ভোট মানেই যেন রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান।
গল্পটা মোটেও তেমন নয়। সাধারণ
মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে। ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে। এসেছে
মানুষের কাছাকাছি। আজকের গল্পটা সেই কাছাকাছি আসার গল্প। প্রেমের। আর সেই প্রেমের
অনুষঙ্গে এসেছে ভোট। ব্যাস। গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে
ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র কাল্পনিক, ঘটনাও,
স্থান-কাল-পাত্রের কাকতলীয় মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাতড়াতে বসবেন না। আপনার
মনে পড়ে গেলে, সে আপনার স্মৃতির দোষ...
পরিচ্ছদঃ ৭
এবার মাঠে নেমে দেখা গেল,
স্কুলটা আসলে কেমন। এই জীর্ণ, ভাঙা চোরা রাস্তার পাশে, এই ধূধূ বালিয়াড়ির মাঝে
হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা চর, দু-একটা খেজুর গাছের সারি, দু-একটা পুকুর-দুয়ারি উঠোনের
দেশে এই দোতলা স্কুল বেশ বেমানান। তাও আবার প্রাইমারি স্কুল। স্বপনবাবু তো বলেই
ফেলেছিলেন, “দেখবেন মশায়, মাটির ঘর, সাপে না কাম্ড়ে দেয়... কারেন্ট তো
থাকবেইনা। মহাআআ ঝামেলা হবে এই বলেদেলাম্মোশায়...”
কারেন্ট সত্যিই ছিল না।
রাস্তার পাশে স্কুল, রাস্তার ইলেক্ট্রিকের পোস্ট থেকে সেক্টরের বলা ছিল, ওয়াটার
ক্যারিয়ার তার জুড়ে একটা আলোর ব্যবস্থা করে দিল। দোতলায় তেমন গরম নেই। চার দিকের
এত ফাঁকা মাঠের হাওয়ায় তো গত রাতে ঠাণ্ডাই লাগছিল।
তো সেই মাঠে এখন একটা ছায়ার
পাশাপাশি সম্বর্ত্তক। ছায়া এগিয়ে চলে, আর ও ছুঁতে চাইছে সেই ছায়ার অবসর। উচু-নিচু
ঢাল পেরিয়ে, মাঠের পর মাঠ, আলপথের নানা রহস্যের কাছাকাছি ওরা হেঁটেই চলেছে। যেন
হাঁটু পর্যন্ত বালিয়াড়ি পেরিয়ে যেতে যেতে, পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বেয়ে, সমূদ্রের
মতো, ছবির মতো এই হেঁটে চলার দেশে ওদের কোত্থাও কোনও ক্লান্তি নেই। শ্রামের অবসর
নেই...
দূর থেকে মনে হবে যেন কিসের
ঢেউ... শুখা মাঠ পেরিয়ে, ফাটল পেরিয়ে, উঁচু আলপথের আড়াল পেরিয়ে, জেলেপাড়া,
তাঁতিপাড়া, শীটপাড়া, খেজুরের সারি পেরিয়ে, মরাগাছের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা কত মৃত
পশুদের ছাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঢালু জমিতে নেমে গেল সেই ঢেউ... সম্বর শহুরে চোখে নতুন দেশ
দেখার সম্মোহন। ওর কেবল অনুসরন করা... যেন অনুসরনের কোনও শরীর নেই...
