভাত আর হাত লালে লালে রঞ্জিত হল। বজলুল সাহেব হড়হড় করে বমি করলেন। লিবিয়ান সাগরের লাল স্রোত তার মুখ নিঃসৃত হয়ে ঘর ভাসিয়ে দিল।

       হাততালির শব্দে মঞ্চে ফিরে এলেন বজলুল সাহেব। মানে তিনি শারীরিক ভাবে মঞ্চেই ছিলেন। এখন হারানো মনোজগতও মঞ্চে ফিরে এল। বজলুল সাহেব একে মাইন্ড ট্রাভেলিং বলেন। টাইম মেশিন কেবল সিনেমায় বাস্তব। কিন্তু বাস্তবের সিনেমা হল মাইন্ড মেশিন। মানে মগজ। মাইন্ড ট্রাভেলার আলোকের গতির  চাইতেও দ্রুততর। আসলে গতি মাপাও দুরূহ হত। কী হত যদি আলোকের গতির বদলে মনের গতিকে আইনস্টাইন তার ই ইক্যুয়ালস টু এমসি স্কয়ারইক্যুয়েশনে  বসাতেন? প্রশ্নটা আইনস্টাইনকেই করেছিলেন বজলুল। আইনস্টাইন জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে ছিল।  বজলুল সাহের তখন থিওরি অব রিলেটিভিটি খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে হাত বাড়িয়েছেন ই ইক্যুয়ালস টু এমসি স্কয়ার’-টা খাওয়ার জন্য।  

         বজলুল পাই। উপস্থাপনায় জনপ্রিয় একজন আবৃত্তিকারের কণ্ঠে নিনাদের মতো উচ্চারিত হল বজলুল সাহেবের নাম। বজলুল যাদের নাম, তাদের নামের দ্বিতীয় ভাগে হায়দার নয়তো শিকদার জুড়ে দেয়া হয়। বজলুল সাহেবের নাম হল বজলুল পাই। পদার্থ বিজ্ঞান সহপাঠি থেকে সহকর্মী সকলেই ভেবে বসত বুঝি পাই দিবসে বজলুল সাহেবের জন্ম। তিনি তখন মিটিমিটি হেসে বলেন,  জন্ম বাইশে জুলাই। জুলাই পঞ্জিকার সপ্তম মাস

           তড়িৎ বুদ্ধির কেউ কেউ ওমনি বলে ওঠেন, ‘কিন্তু বাইশ বাই সাত তো পাইয়ের সঠিক মান নয়। বরং পাইয়ের চেয়ে বড়

         বজলুল সাহেব এবার সূত্রটা মিলিয়ে দেন চওড়া হাসি দিয়ে, ‘ওটাই তো!  বাবা বলতেন তুমি পাইয়ের চেয়ে বড় হও

           উপস্থাপক বজলুল পাইয়ের অবদানের তালিকা বলে চলেছেন। গবেষণা, প্রবন্ধ, নিবন্ধে বজলুল সাহেব কালোত্তীর্ন। আমরা যেখানে বিদেশি ভাষার গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করার পরিশ্রম করি, সেখানে তার বেশ কটি বাংলা গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। বজলুল পাই খেয়াল করলেন, উপস্থাপক তার সব কটি গ্রন্থের নাম পাঠ করলেও একটি গ্রন্থ অনুচ্চারিত রইল মঞ্চে। তার দর্শনই ধর্ম গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিল কারা যেন। গ্রন্থের উৎসর্গ পাতায় ছিল দুটো লাইন, ‘অনুশাসন নয়,  মানব মুক্তি ঘটাবে দর্শন বইটা অচ্ছুত হয়ে গেল সাহিত্য পর্ষদ থেকে। অনেক প্রাজ্ঞ  ব্যক্তি যারা শুরুতে তাকে জানিয়েছিল বইটি সংগ্রহ করেছেন, তারা আবার পত্রিকায় বললেন, বইটি তারা এখনো পড়েননি, শুধু শুনেছেন যে বইটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ককে প্রজ্ঞাহীনেরা ভয় করে কেবল। বজলুল পাই এমনটাই ভাবেন। যে কারণে তার গ্রন্থটি প্রকাশকের গোডাউনে ছাড়পোকার খাদ্য হল, সে কারণকে বহুজনে অনুভূতি নাম দিলেও বজলুল পাই বুঝে নিলেন সমাজে অনেকের খোসপাচড়া রোগ রয়েছে।

