সে এক যুগ ছিল আমাদের। মানে বাংলা কবিতার। ক্লাসিক জীবন ছাপিয়ে, ক্লাসিক কবিতার পর তখন এক নতুন আকাশ... কোনও হিসেব মিলছে
না। কবিতার, জীবনের...
খিদে তো অনেক... আমাদের। খিদে তো অফুরান... তাঁর মাঝে সেই সব শেয়ালেরা ছুটে যাচ্ছে... দেখছি, চোখের সামনে দিয়ে কত নেতার বউ, ভাই, ছেলে, বউমা নেতা
হয়ে যাচ্ছে... কবিরাও কেমন দৌড়ে যাচ্ছে সততা আর না-সততার মিছিলে, চেয়ার মোছামুছির সে কি হিড়িক... চেয়ার দখলের... এসবের মধ্যে আমাদের একটা
থাপ্পড়।
তুষার আর ফালগুনী। দুই ভেতরের কথা। বাকিটুকু, পাঠক বুঝে নেবেন...
--তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
তুষার রায়
(১৯৩৫-১৯৭৭)
ভাস্কর চক্রবর্তীকে লেখা তুষার
রায়ের চিঠি
M.R.B Sanitarium
Ward 2, Bed- 16
P.O- Digri,Midnapur
প্রিয় প্রাণাধিক ভাস্কর,
কেমন আছেন আপনি; আপনারা? হয়তো আমার সঙ্গ ভালো লাগতো
না আপনার, নিঃসঙ্গ আমি ভাবি এই কথা। মনে মনে আমি আপনি আর রবিন কতদিন যেন হেঁটে যাচ্ছি কলকাতার বদল না হওয়া ফুটপাত
দিয়ে- আমার পাশে রয়েছেন চমৎকার ফিটফাট সদ্য শেভড্ আপনি, যাকে কিনা বিষাদে আরো সুন্দর দেখায়।
কিন্তু মধ্যের স্পেশে পরিসরে
কে যেন অলক্ষ্য থেকে ইনজেক্ট করে দিলো ব্যবধান, হয়তো...।
র্যাঁবোর নির্বাসন সময়ে লিবেয়ার
নির্জন ভয়াল সেই মরুভূমির Prison থেকে তাঁর
মাকে লেখা চিঠিতে যে বর্ণনা আছে সেই সান্ধ্য ভয়াবহতার, কিছুটা
মেলে তার সঙ্গে এখনকার গলাচাপা সন্ধ্যা ও মধ্যরাত্রির। সেদিন মেঘবর্ষা
কুয়াশা ও শীত হিমেল উত্তুরে হাওয়ার রাতে Ward এর বাইরে বেরিয়ে শালবনের দিকে যেতে গিয়ে জেনেছি স্তব্ধতা কাকে বলে। যখন সমস্ত রাত পোকাও কি এক ভয়ে বন্ধ করে তাদের ঐকতান। বহুদিন শুনিনি
আপনার গলায় সেই রহস্যময় কিন্তু সমস্ত অস্তিত্ব ছুঁয়ে থাকা কবিতা Which will surely touch the time. I hope so. আপনি সেই Unknown
factor (অর্থাৎ কবিতা) কে ধরার চেষ্টা ছাড়বেন না। if a few clouds drift acrose the nighty Sky, The earth's companion
becomes the poets "ghostly gallion".
