মেঘবৃষ্টির শামিয়ানা ।। অখিলরঞ্জন বিশ্বাস ।।


একজন অচেনা যাত্রীর ধারাবাহিক আত্মজীবনী- 

               মেঘবৃষ্টির শামিয়ানা
                       অখিলরঞ্জন বিশ্বাস




                                   ১
                      ‘নয় এ মধুর খেলা...’ 

                গত ১৯ মার্চ ধর্মসংকটে পড়লাম। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের মুখোমুখি ভারত। আমার কাকে সমর্থন করা উচিত? উত্তরটা আমার সাড়ে পাঁচ বছরের নাতিও অতি সহজে দিয়ে দেবে। কিন্তু আমি কি খুঁজে পাব এই উত্তর? রাজনৈতিক কারণে ভারত ও বাংলাদেশ নাম দুটো ভিন্ন ভিন্ন হলেও আমার কাছে তাদের অর্থ অন্যরকম। আমার অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে নাম দুটো। শেষমেশ ঠিক করলাম, আমি ক্রিকেটকেই সমর্থন করব। খেলায় বাংলাদেশ পরাজিত হল। কয়েকটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি, না-হলে একটা লড়াই হতে পারত। এই দিনের সব থেকে মধুরতম মুহূর্ত হল রবি ঠাকুরের দুটো গান দু-দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেজে ওঠা। সে-সময় আমার রোম খাড়া হয়ে আসছিল। রবীন্দ্রনাথ। নামটাই গোটা বাঙালিকে রোমাঞ্চিত  করতে যথেষ্ট। যে-বর্ষায় তিনি চলে গেলেন, সেই বর্ষায় আমি এলাম, মেঘ আর বৃষ্টি মেখে। আমার বাবা নিত্যানন্দ বিশ্বাস, মা মনোরমা বিশ্বাস। দাদা নিখিলরঞ্জন বিশ্বাস। দাদার থেকে আমি প্রায় দশ বছরের ছোট। আমাদের আট-নয়টি ভাইবোন জন্মের পরপরই মারা যায়। ফলে হারাধনের দুটি ছেলে পড়ে রইল। আজ একটি। দাদা পনেরো বছর আগে ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন।  আমিও যে কোনো সময় চলে যাব। মাস দুয়েক আগে আমার একটা লাইট সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেছে। চিকিৎসকদের মতে  মস্তিষ্কের একটি অঞ্চলের কোষেদের মৃত্যু ঘটেছে। হয়তো এরকম কয়েকটি অ্যাটাকের সুযোগ পেতে পারি, আর তারপর আমিও হারাধনের কোল শূন্য করে চলে যাব বহুদূর, যেখানে আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা অকালমৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে আমার দাদার সাথে আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আর বাবা বলছেন, ‘কীরে, আমার হাতটা ধর’! আর আমি হাত ধরার জন্যই ছুটে যাব অনন্ত কাল!  
                 সকালের রোমাঞ্চ সন্ধ্যায় উবে গেল অদ্ভুত ভাবে। টিভিতে খবর বাংলাদেশ ক্ষিপ্ত। পরদিন খবরের কাগজেও পড়লাম এপার-ওপার থেকে বিদ্বেষ মূলক কথাবার্তা। এ-খেলায় কে জিতল জানি না, কিন্তু মনে হল গোটা ক্রিকেটটাই একেবারে গো-হারা হেরে গেল!

                                         ২
              ‘আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডোবাইলি রে...’

