নভলেট/ রূপাই পান্তি

সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল

ভোট মানেই যেন রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন দাঁড়ান, দাঁড়ান গল্পটা মোটেও  তেমন নয় সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে এসেছে মানুষের কাছাকাছি আজকের গল্পটা সেই কাছাকাছি আসার গল্প প্রেমের আর সেই প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে ভোট ব্যাস গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র কাল্পনিক, ঘটনাও, স্থান-কাল-পাত্রের কাকতলীয় মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাতড়াতে বসবেন না আপনার মনে পড়ে গেলে, সে আপনার স্মৃতির দোষ...

পরিচ্ছদঃ ৫


রান্নার লোকের সাথে কথা হয়ে গেল, গাঙ্গুলি চিন্তা করো না সেক্টর ছিল ব্যাবস্থা হয়ে গেছে ওদের আই কার্ডে একটা করে স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে দাও” 
দিব্যেন্দুদা মানে টেনশান কমে যাওয়া সম্ব দোতলায় মেঝেতে কাগজপত্রের স্তুপে মুখ গুঁজে ছিল  কার্ডগুলোতে সই করে দিয়ে আবার কাজে মন দেয় এত ফর্ম, এত ফর্ম্যালিটি... আসল কাজের কোনও বালাই নেই...
দরজায় কার ছায়া পড়েছে কালো চোখের ছায়াটা সম্বকে যেন টেনেই তুলবে মুখ তুলতেই সরে যায় কাজে মন দিতে চাইলে আবার ছায়া পড়ে সম্ব মুখ না তুলেই বলছে, “ভেতরে এসো!”
তো, সরে যাওয়া ছায়া ক্রমে কাছাকাছি এসে পড়ছে, দীর্ঘ হচ্ছে, নেমে আসছে ভোটপ্রস্তুতির কাছাকাছি দেখছে নানান কাগজের স্তুপে ডুবে থাকা ভোটবাবুকে কিন্তু কিছু বলার সাহস হচ্ছে না আর তখন রান্নার দল কলকললিয়ে উঠে আসে সিঁড়ি বেয়ে আর পাশ থেকে ছিটকে সরে যায় এই প্রবল গ্রীষ্মের দেশে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া সামান্য আশ্রয়টুকু...   
ও মা! সেনেটি যে দেকি ইখেনে রইছ্যে
সম্ব দেখল সেনেটিকে দেখল রান্নার দলের পাঁচ-ছয়জন ঝর্ণার মতো নরম, আঁকাবাঁকা হাসি কে একজন এগিয়ে এল একপা “আমি ইদির দলের হেড সেনেটি আমার নোনোদ হয়, সার
সম্ব হাসে কি বলার আছে এই সাধারণ আলাপের শেষে? তবু, বলতেই হয়, “আজ রাত্রে কী খাওয়াচ্ছেন আমাদের?”
বিকিলে তো বাজার হবেনি... ডিম রেঁনেদি আইজ? আর ডাইল?”
সম্ব মাথা নাড়ে নিত্যবাবু ওদের ডেকে নিয়ে কিসব বোঝাতে শুরু করেন জানালা দিয়ে দূরের মাঠের দিকে তাকালে তখন বিকেলের আলো পেরিয়ে চলে যাচ্ছে চাষিদের দল মাথায় ঘাস, শুকনোকাঠের বোঝা নিয়ে ছাগল চরিয়ে ফিরে আসছে মেয়ে বৌদের দল
সেনেটি মৃদু স্বরে ছায়ার কাছাকাছি রেখে দিল একটা রঙিন র‍্যাপারে মোড়া লজেন্স সম্ব মোড়ক খুলে মুখে পুরে দিতে দিতে দেখল সেনেটির মুখের লজেন্সটা গালের একপাশে কেমন সগর্বে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে
আপনার কিন্তু খুব সাহস
কেন বলতো?” সাহসের মতো কিই বা করেছে ও এই একবার দেখার মধ্যে? 
আপনি যেভাবে ওদের সাথে কথা বলছিলেন... ওরা না খুব খারাপ...”
ভয় পেলে চলবে? লোকে যদি বুঝে যায় আমি নরম, তাহলে তো সবাই মাথায় চড়ে বসবে...”
নিচ থেকে স্বপনবাবু ডেকে ওঠেন “সাআআআর... একবার নিচেআসেন
সেনেটি কখন সিড়ির কাছে চলে গেছে, সম্ব নামতে নামতে কাছাকাছি চলে আসে সেই অদ্ভুত গন্ধের কাছাকাছি সারাপিঠ জুড়ে একঢাল কালো মেঘ সরু কোমর পেরিয়ে নানান বাঁক পেরিয়ে কতদূর যে মেনে গেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না... সম্ব ওর পাশ কাটিয়ে নামতে নামতে বুঝল একটা মেঘের ছায়া তার সামান্য বৃষ্টির সম্পদ নিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর বুক সেই বৃষ্টির ফোঁটার নরম আদরে সারা শরীর কেঁপে উঠছে ওর আর ছায়া হেঁসে উঠছে ঝিরঝির...
****
মাঠে অনেক লোক স্বপনবাবু, নিত্যদাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট দল দিব্যেন্দুদার কাছে বয়স্ক দুএকজন বলছেন, “ভেইব্যেন্না সাড়িয়াটশোর বেশি ভোট পড়ব্যেন্না
দেরিও হবেন্ন্যা দিল্লির ভোটতো... গিরামির অনিক লোকিতো বাইরিই থাকে... তা সের‍্যা আসিওনা, ভোটও দ্যেয়ন্না
সম্বকে আসতে দেখে ছোট ছোট দল জুড়ে গেল সম্ব তাকায় সবার মুখে যেন কিসের একটা বিস্ময় ওকে দেখছে অবাক... কেউ কেউ যেন কীসের আশায় তাকিয়ে থাকে কেউ সন্দেহে...
আমরা পেঁচাপার্টিরথ্যে এইছি ভোটের মেশিন দেখাত্যিবে...”
আমাদেরও...” দূরের থেকে কে যেন সায় দেয়...
ভোট সোমবার সোমবার সকাল ৬টায় মক পোল হবে তখন আপনাদের সবাইকে মেশিন দেখানো হবে ওইদিন সকালে সময়মতো আসুন
না, আজই দ্যাখবো
আপনার ইচ্ছে হলেই কি হবে, দাদা? কমিশনের যা নিয়ম, সেটাই হবে...”
তাই দেখাবেন্না?”
সোমবার সকাল ঠিক ৬টা” কেটে কেটে বলে সম্ব
ওর বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল লোক-জন চুপ হয় আস্তে আস্তে ভিড় কমে 
সম্ব বুঝতে পারে, পেছনে আবছা অন্ধকারে, সিঁড়ির কোণে একজোড়া চোখ অবাক তাকিয়ে দেখছে ওকে, দেখছে ওর রুখে দাঁড়ানো... আর রাত নেমে আসছে ঝুপ করে রাতের পেট চিরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে স্কুলবাড়ি যেন জীবন ফিরে পাচ্ছে যেন কোন নতুন সকাল হবে বলে বেঁচে থাকছে জ্যোৎস্নাভেজা ধূ ধূ মাঠ  দূর খেজুর আর ছাল-বাকল ছাড়িয়ে নেওয়া সাদা ইউক্যালিপটাস গাছেদের অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রস্তুতি দেখতে দেখতে সম্ব আরও একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে
****
রাত বাড়ছে আর সেই তালে বাড়ছে ঝিঁঝিঁর ডাক রান্নার দল ওদের খাবার সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে দোতলার গ্রিলঘেরা বারান্দায় স্বপনবাবুর চলাফেরার শব্দ ছাপিয়ে গিন্নির সাথে সংসারের গোপন কথার চর্চা নিয়ে দিব্যেন্দুদা সম্বকে শোনাচ্ছে নানান গল্প ওদিকে দত্তবাবু কেশেই যাচ্ছেন, আর সুধীরবাবু বারবার বলে যাচ্ছেন, “আলোটা বন্ধ করেন সার, আলোটা...” এমন সময়, ওদের ওয়াটার ক্যারিয়ার নিচ থেকে ডেকে উঠে ভেঙে দিল সামান্য জ্যোৎস্নাযাপনের মুহূর্তটুকু
আবার সবাই থমকে যায় আবার আশঙ্কা গ্রাস করছে সকলকে দত্তবাবু মুহূর্তে টানটান পুলিশের জামাটা পরে দাঁরিয়ে বললেন, “আপনি দাঁড়ান, গাঙ্গুলিবাবু আমি দেখছি” বন্দুকটা নিয়ে জোরপায়ে নেমে যাচ্ছেন দত্ত, ওদের পুলিশকাকু সম্বর হাসি পাচ্ছিল, ঐ তো বন্দুকেই ছিরি, জীবনেও গুলি বের হবে না...
আর ভাবতে ভাবতে দত্তবাবুর গলা পাওয়া যাচ্ছে, “গাঙ্গুলিবাবু, নিচে আসবেন একটু? এই ইস্কুলের  হেডমাস্টার দেখা করবেন...”
সম্ব যার সামনে দাঁড়াল, জ্যোৎস্নার আলোয় লোকটাকে তখনও হাঁপাতে দেখা যাচ্ছে হাত জোর করে নমস্কার জানায় সম্ব 
আমি শান্তিরাম হাঁসদা এই ইস্কুলির হেডমাস্টার আপনার সাথে কিচু কতা ছেল...” শান্তিরাম আগাগোড়া দেখে নিল সম্বকে যেমন শুনেছে, ঠিক তেমন “কতাডা, মানে, খবরডা গোপন... পেঁচাপার্টির লোকজন বাইরির লোকানচে এড্ডা গোলমাল বেঁধি যাবে যে... উরা মেশিন দখল নেনেবে...” 
মেশিন দখল? আপনি কী করে জানলেন?” সন্দেহ দানা বাঁধে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ কাউকে ভরসা করে বলতে পারছে না মনের কথা সন্ধ্যের পর গ্রামের বাঁকে বাঁকে অচেনা ছেলের দল বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ঝোঁপে-ঝাড়ে ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে, ডানাওয়ালা পিঁপড়ের মতো গ্রামের কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে ছুটে যাচ্ছে, আর আগুনের তাপে ঝলসে যেতে বসেছে এই শান্ত গ্রামের শীতল জ্যোৎস্না...
আমি নিজির কানে শুনিচি
তখন দোতলা থেকে সম্বর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের দলের সকলে একটা ভোটে এসে এত উদবেগ আগে কারও হয়নি কখনও... সম্ব তাকিয়ে থাকে ওর পুলিশদের দিকে দুজনেই হাঁপানির রুগি সুধীরকাকু তো ভালো করে হাটতেও পারেন না... খাতার কলমে ৫ মাস চাকরী বাকি... ১০৭০ ভোট...
মেশিন দখল নেবে? মামার বাড়ি?” সম্ব তাকায় দিব্যেন্দুদা...
শান্তিরাম ওর দিকে তাকিয়ে সম্ব শুধু বলছে, “আপনি চিন্তা করবেন না আমরা আছি গোলমাল যাতে না হয়, সে দায়িত্ব আমাদের আপনি বাড়ি যান পরে কথা হবে...”
শান্তিরাম তাকিয়ে আছে ওর দিকে ওর সন্দেহ কেটে যাচ্ছে মানুষ ভালোই চেনে শান্তিরাম প্রিসাইডিং অফিসারের বয়স কম ছেলেমানুষ... কিন্তু এ ছেলের মনের জোর আছে এ ছেলে পারবে... ঠিক পারবে...

