সে এক যুগ ছিল আমাদের। মানে বাংলা কবিতার। ক্লাসিক জীবন ছাপিয়ে, ক্লাসিক কবিতার পর তখন এক নতুন আকাশ... কোনও হিসেব মিলছে
না। কবিতার, জীবনের...
খিদে তো অনেক... আমাদের। খিদে তো অফুরান... তাঁর মাঝে সেই সব শেয়ালেরা ছুটে যাচ্ছে... দেখছি, চোখের সামনে দিয়ে কত নেতার বউ, ভাই, ছেলে, বউমা নেতা
হয়ে যাচ্ছে... কবিরাও কেমন দৌড়ে যাচ্ছে সততা আর না-সততার মিছিলে, চেয়ার মোছামুছির সে কি হিড়িক... চেয়ার দখলের... এসবের মধ্যে আমাদের একটা
থাপ্পড়।
তুষার আর ফালগুনী। দুই ভেতরের কথা। বাকিটুকু, পাঠক বুঝে নেবেন...
---তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
ফালগুনী রায়ের উপর লেখা সুবিমল বসাকের একটি গদ্য
ফালগুনী রায়। সে হতে চেয়েছিল ফালগুনী রায় । কবি ফালগুনী রায়
। নিজের আইডেনটিটিকে জোরদার করার প্রথম ধাপ: নাম। মাত্র
পঁয়ত্রিশ বছর এই পৃথিবীর ধুলো, রোদ,
বৃষ্টি, বায়ু-দূষণময় এই জগতে নিঃশ্বাস
নিয়ে বেঁচে ছিল সে । মৃত্যু ৩১ মে
১৯৮১। পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে থাকা বাস্তবিকই কঠিন। জীবিত থাকলে ফালগুনীর বয়স আমাদের সমান হতো। হয়তো
রেখে যেত আরো কিছু কবিতা/গদ্য/প্রবন্ধ । হয়তো এই কারণে
যে পরবর্তী সময়ে মেধা ও অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা-জাত বোধ তাকে কোথায় ঠেলে নিয়ে যেত
জানা নেই। কবি হিসাবে তার পরিণতি, মৃত্যু সময়াবধি, যা দেখেছি,
অস্বাভাবিক ছিল না । শহিদ নয়; আত্মহনন ছিল তার অভীপ্সা। জেব্রাদ্বিতীয়
সংখ্যায় প্রথম কবিতা প্রকাশের কালানুক্রমে, তার কবি জীবন মাত্র ১৩ বছর। এই ১৩
বছরে সে রেখে গেছে কিছু কবিতা, চিত্রনাট্য,
গল্প, সমালোচনা --- যা থেকে বাছাই করে
প্রকাশ করা হয়েছিল নষ্ট আত্মার টেলিভিসন , বাসুদেব
দাশগুপ্তের প্রকাশনায় --- ছোট, সাজসজ্জাহীন, আটপৌরে, ১৬ পৃষ্ঠা, হাফ
ক্রাউনে, চটি --- এই কবিতা-পুস্তক। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত ।
১৯৬৪-৬৫এর ভয়ঙ্কর অবস্হায়। হাংরি জেনারেশানের মামলা কোর্টে --- কেসের ডেট, অ্যডজোর্ন, অ্যাপিল, হীয়ারিং, সাক্ষি-ফরিয়াদি, দালাল-ফড়ে, পুলিশ-ফেউ, উকিল-পেঙ্গুইন, সোয়াল-জবাব, কাঠগড়া-আসামী-সরকারপক্ষ --- এসব মুদ্রার এক পিঠ; অপর পিঠে সাহিত্যিক ও সাহিত্য-নির্ণায়কদের ভ্রুকুটি, তৎপরতা, খুরপি হাতে সমূলে উপড়ে ফেলার সদিচ্ছা। আমরা তখন দিন-রাত ধিকৃত ও নিন্দিত। উপহাস, অবহেলা, উপেক্ষা, ব্যঙ্গোক্তি, অপমান, কটুক্তির
কালো পালক আমাদের মাথায় গজিয়ে উঠছে। এইরকম অবস্হায় , প্রতিকূল পরিবেশ, তেল বা
ঘামের ব্যবহার ছাড়া, হঠাৎ বল্গাহীন, উন্মত্ত, মেঘকৃষ্ণ আকাশের তলে, বেমক্কা ফসফরাসের মত জ্বলে উঠেছিল জেব্রা। মলয় আর আমি
গোপনে ছাপিয়ে আনতাম বহরমপুর থেকে, এই কারণে যে, কলকাতার
প্রেসে-প্রেসে টাউটদের উঁকি-ঝুঁকি ও ভ্রুকুটি বেড়ে গিয়েছিল। জেব্রা প্রথম সংখ্যা বার হবার পর, একদিন, তখন বিকেল, ফালগুনী
এসে হাজির আমার আস্তানায় যেহেতু যোগাযোগের ঠিকানা ঐ । আস্তানা
বলতে ১০ বাই ১০ চৌকো ঘর, দোকান বাইরের
দিকে বলে, প্রবেশ-প্রস্হানের সুবিধে ছিল বাধাহীন --- যা
ছিল আমার জ্যাঠামশায়ের ।রাতের আশ্রয় ব্যতীত অন্য সব দরকারি-অপ্রয়োজনীয় সারতে হতো
বাইরে ।
ফালগুনী ১৯, শীর্ণ, মাঝখানে সিঁথি-কাটা ঘন
কেশ , ভাঙা গাল, গাল জুড়ে ঘন
শ্মশ্রু, উপচে বেরুনো কন্ঠা, কোর্স
ধুতি এবং গলাবন্ধ লম্বা কালো মিস-ফিট গরম কোট । কোটটি, নিঃসন্দেহে ফালগুনীর নিজস্ব নয়, অন্তত কোটটির ঝুল ও ব্রেস্ট-সাইজ দেখে তর্ক করার অবসর ছিল না। পুরানো ও ব্যবহৃত, নিশ্চিত তার দাদার বা কারোর । প্রথম দর্শনে যা বিদ্ধ করেছিল, ভয়ঙ্কর, তা হলো ফালগুনীর চক্ষুদ্বয়। বস্তুত তা ছিল আয়ত --- উজ্জ্বল ও ভাষাময়, আমর্ম আবেগচঞ্চল করে তোলার মত প্রাণবন্ত, একগাদা
স্বপ্নের প্রতিফলন । সবে সে প্রেম
পেতে শুরু করেছিল, তারি ছটা ছিল
মুখশ্রীতে, দৃষ্টিতে, হাবভাবে,
চাল-চলনে । পরবর্তীকালে, ফালগুনী দাড়ি বাদ দিয়েছিল, চুলের
সিঁথি পরিবর্তিত হয়েছিল, আরও পরে, চোখের দৃষ্টিও হয়েছিল পোড়খাওয়া । প্রেম
সাফল্য অর্জন করেনি, ব্যর্থতা ঘিরে
ধরেছিল, সাময়িক । সেই
প্রেমিকা, গ্রহণ করেছিল এমন একজনকে, যার পটভূমি ছিল সুখী জীবন । অর্থাৎ
আমৃত্যু নিরাপত্তা, প্রচুর অর্থ,
স্বচ্ছলতা, বিলাস, জীবন উপভোগের আরো, আরও অনেক উপকরণ। ফালগুনীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না কোনোটাই, একমাত্র পূর্বপুরুষদের আভিজাত্য, বংশমর্যাদা
ছাড়া।নারীর রহস্যময়তা ও ব্যবহার, ফালগুনীকে একেবারে ধ্বস্ত করে ফেলেছিল।শুরু হয় নিজের মধ্যে খেলা, আইডেনটিটির উন্মোচন, নেশা,
গাঁজা, ভাঙ । পরবর্তীকালে নেশা করাটা ফালগুনীর রক্তে মিশে গিয়েছিল । নিজের 'ইগো' ঝালিয়ে নেবার জন্য,
ইমোশানকে সতেজ করার জন্য, নেশা একান্ত
প্রয়োজন, ফালগুনীর এইরূপ বিশ্বাস ছিল।
জেব্রা প্রথম সংখ্যা এবং
হাংরি জেনারেশানের লিফলেটগুলি ফালগুনীকে টেনে এনেছিল আমার কাছে । মনে পড়ে, সেদিন ফালগুনীকে নিয়ে
শেয়ালদা স্টেশানে বসে অনেকক্ষণ গল্প করি । ফালগুনী
সদ্য পাঠ-সমাপ্ত কবিতার গোছা থেকে একটি কবিতা দেয়, মাত্র একটি।জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যার প্রস্তুতি চলছিল, এবং ঐ কবিতা ছাপা হয়। পরে
আমাদের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । ফালগুনীর অন্য
কোনো পত্রিকার প্রয়োজন পড়েনি। হাংরি বা হাংরি
মনোভাবাপন্ন পত্রিকায় তার কবিতা, চিত্রনাট্য,
রিভিউ বেরিয়েছিল। গল্প-কবিতা, কৃত্তিবাস-এও ২/১টা।
ফালগুনীর দাদা তুষার রায়, কবি হিসাবে ছিলেন তখন প্রচারিত । তুষারের ঘোরাফেরা ছিল পঞ্চাশের কবিদের মাঝে, কৃত্তিবাস, দেশ-আনন্দবাজার, কবি-লেখকদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল, ফলে প্রশ্রয় ও
তোল্লাই দুটোই পেয়েছিলেন অপর্যাপ্ত। ফালগুনী ও
তুষারের মাঝে চরিত্রগত ব্যবধান ছিল পাতাল-আকাশ, দুজনেই নেশা-প্রিয়, নেশার পর তুষার হয়ে উঠতেন
এক্সট্রোভার্ট; ফালগুনী যেত নিজের খোলসে সেঁধিয়ে। এমনিতে স্বল্পবাক সে, প্রথম
সারিতে হুড়মুড় করে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল না বা গলা উঁচু করে চ্যাঁচানো । আকন্ঠ মদ গিলেও মাতলামো ছিল না । বস্তুত সে ছিল
প্রাসাদ-প্রতিম অভিমানী; অবহেলা অবজ্ঞা
সে হজম করে নিয়েছে নিরবে, কখনও বা তাকে গ্রাস করেছে
সাময়িক বিষণ্ণতা। তখন সে একা, নিঃসঙ্গ, মৌনগভীর।
তুষার ফালগুনীকে সহ্য করতে
পারতেন না । পটভূমি অজ্ঞাত । আপাত দৃশ্যে পারিবারিক হিসেবনিকেশ থাকতেও পারে । একবার
আমি আর ফালগুনী কফিহাউস থেকে বেরিয়ে নিচে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়েছি, উল্টোদিকের ফুটপাতে তুষার । হঠাৎ
সিটি মারার শব্দ; তুষার ছুটে
এসে ফালগুনীকে -- "কে সিটি মেরেছে ? অ্যাঁ? কে সিটি মেরেছে?" ওঁর ওই মারকুটে মুখ
দেখে ফালগুনী চুপ, আমিই বললুম অগত্যা -- "জানি না। ওদিকে হয়তো বা"। "ও, হ্যাঁ।" তুষার ফিরে যান। এ-ধরণের অযথা, অনাবশ্যক, নানান ব্যাপারে
ফালগুনীকে হেনস্হা হতে হতো । ফালগুনী ও
তুষারের কাব্যভাবনা আলাদা ছিল । যদিও নেশা, যথেচ্ছাচার দুজনকেই মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল । প্রেম, ভালোবাসা, অভিলাষ ও আকাঙ্খার প্রতি অক্ষমতা, যা ফালগুনীর
কবিতায় হাহাকার তুলত, যা মূলত অপুরণের অক্ষমতা -- দ্বিধা
ছিল কতদূর নিয়ে যাবে তাকে । ফালগুনী তখন
কবিতা নির্মাণের ব্যাপারে সিরিয়াস। পরবর্তী সময়ে
নেশা এবং অসুখ তাকে বিছানাশায়ী করে ফ্যালে । এই সব ছাপিয়ে
কবিতা নির্মাণের ব্যাপারটা সে, বলাবাহুল্য,
অবহেলা করে গেল একরকম। ব্যক্তিগত
সুখ ও তৃপ্তির অভাব তাকে চাতালহীন ধরার ওপর নাচিয়ে ছেড়েছে; যন্ত্রের, ভোগহীনতার দুঃখ,
নিজেকে পাপ-পূণ্যের দাঁড়িপাল্লায় তোলা, অপাংক্তেয়
ও ফালতু ভাবা।
মুদ্রার অপর পিঠ আড়াল করে
রাখা হয়।সুজলাং সুফলাং মলয়জ শিতলাং-- অথচ এই কলকাতার বাস্তব রাস্তায় রেশন ও
কেরোসিনের জন্য দীর্ঘ লাইন, ফুটপাথে
হাজার-হাজার পাথুরে বিছানা, রেল-লাইনের ধারে-ধারে ঝুপড়ি ও
চুল্লুর ঠেক, স্পল্যানেডে সন্ধের সময় দালাল ও ছিনতাইবাজ,
হাইরাইজ বিল্ডিঙের গোপন কক্ষে মৌ-মক্ষিকার চাক-জমাট মধু, প্রকাশ্য দিবালোকে খুন ও বোমাবাজি, বিজ্ঞানসন্মত
রিগিং, ঘুষ ও কালোবাজারি, বধুমাতা
ও যৌনকর্মীর সদৃশ আচার, ভিখিরির মিছিল ও চাঁদা আদায়কারী
-- রেশানালিজম ও রোমান্টিসিজম, বহুদিন আচ্ছন্ন করে