আপনার লোক্যাল বন্ধুরা কে কেমন
আছে; এখানে যথাক্রমে সুব্রত ও আরো অনেকের চিঠি
পাই। সম্প্রতি সুব্রত এক অতি চমৎকার চিন্তা
প্রক্ষেপিত ও মুদ্রনযোগ্য মূল্যবান চিঠি লিখেছেন। লিটল ম্যাগাজিন
সমূহের কি খবর জানতে ভারি ইচ্ছে হয়।
শেষ নৌকায় ব্যবহৃত শব্দ সকল কোথায়
ভুল প্রয়োগ আছে জানাবেন। আপনারও কি তাই মনে হয়েছে? এক কিছু মুদ্রন প্রমাদ পাঙ্কুয়েশ্যন, এক প্রেস প্রমাদ (যা ছাপাখানার ভূত করে) ছাড়া ভাষা মানে চাপর চাপর বাং গদ্যকে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্য এক জায়গায়। যেখানে বিদগ্ধ ব্যাক্তিদের
নতজানু হওয়া উচিৎ। গঁক্যুর সমতুল্যের কোনো সন্মান নয়
স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। অনীতা ও আপনাকে একসঙ্গে লিখছি চিঠি
য়ামি ভালো আছি কিম্বা নেই স্বাস্থ্য এমন যা দেখে কোলকাতার যে কোনো মেয়ে সাবধান হবে। দাড়ি কামাবার সময় জারমন ষ্টার হার্দী ক্রুগারের মতো কিম্বা যৌবনের রবার্ট টেলরের
মতো লাগে নিজেকে।
প্রেম ও শুভেচ্ছা,
তুষার
রায়
সূত্র : রংনাম্বার। বানান অপরিবর্তিত ।
ভাস্কর চক্রবর্তীর ডায়েরিতে তুষার
রায়ঃ
১১ই সেপ্টেম্বর ' ৭৭ ।। ভাস
কেউ রাত্রিবেলা মারা যায় , কেউ দিনের বেলায় । কলকাতা যখন
আরেকবারের জন্যে জেগে উঠছিলো , ফুটপাথগুলো
যখন আবার সরব হয়ে উঠেছিলো , আস্তে আস্তে - তুষার - শেষবারের
মতো চুপ করে গেলো । ভোররাতে । আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম ।
আমি সকালবেলা , ঝুঁকে পড়ে দেখছিলাম , তুষারের
দু' চোখের নীচে কোনো জলের রেখা আছে কিনা । - না , নেই । ছিলো না । মেঘের সকালবেলায় তুষারের হলঘরের বারান্দায় দরজার হাত দিয়ে , একা , দাঁড়িয়েছিলাম । আমারও চোখে জল আসেনি ! এমন সময়ে তুষার এলো । টেম্পোয় চড়ে
। দেখলাম , মুখ ফিরিয়ে আছে । গায়ে , সেই দেড়শ' টাকার নতুন পাঞ্জাবি । সঙ্গে , নিস্তব্ধতা । এ হচ্ছে সেই
নিস্তব্ধতা যা তুষারকে নিঃশব্দে এড়িয়ে চলতো । - বাংলা কবিতায় - গদ্যে - কবিতা
- পাঠে - এমন এক সটান কিংবদন্তি , আমাদের দেশে
, বহু বছর পিছন দিকে ঘুরে এসেও চোখে পড়ে না ।
আমরা শিখেছিলাম , ভোরবেলার যে আলো , সেই আলোয় সমস্ত
অসুখ সেরে যায় । শেষ পর্যন্ত , আমাদের কোনো অসুখ সারেনি । আমরা , তুষারের , রুগ্ন্ , আর অযোগ্য বন্ধু । - অন্তরঙ্গতা সূত্রে , তুষারের কিছু কিছু প্রিয় জিনিসের কথা জানতে পেরেছিলাম । তুষারের উৎসুক পাঠক - পাঠিকাদের জন্যে এখানে তা লিখে রাখা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক
হবে না ।
১) তুষারের প্রিয় ফিল্ম , ত্রুফোর , ' দ্য ফোর হান্ড্রেড
ব্লোজ ' , যে ফিল্মটার কথা তুষার প্রায়ই বলতো ।