          বাবার জন্ম কত সালে জানা নেই। বাবা মারা গেছেন ১৯৭৩ সালে। বোধহয় বাবার জন্ম ১৯০০-এর আগে কিংবা পরে। তিলকচন্দ্র বিশ্বাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহিমাচরণ বিশ্বাসের মধ্যম পুত্র ছিলেন আমার বাবা। ওড়াকান্দির মিশনারিতে তিনি শিক্ষালাভ করেছেন, সেখান থেকে আই এ পাশ করেন তিনি।  সেখানে তিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল খুবই সুন্দর। গায়ের রং উজ্জ্বল বাদামি। টিকালো নাক। উচ্চতা প্রায় ছ-ফুটের কাছে। আমি পাঁচ ফুট ছ-ইঞ্চি। তাঁর সাথে হেঁটে কোথাও গেলে হাঁপিয়ে উঠতাম। সারাজীবন তিনি সোজা হয়ে চলেছেন।
             বাবা ব্যবসা করতেন, যদিও জাতিতে আমরা ব্যবসায়ী ছিলাম না। আমরা জাতিতে নমশূদ্র। শূদ্র সম্প্রদায়ের একটি বিভাগ এটি। বৈদিক যুগে সৃষ্ট ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য – এই  তিন সম্প্রদায়কে সেবা করার জন্য সে শূদ্র সম্প্রদায়ের উপর দায়িত্বভার এসে পড়েছিল, সেই সম্প্রদায়ের লোক ছিলাম আমরা। তবে শূদ্র সম্প্রদায়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কম ছিল বলা চলে। হতে পারে অন্য সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের রক্ত এই বংশে আছে, বিশুদ্ধ রক্ত বলে তো কিছু হয় না, সময়ের দীর্ঘ সারণীতে অনেক কিছু মিলে মিশে এক হয়ে যায়। এসব বলছি, কারণ আমাদের দৈহিক গড়ন আর মেজাজ। আমরা জমিদার ছিলাম না, কিন্তু চলনে-বলনে একটা জমিদারি ভাব ছিল। আমার দাদা ও-দেশে থাকাকালীন ঘোড়ার পিঠে চড়েই প্রাতঃক্রিয়া সারতে যেতেন। এটা তার অভ্যাস। টুকটুকে ফর্সা দাদা ছিল আমাদের রাজকুমার। বাবার দোকান ছিল। হাটে হাটে তাঁর দোকান। দোকান ঘর। চালার দোকান। চার-পাঁচটা হাটে। তখন ফারাক্কা ব্যারেজ হয়নি। শ্রাবণ থেকে আশ্বিন এমনকি কার্তিক পর্যন্ত হাট-মাঠ-রাস্তা-ঘাট  জলে ডুবে থাকত। আর তখন নৌকাই ছিল আমাদের সব কিছু। নৌকায় হাট বসত। শ’য়ে শ’য়ে নৌকা। লোকে নৌকা চড়ে হাট  করতে আসত। প্রতি বছর জল হত এমন নয়। হয়তো প্রকৃতি দেবতার আশীর্বাদে এক-দু’বছর জল থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। বাবা খান্দারপাড়ার হাট, ট্যাংরার হাট , জল্লিরপাড়ার হাট, পুঁইসুরের হাট ইত্যাদি নামকরা হাটে নিয়মিত কাপড় নিয়ে বসতেন।  আমাদের ছিল চারটি ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে করে কাপড় নিয়ে আসা হত হাটে। আমাদের স্থায়ী পাঁচ জন চাকরদের মধ্যে তিন জন ছিল ব্যবসার কাজে নিযুক্ত। তিনজনের মাথায় থাকত কাপড়ের গাঁট। ব্যবসা ছাড়া বাবার প্রায় দুশো বিঘে জমি ছিল। দুজন স্থায়ী চাকরদের দ্বারা অস্থায়ী চাকরদের সাহায্যে ওই জমি চাষাবাদ করানো হত। নিজেরা লাঙল দিতাম না। তার প্রয়োজন ছিল না কখনও। সখ করে লাঙল দিলেও চাকরবাকর কিংবা বাড়ির বড়দের বকা শুনে ফিরে এসেছি আর কী!  
               একটা কথা এই ফাঁকে মনে পড়ল, হাটের কথা আলোচনা হচ্ছিল তাই। পুঁইসুরের হাটের নাম সারা বাংলা তথা সারা ভারত জেনে গেল, কারণ একটা প্লেন খারাপ হয়ে যাবার পর এই ট্যাঁকে এসে অবতরণ করে। ফলে অনেক লোক মারা যায়। প্রচুর  লোক দেখতে গিয়েছিল। আমি নেহাত ছোট বলে কেউ নিয়ে যাইনি। ঘটনাটা স্বাধীনতার কিছু আগে বোধহয়।
               দেশভাগের পর আমাদের পরিনতি এমন হয় যে আমার বাবা এদেশে এসে কেবল টিউশানি করে কোনও মতে সংসার চালিয়েছেন, আর আমাকে রেখে দিয়েছেন পরের বাড়ি, আমি তাদের ফরমাইশ খাটি, বিনিময়ে থাকার জায়গা পাই, দুটো খেতে পাই, পেট ভরে না, তবু আর দুটো ভাত চেয়ে খেতে মুখ ফোটে না। আর আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন হল যে, আমি যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে  যৎসামান্য মাইনের চাকরি করি ( আমার প্রথম মাইনে ছিল ৫০ টাকা ৫০ পয়সা, ১৯৬৫ সালে) তখন খবর আসে আমার মা মারা গেছেন, তাঁকে দাহ করাও হয়ে গেছে, আমার মায়ের মুখখানি দেখার সুযোগ আর রইল না। পরে বাড়ি এসে যা শুনেছি তাতে কষ্ট ক্রমশ বেড়েছে। মা মারা যান বনগাঁ মহাকুমা হাসপাতালে। সালটা ১৯৬৭। মাকে দাহ করার পয়সা বাবার কাছে ছিল না। বাবা মাকে দাহ করার জন্য ডোমেদের হাতে লিখে দিলেন। মা তখন ঠাণ্ডা ঘরে, আর আমি দূর দেশে দেশ রক্ষার কাজ করছি। এই খবর যখন গ্রামবাসীরা জানতে পারল, তারা রীতিমতো নিজেরা এগিয়ে এসে মাকে দাহ করার কাজ সম্পন্ন করলেন। এই ছিল আমাদের গ্রাম। হয়তো গ্রাম এমনই। কিংবা তখন গ্রাম এমনই ছিল। এক সাথে। এক জোটে।   
          আমার মা, যাঁর গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁকে রূপ দিয়েছেন, যে মা দেশে রাজরানীর মতো জীবন কাটিয়েছেন, সেই মা...
         কথায় বলে ,’ মানুষের দশ দশা, কখনও হাতি কখনও মশা’। আজ এসব ভাবলে চোখে জল আসে। চোখে বৃষ্টি নামে। বর্ষায় জন্মেছিলাম তো!

                                                      
                               ‘এডা মোগো দ্যাশ...তুমাগো না!’  