রেখেছিল বাংলা সাহিত্যকে । এইসব আচ্ছন্নতা, চটচটে ব্যাপার গোড়ালি থেকে তুলে ফেলার কৃতিত্ব ফালগুনীর। ভাষা এবং তেজ বাদ দিয়ে পোস্টমডার্ন সাহিত্য হয় না।
ফালগুনীর কোনো হাতঘড়ি ছিল না, রোদ-চশমা ছিল না, আংটি ছিল না
-- সব সে বিক্রি করে দিত, অবলীলায়। তারপর মদ -- নেশা। সাফাইযোগ্য জিনিসপত্তর বাড়ি থেকে
হাতে করে নিয়ে আসত, শেয়ালদা
সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে হাতবদল হয়ে যেত। তার
নিজস্ব কোনো বই ছিল না । জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যা সবে
বেরিয়েছে, ফালগুনী প্রস্তাব দিল সেলিব্রেট করার,
পকেট সংক্ষিপ্ত টের পেয়ে জেব্রার কপি নিয়ে মেট্রো সিনেমার সামনে
দাঁড়িয়ে পড়ি । মৃনাল সেনের ফিল্ম শেষ, আমাদের হকারি শুরু । জেব্রা
বিক্রি করে দারুন সেলিব্রেট করেছিলুম।
ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রগতি কিছুই আর পৃথিবীকে বদলাতে পারেনি বিশেষ, ঘুরে-ঘুরে মানুষের জিভ বদলানো ছাড়া আর কিছু বদলায়নি। মৈত্রী, শান্তি, আদর্শ , সদভাবনা, সদাচার
-- এই সকল বড়-বড় বুকনি মানুষকে, মানব সমাজকে, পাথর করতে সাহাজ্য করেছে। ভুল জীবন, ভুল সংঘাত, ভুল ধারণা, ভুল পরিণতি। অনেকের ধারণা
ইতিহাস মানে প্রগতি । ওটা ভুল। একটা
সভ্যতা জন্মায়, বড় হয়, পালটায়। সংস্কৃতি বলতে
বোঝায় এই মুহূর্তের ব্যাপার, এখনকার। সংস্কৃতি ফুলের মত, নিজের ইচ্ছাতেই
বাড়ে এবং ঝরে যায়। সংস্কৃতি মরে গেলে তা সভ্যতা হয়ে
যায়। সভ্যতা মানে শৃঙ্খলা । সভ্যতা
কৃত্রিম। কিন্তু সংস্কৃতি কৃত্রিম নয়।ধর্ম মানে
মৃত্যুবোধ।
আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান,
আমি পার্সি এরকম ধারণা ভুল। আমি
সমস্ত ধর্মেরই লোক। যেহেতু আমি একটা সম্প্রদায়ে
জন্মেছি, তাই সেই সম্প্রদায়ের মৃত্যুবোধের ওপর
নির্ভর করে আমার নিজস্ব জীবনদর্শন। পরম্পরা মানে
অতীতের গুণগুলোকে কেবল গুরুত্ব দিয়ে যাব তাতো ঠিক নয়, অতীত গুণকীর্তন করে বেঁচে থাকলে ডায়নোসরের মত লুপ্ত হয়ে
যেতে হবে।কবি বা সাহিত্যিক ভবিষ্যৎবক্তা, দ্রষ্টা, ভিশনারি । নিজের চেতনাই প্রত্যেকের কাছে চূড়ান্ত ও ধ্রুব । স্ব-চেতনাকে
বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যেই মাদকের ব্যবহার, বলতেন ফালগুনী।
ফালগুনীর কবিতা-প্রকাশ শুরু
ষাট দশকের প্রথমার্ধে । সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল
সক্রিয়। যদিও সে পরিচিতি লাভ করে সত্তর দশকে, কারণ এই সময়ে সে খুঁজে পেয়েছে তার হাত-পা রাখার জায়গা। তার সমসাময়িক কবিরা যখন গাদাগাদি কবিতা নিয়ে ঝুলন্ত বাসের হাতলে, ফালগুনী তখন রাস্তার একধারে, ধুলো-ওড়া
গাছতলায় দাঁড়িয়ে।সমকালীন কবিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, চোখে পড়ার মত আলাদা, হুড়মুড়ে প্রবাহ থেকে
পেছনে। তার কবিতার মনোভূমি, জীবনদর্শণ, চেতনা, উপলব্ধি, উপস্হাপনা, স্বাতন্ত্র্যে
ঝকঝকে।
নিজেকে সে অশিক্ষিত মনে করত, বোদা, এই কারণে যে, চুরির সপক্ষে যে যুক্তি খাড়া করতে পারে সেই এলেম ওর ছিল না। দৈনন্দিন ও জাগতিক জীবনের, জীবন
সংক্রান্ত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা, অনুভুতি, সর করায়ত্ত করেছিল, এবং তা থেকে পাওয়া শিক্ষাই
সে চুড়ান্ত মনে করত, এবং সে-প্রাপ্তিই ছিল তার
আত্মপ্রকাশের সিংদরোজা । জীবনের অভিজ্ঞতা
থেকে বেরিয়ে এসেছে কবিতা, জীবনেরই ফসল
-- জীবনের মত অপরিবর্তনীয় । আমাদের সঙ্গে
মেলা-মেশা, দিবারাত্রি, কলকাতার ভিড়পথ, নির্জন রাস্তা পরিক্রমা,
বিভিন্ন লোকেদের বাকচাতুর্য, ভুল ধারণা,
গ্রন্থ থেকে উঠে-আসা আক্রমণাত্মক কোনও ধারণা -- এসব সাহায্য
করেছিল তাকে নিজস্ব , একেবারে নিজস্ব, ভাষাজগত এবং ভাষাপৃথিবী সৃষ্টি করার; লক্ষণীয়,
কবিতায় তার নিজস্ব উপলব্ধি । নেই কোনও
ভাবাবেগ, বা ছিলছিলে রোমান্টিকতা, বা নিসর্গের আকাশবাণী, এবং আমরা পাই
পোস্টমডার্ন, ক্রুর, খসখসে,
নির্মম, লেপাপোছা, উবড়ো-খাবড়া, কাঁটাতার, নুড়িবালি ছড়ানো-ছিটানো। যদিও, অভিজ্ঞতার এলাকা ব্যাপক ছিল না , সীমাবদ্ধ, বাঁধাধরা গন্ডীর মধ্যে বাস্তবতার
ঘেরাটোপে, অথচ কী অমোঘ ! তার জীবনে প্রেম-প্রেমহীনতা,
সাফল্য-ব্যর্থতা, ক্রোধ-আকাঙ্খা,
উথ্থান-পতন, আন্তরিকতা-দুৎকার, হাহাকার- উচ্ছলতা, সন্দেহ-বিশ্বাস, সুস্হতা-অসুস্হতা, দুঃখ-আনন্দ, বিষণ্ণতা-সুখ, উপদেশ-গালাগাল, শিষ্টতা-আভদ্রতা, শ্লীলতা-অশ্লীলতা, সহজ-জটিল সব কিছু সে আগাপাশতলা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে, তুলে ধরেছে নিক্তির কাঁটায় ।
আভিজাত্য ব্যাপারটা ফালগুনীর
একেবারেই ছিল না, অথচ থাকার কথা
তারই।হামরা হাংরি আন্দোলনে অধিকাংশ উঠে এসেছিলাম নিচের তলা থেকে । অভিজাত শব্দোচ্চারণ যা আমাদের দৃষ্টিপথে এসে দাঁড়ায়, তার সঙ্গে সম্যক পরিচয় আমাদের অনেকেরই ছিল না। আত্মীয়-স্বজনদের নামোল্লেখ করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করার মত কিছু ছিল না। আমরা নগর-শহরের বাসিন্দা ছিলাম না। আমাদের মুখ থাকত
কাঁচুমাচু, কফিহাউসের টেবিলে বিদেশি
লেখক-কবিদের নাম শুনে আমরা থৈ-হারা হয়ে পড়তাম। আমাদের
পকেটে রুমাল ছিল না, চুলে কখনও বা
সরষের তেল, শার্টের তলায় ছিন্ন নোংরা গেঞ্জি, ঠোঙায় মুড়ি-তেলেভাজা চিবোতে-চিবোতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতাম, পিরিচে চা ঢেলে সুরুৎ-সুরুৎ শব্দে পান, ভিটামিনের
অভাবে ঠোঁটে খড়ি, টিউশানিতে চা-বিস্কুটের প্রত্যাশা,
খুঁটি নেই, সুপারিশ নেই, প্রেম করার আর্টও রপ্ত করিনি।
ফালগুনীর ছিল বনেদি
ব্যাকগ্রাউন্ড। অথচ আর্থিক অবনতি তাকে ঠেলে
নামিয়ে দিয়েছিল একেবারে সাধারণ পর্যায়ে। অবলীলায়, অতি সাবলীল, স্বচ্ছন্দে সে সব
কিছুকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই যে
ধ্বংসের প্রকোপ -- তার জানা ছিল পরিণতি । এই ধ্বংসের
পরিণামে সহজেই সে টের পেয়েছিল গোপন সূত্র -- যে সূত্র তাকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিল। রাস্তায় সহজভাবে সে রিকশওয়ালার কাছ থেকে খৈনি চেয়ে ঠোঁটে গুঁজে নিত, দেশি মদের টেবিলে পাশে-বসা শ্রমিকের ঠোঙা থেকে ভেজা
ছোলা-আদা তুলে নিতে তার কোনো দ্বিধা বা সংকোচ ছিল না। সচেতন
ছিল বলেই সে মিথ্যা ভড়ং বা ভুল অহমিকা থেকে সরে এসেছিল।
স্নান না করে অনায়াসে দিন
কেটে যায় দেখে সে স্নান করেনি কতদিন। যে বর্ধিত নখে
রমণীকুলের পালিশ ঝকঝকিয়ে ওঠে, ফালগুনীর
বাধাহীন সেই নখ বাড়তে দিয়েছে হাতে-পায়ে, ময়লা জমেছে নখে,
কানের গর্তে, গলার ত্রিবলিতে, ঘাড়ে, কন্ঠায়, কনুইয়ে,
চামউকুন লেপ্টে থাকেছে -- কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। চুলে তেল পড়েনি, রুক্ষ,
শন, দশ বা পাঁচ আঙুলের চিরুনিদাঁড়া
কিছুটা এলোমেলো বিন্যস্ত করে ; দাঁত মাজেনি কতদিন,
পিচুটি দেখা গেছে কতদিন -- এই নয় যে এসব ব্যবহার তার ইচ্ছাকৃত --
কবি হতে হবে বলে এই সব, যেমন কফিহাউসে কবিদের কন্ঠস্বরের
পরিবর্তন, অস্বাভাবিক বলার ভঙ্গিমা, কাব্যপাঠের স্বরপ্রক্ষেপ, ছুঁচালো ও সরু
ঠোঁটের ব্যবহার, চোখের চাউনি, পালিশ
চকচকে মুখ, এনামেল দাঁতের হাসি, সিগারেটে
ঠোঁটের বিচিত্র স্টাইল -- এসব ফালগুনীর ছিল না। শরীর
চর্চা বা দিনচর্যা নিয়ে কখনও ভাবিত হয়েছে বলে মনে হয় না । সংবাদপত্র
না পড়েও দিন অবলীলায় অতিক্রম করে বলে সংবাদপত্রও ছুঁয়ে দেখেনি কতদিন। আরোপিত নয়, ঐ ধরণের
জীবনযাপনে স্বচ্ছন্দ বোধ করত নিশ্চয়ই। দৈনন্দিন
নির্দিষ্ট কোনো রুটিন ছিল না, বন্ধু-সহমর্মীর
বাড়িতে রাত কাটাত মাঝে-মাঝে । কন্ঠস্বর ছিল
শ্রুতিকটু, বলা চলে ফ্যাসফ্যাসে। অথচ রাস্তায়, হাঁটা-চলাকালীন,
যখন সে খুব আনন্দিত হতো, গেয়ে উঠত
রবীন্দ্রসঙ্গীত । প্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, দারুন ভক্ত। প্রিয়
পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কট্টর
সমালোচকও বটে। ফালগুনীর তখন যৌবন; নিহিলিস্ট নয়, অন্তর্ঘাতক
মনে-হৃদয়ে, এসময়ে অহংকে শাসনে রাখা সম্ভব নয়।
নৈরাজ্য ছিল না ফালগুনীর মনে
ও হৃদয়ে; অভাব ছিল বটে -- আর্থিক অনটন,
নিরাপত্তার অভাব, প্রেমের অভাব, পোশাকাদির অভাব, সাংসারিক সুখের অভাব -- এসবই
ছিল তার, তবু সব কিছু উপেক্ষা করার মত দুর্দমনীয় আত্মা
ছিল তার, ব্যবহারিক জীবনে জীবিকার জগৎ বলতে তার কিছুই ছিল
না । জীবিকার জগৎ থাকলেই এসট্যাবলিশমেন্টের