২) তুষারের প্রিয় গল্প , রাজশেখর বসু'র ' লম্বকর্ণ ' , যার সংলাপ - অংশ তুষার টেবিলে টেবিলে
অভিনয় করে শোনাতো ।
৩) তুষারের প্রিয় গান , রবীন্দ্রনাথের , ' আমি শ্রাবণ
আকাশে ওই ... ' যা গাইবার সময় তুষারের চোখ বুজে আসতো
, আর আমি তুষারের প্রেমিকার মুখটা কীরকম , ভাববার চেষ্টা করতাম ।
৪) তুষারের নিজের প্রিয় লেখা
- কিংবদন্তীর উপত্যকা ।
৫) তুষারের প্রিয় ট্যাবলেট -
ডরিডন ।
৬) তুষারের প্রিয় কয়েকটা শব্দ
- জগঝম্প , ইলেক্ট্রোক্ষিপ্র , কড়াক - পিং ইত্যাদি ইত্যাদি ।
- ঐ ব্যান্ডমাস্টার চলে যাচ্ছে
। কোথাও তার মৃতদেহ দর্শনার্থীদের জন্যে রেখে দেওয়া হয়নি - কোথাও পতাকা অর্ধনমিত
থাকে নি - দু'পাশের বারান্দা থেকে ছেলেমেয়েরা
, কাজ ফেলে রেখে , ছুটে আসেনি - গঙ্গার পাশে
বসে অনবরত হাওয়ায় আমি দেখছিলাম , তুষার শান্তিতে পুড়ছে
, আমি শুনছিলাম সেই ব্যান্ডের বিলীয়মান শব্দ যা কোনোদিনই শোনা যাবে
না আর ।
- ভাস্কর চক্রবর্তী
তুষার রায়ের কবিতাঃ
শুধুই তুষার ঝরছে
সকলেই নেমে যায় নীচে বিখ্যাত
পাকদণ্ডী রেলপথ বেয়ে
শীতের মেঘলা দিনে ছেড়ে দার্জিলিং
কোলাহল শান্ত, শুধু গোম্ফার ডং ডিং ঘন্টাধ্বনি বাজে
আর তুহিন বাতাসে ভাসে তুষার ও
হিম, সুরেখা
আমি ও নিখিল শুধু রহে গেছি মুনলাইট
গ্রোভে
স্টোভে শুধু কেটলির সোঁ সোঁ শব্দ
নীলগিরি কফি
টেবিলে স্টিল লাইফ ওল্ড মঙ্ক
রামের বোতল
ফায়ার প্লেসের কাঁপা কাঠের আগুনে
কাঁপছে
হাইলাইট বোতল ও গ্লাস
সাপঘুম ইচ্ছে করে দীর্ঘবেলা ধরে, চলো তবে
পরস্পর তিনজনে শুই- আমি ও নিখিলের
মধ্যে
স্যান্ডউইচ সুরেখা সান্যাল
এরকমই শর্ত ছিল আমাদের- আছে , বা থাকবে
ঘুমের ভেতরে হবে বৃষ্টিপাত, তুষার ঝরবে ফার
পাইনের বনের ওপর- তুহিন শীতের
রাত ক্রমান্বয়ে
আরো হিম হবে, আর
আচম্ববিতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
কেউ নেই নিখিল বা
সুরেখা সান্যাল , শুধু জং
বাহাদুর কফির পেয়ালা হাতে, আর ডিং ডং
ঘণ্টার শব্দ শুধু ভেসে আসছে তিব্বতী
গোম্ফার,
ব্যস আর কেউ নেই, কিছু নেই শুধুই তুষার, শুধু
ধূ ধূ প্রান্তরে বনের কেবলই তুষার
ঝরছে, শুধুই তুষার
দেখে নেবেন
বিদায় বন্ধুগন, গনগনে আঁচের মধ্যে
শুয়ে এই শিখার রুমাল নাড়া নিভে
গেলে
ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল
কিনা ।
এখন আমার কোন কষ্ট নেই, কেননা আমি
জেনে গিয়েছি দেহ মানে কিছু অনিবার্য
পরম্পরা
দেহ কখনো প্রদীপ সলতে ঠাকুর ঘর
তবু তোমরা বিশ্বাস করো নি
বার বার বুক চিরে দেখিয়েছি প্রেম, বার বার
পেশী অ্যানাটমী শিরাতন্তু দেখাতে
মশায়
আমি গেঞ্জি খোলার মতো খুলেছি
চামড়া
নিজেই শরীর থেকে টেনে
তারপর হার মেনে বিদায় বন্ধুগন,
গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখার
রুমাল নাড়ছি
নিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন
পাপ ছিল কিনা ।
চাবি
প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির
কথা ভাবি
প্রতিটি পাতায় যেন আশা করা মহৎ
কবিতা
এভাবেই ভালোবাসা প্রতিটি পাথর
ছুঁয়ে ছুঁয়ে
চালভূঁয়ে এরকমই মেনে যেতে যেতে
তুমি
রহস্যের কোন গূঢ় কথা বলেছিলে-
তবু দেখি
প্রতিটি শিকল আজও অটুটই আছে, আর
প্রত্যেক বিকেল রোজ নিকেল কে
মুছে দিন
ডুবে যায় সন্ধ্যার বাদামি আঁধারে-
দেখি
তখন বাঁ ধারে কিংবা ডানদিকে কোনো
দরোজা কি আছে কিনা ভাবতে ভাবতে
আমি
প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির
কথা ভাবি ।
গোধূলি
কেই বা আগেতে ছিলো কেই বা পিছনে
এসব প্রশ্ন যতো অবাস্তব ভেবে
চির পাইনের সারি
পাতায় পাতায় শুনে হেসে ওঠে
হাওয়া, হাওয়া ওঠে ঘুলিয়ে উঠেছে লাল ধূলো
পূবের হাওয়ায় দূর ধান ক্ষেতে
মহিষ ও গরুগুলো
এরকমই উজ্জ্বল বিকেলে ভাবে
খোল ভূষি খড় মাথা গন্ধের
বাথান
অথবা সে গভীর দুপুরে নেমে গহীন
সে ঝিলে
নাকি ভাসিয়ে আধো হাওয়া জলের
মধ্যে নাকি
মহিষ দেখতে পায় গভীর মহিষ নাকি
সেইখানে
ভূত, ভয় পেয়ে ছুটে চলে আসে
ফিরে আসে গরু মোষ এই পথ
লাল ধূলো মিশে যায় মহিষের গায়ের
রঙের
মতো গাঢ় সন্ধ্যায়।
আনুপুঙ্খ
আমি আর আনুপুঙ্খে যেতে চাই না
ইদানীং
আমি একটু স্বাদ ও সম্পৃক্তির
মধ্যবর্তী শর্টওয়েভে
কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রাতিগ মূর্তি
থেকে বিমূর্তনে
এই নীল লাল ও হলুদ তাপ সংবহনে
পরস্পরা নিয়তই ভেঙে ভেঙে ত্রিডবল
ছয়গুন, বারো ও চল্লিশ থেকে লাফ
দিতে ক্রমশই
আরোহাবরোহনের নঙর্থক হৃদি
যদিদং হৃদয়ং বলতে ফেটে যাব
লাল নীল হলুদের থেকে ইনফ্রারেডে
এ কথায় কেমন বোঝানো গেল সেই
রাগত সংশ্লেষ
এই ট্রেন থেকে আমি অতএব নেমে
চলে যাব বনান্তরে- ক্রমশ গভীর
ওই বনে
গিয়ে ওই বাঘিনীর রোমশ শরীর
মেখে শোবো।
আমরা
অস্পষ্ট ধোঁয়ার মতো নাকি স্পষ্ট
মেঘময়
পাহাড়ের ভাঁজে কোনও নিষিদ্ধ নগরী
সূর্যের কিরণে যা অদৃশ্য, অথচ ফোটে
ফুটে ওঠে জ্যোৎস্নার নম্র সম্প্রপাতে
কার হাতে চাবি আছে, এ শহর জেগে উঠবে
কার পদপাতে?
জাল পাসপোর্ট নিয়ে আমরা আসিনি
সন্ত্রাস কামান ঘোড়া আমাদের নয়
আমরা তো লক্ষত্রের বাতি দেখে
এখানে এলাম
প্রভুর সংবাদ নিয়ে এই বেথেলহেমে
।।
"ঠিকঠাক কিছু নয়"
অরণ্য ঝাউ শন শন শব্দ করে
অথবা হাওয়ায়
অথবা হাওয়ায় কিছু ফিসফাস
কে জানে, এমন হাঁটতে তারাতলা রোড ধরে
ঠিকানাবিহীন এমনি পৌঁছে যাবো
ঠিক
ঠিক ঠাক লোকজন, বন্ধু কিংবা নারী
কার কাছে
অরণ্য ঝাউ কি এসব কথা বলে
অথবা কি বলে দেবে কার্যকারণের
মতো
লেটার বক্সের থেকে যে রকম চলে
যায় চিঠি
অন্ততঃ ঠিকানাটা থাকলেই হল, অন্ততঃ
পোস্টেজ স্ট্যাম্পটুকু ?