             ১৯৪৭। ১৫ আগস্ট। ভারত স্বাধীন হল। আমরা হলাম একদিন আগে। ১৪ আগস্ট। এই স্বাধীনতার জন্য না কি আমাদের বিপ্লবীরা লড়াই চালিয়ে আসছিল সুদীর্ঘকাল। হাজার হাজার প্রাণ দিয়েছে। হাজার বন্দি। শেষমেশ স্বাধীন হলাম। কিন্তু এ কোন স্বাধীনতা, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়? যে দেশে কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বসবাস করে আসছেন, সেই দেশ আমার না? আমরা এতটা আঁচ পাইনি। বড়রা বোধহয় পেয়েছিলেন। তাই তারা দেখলাম কেমন গুমরে  রইলেন। আমাদের কী? আমরা তো ছোট, আমরা শৈশবের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম বাংলার মাঠে ঘাটে, খালে বিলে। আমরা যারা সবে হাঁটতে শিখেছি সবাই তখন প্রায় সারাদিন পুকুরে সাঁতার শিখছি, সাঁতার কাটছি, সারাদিন কতবার যে স্নান করেছি তার কোনো হিসাব নেই! টের পেয়েছি আমাদের এই হিন্দুপ্রধান গ্রাম থেকে উচ্চবর্ণের লোকেরা ধীরে ধীরে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওঁরা বেশিরভাগই শিক্ষিত মানুষ।  তাদের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষা যেমন ছিল, পারিবারিক শিক্ষাও ছিল তেমনই। তাঁরা হয়তো টের পেয়েছিলেন, এখানে কী হতে চলেছে! তাঁরা মেধার কাজ করতেন। জমিজমা যা ছিল রাতারাতি বিক্রিবাটা করে চলে গেলেন। সেই সব জমি কিনেন নিল আমার জ্যাঠামশাই রজনীকান্ত বিশ্বাস। কিনে নিজের লোকেদের বসাতে লাগলেন। তিনি হয়তো বুঝেছিলেন এক সাথে থাকাটা বড় বেশি দরকার। থাকলেনও। কিন্তু মনে সেই খটকা রয়েই গেল। আমরা এখন এমন একটা দেশে বাস করি যে দেশটা আমাদের না, আমাদের জন্য না! কে এমন সিদ্ধান্ত নেয়? তারা কি আমাদের কথা ভেবেছিল? আমাদের মতো হাজার হাজার মানুষদের কথা? এরকম না হলে কি আর কখনও স্বাধীনতা আসতো না?  গান্ধী, জিন্না, নেহেরু... কে দায়ি? না ব্রিটিশ? এক  সিদ্ধান্তে আমরা দেশ হারাতে বসেছি। চারিদিক থেকে দাঙ্গার খবর আসছে। বড়রা আরো শুকিয়ে যাচ্ছেন। উচ্চবর্ণের লোকেরা টের পেয়েছিলেন, এ-দেশ আমাদের না, চলে গিয়েছিল, সব ছেড়ে, সব মায়া ছেড়ে। কিন্তু আমরা কী করে যাবো? আমাদের তো দুশো বিঘে জমি। আমাদের জ্যাঠা-কাকাদেরও প্রত্যেকেরই সেই রকম বা তার বেশি। ওদিকে আমাদের ব্যবসা। ব্যাবসা ছেড়ে যাওয়া যাবে। ওই দেশে গিয়ে আবার না হয় ব্যবসা করা যাবে। কিন্তু জমি! জমি যার নেই তাকে জমির টান কখনও বোঝানো যাবে না। এ-দেশে আসার পর এই টানেই কিছু জমি কিনেছিলেম। আজ যার মাত্র দেড় বিঘে পড়ে আছে। চাষাবাদ হয়। তবে অন্য লোকে করে। ছেলেরা অন্য জমিগুলোর মতো সেটাকেও বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত। জমির ঝঞ্ঝাট ঝামেলা নিতে চায় না তাঁরা। আসলে জমির টান ওদের নেই। জমি এমন এক জিনিস, প্রাণ যাবে তবু জমির অধিকার সে কাউকে দেবে না। এ-জমি আমার মা। এই মাকে ছেড়ে যাবো কী করে? আমাদের যুগটা ছিল সেন্টিমেন্টের যুগ। এই জমি সেন্টিমেন্টই আমাদের পায়ে শেকল পরিয়ে দিল। আমরা থেকে গেলাম।
               আমরা চার-পাঁচ মাইল দূরে ধারেন্দা প্রাইমারি ইস্কুলে পড়তাম। যেতাম হেঁটে। জলের সময় অবশ্যই নৌকো করে। আমাদের পরিবারের সাত আটজন থাকত সেই নৌকায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। আমরাই নৌকা চালাতাম। ডুবে যাওয়া রাস্তার উপর দিয়ে, ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতাম। আহা, সে এক সময় ছিল!
             এমনই একদিন ইস্কুল থেকে ফিরছি, তখন আমরা ধানখেতে, ডুব জল, আশেপাশে কয়েকটি নৌকা নিয়ে লোকজন ধান কাটছে। হিন্দু, মুসলমান- সবাই আছে সেখানে। আসলে এই হিন্দু-মুসলমান ব্যাপারটা আমাদের মাথায় এতদিন ছিল না। আমরা ছিলাম এক সাথে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত রেখে খেলতাম, মাছ ধরতাম, তাল কুড়োতে যেতাম; কিন্তু ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ তারিখটা আমাদের জীবনের সবকিছু পালটে দিল। দূর থেকে দেখছিলাম আর একটি নৌকো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।  আমরা ভাইবোনেরা তখন মনের আনন্দে নৌকো করে ফিরছি। দূরের নৌকোটা ইতিমধ্যে আমাদের কাছে চলে এসেছে। নৌকোয় তিন-চারজন বসে। একজন তার মধ্যে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন বাড়ির?’ আমি বললাম, ‘চিতলকোনা বড়ো বাড়ির’। ব্যাস। আমার আর কিছু বলা লাগেনি। আমাদের নৌকায় সেই প্রশ্নকর্তা লাফিয়ে এসে উঠলেন আর  এক-একজনকে ধরে জলে ছুড়ে মারলেন। আশেপাশে থেকে অন্য মাঝিরা, চাষিরা চিৎকার করতে লাগলেন, ‘ওই ওই মিয়াঁ, কী করোস?’ প্রশ্নকর্তা তাদের দিকে  রক্তচক্ষু করে বললেন, ‘চোপ! এইডা এহন মোগো দ্যাশ!’
            আমাদের জলে ফেলে লোকগুলো নৌকাটাও নিয়ে চলে গেল। সবাই সাঁতার জানতাম। জানলে কি হবে, আশেপাশে তো কোনো ট্যাঁক নেই। কতসময় ওই ভাবে সাঁতার কাটা যায়? সেদিন আমাদের আট জনের সলিল সমাধি হত, যদি না আমাদের ওই মাঝিরা, চাষিরা তাদের নৌকা নিয়ে এগিয়ে না আসতেন। আমরা বাঁচলাম। তাদের জন্যেই।
           এই ঘটনা বড়দের কপালে আরো ভাঁজ ফেলে দেয়। এই নিষ্ঠুরতা অনেকেই মানতে পারেন না। অবশেষে ঠিক হয় আমাদের মণ্ডপেই স্কুল শুরু হবে। আমাদের নিজেদের স্কুল। সেখানে ধারেন্দা থেকে এক মাস্টারমশাই আমাদের পড়াতে আসতেন। স্কুলটি এমন জনপ্রিয় হল যে, বড় বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছাড়াও অন্যরাও সেখানে যোগ দিতে লাগল। আর ধারেন্দার স্কুলটি প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হল। অবশেষে আমাদের বাবা-কাকাদের কাছে অনুরোধ আসতে লাগল ছেলেমেয়েদের  ধারেন্দার স্কুলে যোগদান দেবার জন্য। স্কুলে ফিরে গেলাম। শুরু হল পুরোনো বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎকার। পুরোনো স্কুল পেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ভুলেই গেছিলাম সেদিনের নৌকাডুবি। আমাদের শিক্ষকেরাও আমাদের পেয়ে খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। 