প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। শতধা বিভক্ত এসট্যাবলিশমেন্টের
ধারা-প্রণালীর মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে মানুষের শিরদাঁড়া বেঁকে নুয়ে পড়ে । গভীর সংকট থেকে উদ্ধারের প্রয়াস মানুষকে এই ভাবে এসট্যাবলিশমেন্ট-বিরোধী
করে তোলে। বিকল্প-ভাবুক করে তোলে।
ফালগুনী ছিল ভয়ানকভাবে একা । ফলে, ভাবনা-চিন্তার সময় ছিল
অফুরন্ত । বাড়িতে থাকলে, দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, কখনও
বি.টি.রোডে সেন্ট্রাল লাইব্ররি, পকেটে দু'টাকা নিয়ে বিকেলের আগে কলেজ স্ট্রিটে, বাসভাড়া
ফাঁকি দেবার সচেষ্ট প্রয়াস, পাতিরামে পত্র-পত্রিকা
নাড়াচাড়া । স্টলে দাঁড়িয়ে সে বহু মূল্যবান ও
প্রয়োজনীয় রচনা পাঠ করেছে; তারপর কফিহাউস।কফিহাউসের
পরবর্তী অধ্যায় হল নানান ঠেক । ফেরার ভাবনা --
পাথেয় সম্পর্কে কোনোরকম চিন্তা ছিল না।
নিঃসঙ্গ থাকার ফলে নিজের
মধ্যে ঘোরা-ফেরা, বলা চলে নিজের
মধ্যে সেঁদিয়ে যাওয়া ও মগজ-ভ্রমণ -- এই প্রবণতা থাকার ফলে তার নিঃসঙ্গতা, বা একাকী থাকাটা তাকে কাতর করেনি তেমন, পরিচিত
বা বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল হাতে-গোনা, তেমন সামাজিকতাও
ছিল না তার। পাড়ার ছেলেবেলাকার সঙ্গী, কলেজের সহপাঠী এবং যৌবনের আমরা কয়জন।
সে ছিল ইমসমনিয়ার রোগী । রাত দুটো-তিনটে ওব্দি পত্রিকা-বই নিয়ে, মুখে সিগারেট, ধোঁয়া -- হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে
গেলে, এরকম দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ত। রাত পেরোলে পরদিন, কিংবা রাত ঘন
হচ্ছে দেখে, 'যচ্ছি-যাচ্ছি' করে
যখন বেরোতো -- বাস বন্ধ। গভীর রাত, স্তব্ধ পরিবেশ, জনমানুষহীন পথ,
গোনাগুনতি যানবাহন, হৈচৈ নেই, একা-একা ভুতের মত রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, এ-দৃশ্য
অনেকের দেখা। শীতে, কুয়াশা-ঘেরা, লম্বা কোট পরনে,
রহস্যময় প্রতিচ্ছায়া নিয়ে ফালগুনী চলেছে । কুকুরের কোরাস-চিৎকার, লরি
যাতায়াতের জোরালো আলো ও আওয়াজ, হঠাৎ-হঠাৎ পাগলের/মাতালের
আবির্ভাব, সি.পি. লেখা কালো পুলিশি ভ্যানের ছুটে যাওয়া। এমনকি, ৭০-৭১ সালে, বরাহনগর-কাশীপুর যখন সংবাদপত্রের হেডলাইন, ফালগুনীর
তখনও একই চলা-ফেরা ।
পাটনায় এক অন্য ফালগুনী । পাটনায় তার দিদি ও ছোটবোন থাকতেন । আর ছিলেন
ফালগুনীর প্রেমিকা, যাঁর ওই শহরে
বিয়ে হয়েছিল। কলকাতায় শরীর যখন ভয়ানক দুর্বল
হয়ে পড়ত, মনে গভীর অবসাদ, দিন-যাপন এক ভার-স্বরূপ, তার মা তখন ফালগুনীকে
পাঠিয়ে দিতেন দিদি-জামাইবাবুর কাছে, পাটনায়। ফালগুনীর জামাইবাবু মলয়ের কলেজের অধ্যাপক ছিলেন; লোহানিপুরে থাকতেন। পাটনায়
ফালগুনী সুস্হ এ একা। প্রকৃতপক্ষে একা। কোনও সঙ্গী নেই, সহমর্মী নেই। সমীরদা, মলয় সেখানে থাকলে, ফালগুনী তাদের কাছে, আনন্দে। আমি পাটনায় গেলে সে হাউইয়ের হতো আমার ওখানে. লোদিপুরে, যে পাড়ার পটভূমি আমার বহু গল্পে। যদ্দিন আমার থাকা, ফালগুনী
ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর, মনের কথা, নতুন কবিতা রচনা ও পাঠ।ফণিশ্বর রেণুর ফ্ল্যাটে যখন তাকে নিয়ে যাই, গরমকাল, কাটগ্লাসে ছাঁকা তাড়ির
ওপর ছোটোএলাচ গুঁড়ো দিয়ে ছড়িয়ে আড্ডা। আমার
গরহাজিরাতেও হাজির হতো মাঝে মধ্যে, কখনও বা মলয়ের সঙ্গে; রেণুর ফ্ল্যাটে গেলে,
গ্রীষ্মকাল বাদে, মল্টেড হুইস্কি।
পাটনায় এগজিবিশান রোডের মোড়ে
কফিহাউসে, একটি কোণে বসতেন রেণুজী, যেটি রেণুজ কর্নার নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিল।টেবিল ঘিরে আমরা, সমীরদা, মলয়, অলোক ধনওয়া, রাজকমল চৌধরী ও অন্যান্য হিন্দি
লেখক। বিহারের রাজ্যপাল দেবকান্ত বড়ুয়ার
ভাই নবকান্ত বড়ুয়াপাটনায় এলে আসতেন রেণুজ কর্ণারে। আমাদের
কবিতা পড়তে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। ফালগুনীর
কবিতাগুলো স্বভাবতই ছিল অন্য রকম, পাঠভঙ্গীও
গতানুগতিক নয়। রেণুজী হিন্দিভাষীদের জন্যে
মুখে-মুখে অনুবাদ করে শোনান। রাজ্যপাল-ভবনে
হাংরি কবিতাকে কারোরই অশ্লীল মনে হয়নি।নবকান্ত বড়ুয়া এরকম কবিতার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না; ফালগুনীকে তিনি অত্যাধুনিক ও ক্রেজি বলেন।
পাটনায় ফালগুনীর জন্য তার
দিদির চিন্তা ছিল, দায়িত্বও। ওর কোনো খবর না পেলে মলয়ের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন, বকুনি দিতেন মলয়কে। পাটনায়
আমরা ভাঙের পকোড়া হাতে গল্প করতে-করতে কখনও গান্ধী ময়দানে, কখনও মহেন্দ্রুঘাটে, কখনও
গোলঘরে, কখনও বা শ্মশানে চরস ও মৃত্যুবোধের খোঁজে।দুজরা শ্মশান
ছিল আমাদের বাড়ির কাছে, গঙ্গার ধারে। ফালগুনীর স্বাস্হ্যের কিছুটা উন্নতি হত, অনিয়ম সত্তেও। সবচেয়ে বেশি
লক্ষণীয় ছিল ফালগুনীর দরোজাখোলা কথাবার্তা, প্রেমিকার সম্পর্কে, শরিকি বাড়ির খেয়োখেয়ি
সম্পর্কে। পাটনায় তবু ফালগুনী কিছুটা
দুর্নাম কুড়িয়েছিল।ছোটো শহর, বাংগালিবাবু-সমাজের
ছেলে কিনা কংকরবাগ তাড়ির ঠেকে বসে তাড়ি খায়। ছিঃ ছিঃ। পাটনার যত্র-তত্র মলয়ের সঙ্গে যেতো, কিন্তু মলয় সেসব কথা লেখেনি এখনও পর্যন্ত।সম্ভবত ১৯৭৪-এ ফালগুনীর অন্তিম
পাটনা বাস, কেননা মলয় তখন হাংরি
মকদ্দমাকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত, ও
দূরত্ব গড়ে ফেলেছে ; পাটনা ছেড়ে মলয় রওনা দিয়েছে লখনউতে
থাকার জন্য।
মাঝে-মাঝে ফালগুনী অবশ্য
বে-রুটিন হয়ে দিদির বাড়ি থেকে গৃহছাড়া হতো। কখনও গান্ধী
ময়দানে, কখনও বা পাটনা রেলওয়ে স্টেশনে,
কখনওবা মহেন্দ্রুঘাটের জাহাজি পাটাতনে। কখনও বা ওর শয্যা ফুটপাতের পাথুরে বিছানায়।


হাংরি আন্দোলনের সময়ে আরো
কয়েকটি আন্দোলন হয়েছিল ভারতবর্ষের নানা ভাষায়।বাইরেও।প্রতিবেশি নেপালে ঘটেছিল 'রালফা' আন্দোলন।রালফা ও
হাংরিদের নিয়ে সমীরদা (রায়চৌধুরী) একটা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, নকশাল নেতা কাঙ্চনকুমারের সহযোগীতায় বেনারস থেকে,
হিন্দি কবি নাগার্জুন-এর অভিভাবকত্বে।রালফার নেত্রী
ছিলেন পারিজাত,অসামান্যা সুন্দরী, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।মলয় এই পারিজাতের প্রেমে পড়েছিল, এবং ওর বেশ কিছু কবিতা পারিজাতকে নিয়ে লেখা; পারিজাতও ওর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু
সে-গল্প মলয় কোথাও লেখেনি এখনও। কাঠমান্ডুতে
আমাদের সদলবলে অভিজান তাঁকে বেশ উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত করেছিল।আমরা মহিষের কাঁচা মাংস 'কাচিলা' এবং দিশি নেপালি মদ
'এলা' খেয়ে পারিজাতের আড্ডায় বহু রাত
কাটিয়েছি; আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন নেপালি অ্যাকাডেমির
কর্ণধার বাসু শশী। নেপালে আমাদের মাসাধিক থাকার ও
যথেচ্ছাচারে কাহিনী নিয়ে একটা পৃথক লেখা হতে পারে।সেই পারিজাত, বিমল রালফাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে উড়ে এসে হাজির
আমার আস্তানায়।ত্রিদিব মিত্র আর আমি তাঁদের তুলে আনি দমদম বিমানবন্দর থেকে -- বেলঘরিয়ায়। ত্রিদিব থেকে যায় আমার বাসায়, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার সেই রাতে অতি আকস্মিকভাবে ফালগুনী এসে হাজির।
তখন আমার ঘরের ডানদিকে ছিল
সবুজ ঘেরা মাঠ, অনেক গাছ-গাছালি, পাখিদের আপিলা-চাপিলা, রাতে ঝিঁঝি, একনাগাড়ে চেয়ে থাকলে চোখ সবুজ হয়ে পড়ে, দূষণমুক্ত
বাতাসে বুক ফুলে ওঠে। অথচ মাঝে-মাঝে ঐ
১৯৭১-৭২ সালে, মাঝরাতে, নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে, কখনও সন্মিলিত
পদশব্দ, দীর্ঘশ্বাস-প্রশ্বাস, চাপা
কাতরানি। ঘুম ভেঙে গেলেও কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে
হতো। ফালগুনীও ছিল তেমন একটি রাতে।পরদিন সকালে সূর্যের আলোয় শুধু
মাটির চাড় ছাড়া আর কিছু লক্ষিত হয় না। বছর ছয়-সাত পরে, যখন বাড়ি তৈরির জন্যে ভিত খোঁড়া হচ্ছে, একাধিক কঙ্কাল, শরীরের খাঁচা। হাতে একজনের লোহার বালা ছিল।
ফালগুনী পারিজাতের ইনটারভিউ
নিতে শুরু করে। 'শিরিষ কা ফুল' উপন্যাসের লেখিকা পারিজাতে
পাহাড়ি টোনে উত্তর দিতে থাকেন। তাঁর কন্ঠস্বরে
মাদকতা ছিল। ফালগুনী উঠে দাঁড়ায় অসমাপ্ত
সাক্ষাৎকারে। "আসছি, রথতলা
থেকে..."। কাঠমান্ডুতে আছে সন্তুলা, জাঁড়; কলকাতায় বাংলা, মা-কালী। ফালগুনী গেল রথতলায়, রথতলায় ছোট্ট গুমটি, যদিও
বেআইনি, সেই যে গেল, পরদিন দেখা
গেল বরানগরে। ইনটারভিউয়ের কাগজ আর পাওয়া যায়নি।