কে জানে, কে জানে তবে, কেন এত ভুল
কেন তবে হয়রানি দেরী, শুনি কতো চিঠি
নাকি কতদিন পরে - বহুদিন পরে
পাওয়া
..................গিয়েছিলো পাকা
ঠিকানায়
তবু আমি ঠিকাদার নই, ঠিক ঠিক ঠিকানার
জিম্মাদার নই আমি কবিতার শুধুমাত্র
অরণ্য ঝাউ শনশন শুনতে এই
তারাতলা রোড ধরে হাঁটি ।
এখন কবিতা
এখন শরীরের প্রত্যেকটি কূপ কিংবা
ক্ষতমুখ থেকে
নির্গলিত এ্যাসিড জ্বালানো বাদামি
ধোঁয়া
এখন দূর বনে কুড়ুল চালানোর শব্দে
আমার রক্তপাত
চারপাশের মুখ ও প্রকৃতির মধ্যে
দ্রুত বিবর্তন, মানে
যার যা হবার কথা সে তার বিপরীত
হয়ে যাচ্ছে
যেমন ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে রমণীর প্রকৃষ্ট
প্রেমিক
হীরের মতো দাম পাচ্ছে তেলাকুচার
মালা ।
বমি করার শব্দের মতো হয়ে এসেছে
গান প্রায়
মস্তিস্কের জায়গায় পেট আর লিঙ্গের
ওপরে চোখ
বহু বদলোক এখন ভেজালের মতো তরলে
তরল
কঠিনে কঠিন মিশে থাকছে
তাই দুধ কি মদের মধ্যে জলের হিসেব
ধরা
এখন সত্যিই খুব কঠিন হে ।
কবিতাই ক্রমশ
কবিতা লিখতে আজকাল প্রথমাংশ থেকেই
ভয়,-
কেননা প্রত্যেকটা লাইন পংক্তি
আপনি ভাঙছে বিভাজনে
অনুঘটন ও সমান তালে শক্তির যেন
শ্যাফট খুলে যাচ্ছে
কবিতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাপার
দাঁড়াচ্ছে বিস্ফোরকের হাতল
আকর্ণ আতা দাঁত বের করে রোমান্টিক
হতে গেলে
দন্ত
পংক্তি ঝরে যাচ্ছে
নেশা জমাতে গেলেই কবিতা ব্যুমেরাং
যেন অস্ত্র, কিংবা
সোনা সাফ করতে এ্যাসিড যেমন মারাত্মক
ধোঁয়া বেরোয়
যেন দেহ গান ঘ্রান রক্তমাংসে
পুড়ে উঠছে ধোঁয়া এমন
সিপিয়া রঙ তার,
কবিতাই ক্রমশ গঙ্গার মতো সাফ
করছে ময়লা কালো,
ঝুল যত ফেঁশো পাট কাটি, কবিতাই তখন গঙ্গার মতো
তর্পন করাচ্ছে
তীরে এবং
ডুব দিয়ে উঠলেই মনে হচ্ছে মন্দির
দেখবো সামনে, কিন্তু
চোখ খুলতেই ঝলসে উঠল মড়ার পেটে
কাক যাচ্ছে ভেসে এবং
ড্রেজার ঝন ঝন বেজে কাজ চলেছে
ভড় নৌকো খড়ের গাদায়
রণরণ
করছে রোদ
আবার ডুবছি ভয়ে ভাবছি এবার মাথা
ভাসালেই
দেখতে পাবো নিজের শরীর ভেসে যাচ্ছে, সোনা গলান
রোদ ফুটেছে সিপিয়া রঙ গঙ্গা
যেন এ্যাসিড হয়ে ফুটে উঠেছে
গাঢ় বাদামী বিষাদ ধোঁয়ায় ঢেকে
যাচ্ছে ব্রিজ।
ব্যাণ্ডমাস্টার
আমি অঙ্ক কষতে পারি ম্যাজিক
লুকিয়ে চক ও ডাস্টার
কেননা ভারি ধুন্ধুমার ট্রাম্পেটবাদক
ব্যাণ্ডমাস্টার,
তখন প্রোগ্রাম হয়নি শুরু- সারা