সেনেটি মাঠের আল থেকে নেমে
ঢালু জমিতে। খেজুরছায়ায় বসলে দেখা যায় দুটো ছায়া কেমন পাশাপাশি নিচু হল। হাত ধরে
টেনে নিল একে অন্যকে। সেনেটির বুকের কাছে সম্ব।
এত কাছাকাছি এলে এক অদ্ভুত
গন্ধে ঘোর লাগে। ভাবে, যদি কিছু হয়ে যায়... ভাবে, আর ঘোর লাগে। ঘোর থেকে জেগে উঠছে
একটা ছায়া। জেগে ওঠে, না ঘোরের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে, সে নিজেও জানে না। দেখে,
সেনেটির ঘন চুল ঢেকে দিচ্ছে মুখ। অন্ধকারে ও হাতরায়।
আনাড়ি সাঁতারুর মতো
খড়কুটো... শ্বাস নিতে নিতে আবার কেন ডুব দিতে চাইল ও। মনে হল, অসাড় একটা শরীর
এতদিন টেনে চলেছিল। মনে হল, ওর সমস্ত অস্তিত্ত্বে কে যেন জীয়নকাঠি বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হল, ওর ভেসে ভেসে যাওয়া শরীরের কাছে
জলদেবীর মতো এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। ওকে বুকে তুলে নিয়ে এতদিনের অসাড় অস্তিত্ত্বের ওপর
থেকে সরিয়ে দিচ্ছে কোন এক ছায়া। মুক্ত করে তুলেছে ওকে।
আর সম্বর্ত্তকের ঘোর লাগছে।
এ কেমন ঘোর, এ কেমন মুক্তি! সম্ব তলিয়ে যাচ্ছে। আবার ভেসে উঠছে। ও যত দুহাতে কিছু
একটা আঁকড়ে ধরতে চায়, মুঠোভরা শূন্যতা ততই সমস্ত বাঁধন খসিয়ে দিচ্ছে। তলিয়ে যেতে
যেতেও যে এভাবে ভেসে থাকা যায়, তা আগে বোঝেনি। তলিয়ে যেতে যেতে দুটো ছায়া ভেসে
ওঠে। দরদরিয়ে ঘেমে, ধুলোয়, কাদায়, জলে, রোদ্দুরে মিশে, ডুবে, ভেসে, তলিয়ে, সাঁতরে
উঠে ওর ঘোর লাগে। আর চোখ খুলতেই সেই ছায়া-ছায়া অন্ধকার...
সেনেটি পায়ের কাছে অগোছাল
কামিজ সাজায়। লুটিয়ে পড়া কালো শরীর ওর। ধুলোর রাজত্বে এতসব দাপাদাপির দাগ... অচেনা
মানুষের ছায়া মুছে রাখে শহরের দামি বুকে। বুক মানিয়ে গেছে ওর... এখন, এই অগছাল
শরীরে... ব্রা আধখোলা। বাবু জানে কীভাবে খুলতে হয়, কীভাবে বাঁধ ভেঙে দিলে
কালোমাটির দেশ জুড়ে বন্য বইবে। আর সে বন্যায় ভেসে উড়ে যাওয়া ভুল-চুক মুছে রাখবে
দূর গাঁয়ের এক মেয়ে। পায়ের কাছে গোটানো প্যান্টি ততক্ষণে মুছে রেখেছে কিছু তৃপ্তি,
কিছু আদিমতা, কিছু চোখ বুজে আয়েসের পরিসর।
সম্ব তাকাতে পারছে না। এত
ছায়া, তবু... চোখ ধাঁধিঁয়ে আসছে, লজ্জায়, অপরাধবোধে... ভাবছে, কী করে কথা বলে...
ভাবছে ওর আজীবনের কুণ্ঠা সাজিয়ে এই অচেনা গ্রামের অচেনা মেয়ের কাছে ধরা পড়ে
গিয়ে...
আর সেনেটি ঘরামি চোখ নামিয়ে
লজ্জায় বলে ওঠে, “আমাকে ভুল বুঝবেন না, বলুন?”
ঠিক-ভুলের হিসেব করার সময়
কখন পেরিয়ে এলাম, সেনেটি, আমিই জানি না... কথাটা কেমন ছ্যাঁত করে লেগে গেল। ও
ছায়ার কাছাকাছি আসতে চাইলে, ছায়া সরে যাচ্ছে... মন বলছে কিছু একটা ভুলতো হয়েইছে।
তো, সেনেটি... সম্ব বলছে
ওকে, “বল, ভুল বুঝব কেন?”
“গ্রামের মানুষ আর আগের মতো
নেই... সবাই তো সরল হয় না, আপনারা শহরে থেকে জানেন না, গ্রাম্যতা কেমন বিষাক্ত...
এ বিষ আমাদের আজীবন বয়ে যেতে হবে...”
সম্ব থমকে গেল। বলে, “কী যেন
বলছিলে...” আর ছায়ার দিকে তাকায়। কালো মেয়ের ছায়া। সেনেটির।
তো, সেনেটি আরও সরে যেতে
যেতে যা শোনাচ্ছে, তা ঠিক সত্যি, না রূপকথা... ভোটবাবুর হাতটা বুকের নরমে রেখেছে
ও। বলছে, “দেখুন, আমার বুক বলবে, আমি মিথ্যে বলছি না।”
সে তুমি যাই বল, আমি বিশ্বাস
করব। ভাবছে সম্ব, বলছে, “তুমি বল। আমি বিশ্বাস করব।”
“আপনার খুব বিপদ।”
“সে তো আমি কালই বুঝে গেছি।
তোমরা তো আছ। চিন্তা কীসের?”