আমাদের কয়েকটি গোপন ডেন ছিল, যেখানে যাওয়া-আসা হত, খালাসিটোলা
বন্ধ হবার পর, নাইট শোয়ে। এখনও চোখ
বুজে, খুললেই দেখতে পাই ফালগুনীর তৎপরতা,
গেলাস হাতে, বগলে বোতল। খালাসিটোলায়, খেতে-খেতে সময়
অতিক্রান্ত হলে কালীদা এসে তাড়া দিত -- গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। কাউন্টারের সামনে তখন দাঁড়িয়ে কমলকুমার মজুমদার, সঙ্গে কয়েকজন। ঠুমরি
নিয়ে আলোচনা। কমলবাবু মলয়কে ওর মকদ্দমায়
১০০টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। খালাসিটোলায় তখন
আমাদের ওঠার লক্ষণ নেই দেখে এক-এক করে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হতো। শুধু
একটি বাতি মাঝখানে। ফালগুনী নেশাগ্রস্ত অবস্হায় বলে
উঠত, "কালীদা, আপনিই তো অন্তর্জলী যাত্রার হিরো। আপনাকে
দেখেই তো কমল মজুমদার ঐ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন"।তবুও কালিদার হাত থেকে রেহাই
পাওয়া যেত না, হুমকি দিয়ে তুলে দিতেন
আমাদের, ওনার "বাউন্সাররা" ওনার হুকুমের
অপেক্ষা করত।
বেরিয়ে কখনও জ্যোতি সিনেমা
হলের পেছনের ডেন-এ। কফিহাউস থেকে বেরিয়ে কলেজ
স্ট্রিট-মার্কেটের পেছনে গাব্বুর ঠেকে। গাব্বুর আসল নাম
ছিল মোহম্মদ সিরাজ, বিহারের লোক,
মলয়ের চেনা।আমাদের সাপ্লাই করত 'বাংলা' -- একটু বেশি দামে। গরমকালে পাওয়া যেত তাড়ি, টক,
অথচ নেশা হতো প্রচন্ড।আর আমরা খেতাম পরোটা, রুটি, এবং হরেক মাংসের টিকিয়া,
চাপ। আমাদের মধ্যে
সুভাষ আর শৈলেশ্বর ধর্মের কারণে গরুর মাংস খেত না, ওরা ডিম খেত।মদের সঙ্গে গাঁজা বা সিদ্ধি খেত না ফালগুনী। বড়বাজারে সত্যনারায়ণ পার্কে, সিদ্ধির দোকানে ও ছিল রোজকার খদ্দের। ভাঙের
গুলি বা সিদ্ধির সরবৎ ছিল লোভনীয়।
ফালগুনীর বাড়ি ছিল বিশাল, অনেকটা জায়গা নিয়ে, সামনে
বিশাল ফটক, ফটকের মাথায় মৃত্তিকা-কেশরী। গেট পার করে অনেকটা হেঁটে প্রথমে মন্দির, পেরিয়ে গাড়িবারান্দা, রেনেসঁসের দিনে ভক্সৌল
গাড়ি থাকত, তারপর সদর। কলকাতার
প্রাচীন বনেদি বাড়ির মতই তার নকসা, নির্মাণ, কারুকার্য, বড়-বড়
থাম-খিলান, মেঝেতে ইটালিয়ান মার্বেলের চৌকোপাথর --
খাপচা-খাপচা তোলা। পরে জেনেছিলাম তা থেকে পাথর তুলে
বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। ভেতরে চারধারে বারান্দা, সামনের ঘর, বন্ধ-কপাট, ভাড়াতেদের দেয়া ও গুদামি হিসেবে ব্যবহৃত। স্যাঁতসেতে
অন্ধকার।
বাঁ ধার ঘেঁষে দোতলায় ওঠার
সিঁড়ি, শালকাঠের সিঁড়ি।চওড়া বারান্দায়
লোহার ঢালাই-করা রেলিং, বিশাল-বিশাল
কক্ষ, মানুষের সমান দেড়গুণ উচ্চতার দরোজা-জানালা। বাঁ ধারে ফালগুনীর মা যে-ঘরে থাকতেন, মাঝখানে ছিল মান্ধাতা আমলের বিশাল পালঙ্ক, পায়া
ছিল লম্বা, বিছানা ছিল মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে।
দোতলার জলসাঘর ছিল বিশাল
আয়তনের। ফালগুনী বলত, এখানে কবিতা-পাঠের একটা মুজরো করা যেতে পারে।ঐ জলসাঘরে
অনায়াসে শ-দুয়েক শ্রোতা-দর্শক বসতে পারে। দেয়াল ছিল
ম্যাড়মেড়ে, চুনের ছাপ পড়েনি এক শতক,
মামড়ি খসার মত দেয়ালের গতর থেকে খসে পড়ছিল চুন। দু-একটা ধুলো-মাখা বিশাল অয়েল-পেইনটিঙ ছিল, যা দেখে সহজে তখনকার জমিদারদের অবস্হা টের পাওয়া যায়।হাংরি আন্দোলনের
পেইনটারকরুণানিধান মুখোপাধ্যায় বলেছিল, এরকম দেয়াল পেলে সাইকেডেলিক আর্টে ভরে দেয়া যায় । আর আলাস্কার তরুণ বিটনিক লেখক ও
শিল্পী ট্রেশম গ্রেগস্রেফ আওড়াতে থাকে -- "ফ্যানটাসটিক. ফ্যানটাসটিক"।ফালগুনী ওকে
খোঁচাচ্ছিল, "ডু ইউ নো ওরিয়েন্টাল
আর্ট ? নো ওরিয়েন্টাল আর্ট, স্যাম
?" ওর মায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ফালগুনী --
আমরা ছিলাম নিমন্ত্রিতজন।
বেনারস থেকে হাংরি চিত্রকর
করুণানিধান, সঙ্গে আলাস্কের ট্রেশম
গ্রেগ এসে হাজির এক সকালে বেলঘরিয়ায়। আমি পাটনার ছেলে
জেনে ফালগুনীর মা বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। ফালগুনীর
সেজদি, যিনি ফালগুনীকে অপরিমিত স্নেহ করতেন,
অসুস্হ হলে যিনি চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে উঠতেন, বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত জেগে থাকতেন দরোজা খোলার জন্য, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতেন না, ছটফট করতেন,
ফালগুনীর ভালো-মন্দের দিকে তিনি সবিশেষ লক্ষ রাখতেন। এই সেজদির পক্ষপাত ফালগুনীকে উৎসাহী করে তুলত। মনে আছে, আমরা চারজন ফালগুনীর মায়ের ঘরে মেঝের ওপরে বসে
খেয়েছিলাম, পরিবেশনায় সেজদি। খাবার
শেষে একসময় তিনি ফালগুনীর কবিতা সম্পর্কে জানতে চান। পরে
কিছুটা বিষাদ-মাখা কন্ঠে বলেছিলেন, "অনিয়ম করে শরীর নষ্ট হলে লিখবে কি করে ?" বস্তুত তাই ঘটেছিল।শেষের দিকে ফালগুনীর শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছিল।
কেন যে দোতলার স্বাচ্ছন্দ্য
ছেড়ে ছাদের একচিলতে চিলে-কোঠায় আশ্রয় নিয়েছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি । নিজের ভেতরে
ঢুকে যাওয়া, নিজের মুখোমুখি হওয়ার মত
এমন নিরিবিলি জায়গা, বস্তুত ছিল লোভনীয়। সিঁড়ির লাগোয়া অপরিসর চিলে-কোঠা, জানালা পশ্চিম-মুখো, পাল্লাহীন ঘর, চিলতে আলো তখন এসে পড়েছিল। ঐ
কোঠাঘরে ছিল একটা ছোট্ট তক্তাপোশ, মাথার
ধারে তেলচিটে বালিশ, মুড়ে-রাখা বিছানা, অর্থাৎ চাদর ও সতরঞ্চি, একটা ছোট্ট কাঠের
নড়বড়ে টেবিল। আগেকার আমলের লোহার টিনের চাদরও
ছিল, আর রাখা ছিল একটা ছোট্ট কুঁজো,
এলুমিনিয়াম গেলাস তার ওপর ঢাকা।আগোছালো অপরিষ্কার ছন্নছাড়া, মেঝেময় ধুলো ও ছাই, দেশলাই
কাঠি, খাওয়ার পর বিড়ির টুকরো। দেয়াল
অপরিচ্ছন্ন। দেয়ালে যিশুর একটা অতি পরিচিত
মূর্তি, ফালগুনী তার গায়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে কালো
রবারের সাপ।কালো দিব্যতা, যাকে নিয়ে ওর
বিখ্যাত কবিতা। একটা তোবড়ানো টিনের সুটকেস, সুটকেসের ভেতরে অবিন্যস্ত কাগজপত্তর, মণিমুক্ত।
ফালগুনীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন
যশোহরের জমিদার । পিতামহ রামরতন রায় , বরানগরে রতনবাবু রোড যাঁর নামে।বরানগরে যে
শ্মশানটি রতনবাবু ঘাট সংলগ্ন, কেবলমাত্র
রামরতন রায়ের পরিবারের সদস্যদের দাহ করার জন্য যা সংরক্ষিত -- ব্যতিক্রম
শিশিরকুমার ভাদুড়ী ও শ্রীরামকৃষ্ণ । ফালগুনীর চিতা
এখানেই নিভেছিল। ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের ফলে
তাদের জমিদারি পাকিস্তানে পড়ে; ফলে আয়ের
উৎস হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
অতিরিক্ত ও মাত্রাহীন
নেশা-প্রীতি, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব,
এবং সেই সঙ্গে পথ্য ও চিকিৎসার অভাব -- তার শরীর ভেঙে পড়ে। ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে। শেষ দিকে, কবিদীপক মজুমদারের সঙ্গে ফালগুনীর আলাপ হয়, ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা। দীপক তাকে
দিয়েছিলেন সেই মজার সন্ধান, যা সম্ভবত
আমরা দিতে পারিনি, কেননা দীপকের যৌনতা ছিল বাধাবন্ধনহীন,
লাগামছাড়া।বিদেশিনীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল দীপকের।তা ফালগুনীকে
মাটির আরও কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।
শেষদিকে একবার সে পাড়ি
দিয়েছিল সাগর-যাত্রায়। পাড়ার ছেলেবেলাকার বন্ধু অরুণের
সঙ্গে। ফালগুনী তখন পুরোপুরি অসুস্হ। ভালোভাবে
উঠতে-বসতে পারে না। ছইয়ের ভেতরে শরীর শায়িত। মোহনার মুখে নৌকা এসে টালমাটাল সাগরের জল ছুঁয়েছে, ওপচানো ঢেউয়ের গর্জন, গম্ভীর
ধ্বনি, নৌকোর গায়ে সাগর-জলের ঝাপটানি। বড় বেশি কাতর হয়ে পড়েছিল ফালগুনী । মাথা তুলে, ছইয়ের বাইরে নীলাকাশ, মেঘের
খেলা, জলচর পাখি, জলে
প্রতিবিম্বিত সূর্য, আলোর ছটা -- আরো বেঁচে থাকার আকাঙ্খা
ছিল তার: " বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই...."
মুহূর্তে দৃশ্যান্তর। ক্যামেরা প্যান করে দূরে পাহাড়শ্রেণির দিকে, মেঘ, নিবিঢ় আকাশ ছুঁয়ে নীতার মুখমন্ডল।মেঘে ঢাকা তারায়
তার আর্ত গোঙানি, দিগ্বিদিক
নিস্তব্ধ পরিবেশকে খান-খান করে ভেঙে ফ্যালে । বাংলা
সাহিত্যে আধুনিকতার যুগের সমাপ্তি হয়।
( হাওয়া৪৯ ফালগুনী রায় সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )
নষ্ট আত্মার টেলিভিশন
ফালগুনী রায়
ফালগুনী রায়
প্রথম প্রকাশ: ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৩
প্রকাশকঃ বাসুদেব দাশগুপ্ত
কবে শেষ হল আধুনিকতার যুগ?