টেম্পল নাম্নী ক্যাবারিনা
তখন এমনি বসে ডায়াসের কোণে,
আমি ড্রামে কাঠি দেওয়ামাত্র
ওর শরীর ওঠে দুলে,
ড্রিরি- ড্রাঁও স্ট্রোকেতে দেখি
বন্যা জাগে চুলে,
তিন নম্বর স্ট্রোকের সঙ্গে নিতম্বতে
ঢেউ
চার নম্বর স্ট্রোকেতে ঝঞ্ঝা ওঠে
গাউনের ফীলে,
নম্বর পাঁচে শরীর আলগা, বুকের বাঁধন ঢিলে,
আম তখন ড্রাম বাজিয়ে নাচাই ওকে
মারি এবং বাঁচাই ওকে,
ড্রামের কাঠির স্ট্রোকে স্ট্রোকে
যেন গালাই , এবং ঢালাই করি
শক্ত ধাতু নরম করার
কাস্টার,
কেননা ভারি ধুন্ধুমার ট্রাম্পেট
বাদক গ্র্যাণ্ডমাস্টার,
আবার বাজাই যখন স্যাক্স চেলো
ক্যাবারিনার এলোমেলো
ডিভাইস এ দ্বন্ধ এলো
আমার বাঁশির সুরের সুতোয়
দেহের ফুলে মালা
ট্রা রালা লি রালা লা
ঠিক চাবি হাতে দেখি খুলে যায়
তালা।
আমি বাঘ
আপনাদের পোষা বেড়াল বাচ্ছাদের
সঙ্গে বাড়তে বাড়তে
মিউ মিউ ডাকের মধ্যে গর্জন করে
উঠেছি
হলুদ শরীরে ক্রমশ স্পষ্ট কালো
রেখাগুলোই বলে দিচ্ছে-
তুমি বেড়াল নও, তুমি বাঘ,
ট্রাপিজ ও ক্লাউনদের খেলা শেষে
জাল ঢাকা এরেনায়
আমি আমার অসম্ভব রাগ ও রোয়াব
নিয়ে গর্জন করবো,
আর তোমার চাবুকে ও শক-এ
নিয়ন্ত্রিত
খেলা দেখাব
তোমাকেই শুধু মানবো রিংমাস্টার।
হাসপাতালের কবিতা-১
হাসপাতাল ভালো লাগে না।
ডেটল ওষুধ হাওয়াকে আসতে দেয়
না।
সিস্টার ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে
দিন,
বাইরে থেকে ঘুরে আসব-
খুব দূরে নয় নদীর কাছে- কাছাকাছি
চলাচলের রাস্তার পাশে
প্রতিদিন যেখানে মানুষেরা কাঁদে
হাসে
সেতুর ওপর ছায়া- সান্ত্বনা
তার তলায় আমি কিছুক্ষন বসব
সিস্টার আমায় নিয়ে যান
যেখানে দিনের শুরু।
হাসপাতালের কবিতাঃ৩
রাত্রি গভীর হয়ে আসে
রাত্রি ভারী হয়ে আসে চোখের পাতায়।
রাত্রি কী কালো
এমন কালো রাত্রি দেখিনি কোনো
দিন।
সিস্টার, সব আলো জ্বেলে রাখুন
এখন আমি ঘুমাব।
আবার কবিতা লিখব
নতুন কবিতা
একটা কবিতা লেখার আগে
কিছুক্ষন ঘুমাব।
আবার কবিতা লিখব
পুরোনো কবিতা শেষ হলে।
হাসপাতালের কবিতাঃ৭
মাঝে মাঝে উদাসীন খুব সারাদিন
মাঝে মাঝে অভিমানী রাগ হয়
মৃত্যুর ওপর
আসছি এখনি বলে চলে গেছে সে ঘুর
পথে
বসে বসে বেলা যায় তার রেখে যাওয়া
ছাতার তলায়
একদিন আসবে রাতে
যখন থাকবো গভীর ঘুমে।
হাসপাতালের কবিতাঃ১০
এইবার গোড়া থেকে শুরু করব জীবন
এইবার জীবনকে পাটে পাটে সাজাব
অনেকদিন তার দিকে ফিরে দেখিনি
