ফেরা
সেখানেই ছিলাম। কতক্ষণ মনে নেই। শুধু
মনে পড়ে সেই রুগ্ন বিকেলে বসে পড়লাম কবির পরিত্যাক্ত বাড়ির উঠোনে। কয়েকটি কাগজের
টুকরো নিয়ে কেবল অসংলগ্ন নাড়াচাড়া। অন্ধকার নামছে বাদুড়ের ডানার মতো। অদূরের
স্টেশন থেকে কেবল ট্রেনের শব্দ আর কয়েক টুকরো আলো এসে লাগে। তারই মাঝে টের পাই রাত
অনেক হল। কত? বুঝে উঠতে স্টেশনে এলাম। নাঃ! কেউ নেই এখানে। বুঝলাম রাত অনেক হয়েছে।
প্ল্যাটফর্মে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। পাগল, ভিখারি কিংবা একটা হকারকেও দেখছি না।
কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন ঢুকল। উঠে পড়লাম। ট্রেন ছাড়ল। জানলা দিয়ে হুহু করে হাওয়া আসছে।
বেশ ঠাণ্ডা। যদিও এখন ঘোর বসন্ত। কামরায় আমি একা। বোধহয় আগের স্টেশনগুলিতে সকলে
নেমে পড়েছে। অন্ধকার পেরিয়ে ট্রেনটি চাঁদপাড়ায় এসে থামল। কেউ উঠল না। কাউকে নামতেও
দেখলাম না। আবার চলা শুরু। বিভূতিভূষণ হল্টে এসে দাঁড়ালে মনে হয় আমার কামরায় কেউ
একজন উঠেছে। ঠিক কামরার শেষ প্রান্তে। জানলা থেকে সরে এসে লোকটাকে দেখতে পারছি।
শেষ প্রান্তে মাথা নীচু করে বসে আছে। ভাবলাম এদিকে তাকাবে। এই নির্জন যাত্রায় সেও
আমাকে দেখে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফাঁকা ট্রেনে নিয়ম ভেঙে একটা বিড়ি ধরিয়ে আর একটা
এগিয়ে দেবে আমার দিকে, আর আমি অমায়িক আন্তরিকতায় সেটিকে ফিরিয়ে দেব। না। এরকম আদৌ
হয়নি। লোকটি আমার উপস্থিতিতে অত্যন্ত বিরক্ত কিনা তাও বুঝতে পারছি না। সিকদারপল্লি
এসে ট্রেনটা ডানদিকে প্রকাণ্ড বাঁক নিল। এই সময় কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে। চারিদিকের
বাড়িগুলো আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রেনটা এবার স্টেশনে ঢুকে পড়ছে ক্রমশ। ঠিক
করলাম, রানিং-এ নামব। নামলামও। আর নেমেই হাঁটা দিয়েছি। অমনি দাঁড়ালাম। ভাবলাম, একবার
দেখি সেই লোকটিকে। ধীরে ধীরে ট্রেন থামল। কিন্তু কেউ নামল না। সেই লোকটি এমনকি
গাড়ির চালক কিংবা গার্ডও! বিপরীত দিক থেকে নামলেও- তো চোখে পড়বে। অগত্যা ফিরলাম। গ্যারেজের
সামনে আমার সাইকেলটা পড়ে আছে একা। দরজা বন্ধ। সাইকেলটা তুলে নিয়ে এগোই। স্টেশন রোডে
এই সময় কুকুরদের খুব উল্লাস। সারাদিন গাড়িঘোড়ামানুষের চাপে তিতিবিরক্ত প্রাণীগুলো
এবারে একটু শান্তির খোঁজে একে একে নেমে আসে পথে। একটু প্রেম আর একটু অপ্রেমে মেতে
ওঠে। রাস্তাটা এখন তাদের। তারাই রাজা। অন্তত এই সময়ের। কিন্তু আজ তারাও নেই। ফাঁকা
রাস্তায় কয়েকটি ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়ছে। রেলগেট পার হয়ে বাড়ির রাস্তা ধরি। সাইকেল যেন
জেট প্লেনের বেগে ছুটে চলেছে। অবশেষে এসে পৌঁছলাম বাড়ির সামনে। সেই পুরনো বাড়ি।
দোতলা। বাবা বানিয়ে ছিলেন। বাইরের ঘোরানো সিঁড়িটার উপর জ্বেলে থাকা বাতিটা আজ নেভানো।
বাড়ির লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। মনে হচ্ছে এ-বাড়িতে আজ বহুদিন পর এসেছি, আর
কেমন অদ্ভুত লতাপাতায় ভরে উঠেছে চতুর্দিক! ডাকলাম। কিন্তু কোনো শব্দ হল না।
আশ্চর্য!
মন্তব্যসমূহ