কেউ কেউ বলেন,১৮৮১ সালের ৩ জানুয়ারী যেদিন চিকিৎসকরা জানলেন যে
নীট্শে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন। আরেক দল বলেছেন,১৫ জুলাই ১৯৭২ বিকেল তিনটে বত্রিশ যখন আমেরিকার সেন্ট
লুইস শহরের একদল নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিক তাদের আধুনিক বহুতল বাসগৃহ কমপ্লেক্স বোমা
মেরে উড়িয়ে দেয়। ঐ বাড়িগুলি
কর্বুসিয়ের-য়ের ‘মেশিন ফর লিভিং’ বলে খ্যাত হয়েছিল। যেদিন
প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘাতকের গুলিতে নিহত হন (১৯৬৩), অনেকের মতে,তখনই আধুনিকতার যুগ শেষ হল।
এই তালিকায় আধুনিকতার আরো
একটি সম্ভাব্য অন্তিম মুহূর্তের উল্লেখ আমি করে রাখি। বুঝি
একটু দুর্বিনয়ের ছোঁয়া লাগবে। তা পৃথিবীর সব
দাবীই অল্পবিস্তর দুর্বিনীত।
আমি বলি, ১৯৭৮ সালের মধ্য বৈশাখে যখন ফালগুনী রায় ‘নষ্ট আত্মার
টেলিভিসন’ বইটি আমার হাতে তুলে দেয়। বই বললে অবশ্য
সেই ক্ষীণ সংগ্রহটিকে অপ্রয়োজনীয় সম্মান দেখানো হবে। তখন বেলা
এগারোটা। ফালগুনী শুখো নেশায় চুর। ফুটপাথে টলছে। বইটি এগিয়ে দিতেই আমার সন্দেহ
হয় এটি পর্নোপুস্তক কিনা। সেইভাবে, গোপনে, সে বইটি আমার হাতে
গুঁজে দেয় এবং আমি খানিকটা চমকেও উঠি। কেননা
তাকে আমি চিনতাম না। সে তখন আমার কানে কানে
বলে-পট্টভির পরাজয়, আমার পরাজয়।
ঐ তার সঙ্গে আমার প্রথম ও
শেষ দেখা।
তারপর কতজনের কতশত
কাব্যগ্রন্থ বেরোল,হারিয়ে গেল ও
পুরস্কৃত হল (এবং হল না),এডিশন হল (এবং হল না),কত কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকাশক হাত নেড়ে বলে গেলেন, না না, কবিতার বইয়ের সেল-টেল কিছু নেই!
কিন্তু সবকিছুর উপর আমাদের
এই লেন-দেন, দেওয়া-থোওয়া, পাওনা-গণ্ডার সমাজসাহিত্যের উপর-ফালগুনী রায়ের এই ভয়ঙ্কর বই আততায়ীর
হাসির মতো আজো অম্লান। কেউটের চোখের
মতো নিষ্পলক তার নেশাতুর চাউনি।
আটের দশকের প্রথম দিকে
ফালগুনী মারা যায়। অনতিকাল পরে মারা যায় ওর দাদা
তুষার রায়, যে ছিল আমার বন্ধু। তার কাছে শুনেছিলাম যে ফালগুনী নাকি শেষদিকে এখানে-ওখানে আমার খোঁজ করে বেড়াত। কেন, কে জানে?
ফালগুনীর সৎকারে কোনো ধুমধাম
হয় নি। সামান্য কয়েকজন শ্মশানবন্ধু ছিলেন। বিউগল
বাজে নি। একুশটি তোপধ্বনিও হয় নি।
খোলা চিতায় তার অবহেলিত দাহ
হয়। বৈশাখের তপ্ত বাতাসে,আজ যেমন তার কবিতার বইয়ের পাতাগুলি, প্রায়
তেমনই অবহেলায়, উল্টে যাচ্ছে নিজে নিজেই।
নষ্ট আত্মার টেলিভিসন
( কবিতার বানান অপরিবর্তিত )
এইখানে
এইখানে সমুদ্র ঢুকে যায়
নদীতে নক্ষত্র মেশে রৌদ্রে
এইখানে ট্রামের ঘন্টীতে বাজে
চলা ও থামার নির্দেশ
এইখানে দাঁড়িয়ে চার্মিনার
ঠোঁটে আমি রক্তের হিম ও ঊষ্ণতা
ছুঁয়ে উঠে আসা কবিতার
রহস্যময় পদধ্বনি শুনি-শুনি
কবিতার পাশে আত্মার খিস্তি ও
চীৎকার এইখানে
অস্পষ্ট কু-আশার চাঁদ এইখানে
ঝরে পড়ে গনিকার ঋতুস্রাবে
এইখানে ৩২৩
খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কোন গ্রীকবীর রমন বা ধর্ষণের
সাধ ভুলে ইতিহাসে গেঁথে
দ্যায় শৌর্য ও বীর্য এইখানে
বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীরের নরম
স্বাদ ভুলে একটি মানবী থেকে মানবজাতির দিকে
চলে যায় চৈতন্যের
উর্ধ্ববাহু প্রেম-সর্বোপরি
ইতিহাস ধর্মচেতনার ওপর জেগে
থাকে মানুষের উত্থিত পুরুষাঙ্গ এইখানে
এইখানে কবর থেকে উঠে আসা
অতৃপ্ত প্রেমিকের কামদগ্ধ
কয়েকলক্ষ উপহাসের মুখোমুখি
বেড়ে ওঠে আমার উচ্চাশা এইখানে
প্রকৃত প্রশ্নিল চোখে চোখ
পড়লে কুঁকড়ে যায় আমার হৃদপিণ্ড এইখানে
এইখানে সশ্রদ্ধ দৃষ্টির
আড়ালে যাবার জন্য পা বাড়াতে হয়
আমি নারী মুখ দ্যাখার
ইচ্ছায় মাইলের পর মাইল হেঁটে দেখি
শুধু মাগীদের ভিড়
সাতাশ বছর-একা একা সাতাশ বছর
বেক্তিগত বিছানায় শুয়ে দেখি
মেধাহীন ভবিষ্যৎ জরাগ্রস্ত
স্নায়ুমণ্ডলীর পাশে কবিদের কবির কবিতা
চারিধারে ঢিবি দেওয়ালের
নীরেট নিঃশক্ত অন্ধকার।
আমার রাইফেল আমার বাইবেল
আমার রাইফেল আমার বাইবেল এই
নামের দুটো কবিতা পকেটে নিয়ে আমি গল্প কবিতার পথে
হাঁটি-এই পথে একজন
অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার এবং একজন সত্তর দশকের
শহীদের নামে রয়েছে একটি
শহীদ-বেদী রয়েছে কলেজ স্কোয়ারের জলে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের
নতুন গ্রন্থাগারের ছায়া
রয়েছে কিছু দূরে মেডিকেল কলেজের মর্গ আর তার উল্টো দিকে দেবালয় ও
গ্রন্থালয়ের মধ্যবতী পথ চলে
গ্যাছে ষ্ট্রেট গণিকালয়ের দিকে এই পথ দিয়ে আমি হাঁটি গল্প কবিতার
দিকে-বুক পকেটে কাগজী নোটের
বদলে দুটো কবিতা-বুক পকেটের তলায় গেঞ্জি গেঞ্জির
তলায় চামড়া চামড়ার তলায়
হৃদয় হৃদয়ের হাড় ভাববাচ্যে কাটা গ্যাছে আমার তবু আমি হাড় কাটায়
যাইনি এখনো কয়েকটা লেখা
নিয়ে গল্পকবিতার দিকে হেঁটে গেছি-পাঠের ক্ষুধা নিয়ে ছুটে গেছি
গ্রন্থের কাছে প্রেম ও
পুরুষাঙ্গর ক্ষুধা নিয়ে ছুটে গেছি প্রেমিকার কাছে কিন্তু গ্রন্থ ফিরিয়ে দ্যায়নি
আমাকে-মানবী দিয়েছে-তারপর
থেকে আমি লালনীল মাছের অ্যাকোয়ারিআমের পাশে বসে
মাছ ভাজা খেয়েছি বেশ্যার
উঁচু বুকে যৌন আকর্ষণের বদলে আমি লক্ষ করেছি মাংসর
ঢিবি-আমার প্রাক্তন
প্রেমিকার বর্তমান স্বামীর দাঁতের উজ্জ্বলতায় আমি টুথপেষ্টের বিজ্ঞাপন
দেখেছিলুম-হাসি দেখিনি
রামকৃষ্ণ শ্মশানে জলন্ত
শবদেহের ঝলসানো মাংস মহাপ্রসাদ মনে করে খেয়ে ফেলে নিমাই সাধু
এবং এমনকি সে খিদে পেলে
গঙ্গামাটি বা স্রেফ নিজের পাইখানা খেয়ে ফেলে ও গাঁজা খায় এবং
হরিনাম করে-নিমাই সাধুকে
অনেকেই মুক্ত পুরুষ ভাবে আমিও মুক্তি চাই কিন্তু সে মুক্তি মানে
পোড়া মড়ার ঝলসানো মাংস
ছিঁড়ে খাওয়া কিংবা মাটি বা নিজের গু খাওয়া নয়-চে গুয়েভারাও
মুক্তি চেয়েছেন এবং পরাধীন
ভারতের কবি লিখেছিলেন যেথায় মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ কাটছে
পথ খাটছে বারোমাস সেখানেই
দেবতা আছেন দেবতা নাই ঘরে-এই ধরণের মুক্তি প্রসঙ্গ লেখা
হয়েছিল স্বাধীনতার আগে-আমি
আজ স্বাধীন ভারতের কবি দারিদ্রতার হাতে বন্দী অগনন
শিশুদের নির্ভেজাল হাসি দেখে
তাদের মুক্তির পথের কথা ভাবি-পেটোর বদলে দুটো কবিতা
পকেটে নিয়ে গল্প কবিতার
দিকে হাঁটি এই পথে একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার
আছে আছে সত্তর দশকের একজন
শহীদের জন্যে একটি শহীদবেদী এই পথে
কালো দিব্যতা
তোমাদের পৃথিবীর পাশে আমার
এই স্বমারনোৎসব
আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর এই গান
আমায় দিয়েছে এনে নির্বানের
মহাসম্মান
এখানে জিভ নিরপেক্ষ শব্দ
দিয়েই করতে হয় সবকিছু
পুরুষাঙ্গ জেগে উঠে হয়ে উঠে
বীন
তখনি এক কালোদিব্যতা করে
আক্রমণ
তার তীক্ষ্ণপ্রতিভা খরশান
ফেটে পড়ে অট্টহাস্যে
উপহাসের গমকে গমকে ঝলসে ওঠে
তার শব্দার্থ
শব্দ কি পরমব্রহ্ম-সব শব্দ?
গনিকাকবিতাপ্রেমযোনি কিম্বা
ঈশ্বর অথবা নভোচারী
শ্লীল শব্দ অশ্লীল শব্দ শব্দ
কি পরমব্রহ্ম?
জানি না জানি না কিছু তবু
স্মৃতিদেহী শয়তান বলে চলে
শব্দ কথা বাক্য শব্দ বাক্য কথা
কে কোথায় কোন উন্মাদ
আছ পাগল উদাসী উদঘাটন কর এই
অনৈতিহাসিক
আত্মলিপি হিচিং ফিচিং এন্তার
টনাকটিং নেশাহীন
মাথার ভেতর কি সব হচ্ছে এসব
শুধু স্মৃতি এসে
করে গ্রাস উন্মাদ এই
বর্ণমালা তখনি সহসা
ছুরি হয়ে উঠে তাবৎ অতীত আর
ধারালো ছুরির
ওপর দিয়ে জীবনের হাঁটা দেখে
থ মেরে যায় হঠযোগী
আমি থমথমে আকাশের তলায় দেখি
জলের দিকে নেবে গ্যাছে সব সিঁড়ি কিছু দেখি না দেখি পাহাড়ি জলের মিঠে স্বাদে
নদিগামী সামুদ্রিক ইলিশ মানুষের ইষ্টবেঙ্গল মোহনবাগানের সংগে জড়িয়ে ফেলছে তার
রূপালী অস্তিত্ব আর যৌনতার টানে সন্দেহপ্রবণ পুরুষও নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে
ভালোবাসার সংগে
আর দেখি
নাগরিক নিয়নের আলোয়
আমার একক ছায়ার পাশে
তোমার একাকী ছায়ার বদলে
আমার শরীরে এক ল্যাজ
ডারউইন থিওরি বা ফ্রয়েডের
নামের বানান ভুলে আমি রাস্তা হাঁটি আমার প্রাগৈতিহাসিক পুরুষের ছায়া হাঁটে আমার
পাশে তখন আর আমার মনে থাকে না অন্যকিছু মনে থাকে না আমি কাকে চিট করেছি কে মেরেছে
আমার দশ টাকা দুঃখ-কষ্টের রোজনামচা দিয়ে সাহিত্যের কথা মনে থাকে না এমনকি খোদ
ভিয়েৎনাম দিবসে ভুলে যাই ভিয়েৎনাম সমস্যা
সে সময় মনে থাকে ঠিক বেলা
পাঁচটার পর কলেজফেরৎ
তুমি ঘুরে বেড়াও তোমার
পুরুষবন্ধু নিয়ে একা হাঁটি আমি
আর অইসব যুবকদের স্বাস্থল
পাছা দেখে জাগে আফশোষ
ইস্ আমি কেন হলুম না সমকামী?