         বজলুল পাইকে মঞ্চে আজকে সম্মাননা দেয়া হচ্ছে, যেখানে দর্শনই ধর্ম গ্রন্থটিকে সম্মানের বাইরে গণ্য করা হয়েছে।  সম্মাননায় প্রাপ্তি হল একটা উত্তরীয়। আরো মিলল একটা সম্মানজনক চেক।  এই সম্মাননা দিয়ে বজলুল পাই কী করবেন? তার মনে পড়ল, যখনই খিদে পাবে, সম্মাননা চেটে চেটে খেয়ে নেবেন। বজলুল সাহেব হাসেন। মনের হাসি মুখেও ছড়িয়েছে। মঞ্চের সবাই তার স্মিত হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছে। দর্শকরা বারবার তালি তো দিচ্ছিলই, সাথে দাঁড়িয়েও গেল। তিনি একবার প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন দর্শকদের, দর্শনই ধর্ম  তারা পড়েছে কিনা। তিনি সে প্রশ্ন আর করেন না। তালি দেখতে থাকেন। তালি শুনতে থাকেন। বিষয়টা প্রার্থনার মতো মনে হল তার। তালিরও একটা ধর্ম আছে। চারদিকে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া শব্দ তরঙ্গকে এক সময় নিশ্চয়ই ছেঁকে নেয়া যাবে। তখন কি বজলুল সাহেবের জন্য গুঞ্জরিত আজকের তালিগুলোকে আলাদা করা যাবে?

        প্রায় ঘণ্টা খানেক পর। গলায় উত্তরীয় জড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন বজলুল পাই। তারপর দাঁড়ালেন।  চা খাবেন নাকি রিকশা নেবেন তা মনস্থির করতে থাকেন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। এ-জায়গাটার চমৎকারিত্ব হল এটা একই সাথে ব্যস্ত আর নির্জন। ব্যস্ত মানে টং দোকান। মানুষের ভিড়। প্রত্যেক মানুষের আবার কয়েকটা করে ছায়া। প্রায় ফুটপাথে উঠে আসা রিকশার সারি। এর ফাঁকে ফাঁকে আইসক্রিম ভ্যান। একটু উলটো পাশে পুলিশ। আর নির্জন মানে অন্ধকার। একটা অশরীরী অন্ধকার। কেমন অস্বস্তিকর। বজলুল সাহেবের মনে হল খাবলা মেরে অন্ধকারটাকেও খেলে ফেলেন। সবার ছায়াগুলো খেয়ে ফেলেন।

         ছায়ার কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ছায়া খুঁজলেন তিনি। তারও অনেকগুলো ছায়া। তবু ওগুলো যেন তার নয়। বজলুল পাই ভাল করে দেখেন। ছায়াগুলো ক্রমশ তার পাশ ঘেঁষে আসছে। ছায়াগুলো এত মিশমিশে অন্ধকার কেন?  যদিও তিনি নড়ছেন না একদম। ঠায় দাঁড়িয়ে। ছায়াগুলো নড়ছে। কুচকুচে কালো ছায়ারা ঘিরে ধরল তাকে। বজলুল পাই আচমকা বুঝতে পারলেন, এগুলো তার ছায়া নয়। তিনি সামনে তাকালেন। দেখলেন কতগুলো ছায়া শরীর। কারো মুখ স্পষ্ট নয়। নাকি ওদের নাক চোখ মুখ কান নেই! বজলুল পাই তিনশ ষাট ডিগ্রীতে ঘুরলেন একবার। তার মনে হল একটা অশুভ চক্রব্যুহের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে তিনি। বেরুনোর পথ নেই। চক্রটা ভাঙার জন্য এক পা এগুতেই টলে উঠলেন তিনি। কেমন সাদা হয়ে গেল চারপাশের অন্ধকার। তিনি নিজেকে স্থির করতে চাইলেন। কিন্তু দাঁড়াতে পারলেন না। কুঁজো হয়ে বসে গেলেন। তিনি চোখ পিট পিট করছেন। চোখ কেমন ভেজা ভেজা। আঠালো। নাকে আঁশটে গন্ধ আর মুখে নোনা স্বাদ ঠেকল তার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বজলুল পাইয়ের শরীর!

