জার্নাল
সুবীর সরকার
‘আরো দিয়া যায় পীরীতির বায়না...’
হাটের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ফাগুন-চোতের
রোদ হাওয়া অতিক্রম করতে করতে রতিকান্তকে
কখন কীভাবে যেন মহামহিম এক হাটখন্ডই হয়ে উঠতে হয়! হাট থেকে হাটের দিকে যেতে যেতে
সে তার ঢোল, ঢোলের কাঠিসমেত কত কত
খেতপাথারবাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। অনুপ্রবেশের হালহকিকত থেকে নতুন ধানের চিড়া খইয়ের
সুঘ্রাণ তাকে আমোদিত করলে রতিকান্ত ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, কিন্তু মগজের কোষে কোষে
গান ঘুম আর স্বপ্ন নিয়ে সে অনুপ্রবেশের চিরকালীনতাকে হাটগঞ্জের বাতাসেই যেন উড়িয়ে
দিতে চায়।
দুই
জীবনের উজানে কি যাওয়া হয় মানুষের! জন্ম
জন্ম ধরে জন্মান্তরের পাকে পাকে ভাটির দিকে এগিয়ে যাওয়াই যেন গাঁথা হয়ে যায়। রতিকান্ত
বয়াতি ঢোল বাজাতে বাজাতে মাথাভর্তি বাবড়ি চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কখন বুঝি চলেই যায়
হাওড়- বাঁওড় বাওকুমটা বাতাসের নৈরাজ্যের ভিতর। তার কাঠিঢোল নিয়ে সে জীবনভর যেতেই
থাকে সোনাপুর মথুরা নিমতি তপসিখাতা বঞ্চুকুমারী দেওডাঙ্গা শালকুমারের হাটে হাটে।
ধুলোর ঘূর্ণী তাকে ঢেকে ফেললেও সে কবেকার যেন বংশপরম্পরা সূত্রেই ভীষণ ভাবে ঢোল
দোতরা আর নাচগান নিয়ে হাটের ভিতর চলে আসে; চলেই আসতে হয় তাকে। বুঝি রতিকান্ত বয়াতি
ছাড়া, বয়াতির ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি বিনা হাট শেষাবধি কিছুতেই হাট হয়ে উঠতেই পারে না!
রতিকান্তের গান, নাচের বিবিধ মুদ্রা, কাঠি ঢোল দীনদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে
নদীজঙ্গলজনপদের ফাঁকে ফাঁকে অনবরত হাটখন্ডগুলি পাশ ফিরতেই থাকে।
তিন
ভাঙা হাটের হাটফিরতি মানুষের চোখেমুখে
চলন বিচলনের ভিতর আকুলতা বিকুলতা থাকে বুঝি! তেমনভাবে রতিকান্তের কথা কেউ না
জানলেও রতিকান্তের বয়াতি হয়ে ওঠার গল্পগাঁথা টুকরোগুলি হাটের পরতে পরতে আঁঠার মতো
আটকে থাকে। রতিকান্তর গুরু ঝাম্পুরা, কিংবা তারও গুরু নালচান সব যেন আইলে আইলে
হাটতে থাকে। হোঁচট খায় আইল কাশিয়ার থোপে থোপে। সবজিহাটার পথে কুপির আলোয় চতুর
শেয়ালের চোখের ভিতর আগিলা দিনের গান বাজে। বাজতেই থাকে। যেভাবে ঢোলের লোকজতা নিয়ে
সর্বশরীরে বিষাদ মেখে নেয় রতিকান্ত বয়াতি। বাতাসের খুব নিকটে কান পাতলেই পাখিদের
ডাক, পাতা খসে পড়া; আর সব ছাপিয়ে হুহু হাহাকার হয়ে বেজে ওঠা গান,
‘ও মুই কং তোমার আগে
ও মোর কইতে শরম নাগে
সগায় যাছে মেলা দেখিবার
মোক না নিগান কেনে’
চার
গান বলি নাচ বলি কালখণ্ড বলি সবেরই ভিতর
যাপিত জীবনের প্রবহমানতা গল্পের পর গল্প জুড়ে যেন ঘাসের স্তূপ বেরিয়ে আসা বাঘেরা
বুঝি জল খেতে চলে আসে দিনকাল ভুলতে বসা হাটবাজারের ভিতর! এতসব ঘটে, ঘটেই চলে;
রতিকান্ত বয়াতির বিশ্বাসযোগ্য কোনো
বৃত্তান্ত রচিত হয় না। গান শুরু হয় নাচ শুরু হয়। বাদল মেঘের নিচে রতিকান্ত দাঁড়িয়ে
থাকে। রতিকান্তর কোনো বৃত্তান্ত রচিত হয় না। বরং রতিকান্তই নতুন নতুন সব
বৃত্তান্তের জন্ম দিতে থাকে জল-হাওয়া-জনপদের ভিতর।
সমাপ্তির আগে
এসব আমার দেখা জীবন। এসবের ভিতর দিয়ে আমি অন্তহীন যেতে থাকি। এ-এক প্রবহমানতা বুঝি বা! অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে
না। জীবন পেরিয়ে আমাদের আরো
আরো জীবন।
জীবনযাপন। চারপাশে সাদা ঘোড়া। লোকদেবতা। লোকপুরাণ।
---------------------------------------------------------------------------------------
না। পড়ে চলে যাবেন না। মতামত রেখে যান। এখানে পোস্ট করার সময় আপনার ই-মেল পাসওয়ার্ড চাইতে পারে। দিন। ওটা আপনি গুগলকে দিচ্ছেন। একবারই দিতে হবে। আর যদি প্রযুক্তিগত কারণে বার বার মতামত পোস্ট করা সত্বেও মতামত যদি পোস্ট না হয় তাহলে সম্পাদকের ফেসবুকের ইনবক্সে পোস্ট করুন। পরে এখানে পোস্ট করে দেওয়া হবে। নাহলে achenayatri@gmail.com-এ মেল করুন। অনেক আন্তরিকতার সাথে আমরা এই কাজটা করি। তাই এই লোভটা সামলাতে পারি না। সমালোচনা করেই লিখুন। কিন্তু লিখুন। আশায় আছি। ধন্যবাদ।
মন্তব্যসমূহ