                                     ৪
                                         বড় বাড়ির দুর্গাপুজো
         ইন্দুহাটির  বড় বাড়ি মানে আমাদের বিশ্বাসবাড়িকেই বোঝাতো। আমাদের বাড়িতে মোষবলি দিয়ে দুর্গাপুজো দেবার প্রথা প্রচলন ছিল। এই প্রথা প্রচলনের পেছনে কারণ ছিল। আমার জ্যাঠামশাই গৌরহরি বিশ্বাস বাল্যকালে একবার বজ্রপাতে জ্ঞান  হারান। কান্নাকাটি পড়ে যায়। কবিরাজি চিকিৎসা চলে। আমার ঠাকুরমা তখন মানত করেন, ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি মোষবলি দিয়ে মা-দুর্গার পুজো দেবেন। ধীরে ধীরে জ্যাঠামশাই সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাড়িতে আনন্দ তখন আর ধরে না। শুরু হল দুর্গা পুজোর প্রচলন। পুজোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল মণ্ডপঘর। মায়ের পুজোর পর বিজয় দশমীর দিনে নৌকা করে মা-কে নিয়ে যাওয়া হত মধুমতী নদীতে বিসর্জনের জন্য। ওড়াকান্দির পাশেই মধুমতী নদী। যেহেতু তখন চারিদিকে জল থাকতো, সেহেতু নৌকায় করে আমরা যেতাম। মহিলাদের জন্য থাকতো আলাদা নৌকা। প্রায় আট-নটা নৌকা করে যেতাম মধুমতীর তীরে। সঙ্গে ঢাক, কাঁসা।  নৌকাতেই চলতো ধুনুচি নাচ। মধুমীতীতে কেবল আমরা নই, আমাদের মতো হাজার হাজার মানুষ জড়ো হত নৌকা নিয়ে মায়ের বিসর্জনের জন্য। আমরা নদীতে ডুব দিয়ে উপভোগ করতাম এই আনন্দ। তার আগে অবশ্যই চলত মায়েদের সিঁদুর খেলা মণ্ডপ তলাতেই। এই পুজোতে ব্যবহৃত হত একটি রূপোর কয়েন। সেটি আজও আমার কাছে গচ্ছিত আছে।
                 দুর্গাপুজো ছাড়াও হত ব্রক্ষ্মাপুজো। এ-দেশে এসে কখনও ব্রক্ষ্মা পুজো দেখিনি, কিন্তু ব্রক্ষ্মাপুজো হত আমাদের বাড়িতেই, সেই মন্ডপে, বৈশাখে। তখন চারিদিক শুকনো। এছাড়া হত দেল, সরস্বতীপুজো। কালীপুজো করতাম গোটা গ্রাম মিলে। খুব আনন্দ হত তখন।  লক্ষ্মীপুজো হত বাড়ি বাড়ি। মা, জেঠিমা আলপনা দিতেন। সে এক দারুণ শিল্পকর্ম!
                আমরা মতুয়া ছিলাম। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। সেই মধুমতী তীরে। খুলনার মতুয়ারা বারুণীতে মতুয়াতীর্থ ওড়াকান্দি থেকে ফেরার সময় বড় বাড়ি হয়ে যেত। তার আগে অবশ্য চিঠির মাধ্যমে আমাদের জানাত যে তারা আসবেন। তারা সারারাত গান করতেন। থাকতেন। বিশ্রাম করতেন। সকালে আবার বাড়ির দিকে রওনা দিতেন। আমার বাবা ভালো একতারা বাজাতে পারতেন। গানের গলাটাও মন্দ না। নিজে গানও লিখতেন। তাঁকেও গান করতে দেখতাম হরি সভায়। আমি ছিলাম বাঁশির ভক্ত। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতাম।