তোমাদের পৃথিবীর পাশে আমার
এই স্বমারনোৎসব
আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর এই গান
আমায় দিয়েছে এনে নির্বানের
মহাসম্মান
সম্মানিত আমি তবু পথ চলি
হাঁটতে হাঁটতে খুলে পড়ে
হাঁটু হতে মালাইচাকী
হাঁটুগেড়ে পড়ে যাই তবু
নতজানু আর হতে পারি না কারো কাছে
প্রেমের কথা ভাবলে কনকনিয়ে
ওঠে দাঁতের গোড়া
অবশ্য এসব অসুখ আমি সারিয়ে
ফেলতে পারবো
কেননা আগেও মানে শরীরে
ল্যাজগজানো বা সমকামী
হতে না পারার আফশোষ জাগার
আগেও আমি রাস্তা
হাঁটতুম একা এবং মারাত্মক আমি
আসলে
মাতৃজঠর থেকে চিতা ওব্দি
হেঁটে যাবার পরেও জীবনের প্রত্যাশী
আমি হাঁটতুম-হাঁটব-হেঁটে
যাবো আমি হাঁটতুম
আমার মাথার ওপরে কবি ও
বিজ্ঞানীর নভোমণ্ডল
আমার শির ও শরীরের পাশে
ট্রাফিকের তিন আলো
আমি মাতাল কবিদের সাথে
গণিকাপল্লীর ভেতর
দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেবেছি
সাবিত্রীসত্যবানের কথা
আমার মাথা ফুঁড়ে জ্বলে উঠত
জ্বলন্ত মোমবাতি সে সময়
ব্রহ্মতালুর ঘি জ্বলে যেত
দাউদাউ চটাচট পুড়ে যেত সব চুল
অবশ্যই আমি সম্মোহিত করে
রাখতুম অন্যদের তারা শুধু আমার অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় ও গাঁজাটানার পর দাড়িগোফময়
মুখের রবীন্দ্রসঙ্গীত দেখতে ও শুনতে পেত তারা দেখত না চার্লি চ্যাপলিনের চেয়ে
দক্ষ কৌতুক অভিনেতা হয়ে আমি কি রকম নিজেকে ভুলিয়ে রাখছি অহেতুক
কৌতুকে কিন্তু আমি দেখতুম
পুরানো গল্পের মতন আমার নিজস্ব কৌতুকের ভেতরে দুঃখ-সেই দুঃখ দেখে আমি হেসে উঠেছি
হো হো শব্দে সেই শব্দে ভেঙ্গে গিয়েছিল বুঝি জীবনানন্দীয় ভাড়েদের কবিতার আসর
এমনকি যেসব প্রথম পোয়াতী মৃতবৎসা হবার বেদনায় হয়েছিল মূক যেসব ব্যর্থপ্রেমিক
ঠিক করেছিল তাদের হারানো প্রিয়ার যোনি চিতা হতে করে নেবে লুঠ তারাও জেগে
উঠেছিল-জীবনের ভাঙাসুর তাদের হয়েছিল সহসা প্রাণবাণ
কিন্তু আমি হাসি থামিয়ে
দিতুম
তখনি অল কোআইট ইন দি
ফিউরিয়াস ফ্রণ্ট
র্যা বোর প্যারিস কিমবা
মিলারের আমেরিকা
অনায়াসে নেমে আসে তখন
খালাসীটোলায়
ওকি গংগা না জর্ডন কিমবা
কলোরাডো
সব কিছু মিলে মিশে হ’ত
একাকার
জানা অজানার মধ্যবর্তী এলাকা
থেকে কালোদিব্যতা এসে
জানাত আমায় উইমেন্স কলেজের
অনার্সছাত্রী আর
হাড়কাটার বেশ্যার ঋতুরক্তের
রঙ এক
ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী
এলাকা থেকে কালোদিব্যতা এসে
জানাত আমায় সাম্যবাদীরও
প্রিয়ার
দরকার হাংরীদের মত
স্মৃতি ও বিস্মৃতির
মধ্যবর্তী এলাকা থেকে কালোদিব্যতা এসে
জানাত আমায় যৌনতার কাছে
গেলে নারীও হয়ে ওঠে
অমৃত ধর্ম ও অধর্মের
মধ্যবর্তী এলাকা থেকে কালোদিব্যতা এসে
জানাত আমায় তুমি অনন্ত তুমি
আনন্দ
আজ তোমাদের পৃথিবীর পাশে
আমার এই স্বমারনোৎসব
আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর এই গান
আমায় দিয়েছে এনে নির্বানের
মহাসম্মান
ক্রিয়াপদের কাছে ফিরে আসছি
আমি নেশাগ্রস্থ তাই সংসারী
সাত্বিক বন্ধুরা দূরত্ব বজায় রাখে ঠিক
ট্রামে ট্রেনে বাসে
ফুটপাথে-আমি আন্দাজ মেপে কথা বলতে
পারিনা কিছুতেই একজন ঘরের বউ
দেখলুম বহুগামিতায়
বেশ্যাদের ছাড়িয়ে গেল
পয়সা ছাড়াই-আমার হাহাকার
ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিলুম অট্টহাসি
প্রেমিকার চোখে চোখ রাখতে
গিয়ে দৃষ্টিফেটে একশো বিষাক্ত সাপ
চলে গ্যালো তার দিকে-আমি
পুরোহিতের মন্ত্রপুত টিকিতে
গোমাংস ঝুলিয়ে পরীক্ষা করতে
চেয়েছিলুম ধর্মসংস্কারের সহ্যক্ষমতা
শুক্র শনি রবি বাদে রোজ ঠিক
সাড়ে বারোটায় রোদ্দুরে
আমি রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে
চেষ্টা করি পানের দোকানে
আমি সোনার তরীর সব ধান লুট
করে বিলিয়ে দেবো
শান্তিনিকেতনের ভিখিরীদের
ভেতর
তারপর খালি নৌকায় চেপে গান
গাইবো বাইশে শ্রাবণের
জল ভর্তি কর্পোরেশনের
কলকাতায়-কে যাবি পারে ওগো তোরা কে
আমি খ্রীষ্টমূর্তির গায়ে
লটকে দিয়েছি কৃত্রিম সাপ
আমি বাবামার ভালোবাসার
আড়ালে যৌন বনিয়াদ
আমি ক্রিয়াপদ পরিহার করতে
চেয়েও ফিরে আসছি
ক্রিয়াপদের কাছে-
মানুষের সঙ্গে কোন বিরোধ নেই
না, মানুষের সঙ্গে আমার আর বিরোধ নেই কোনো-
এখন পাওনাদার দুর্ঘটনায়
পড়লে তাকে নিয়ে যেতে পারি হাসপাতাল
প্রাক্তন প্রেমিকার স্বামীর
কাছ থেকে অনায়াসে চাইতে পারি চার্মিনার
দাড়ি গজানোর মত অনায়াসে এ
জীবনে আমি
রামকৃষ্ণের কালীপ্রেমে দেখি
সার্বভৌম যৌনশান্তি
বাবলিদের স্বামীপ্রেমে দেখি
সার্বজনীন যৌনসুখ
একটা চটী হারিয়ে গেলে আমি
কিনে ফেলি একজোড়া নতুন চপ্পল
না, মানুষের সংগে আমার আর বিরোধ নেই কোন
বোনের বুকের থেকে সরে যায়
আমার অস্বস্তিময় চোখ
আমি ভাইফোঁটার দিন হেঁটে
বেড়াই বেশ্যা পাড়ায়
আমি মরে গেলে দেখতে পাবো
জন্মান্তরের করিডোর
আমি জন্মাবার আগের মুহূর্তে
আমি জানতে পারিনি আমি জন্মাচ্ছি
আমি এক পরিত্রাণহীন
নিয়তিলিপ্ত মানুষ
আমি এক নিয়তিহীন
সন্ত্রাসলিপ্ত মানুষ
আমি দেখেছি আমার ভিতর এক
কুকুর কেঁদে চলে অবিরাম
তার কুকুরীর জন্যে এক
সন্ন্যাসী তার সন্ন্যাসিনীর স্বেচ্ছাকৌমার্য
নষ্ট করতে হয়ে ওঠে তৎপর
লম্পট আর সেই লাম্পট্যের কাছে
গুঁড়ো হয়ে যায় এমনকি
স্বর্গীয় প্রেম-শেষ পর্যন্ত আমি
কবিতার ভেতর ছন্দের বদলে
জীবনের আনন্দ খোঁজার পক্ষপাতী
তাই জীবনের সঙ্গে আমার কোন
বিরোধ নেই-মানুষের সঙ্গে
আমার কোন বিরোধ নেই
ফ্রেশ ইনফরমেশন
ভাদ্রের রৌদ্র আমায় কুকুরের
কামোত্তেজনা জানানোর বদলে জানাল শরৎ এসে গ্যাছে-আমি নক্ষত্র ও নৌকার নিহিত
সম্পর্কের কথা জানলুম নদীর নিকটবর্তী জেলেদের কাছ থেকে-মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পাশ করা
আমার এক বন্ধু কম্পাসের সাহায্যে সমুদ্রের দিক নির্ণয়ের কথা জানিয়েছিল আমি মরে
গেলে আমার চারধারে আর চারদিক থাকবে কি?
ভাদ্রের রৌদ্রে শরতের আভাষ
তখন পাবে অন্য কেউ যেরকম আমার বাবা যে কাঁচামিঠে গাছের আম খেয়েছিলেন তিনি মারা
যাবার পর আমি সেই কাঁচামিঠে গাছের আম খাচ্ছি-এ ভাবেই আমি মরে যাবো কাঁচামিঠে গাছের
আম তখন খাবে আমার উত্তর পুরুষ অর্থাৎ আইনষ্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত
কথোপকথনের মতন ব্যাপারটা অর্থাৎ মানুষ না থাকলে সুন্দর অ্যাপোলো মূর্তির
সৌন্দর্যের কোনো তাৎপর্য থাকবে না কিন্তু মানুষ না থাকলেও পৃথিবী সূর্য ব্রহ্মাণ্ড
থেকে যাবে ঠিকঠাক
মানে আমি বলতে চাইছি মানুষ
না থাকলে আমটী কাঁচা অবস্থাতেও মিঠে থাকবে কিন্তু সেটা বলার কেউ থাকবে না-সুতরাং
সূর্যকে সূর্য মোমবাতিকে মোমবাতি মানুষই বলেছে-মানুষই বলেছে নরের পূর্বপুরুষ বানর
বা নরগণ ঘোষণা করেছে এরূপ বিদ্যা ফোনেটীকস অইরূপ বিদ্যা ফিললজি সেইরূপ অসুখ
ফাইলেরিয়া এইরূপ প্রত্যংগ ফ্যালাস ইত্যাদি ইত্যাদি
এমতঅবস্থায় আপন কণ্ঠস্বর
খুঁজতে গিয়ে যদি কোনো কবি খাবি খায় তবে আমরা আর কিইবা করতে পারি-আমার প্রপিতামহ
যাকে বলেছিলেন জল আমিও তাকে বলছি জল-আমার প্রপিতামহ যাকে বলেছিলেন আগুন আমিও তাকে
বলছি আগুন-মানে বাবারা যা বলে গ্যাছেন ছেলেরাও তাই বলছে নাতিরাও তাই বলবে অর্থাৎ
বস্তুর বস্তুগত নামটি একই থাকবে কেবল পাল্টাবে তার ধারণা যেমন আদিকালে পুরুষাঙ্গকে
প্রজনন প্রত্যংগ হিসেবেই দ্যাখা হ’ত-বর্তমানে পুরুষাঙ্গকে টেলিপ্যাথিক
কম্যুনিকেশনের রাডার হিসেবেও দ্যাখা হচ্ছে-অনেকেই আপেল-কে গাছ থেকে পড়তে দ্যাখে
কিন্তু নিউটন কেবল আপেলের পড়াটাই দ্যাখেননি দেখেছিলেন তার সঙ্গে
মাধ্যাকর্ষণ-ভাস্করাচার্য অবশ্য ল অফ গ্রাভিটেশন-কে অন্যভাবে আবিষ্কার করেছিলেন
এবং কোপার্নিকাসের অনেক আগেই আর্যভট্ট আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীর সূর্যকেন্দ্রিক
আবর্তন-এইসব ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত হয় একই সত্য-কে বিভিন্ন আবিষ্কারক ভিন্ন
ভিন্ন পদ্ধতিতে মত আবিষ্কার করেন অনেকটা রামকৃষ্ণের বিখ্যাত উক্তির মত যত মত তত পথ
নিয়ে মানুষ-মানুষের ঐক্যের ভেতর এ ভাবেই বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যের ভেতর ঐক্য খেলা
করে-শুধু জ্ঞানান্ধ সমালোচকরা সত্যের গুহায় বসে বলে দ্যান-
অমুক তমুকের চর্বিতচর্বন
ছাড়া কিছু নয়-হায় হায়-বিদ্যাসাগর অ আ ক খ শিখেছিলেন অন্যের কাছ থেকে তারপর
নিজেই প্রণয়ন করেন বর্ণপরিচয়-হে মহান সমালোচকগণ জানান আমায় বিদ্যাসাগর কার
চর্বিতচর্বন ছিলেন-জানান-জানান-ভাদ্রের রৌদ্র আমায় কুকুরের কামোত্তেজনার খবর
জানাবার বদলে জানিয়েছে শরৎ এসে গ্যাছে-আপনিও অইরকম কিছু ফ্রেশ ইনফরমেশন দিন-নাকি
মাও কোট পরে আপনি কোট করবেন টাওইষ্ট মতবাদ-গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে আপনি একহাতে
রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ অন্যহাতে হ্যাভলক এলিস রেখে বলে উঠবেন- লেনিন বলেছেন
না-সন্ন্যাসী না-ডনজুয়ান এর মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের থেকে যেতে
কোনটা স্যার ?