“আপনি বুঝছেন না। ওরা আপনাকে
এখান থেকে সরিয়ে ফেলবে।”
“সরিয়ে ফেলবে? তা কখনও হয়?
ওদের কথা ইলেকশান কমিশন মানবে কেন?”
“ওরা বলবে... বলছে...”
সেনেটি অসহিষ্ণু... কিছু একটা গোপন করে গেছে যেন..., সেনেটি, বল, বল, সম্ব মনে মনে
কথা বলে ওঠে এবার... কী সেই গোপন...
“ওরা বলবে, ভোট নিতে এসে
আপনি আমাদের মেয়েদের সাথে সহবাস করেছেন... নাকি, ধর্ষণ?” মনে মনে বলতে বলতে কখন
স্বর পেয়ে যায় ওর ভাবনা... সেনেটি চমকে ওঠে... কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে একটা ছায়া
অন্য একটা ছায়াকে জড়িয়ে ধরে... দুটি ছায়া ফুলে ফুলে ওঠে কেমন... দুটি বিপন্ন ছায়া...
আর সেই বিপন্নতার উথাল-পাথাল থেকে সেনেটি বলে যাচ্ছে এই মরা গাছেদের দেশের নানা
ইতিহাস, নানা ভূগোল, নানা রাজনীতি... নানা শব্দে, নানা দৃশ্যে...
“তুমি চাইলে আমি চলে যাব,
সেনেটি। কিন্তু ভেবে দেখ, তোমাদের সেই শান্তির গ্রাম... এই একটা মাত্র সুখ নিয়ে
তোমরা বেঁচে ছিলে, যে আমাদের গ্রামে রাজনীতির বিষ আজও ঢোকেনি... ভাবো, সেই সুখের
কী হবে... ভাবো, সেই স্বপ্নের কথা... ছোটদের জন্য তোমরা কী রেখে যাবে...”
“আমি এসব চাইনি, বিশ্বাস
করুন, বাবু... আমি এসব চাইনি...”
সম্ব তাকাল। কালো পুকুরের
জলে একটাও খড়কুটো নেই। ওর ভয় হল... তাহলে শেষমেশ সম্বর্ত্তক গঙ্গোপাধ্যায় ভোট নিয়ে
এসে ধর্ষণের দায়ে জেলে যাচ্ছে... মরে গিয়েও শান্তি পাবে ও?
তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্ব
দেখছে একফোঁটা জল কেমন পুকুরের পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়ছে। আর শান্ত জলে হঠাৎ কীসের ঢেউ
উঠে অস্থির করে দিয়েছে ছায়ায় বসে থাকা এই দুপুরের অবসর।
সম্ব কিছু বলে না। মাথায়
কিচ্ছু আসছে না ওর। আপোষের স্বভাব না থাকা মানুষের মাঝে মাঝে যেমন হতাশ লাগে...
আপোষ করতে না জানার জন্য এতবড় মাশুল দিতে হচ্ছে হয়ত। পেঁচাপার্টির কথা মেনে
নিলে...
“আপনি যাবেন না, বাবু...”
সেনেটির নরম কণ্ঠের ঢেউ ভেসে এল। “আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে...
দেখবেন...”
“কী আর ঠিক হবে, সেনেটি? যা
একবার ভেঙে গেল... যে বিশ্বাস? তার কী হবে?”
“আমাদের একটা সুখ ছিল, বাবু।
এই গ্রামে কোনোদিন ভোটের কারণে গোলমাল হয়নি। এই সুখ আমরা সহজে ছাড়তে পারি? তাহলে
আমাদের পরে যারা আসবে, তাদের আমরা কী গল্প শোনাব, বাবু?”
সম্ব তাকায়। টলটলে জলে একটা
একটা করে তরঙ্গ উঠছে কেমন...
“আপনি তো কালই চলে যাবেন...