                                                       ৫
            ইন্দুহাটি হাইস্কুল ও আমার ছোটদাদু
          আগেই বলেছি, আমারা জমিদার না হলেও জমিদারি চাল ছিল আমাদের মধ্যে। বাইচ প্রতিযোগিতা, ঘোড়া ও গোরু দৌড়, ফুটবল ইত্যাদিতে আমাদের নিজস্ব দল ছিল। অন্য গ্রামের লোকেদের সাথে খেলা হত। ফুটবল খেলায় আমাদের বাড়ি থেকেই একটা ট্রফি দেওয়া হত প্রতি বছর। সে ট্রফি এবার কার দখলে থাকবে সেটা নিয়েই সারা বছর গুঞ্জন চলত। ফুটবল খেলা হত ইন্দুহাটি হাইস্কুলের মাঠে। এই স্কুলটা আমার ছোটদাদু রজনীকান্ত বিশ্বাস স্থাপন করেন। জানি না ইতিহাসে সে-সব নাম আছে কি না। কারণ ইতিহাস এক বড় অদ্ভুত জিনিস। অনেক কিছুই মুছে ফেলা হয় ইতিহাসের পাতা থেকে, আবার অনেক কিছুই জুড়ে দেওয়া হয় সেখানে। আমরা সেগুলো  সত্য বলে মেনেনি। এদেশে এসে দেখেছি যিনি সারা জীবনেও কখনও কোনোদিন কোনো স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকনেনি, তিনি পেয়েছেন স্বদেশী আন্দোলন করার ভাতা! যাক সে কথা, এই খেলার মাঠ আমার ছোটদাদুর। বিত্তশালী মানুষটি এখানে স্থাপন করেছিলেন হাইস্কুল। টিনের ঘরে পড়াশুনো করতো সবাই। স্কুল সংলগ্ন বোর্ডিং হাউজ ছিল। দূরের ছাত্রেরা এখানে থেকে পড়াশুনো করতো। এখানেও কম অত্যাচার হয়নি। কখনও টিন খুলে নেওয়া হয়েছে, কখনও বা টেবিল–বেঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়েছে। অত্যাচারে বোর্ডিংয়ের ছাত্রেরা বাড়ি ফিরে গেল। চলে যাবার পর এবার বোর্ডিং হাউজের টিন চুরি হল। পড়ে রইল শুধু ভিত। স্কুলটা তবু চলল।  
  

                                                        
                        ওই এল রাজার ডাকাত...’ 