পরিচ্ছদঃ ৬ 


যেদেশে এলাম, মরাগাছ চারিদিকে...”
কেন? এদেশে কি জ্যান্তগাছ চোখে পড়ল না?”
তা কেন? তবে, দেখ, দূর দূর যত গাছ, সব কেমন প্রাণহীন দেখাচ্ছে...” জানালা দিয়ে যা দেখছে সম্ব, খেজুর গাছ আর ইউক্যালিপটাসের সাদা বাকল ওঠা সারি...
দোতলা থেকে গ্রামের দূর দূর অবধি দেখা যায় সকালের খাবার খেয়ে তাই ওদের দলের সবাই বেরিয়েছে  ‘দেশটাকে বরং ঘুরে দেখি’ গোছের ব্যাপার ও ভাবে, তারপর যদি মনে হয়, প্রতি মুহুর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে... তখন?
সেনেটি দেখাচ্ছে, জেলেপাড়া, তাঁতিপারা, ঘরামিপাড়া, ঐ দিকে সোরেনরা থাকে আর ওইদিকে থাকে শীট... মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে... নিচু চার পাশে জেগে থাকা আলপথ উঁচু আলপথ
এত উঁচু কেন?” 
যাতে জল ধরে রাখা যায়...”
কেন, নদীর জল?”
তাতে কি চাষ হয়? সে তো নোনা জল...” কথা চলে উঁচু আলপথের বুকে হেঁটে যায় গ্রামের মেয়ে বউরা  মাঝে মাঝে ইঁট পাতানো রাস্তার ধারে ডোবা সেখানে বাসন মাজা, স্নান করা চলছে 
মাঠে মাঠে ছাগল চরে, গরু, সাদা শরীরের ইউক্যালিপটাসের সারি এদেশের মেয়ে-বউদের পাশে বেমানান
তাহলে কোন গাছ মানায়?”
কেন? খেজুর!”
খেজুর? এ খেজুর খাওয়া যায় না বলে?” 
না, না, খাওয়ার প্রশ্ন কেন?  দেখ, কেমন বাঁকানো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে... এই সৌন্দর্য... এমন তীব্র রোদেও কেমন টানটান...”
আপনি যেন কেমন কথা বলেন...”
কেমন কথা?”
কথার অবকাশ খুঁজে নিয়েছে সকাল প্রাইমারি স্কুলের দোতলার ঘরের মেঝেতে ত্রিপল পেতে ছড়িয়ে বসেছে ভোটবাবুরা সম্ব এককোণায় ত্রিপলের ওপর সাদা চাদর পেতে কাগজপত্র বাছছে সাদা চাদর ভরে হলুদ ফুল ফুটেছে অল্প লতাপাতা রকমারি ফর্ম, রঙিন খাম নির্বাচকের নিবন্ধ ১৭ এ-র পাতায় পাতায় সই করে, সিল দিয়ে, দরকারি ফর্মগুলোতে ভোটকেন্দ্রের নাম, সই, সিল দিচ্ছে
এ কী ফুল? চাঁপা?”  সেনেটি ঝুঁকে পড়েছে পিঠের কাছে দুটো নুড়ির খোঁজ পাচ্ছে সম্ব যেন নদীর ধারে কাদায় রেখে গেছে কেউ ও তুলছে না
আপনার খুব কাজ?”
কাজ তো বটেই...”
আর বাকিদের বুঝি কোনও কাজ নেই?”
কাজ তো সবার...”
তবে যে ওরা সাত সকালে ঘুরে বেড়ায়? আর আপনি খেটে যান?”
তা কেন? ওদের কাজতো ভোটের দিন আমার তো সব দায়
পুলিশগুলোই বা কী? যদি বিপদ-আপদ কিছু হয়? ওরা পারবে সামলাতে?”
বিপদ? কেন, তোমরা তো আছ...”
শান্তিকাকু বলছিলেন কাল ওরা বাড়ি বাড়ি এসে শাসাচ্ছে
ওরা?”
কেন, কাল যারা এসেছিল... পেঁচাপার্টি... আমাদের সবার ভয় হচ্ছে আপনি তো ভালোমানুষ, আপনার না...”
আমার কিছু হবে না তোমরা সবাই আছ না...”
সিড়ি বেয়ে তখন সুধীরকাকু উঠে আসছেন হাপাতে হাপাতে আর এসেই শুয়ে পড়ছেন ঘরের এককোণে সম্ব তাকিয়ে থাকে সেনেটিওবলে, “চল, সেনেটি, ঘুরে আসি

আর সুধীরকাকু কাশতে কাশতে বলছেন, “হ্যাঁ, সার, যান ঘুরে আসেন ভালো লাগবে... আমি তো আছি, কোনও চিন্তা নেই...” বলছে বটে, সম্ব ভরসা করতে পারছে না... তবু কীসের টানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে সেনেটির পাশাপাশি আর নামতে নামতে সিড়ির প্রথম ল্যান্ডিং-এ হঠাৎ ঠোঁটের ওপর নেমে আসছে শান্ত, শীতল এক ছায়া সম্ব আশ্রয় নেয় কিছুক্ষণ শ্বাস নিতে যেটুকু বিরাম...


মন্তব্যসমূহ