           অন্ধকার বলে রক্তস্রোত কালো কালো ঠেকছে। কিন্তু গলগল করে মাথাঘাঢ় গড়িয়ে নামা রক্তে বজলুল পাই রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছেন। আরেকবার সাদা হয়ে গেলে তার চারপাশ। এবার তিনি ধপ করে শুয়ে পড়লেন। বজলুল সাহেব তবুও কী যেন দেখতে চাইছেন। শরীরী আর অশরীরী অবয়ব । অশরীরীরা তাকে আঘাত করেছে। শরীরীরা তার থেকে দূরে দূরে। অথচ ওই শরীরীরাই না তখন তালি দিল! তখন শরীরীরা বাতাসে যে তরঙ্গ ছড়িয়ে ছিল, এখন তাদের শরীর থেকে কোনো তরঙ্গ ছড়াচ্ছে না বাতাসে।

             বজলুল পাই আর ভাবতে পারছেন না। কেবল চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করলেন। জমাট অন্ধকারে সাদা সাদা আলো দেখা দিচ্ছে কি? তিনি সত্যি সত্যি দেখতে পেলেন ছায়াশরীরগুলোর ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে এগোচ্ছে কিছু আলোক শরীর। আইনস্টাইন! নজরুল! লালন! রবীন্দ্রনাথ! ওঁরা একেকজন একেক দিক থেকে ভেসে আসছে বজলুল পাইয়ের দিকে। তাদের শরীর আলোর তৈরি। কেবল বজলুল পাই দেখছেন সে আলোক দেহধারীদের।

           নজরুল ভেসে এসে বলে উঠলেন, ‘বজলুল পাই! ওই যে তোর কাটা আঙুলটা পড়ে আছে, ওটা পৃথিবীতে অগ্নিবীনা  বাজাবে এখন। আইনস্টাইন বজলুল পাইকে ঘিরে বৃত্ত রচনা করতে করতে বললেন, ‘বজলুল, ওই যে! তোমার মগজটা ছিটকে আছে পথে! এখন তোমার সেই মস্তিষ্ক বাতাসের মধ্য দিয়ে মাইন্ড ট্রাভেলিং করবে। এর গতি আলোকের গতির চাইতে অনেক বড়। আর তুমি বজলুল পাই অবিস্মরণীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সকলের ভেতরে। বজলুল পাই কুঁজো হয়ে থাকা লালনকে দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেন রবীন্দ্রনাথকে। লালন পথের উপর তার লাঠি ঠুকে ঠুকে বললেন, ‘আলেকবাজি! আলেকবাজি’! রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির পৃষ্ঠাগুলো একটা একটা করে উড়িয়ে দিলেন।  গীতাঞ্জলির পৃষ্ঠাগুলো আলোককণা হয়ে বাতাসে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বজলুল পাইয়ের খিদে পেল। আলোকভূক খিদে!  এত আলো! এত আলো! ওই আলোয়  ফুটপাথের অশুভ অন্ধকারকে আর দেখা যাচ্ছে না। বজলুল পাই আবেশিত চোখে দেখছেন, আলোককণাগুলো পথের ভিড়ে থাকা একেকজন মানুষের শরীরে তীব্র গতিতে ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে। তারপর মানুষগুলোর মাঝে কী যেন ঘটে গেল। এতক্ষণ কেবল বজলুল পাই দেখছিলেন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন, আইনস্টাইন মিলে বৃত্ত গড়ে ঘুরছেন, এখন মানুষগুলোও দেখতে পেল। মানুষগুলো দেখল, বজলুলের দেহটা পড়ে আছে ফুটপাথে। তারা দেখল, কতগুলো মিশমিশে কালো শরীর আরো কালোয় গা-ঢাকা দিতে দিতে পালাচ্ছে।  মানুষগুলো এখন আর ভয় পেল না। আলোক শরীরের মানুষগুলো আলোর গতিতে ধেয়ে আসতে থাকল।


---------------------------------------------------------------------------------------


 না। পড়ে চলে যাবেন না। মতামত রেখে যান। এখানে পোস্ট করার সময় আপনার ই-মেল পাসওয়ার্ড চাইতে পারে। দিন। ওটা আপনি গুগলকে দিচ্ছেন। একবারই দিতে হবে। আর যদি প্রযুক্তিগত কারণে বার বার মতামত পোস্ট করা সত্বেও মতামত যদি পোস্ট না হয় তাহলে সম্পাদকের ফেসবুকের ইনবক্সে পোস্ট করুন। পরে এখানে পোস্ট করে দেওয়া হবে। নাহলে achenayatri@gmail.com-এ মেল করুন। অনেক আন্তরিকতার সাথে আমরা এই কাজটা করি। তাই এই লোভটা সামলাতে পারি না। সমালোচনা করেই লিখুন। কিন্তু লিখুন। আশায় আছি। ধন্যবাদ।


মন্তব্যসমূহ