           দেশে ডাকাতি আগে ছিল। কিন্তু এই ‘ওগো দ্যাশ- মোগো দ্যাশ’– হবার পর থেকে ডাকাতি ক্রমশ বাড়তে লাগল। বিশেষ করে হিন্দু ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য করে হত এই ডাকাতি। ইংরেজ আমলে ডাকাতরা কিছুটা ভয় পেলেও পাকিস্তানি আমলে তারা হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া। কয়েক প্রজন্মের ব্যবসা আমাদের। এর আগে কখনও ডাকাতির মুখে পড়তে হয়নি। প্রথম বার পড়তে হল স্বাধীনতার পরপরই। তখন সাহা-রা ছিল মহাজন। তাদের কাছ থেকেই আমরা কাপড় কিনতাম, আর সেই সব কাপড় বিভিন্ন হাটে গিয়ে বিক্রি করতেন আমাদের পরিবারের লোকজন। এমন একদিন সাহাদের কাছ থেকে কাপড় কিনে ফেরার পথে আক্রমন করল ডাকাতেরা। ভোজালি, দা- কাটারি এমনকি তলোয়ার নিয়ে হামলা করল প্রায় পঞ্চাশ জন ডাকাত। ব্যাস। সব লুঠ করে পালাল। এই ঘটনায় বাবা এতটাই মানসিক আঘাত পান যে প্রিয় দেশ ছাড়ার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেন। ভিটে বাদে টিনের দোতলা বসত বাড়িটা বিক্রি করে দেন। জমি-জমাও বিক্রি করার ব্যবস্তা করেন। কিন্তু জ্যাঠামশাই-কাকা এমনকি বংশের অন্যান্যরা বাবাকে বোঝাতে থাকেন এখানে থাকার জন্য। তাঁরা তো আছেন। এক সাথে থাকবেন। একটা ডাকাতির জন্য এই ভাবে ব্যবসা ছেড়ে জমি ছেড়ে কেউ স্বদেশ পরিত্যাগ করে চলে যায় পাগলের মতো!
             জ্যাঠা-কাকারা সেদিন ভুল করেছিলেন। বাবাকে বাধা দেওয়া ঠিক হয়নি। বাধা না দিলে বাবা অনেক আগেই ভারতে এসে সামলে নিতে পারতেন। তা আর হল না। ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।’ খান্দারপাড়ায় রমেন মজুমদার থাকতেন। ইতিহাসে এমএ। খুব নামডাক তাঁর। তিনি উচ্চবর্ণের মানুষ। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হবার ঠিক আগেই ভাব বুঝে ভারতে চলে আসেন। আমার বিশ্বাস, এখনও যাঁরা আছেন তারাও ধীরে ধীরে চলে আসবেন। বাংলাদেশ একদিন হিন্দু শূন্য হবে। আমি চাই আমার এই ভবিষ্যৎবাণী যেন বাস্তবে পরিনত না হয়। কিন্তু  আমার মন বলছে এ-রকমই হবে। বাংলাদেশে হিন্দুরা কমতে কমতে একদম কমে গেছে। ১৯৪১ সালে বাংলাদেশে ২৮% হিন্দুরা থাকতেন, আর ২০০১ সালে সেটা এসে দাঁড়াল মাত্র ৯.৬ শতাংশ। অনেক দিন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি, সেই সংখ্যা এখন বোধহয় আরো কিছুটা কমে গেছে। এই নিয়ে দুই বাংলার তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদদের মুখে কুলুপ। মুখ খুললেই যে ভোট কমে যাবে। ভোট এক অলীক যাদু! বুদ্ধিজীবীরাও চুপ। পাছে কেউ সাম্প্রদায়িক বলে। পাছে কেউ ‘অভিজিৎ রায়’-এর মতো হত্যা করে ফেলে রাখে রাজপথে, যে রাজপথের পুলিশেরাও তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে, তাদের হাফভাব দেখে মনে হয়, ‘খুব লাফাচ্ছিলি! যা শালা, এবার মর!’ আমি বা আমরা কেউ মুসলিম বিদ্বেষী নই, দেশে থাকতে এক সাথে খেলেছি, ১৯৬৫ সালে ও ১৯৭১ সালে যুদ্ধে এক সাথে যুদ্ধ করেছি, মুক্তি যোদ্ধাদের রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি, সেও তো আমার দেশ,  আমার মা, মায়ের অপমান যেন দু’চোখে দেখার নয়, পথে পথে কত লাশ কুকুরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে কত ধর্ষিতা...কেউ আবার অন্তঃসত্ত্বা... কত সন্তান হারানো বুক... লাশের  মধ্যে মাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট্ট শিশু... সে-সব দু’চোখে দেখা যায় না, কেবল জল গড়িয়ে পড়ে দু’চোখ বেয়ে... চারিদিকে ভায়েদের লাশ, বোনেদের লাশ, মায়েদের লাশ। লাশের মধ্য হেঁটে গেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। পাকিস্তানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছি। একদিন স্বাধীনতা এসেছে। একদিন। ‘মোগো দ্যাশ’-এর জল হাওয়া যে কী সুন্দর সেদিন টের পেয়েছিলাম। সেদিন শেকড়ের তান অনুভব করেছিলাম।      