নির্বিকার চার্মিনার
মা,আমি আর তোমাদের অভিজাত সমাজের মাজাঘষা বাঁকাহাসি হাসতে
পারবো না করুণাঘন ঈশ্বরের ক্যালানেকেষ্ট সাদাদাঁত নিয়ে শয়তানের মেধাবী চোখ নিয়ে
আমি আর পারবো না রামকৃষ্ণীয় ভংগীতে স্ত্রীকে ব্যবহার করতে মাতৃতান্ত্রিক প্রথায়
চিনির বদলে স্যাকারিন খেয়ে
ডায়বেটিসকে ভয় করতে পারবো না আমি পারবো না অসুখী লিঙ্গ নিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার
গায়েহলুদের দিন দেবদাস হতে খালাসীটোলায়
আমার লিভার ক্রমশঃ পচে আসছে
আমার পিতামহর সিরোসিস হয়েছিল হেরিডিটী বুঝিনা আমি মদ খেয়ে কবিতা পড়ি আমার বাবা
পূজোআচ্চার জন্যে করতেন উপবাস পাড়ার দাদারা ধর্মের দোহাই দিয়ে দোলের দিন টিপে
দ্যান পাড়াতুতো বোনদের মাই
মা বিদেশ ভ্রমণের দিন
তোমাদের অভিজাত সমাজের অনেকেই ভদকা গিলেছেন আমি নির্বিকার তোমার চিতা থেকে ধরাবো
চার্মিনার-তোমার মৃত্যুর কথা ভাবলে আমার চোখে জল আসে তখন আমি ভূমির ভূমিকম্প
কিম্বা জলের জলোচ্ছ্বাসের কথা ভাবিনা কুমারী প্রেমিকার শায়ার দড়িতে হাত রেখে আমি
বৈষ্ণব পদাবলীর কথা ভাবিনি মা আমিও মরে যাবো একদিন
বেলুড় মন্দিরে প্রণামরতা এক
বিদেশীনির স্কার্ট ঢাকা আন্তর্জাতিক পাইথনপাছা দেখে জেগেছিল আমার সীমাহীন যৌনতা মা
তোমার যৌনতা আমৃত্যু বাবার চিতার সঙ্গে লেপ্টে থাকবে বলে আমি তোমায় ঈর্ষা করছি
নিরহংকার নোংরামি নিয়ে লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অন্যগ্রহের জীব মনে হচ্ছে এখন
আমার মুখের ওপর এসে পড়ছে ডুবন্ত সূর্যের আঁচ আর সূর্যাস্তের রং পাখায় মেখে
পরিবার পরিকল্পনাহীন পাখির দল ফিরে যাচ্ছে বনলতা সেনের চোখের শান্তিময় নীড়ের
দিকে-ডিমে তা দেবার সময় এসেছে তাদের
ভ্রমর বিহীন কিছু ফুল
ভ্রমর বিহীন কিছু ফুল এখানেই
ঝরেছিল রক্তের ভেতর
আমার রাজহাঁস
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ রাজহাঁস এখানেই
কাটা হয়েছিল-সুস্বাদু
মাংসের গন্ধে পরিতৃপ্ত জ্বলন্ত উনুন
দেখেছিল আকাশের অন্তহীন
উনুনের তাপে শীতের কার্ডিগান
খুলে এক বালিকা দুই বুকে তার
রেখেছে উত্তাপ
তার পিকনিক গার্ডেনের কাছেই
কাটা হয়েছিল রাজহাঁস আমার
রক্তের ফুলগুলি ভ্রমর বিহীন
ঝরে পড়েছিল সেদিন
রাজহাঁস ও ফুল বিষয়ক
কবিতাগুলি আমি
মাংস রাঁধার জন্যেই
দিয়েছিলুম উনুনে
সাধ ছিল সে বালিকা পাবে বটে
মাংসের সুঘ্রাণ
কারণ অনেক মাংস ঘেঁটেছি আমি
আমি দেখেছি মাংসের ভিতর
বায়ু পিত্ত কফ দেখেছি
এমনকি সত্ত্ব তম রজ এই
তিনপ্রকার গুণও থাকে মাংসাশী শরীরে
তবুও আমি এক জরায়ু থেকে
বেরিয়ে আরেক জঠরে
খুঁজেছিলাম আমার সন্তানের
মুখ-
আমার মৃত পিতার শরীর দেখে
আমি বুঝেছিলুম
বেঁচে থাকা জরুরী আমার মা-র
হতাশা দেখে
বুঝেছিলুম মৃত্যুও দরকারী
হতে পারে জীবনের
তবু সকল জ্ঞানের পর কাঁটা ও
কমপাস বিহীন-আমি
আমি এক বালিকার জন্যে কেটে
ফেলি আমার রাজহাঁস
কবিতার খাতা ঠেলে দিয়েছিলুম
উনুনে এক বালিকার
জন্যে আমার চৈতন্যের ক্রন্দন
আমি দেখে ফেলি
বীর্যরসে-তৎক্ষণাৎ আর দেরী
নয় বলে
আমি জড়িয়ে ধরি অশোক-ষষ্ঠীর
দিন সেই বালিকার শরীর
রক্তের ভেতর ভ্রমর বিহীন
ফুলগুলি ফুটে ওঠে সেদিন
আমি মানুষ একজন
আমি মানুষ একজন
প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি
দুঃস্বপ্নের পিঁচুটি
পরিষ্কার আর তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে
ব্যবহার করতে পারি জল
দুরকমভাবে-শোক ও শান্তিতে
ব্যবহার করতে পারি মদ
দুরকমভাবে-আমি
মানুষ একজন জরায়ু থেকে চিতা
ওব্দি হাঁটতে হাঁটতে
নিসর্গের রেফ্রিজেটার থেকে
আমি তুলে আনি
আমার নিজস্ব আত্মা-
না পচন করে না গ্রাস তাকে-সে
গনিকালয়ের পথে অহেতুক হেঁটে
মনে রাখে প্রেমিকার প্রতিমার স্মৃতি-
মনে রাখে যে শরীরে তার
আশ্রয় এখন সে
শরীরের মেধাময় মাথার ওপর
কখনো ফাঁসীকাঠ কখনো কড়িকাঠ
কানের পাশে কখনো
রবীন্দ্রনাথের গান কখনো ব্রেন কিম্বা মেশিনগান
আর কখনো
কেবলি আকাশ আর রৌদ্র আর
সূর্যাস্তের নদী
আর অন্ধকার
অন্ধকার আকাশে সে দ্যাখে
প্রেমিকার নক্ষত্রচোখ আর চোখের
গনিকাদৃষ্টির রাধিকারূপ আমি
মানুষ একজন গালাগাল খাওয়া আর
দেওয়া দুটোই করতে পারি
আমি মানুষ একজন
এখন যে শরীরে থাকি সে শরীর
ছিল তার
বাবামার শরীরে এবং কি
আশ্চর্য তার
বাবামার শরীর ছিল তাদের
বাবামার শরীরে-আরো আশ্চর্য
তাদের
বাবামার শরীর ছিল তাহাদের
বাবামার শরীরে-আহা-কে বলবে
আজ আর
প্রথম ভ্রুণের দিন ছিল আমার
মত কতজন মানুষ
তার মত মানুষী
আমি আর কবিতা লিখতে পারি না
আজকাল কিন্তু
দ্যাখো নারী-তোমার
সান্নিধ্যে এলে আমি পাই
আমার ঈশ্বরী-তোমার নিকটে
গেলে আমিই কবিতা হয়ে যাই মনে হয় লম্পটেরও ভালবাসা থাকে আর আমি এখন যে শরীরে থাকি
সে কুঁচকে গ্যাছে কর্কশ ভীষণ থ্যাঁৎলানো
কিন্তু তার মাথায় গিঁথে
থাকা জ্বলন্ত মোমের আলোয় সে দেখেছে শোকগ্রস্থ
শরীরেও থেকে যায় অ্যামিবার
প্রাণবন্ত প্রাণ
না বাপু-আমি ঈশ্বর কিমবা
শূয়ারের সন্তান নই
স্রেফ মানুষের
বাচ্চা-আপনিতুমিসেতাহারা রয়ে গ্যাছে
আমার ভেতর-আমার ভেতরে আছে
স্মৃতির কবর
শব্দের অন্তহীন খনি আর
পরমব্রহ্মের অণ্ডকোষ
ধরে ঝুলে থাকা আস্তিক
সম্প্রদায়ের বিশ্বাসভূমিতে
আমি একা উদোম ন্যাংটা ঘুরে
বেড়াই বিশ্বাসবিহীন
খুব সহজ নিশ্বাসে-
কিন্তু দীর্ঘনিশ্বাস যখন
লোকচক্ষুর আড়ালে ছাড়ি
তখন তুমি নারী
তুমি দেখো না সেই কামুক
জন্তুটার চোখে কি রকম জল থাকে যার অপর নাম অশ্র“
শেষ পর্যন্ত আমি দেখলুম যে
গঙ্গার জলে আমি করছি পেচ্ছাব সে গঙ্গার জলেই আমি
সেরে নিচ্ছি স্নান
যে মেয়েটিকে বলছি
বেশ্যা-তার ভেতরই
খুঁজে পাচ্ছি জায়া ও জননী-
আমার চ্যাংড়া আত্মা কিন্তু
নীলকণ্ঠকে পুঁক দ্যায় আর শ্রীকৃষ্ণের
গোপিনীপ্রেমের চেয়ে ঢের
বেশি ভালোলাগে
কৃষ্ণের সেই চোখ-যার
দৃষ্টিতে প্রকৃতি
ছাড়াও কৃষ্ণ নিজের ভেতরে
খুঁজে পেতেন রাধাকে
নারী-তুমি শ্রীরাধার চেয়ে
রমণীয়া-আমি তাই কৃষ্ণের বিশ্বগ্রাসে
পাই জীবনের অন্তিম কুহক রূপক
এখানেই পৃথিবীর শুরু
চার্মিনার স্বাদ তামাকের
খামার ছাড়িয়ে
এইখানে পাওয়া যায় ধোঁয়ার
ভেতর
এইখানে পৃথিবীর শুরু
এইখানে গর্ভপাতকামী মানুষের
মনে জাগে সন্তান প্রেম
এইখানে পৃথিবীর শুরু
নিদ্রায় নেমে আসে স্বপ্নিল
জাগরণ-ঘুমের ভেতর জাগে দুঃস্বপ্নের ভূত
বিস্মৃতির জরায়ুতে সহসা
ককিয়ে ওঠে ক্ষতদুষ্ট স্মৃতি
পরমাপ্রকৃতি এইখানে
পুরুষাঙ্গর বন্দনায় জেগে ওঠে নারীর হৃদয়ে
এইখানে চেতনার শুরু-
নষ্ট আত্মার টেলিভিসন
আমার হাত আমি দেখি রোজ আমার হাতে
ডবল ব্রেনলাইন শোনা যায় যা হস্তরেখাবিদ কিরোর হাতে ছিল আমি বিশ্বাস করি না হাত
দ্যাখা আমি বাসের হাতলে ঝুলে শুনে ফেলেছি কবিতা ও মৃত্যুর ধ্বনি আমার করোটীতে
বিধিলিপির বদলে হাড়ের কাঠামো বোমার শব্দে বা গুলির শব্দে আমার জেগে ওঠে মৃত্যু
ভয় আমি বিপ্লবকামী মানুষ একজন কামের আবেগে চুমু খেয়ে পাই স্বর্গাতীত আনন্দ অন্য
অনেক সময় ইত্যকার অনুষ্ঠানে অনীহা নিহিত থাকে দেহের ভিতরের বিস্ময়ের দেবতা মনের
মধ্যে কবিতা লেখার জন্যে নেশা করে কাব্য ভাবনায় অনিচ্ছা জন্মায়-
বিপ্লবীদের পাইপগানের
ছিটকিনি পরিস্কার করে দেবার পরেও অনিচ্ছা জন্মায় গুলি চালাতে আমি শ্রীচৈতন্যের
প্রেমধর্ম অনুযায়ী একযোগে নকশাল ও মিলিটারী প্রতি আমার ভালোবাসা বিলোবার ফলে আমি
দু’পক্ষের শত্র“ হয়ে গেলাম আমি দেখেছি আমার ক্ষিধে পেয়েছে আমায় রুটি দাও বা