তার বায়নাক্কার পাত্তা দিইনি
তাচ্ছিল্য করেছি অনেক
চোখের জলের দাগ মুছিয়ে দিইনি
তাই তার এই প্রতিশোধ-
একা একা দিন গোনা
এইবার জীবনকে অতি সযত্নে সাজাব
ঘুম-হাসপাতালের থেকে বেরিয়ে
আমাকে আরো একবার সুযোগ দাও হে
নাথ।
একবার
যেমন সমস্ত সমুদ্রের সাধ একবার
............ফুঁসে ওঠে ঝঞ্ঝায়, জলস্তম্ভে
তেমনি তো একবার
...সমস্ত অমিল ভেঙ্গে ছুঁতে ইচ্ছা
তোমাকে কবিতা,
একবার মৃত্যু বাজী রেখে ঝাঁপ
ইচ্ছা করে
উন্মুখ অনেক নীচে কাঁচ ও পেরেক-এ
কোথায় রয়েছ বলো,
............এ জীবন ঝাঁকিয়ে খুঁজছি
কোথায় রয়েছ বলো, আমি বুক ফুটো করে
...রক্তে ছড় টেনে একবার একবারও
অন্ততঃ
.........সব সুর মেলাবো নিখুঁত
।
গতি
এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে
হঠাৎ হরিণ
তড়াং লাফিয়ে গেলে নিঃসঙ্গ চোখের
সামনে
খুলে যায় প্রত্যেক জানলা-
সিঁড়ির পর সিঁড়ি
বিপরীতে তীব্র ছোটে বিমানের
তলায় রানওয়ে
সেইখানে তবে পৌঁছনো যাবে ভাবতে
বুক
বুকের মধ্যে যন্ত্রপাতি রোম কূপে
কূপে
আনন্দের তেলঘাম বেরিয়ে আসে দেখি
এইবার
গুড়ি মেরে বসে থাকার মতো এতোদিন
হেঁটেছি জীবন
এইবার, এইবার ফিটফাট লাফ দেবো ভাবি
ঝাঁ চকচকে শরীরে, ভঙ্গিতে ঠিকঠাক এইবার
সব চাকা যায়, ফিরে আসে ফের আমি
ত্রিকোন সাধের দিকে চেয়ে বলি
ফেরো
নয়তো স্থির থাকো মধ্যযামে চাঁদমারী
হে জীবন, গুড়ি মেরে এতোদিন থেকেছি বসে
এইবার, এইবার ফিটফাট লাফ দেবো ভাবি
গম্ভীর চেয়ারে বসে, আঙুলে কফির কাপ
সামনের জানলায় প্রেশারকুকারের
শোঁ শুনতে
গুনতে সাত পাঁচ আঠারো বাইশ এইবার
উনুন উলটে কেটলির মতো উত্তাপে
শাসিয়ে
পৃথিবীকে হাসিয়ে ভালোবাসিয়ে
নেবো আমি।
ভালোবাসাঃ দুই
আমায় অপমান করে যে লোকটা
তাকেও আমি ভালোবাসি
এ ভাবেই ভালোবাসতে বাসতে
অপমান করি নিজেকে, তোমাকে , এবং
ভালোবাসাকে
এ ভাবেই ভালোবাসা পেয়ে যায়
ভুলভাল শত্রুমিত্র থেকে
শূন্য কলসী এবং ঘুঘু
যে লোকটা কাঠের ক্রুশ তৈরি করছে
অথবা যারা বানাচ্ছে পেরেক আমার
জন্য
তাদের দিকে তাকিয়ে জানতে পারি
আমিই সেই যিশু কিংবা কালোবাজারী
যাকে ঝোলানো হবে নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টে
তখন আমি ভালোবাসতে শুরু করি ল্যাম্পপোস্টকেও
।
ঋণঃ মলয় রায়চৌধুরী, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় , ভাস্কর চক্রবর্তী, গৌতম বসুমল্লিক, ভারবি।
মন্তব্যসমূহ