          বাবা আবার শুরু করলেন। শূন্য থেকে শুরু। এর মধ্যে জ্যাঠামশাইদের ডাকাতি হয়। খান্দারপাড়া থেকে ফেরার সময় বাবা দেখলেন আমার দুই জ্যাঠতুতো দাদা অতুল ও আশুতোষ  বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করছে। কিছু খদ্দের তখনও দোকানে। বাবা তাদের দেরি দেখে লোকজন নিয়ে চলে এলেন। দাদারাও তাতে আপত্তি জানালেন না। ফেরার সময় ডাকাতেরা তাদের ঘিরে ধরল। অন্ধকার রাস্তায় হাতে হ্যারিকেন নিয়ে এগিয়ে যায় তাঁরা। মাথায় কাপরের গাঁট। সঙ্গে দুজন চাকর। পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে যাওয়া লোকজন দেখে চমকে ওঠে তাঁরা। কিছুক্ষণ পর তাঁদের ফাঁকা পেয়ে ঘিরে ধরে। অতুলদাকে পিঠে লাঠির বাড়ি মারে আর আশুদাকে চাকু। ভাগ্যক্রমে পিঠের বদলে সেই চাকুর এসে লাগে হাতে। দাদা বেঁচে যান। কিন্তু লুঠ হয় সব কিছু। তারপরও জ্যাঠামশাই থেকে যান। কিন্তু এরপর ১৯৫২-তে ঘটে যায় এক ভয়াবহ ডাকাতি। জলের সময়। পানসি নৌকোতে এক বিশাল কাঠের গুদাম ছিল, যাতে তালা দেওয়া থাকত ব্যবসার মালপত্র। সেদিন হাট থেকে ফেরার সময় ডাকাতেরা ঘিরে ধরল। বাবা সহ সবাইকে নৌকোয় বেঁধে বল্লম দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে ভাঙা হল গুদাম। আর তারপর মহোল্লাসে তারা নিয়ে গেল সবকিছু।
           বাবা সেদিন ফিরে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলেন। এবার তিনি আর থাকবেন না। দাদারা বললেও থাকবেন না। এবারও নানান বাধা এসেছিল। কাছের মানুষ অন্য দেশে চলে যাক ভিটে মাটি ছেড়ে-এ কি কেউ চায়? কিন্তু বাবার সেখানে আর থাকা চলবে না। বাড়ি বিক্রি করলেন। বাবা টিনের দোতালা বাড়ি বিক্রি করেছিলেন সেবার, কিন্তু বাড়ির জমিটা বিক্রি করেননি। থেকে যাবার পর সেই জমিতেই আবার টিনের একতলা বাড়ি তুলে ছিলেন। এবার ভিটে সহ বাড়িটা বিক্রি করলেন। জমিও কিছু কিছু বিক্রি করলেন। কিন্তু হঠাৎ হিন্দুদের জমি রেজিস্ট্রি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পাকিস্তানি আইনের ফ্যাসাদে পড়লেন বাবা। ভালোভাবে থাকতেও দেবে না, আবার বিক্রিবাটা করে আসতেও দেবে না! হাতেও মারবে, ভাতেও মারবে! তবু আমার বাবাও খুব অল্প পয়সা নিয়েই ঠিক করলেন এবার রওনা দেওয়া যাক। অনেক হয়েছে, আর থাকবেন না সেখানে। ১৯৫৩-এর অক্টোবর। দুর্গাপুজোর পরপরই যাত্রা শুরু। বাবার চোখে জল। এই পুজোই শেষ পুজো। বাপ-ঠাকুরদাদার ভিটেমাটি ফেলে আমাদের নিয়ে চললেন দূর দেশে। তার আগে ঢাকা গিয়ে ভারতীয় দূতাবাস থেকে মাইগ্রেশান করে নিলেন। বাবার সাথে মা, দাদা-বৌদি ও আমি। আমাদের রাজকুমার বছর দেড়েক বিয়ে করেছে। বোউদির নাম চপলা। ইতিমধ্যে এক পুত্র সন্তান হয়েছিল তাদের। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই সে হতভাগা মারা যায়। সেই শোক নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। ক্রমশ। শত মৃত সন্তানদের কোলে নিয়েই আমাদের অনন্ত যাত্রা!