কিন্তু আমাদের তো এ গ্রামেই থেকে যেতে হবে, এই বিষ বয়ে যেতে হবে আজীবন... আমি পারব
না, বাবু... নিজের কাছে হেরে গিয়ে কী করে বেঁচে থাকব?”
তুমি সত্যিই জলদেবী, সেনেটি।
আমাকে একবার ডুবিয়েও ভাসিয়ে রেখেছ কেমন... সেনেটি ওর পাশে দাঁড়াল তখন। রোদ্দুর তখন
মুখ লুকিয়েছে খেজুর গাছের সারি সারি কাঁটার আড়ালে...
চলে যেতে যেতে সম্বর হাতে
হাত রেখে সেনেটি শুধু বলে গেছে, “আমি মনে রাখব, বাবু... আপনার কথা...”
পরিচ্ছদঃ ৮
এভাবে যেন হয় না। এভাবে,
মানে কী ভাবে, কেউ জানে? নদী-জল-বাতাসের কাছে এই যত কথা আছে, আজ সারাদুপুর ধরে বলে
যাচ্ছে সম্ব। একা। যেমন বলে বারবার। আর সবাই দূর থেকে ভাবে, স্বপ্নবিলাস। একটু
আগে, সেনেটি আবার এল। দুপুরের খাওয়ার পর।
বৌদি খাবার বেড়ে দিল,
হাতেহাতে ননদ। পুলিশকাকু মাথা নেড়ে নেড়ে বলে গেছেন সারাক্ষণ, শহরে লেখা পড়া করল,
শহরের বুলি বললেও, দেখ, মেয়ে সেই ঘরের মেয়েই আছে। আর বৌদি সায় দিল।
সম্ব খেয়েছে চুপচাপ। যেমন
খায়। আজ আবার ছোবল সামলে দাঁড়াতে হল, নিজের মুখোমুখি। আবার অজানা এক আক্রমণের জন্য
তৈরী করল নিজেকে।
“তুমি এত দুঃখী দুঃখী মুখ
করে থাকেন কেন, গাঙ্গুলি ? কীসের দুঃখ তোমার?”
দুঃখ বলছেন কেন,
দিব্যেন্দুদা, ব্যাথা বল, আমার কীসের ব্যাথা? যদি জানতেম... সব ব্যাথার কারণ কি
জানা যায়? না বোঝানো যায়?
অনেকেই বলে, সম্বর বন্ধুরা,
তোমার তো চিন্তার কারণ নেই, চাকরি পেয়েছ, নিশ্চিন্ত জীবন... তবু জীবনের বাঁকে বাঁকে কে যে বারবার
অদৃশ্য অস্ত্র হাতে অপেক্ষা করে, কে কবে ছোবল মারে... দুখের কারণ কী, সম্ব জানে
না। নিজেকে দায়ী করে চলে অবিরাম, ভাবে আমার ভুল, আমার, আর মনখারাপ গ্রাস করে।
ওর বন্ধুরা বলে, মাঝে মাঝে
খিস্তি কর। রাগ হলে। অন্য কেউ মেজাজ দেখালে তুই তার দ্বিগুন মেজাজ দেখাবি। ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে খিল্লি কর
সারারাত। ভাবে, হয় না। সব হিসেব তো আর মেলে না।
সেনেটি পাশে দাঁড়িয়েছে। হাত
রেখেছে পিঠে। আর হু হু মনখারাপ... গ্রীলের খোলা দিগন্তের পাশ কাটিয়ে আবার সটান
সম্বর মাথার ভেতর...
“এখনও রেগে আছেন?”
“রাগ? কার উপর করব? কী বা
অধিকার আছে রাগ করার? এইতো একদিনের পরিচয়...”
“তবু এতদূর এসে পড়লাম...”
“কী এক গভীর খাদের সামনে এনে
ফেলে দিলে আমাকে... এখন পিছনে ফিরলে লোকে হাসবে, আর এগোলেই...”
“আপনার এত অভিমান!”
ফিসফিসিয়ে বলেছে সেনেটি... যে কথাটা কেউ কখনও বলেনি ওর কানে কানে... আর শুনে ফিরে
তাকায় ভোটবাবু। তাকায় এক ছায়া ছায়া অন্ধকারের দিকে, আলোর দিকে, এক ইতিহাস অন্য আর
এক ইতিহাসের চোখে চোখ রাখে...
মন্তব্যসমূহ