                                             
                     ‘আর কতদূর গেলে আমাদের বাড়ি?’

       রাস্তায় তখন জল। নৌকো করে বিদায় নিলাম। চোখের জলে সে বিদায়। তখন কি ভাবতে পেরেছিলাম এই গ্রামে এ-জীবনে আর কখনও ফিরে আসব না। আমার গ্রামে। আমার প্রাণের গ্রামে। আমার নৌকায় আর কখনও ঘোরা হবে না আমার। আমাদের দাদাভাই-দিদিভাই-বোনেদের  নিয়ে আর এক সাথে ধারেন্দার স্কুলে যাওয়া হবে না। হায় দেশ! বিদায়, বিদায় তোমায়!
       নৌকো করে খান্দারপাড়া হয়ে পশ্চিমদিকে ব্যাসপুরা রেল স্টেশানের দিকে গেলাম। ওখান থেকে ট্রেনে করে কালুয়াখালি। তারপর ট্রেন বদলি করে বার্নপুরের ট্রেন ধরে সোজা শেয়ালদা। মাঝখানে বেশ কয়েকবার মাইগ্রেশান চেকিং। আমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো নিকটাত্মীয় না এলেও এসেছিলেন আমাদের গ্রামেরই একটু দূরের আত্মীয় বনবিহারী বিশ্বাস ও তাঁর পরিবার। আর আমাদের সঙ্গে ট্রেনে ছিল আমাদের মতো হাজার হাজার হতভাগ্য পরিবার। শেয়ালদায় আমাদের দু’রাত কাটল। সেই সব পরিবারও ছিল সেখানে। কাতারে কাতারে উদ্বাস্তু। এ দেশীয় লোকেদের কাছে আমরা তখন উটকো লোক মাত্র। তাদের জ্বালাতে এসেছি। তাদের চাউনিতেই এক অজানা ঘৃণা টের পেয়েছিলাম। তাহলে আমার দেশ কোথায়? কোথায় আমার ঘর? আমার ঠিকানা? জিন্না, গান্ধী, নেহেরু—আপনারা কী করলেন সেদিন? এক সাথে কী থাকা যেত না? এত বছর তো ছিলাম এক সাথে, বলুন, এভাবেই তো থাকতে পারতাম আমরা, তাই না? না ক্ষমতার  লোভ আপনাদের পেয়ে বসেছিল? এই প্রশ্ন কেবল আমি নই, আমার মতো কোটি কোটি উদ্বাস্তু করবে, তাঁরা না হিন্দু না মুসলিম, তাঁরা কেবল উদ্বাস্তু! সেই অমিতাভর ‘দিবার’ সিনেমার মতো আমাদের হাতে কেউ লিখে দিয়েছে, ‘তোদের কোনো ঘর নেই, দেশ নেই, তোরা এক চলমান উদ্বাস্তু!’  
        খাওয়া জুটল। না জোটার মতোই। রিলিফের লোকেরা এল। ঠিক হল আমরা পানাগড় ক্যাম্পে যাব। বনবিহারীদের জন্য কুচবিহার। রিলিফের লোকেরা ট্রাকে করে নিয়ে গেল হাওড়া, সেখান থেকে ট্রেনে পানাগড়, পানাগড় স্টেশান থেকে ট্রাকে করে কাঁকসা ক্যাম্প। এখানে মোট তিনটি ক্যাম্প বসেছিল। আমারা ছিলাম এক নম্বরের শেষ দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মাঠ   মিত্র সেনাদের ক্যাম্প ছিল। নিচেটা শান। তাতে তাবু টাঙানোর আংটা ছিল। তাবু টাঙানো হল। বিশাল মাঠে ছোট ছোট তাবু। পাশের মাঠটাতে বসেছিল দ্বিতীয় ক্যাম্প। সেটা মাঠই ছিল। নিচে মাটি। আর একটু দূরে ছিল তৃতীয় ক্যাম্প। আমবাগানে। এখানেই এখন আমাদের যাপন। রেশনে চাল, ডাল ও খুব সামান্য পয়সা দেওয়া হত। দেওয়া হত জামা-কাপড়। আমাদের সেই অতি সামান্য খাবারে চলত না। কয়েক মাস এভাবে যাবার পর যে যার মতো কাজ বেছে নিল। কেউ লোকের বাড়ি চাকরের কাজ করল, কেউ রান্নার কাজ, কেউ কৃষিকাজ। বাবার পেটে যেহেতু বিদ্যে ছিল, তাই তিনি শুরু করলেন গৃহশিক্ষকতা। বাবা আমৃত্যু এই পেশাই করে গেছেন। আর যখনই  সময় পেয়েছেন লিখেছেন গান, কখনও সে গান নিজের, কখনও সংকলন করেছেন অন্যের গান। আমাদের মতো কত পরিবার সেখানে এভাবে বেঁচে আছে। রোদ–ঝড়–বৃষ্টি আমাদের শয়ে গেছে। আমরা তো আর মানুষ না, উদ্বাস্তু, তাই এ-সব সহ্য হয়ে যায়। শহ্য করে নিতে হয়। গরমের সময় দিনের বেলা এক মুহূর্তের জন্য তাবুর নিচে কাটানো ছিল ভীষণ কষ্টের। আমরা তা কাটিয়েছিলাম। হাড় কাঁপানো শীতেও আমরা ভয় পাইনি। আমাদের মাথার উপর দিয়ে কখন সূর্য চলে যায় আমরা তা টের পাই না। কখন যে দুর্গাপুজো চলে যায়! দেশের বাড়িতে সবাই কী আনন্দ করছে! আর আমরা? দিনে হয়তো আধপেটা সিকিপেটা খেয়ে বেঁচে আছি। না খেয়েও। যেখানে মানুষ একদিন কাটাতে পারে না, আমরা সেখানে একমাস নয়, এক বছর নয়, তিন-তিনটে বছর কাটিয়েছি! পেরেছি। আমরা না উদ্বাস্তু! আমাদের কোনো দেশ নেই। কোনো কষ্ট নেই।
         দেশে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারিনি। ক্যাম্পের ছেলেমেয়েদের জন্য  প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। বাবা আমাকে পুনরায় চতুর্থ শ্রেণিতে ভরতি করালেন। বিনামূল্যে বই পেলাম। পড়লাম। পরের বছর পানাগড় হাইস্কুলে ভরতি হলাম। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনো চলল। আবার ডাক এল। চলো! এ-দেশ তোমার নয়। তল্পিতল্পা গোটাও। ১৯৫৭-এর মার্চ। আমরা পানাগড় ত্যাগ করলাম। আরও সংগ্রাম অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আরো অনিদ্রা। আরো দারিদ্র। আরও আধপেটা সিকিপেটা রাত্রিযাপন।
                                                                                 (চলবে)

                                          অনুলিখন: সুমনা বৈ. বিশ্বাস ও কুমারেশ পাত্র


---------------------------------------------------------------------------------------
না পড়ে চলে যাবেন না মতামত রেখে যান এখানে পোস্ট করার সময় আপনার ই-মেল পাসওয়ার্ড চাইতে পারে দিন ওটা আপনি গুগলকে দিচ্ছেন একবারই দিতে হবে আর যদি প্রযুক্তিগত কারণে বার বার মতামত পোস্ট করা সত্বেও মতামত যদি পোস্ট না হয় তাহলে সম্পাদকের ফেসবুকের ইনবক্সে পোস্ট করুন পরে এখানে পোস্ট করে দেওয়া হবে নাহলে achenayatri@gmail.com-এ মেল করুন অনেক আন্তরিকতার সাথে আমরা এই কাজটা করি তাই এই লোভটা সামলাতে পারি না সমালোচনা করেই লিখুন কিন্তু লিখুন আশায় আছি ধন্যবাদ

মন্তব্যসমূহ