আমার চাক্রীর দরকার আমায় একটা চাক্রী দাও বললে কেউই একটা রুটী কিমবা চাক্রী পায়
না তার কাছে পিকাসোসার্ত্রসত্যজিতের থেকে তখন একটা রুটী চাক্রীর কামনা বেশী আসলে
মানুষ দেখে ফেলে যৌনতা ও অর্থনীতি দিয়ে তৈরি বাবামাভাইবোন নিজের বউ পরের বউময়
সমাজ আমি হাতের করতলে দেখি ডবল ব্রেনলাইন-যা কিরোর হাতে ছিল-আমি বিশ্বাস করি না হাত
দ্যাখ্যা তবে হাত্মেরে আমার আত্মা লক্ষ করেছে অনেক নারী রয়ে যাচ্ছেন অনায়াত্তা
আমার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভবে এই ব্যাপারটা আমায় রাষ্ট্রবিপ্লবের পথে ঠেলে
দ্যায় অর্থাৎ সুকান্তের ভাষায় প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা ভেঙেছিস ঘরবাড়ি সে
কথা আমি কি সহজে ভুলিতে পারি এই লাইনগুলোকে আমি ব্যবহার করি একপ্রকার মানসিক
সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে কিন্তু আমার প্রিয়ার ভূমিকাটি যে মেয়েটি পালন করত সে
নিজেই নিরাপত্তার ফ্রিজসভ্যতার দিকে চলে যায় এবং তারপর থেকে আমি হ্যাভলক এলিসের
যৌন মনস্তত্ব আর জগদীশবাবুর গীতা জুড়ে আমি বানিয়ে ফেলেছি আমার যোগাসন ফ্রয়েড
পড়বার অনেক আগেই আমি বুঝে গেছিলুম কাকে বলে অয়দিপাউস কমপ্লেক্স কিন্তু নিজের মার
সঙ্গে করতে ভালোলাগে না আমার কিন্তু অনেক সময় মায়ের বয়সী মহিলার শরীরের স্বাদ
নেবার প্রবণতা আমার থেকে গেছিল কিশোরকালের দুরন্ত দুপুরে আমি আত্মহত্যা করবার
জন্যে একবার বেরিয়েছিলুম পথে কিন্তু পেটোর উপর্যুপরি শব্দে ফিরে আসি প্রাণভয়ে
আমি দাস ক্যাপিটাল না পড়েই বুঝেছিলুম কাকে বলে হিংসাত্মক বিপ্লব-
হিংসা ভালোলাগে না আমার
বিপ্লব ভালোলাগে জোতদার ও কৃষকের যুদ্ধময় ধান ক্ষেতে আমিও খেয়েছি খুব ধানশীষের
দুধ-ধান সেদ্ধ মদের দোকানে ধানসিঁড়ি নদীর কিনারের কবির জন্মদিন পালন করে খুঁজেছি
জীবনের আনন্দ অনেক সময় আমার কাছে চার্মিনার থাকে
দেশলাই থাকে না
দেশলাই থাকে
থাকে না চার্মিনার
যৌনতা থাকে কিন্তু প্রয়োগ
করবার জন্যে আধার বা রাধা বা রমনী মানে মেয়েছেলে থাকে না মেয়েছেলে থাকে যৌনতা
থাকে না-প্রত্যুৎপন্নমতি থাকে অবিমৃষ্যকারী থাকে না অবিমৃষ্যকারী থাকে
প্রত্যুৎপন্নমতি থাকে না এভাবেই দিন যায় রাত যায় একটু অন্যভাবে দিনরাত কাটিয়ে
আমার বাঙালী বাবা মা জন্ম দিয়েছেন আমায় সময়ের ভেতর অর্থাৎ বাবার শরীর মায়ের
শরীরে দুই শরীরের মিলনে আমার একটি শরীর অর্থাৎ দ্বৈত থেকে অদ্বৈত হওয়া এভাবেই
পিতা হবার ইচ্ছাকে আমরা লক্ষ করি স্বয়ংরতির ভেতর তরল বীর্যস্রোতে দুশো ছয় হাড়ের
কাঠামো ও কাঠামোর সংলগ্ন মাংসল স্নায়ুর চিন্তাবাহন শব্দের স্মৃতি ধারণের বীজ তরল
বীর্যের ভেতর কি আশ্চর্য মিষ্টার খান্না-হিন্দীভাষী কিন্তু কিমাশ্চর্য তার স্ত্রী
বাঙালী হওয়ায় মিষ্টার খান্নার পাঁচ বছরের ছেলে বাঙলা হিন্দী দুটোই বলতে পারে জিভ
দাঁত তালু কণ্ঠ ওষ্ঠের সম্যক ব্যবহারে আচ্ছা সেকি তার ভ্রুণকোষের নাইট্রিক
অ্যাসিডগুলির ভেতর নিয়ে এসেছিল তার কথা বলা ও বোঝার ক্ষমতা প্রিয় হেরিডিটী ভাষা
জিনিষটা কি হেরিডিটী-পরিবেশ না প্রয়োজন কার দরকার ভাষা গঠনে-ভালোবাসার ভাষা আছে
কিনা জানিনা তো হেরিডিটী অনুভূতির ভাষা শুধু দেখি একই কায়াবিশিষ্ট মানুষ কেউ হতে
চাইছে জেমসজয়েস কেউ আলামোহন দাস অথচ কাউর জন্মের ওপর তার নিজের কোন হাত নেই কোন
সুজুকির জন্মের পেছনে বুদ্ধের কোন হাত ছিল কি?
আমার সাহেব মেম বন্ধু
বান্ধবীরা তোমরাও বাঙলা জানোনা জন্মসূত্রে যেমন অনেক বাঙালী জন্মসূত্রে জানে না
ইংরেজি তোমাদেরও খিদে পায় বাড়ি খোঁজার সময় তোমরাও দ্যাখো পাইখানা বাথরুম আমাদের
মত ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করো তোমরা আমাদেরই মত অ্যালেন গীন্সবার্গ স্বপ্ন ও
দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে দেখতে পান তাঁর কবিতার নদী তবু শালা আমি বাঙালি
ম্যাক্সমূলার পড়ে জানবো শতপথ ব্রাহ্মণের ভগবান তাই সোম ও সুরা মানে সিদ্ধি ও মদ
পান করবো একযোগে প্রায়শ সন্ধ্যায় আর বুদ্ধদেব বসু হাংরিদের নিরক্ষর বলে বীটবংশের
ওপর লিখবেন ধীমান প্রবন্ধ-হায় আমার চিন্তার ভাষা কেন ইংরেজি হোলনা কেন আমার বাবা
মা বাঙালী-হায় বাঙালী কেন বল তুই কবি হলি-
মধ্যনিশীথের নীল অন্ধকার
নেমে আসে তোমার চোখের তারায় না আমি এখন তোমায় নগ্ন করবো না-তোমার জননেন্দ্রিয়ে
রাখবনা আমি আর আমার শব্দের ইন্দ্রিয়-এখন রাসবেহারীর মোড়ে তুমি কিনতে পারো বেলফুল
কিংবা পাতিরাম থেকে হাংরি-গ্রন্থ-কিন্তু না-তোমায় এখন আমি আর নগ্ন করবো না-
চারপাশে কেবলি
গ্রন্থ-জ্ঞান-অক্ষররূপ ব্রহ্মের অস্তিত্ব এখন চারপাশে আভাঁগার্দ ফ্রেঞ্চফিল্মে
দেখেছিলুম পুড়ে যাচ্ছে গ্রন্থ-কাফকা তাঁর পান্ডুলিপি পোড়াতে চেয়েছিলেন আমি আমার
আত্মজীবনী পুড়িয়ে ফেলেছি আমি সীননদীর ধারে যাইনি কখনো আবসাঁৎ খেয়ে ঘুরিনি
প্যারিসে আমি গঙ্গার ধারের ছেলে কালবৈশাখীর রাতে বিদ্যুৎ-কে ডেকে বলেছিলুম বিদ্যুৎ
তুমি ঝলসে ওঠ আমি তোমার নীলাভা দেখবো গঙ্গার বুকে-আমি খ্রীষ্টের ক্রুশ আর র্যাঁবোর
চোরাই চালান বন্দুক দিয়ে গান্ধি শতবার্ষিকীর দিন হেঁটে গেছি সশস্ত্র বিপ্লবীদের
মিছিলে গোমাংস খেতে খেতে করেছি হরিনাম-এখন মাথায় নেশা নেই স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন বা
দুঃস্বপ্ন নেই দাঁড়িয়ে আছি চার্মিনার টানার উৎসাহ নেই-কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বসে
আছি আমি এক নিগ্রন্থ মানুষ-তুমি এখন যাও কিনে নাও বেলফুল বা কবিতার বই এমনকি তুমি
এখন আমার বন্ধুর দ্বারা গর্ভবতী হতে পারো এখন আমি হব না প্রতিহিংসা পরায়ণ-তুমি
যাও আমায় দেখতে দাও এখন মানুষের জন্ম তার পিতামাতার যৌনকামনার ফল ছাড়া আর কিছু
না?
আমি এক সৌন্দর্য রাক্ষস
প্রজাপতির চিত্রল ডানা দেখে
বিরহ হতে বিবাহের দিকে
চলে যায় মানবসম্প্রদায়-আমি
এক সৌন্দর্য রাক্ষস
ভেঙে দিয়েছি প্রজাপতির
গন্ধসন্ধানী শুঁড়
আমার নিজের কোনো বিশ্বাস নেই
কাউর ওপর
অলস বদ্মাস আমি মাঝে মাঝে
বেশ্যার নাঙ হয়ে
জীবন যাপনের কথা ভাবি যখন
মদের নেশা কেটে আসে
আর বন্ধুদের উল্লাস ইআর্কির
ভেতর বসে টের পাই ব্যর্থ প্রেম
চেয়ে দেখি পূর্ণিমা চাঁদের
ভেতর জ্বলন্ত চিতা
এখন আমি মর্গের ড্রয়ারে
শুয়ে আছি-এক মৃতদেহ
আমার জ্যান্ত শরীর নিয়ে চলে
গ্যাছে তার
শাখাভাঙ্গা বিধবার ঋতুরক্ত
ন্যাকড়ার কাছে
মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে
আছি-চিতাকাঠ শুয়ে আছে বৃক্ষের ভেতর
প্রেম নেই প্রসূতিসদনে নেই
আসন্ন প্রসবা স্ত্রী
মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি
এ ভাবেই রয়ে গেছি কেটে যায়
দিনরাত বজ্রপাত অনাবৃষ্টি
কত বালিকার মসৃণ বুকে
গড়িয়ে উঠল মাংস ঢিবি
কত কুমারীর গর্ভসঞ্চার
গর্ভপাত-সত্যজিতের দেশ থেকে
লাভ ইন টোকিও চলে গ্যাল
পূর্ব আফরিকায়-মার্কস স্কোয়ারে
বঙ্গ সংস্কৃতি ভারত
সার্কাস-রবীন্দ্রসদনে কবিসম্মেলন আর
বৈজয়ন্তীমালার নাচ হ’ল-আমার
ত হ’ল না কিছু
কোনো উত্তরণ-অবনতি কোনো-
গণিকার বাথরুম থেকে
প্রেমিকার বিছানার দিকে
আমার অনায়াসে গতায়াত শেষ
হয় নাই-আকাশ গর্ভ
থেকে তাই আজো ঝরে পড়ে
নক্ষত্রের ছাই পৃথিবীর বুকের ওপর
তবু মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে
আছি এবং মৃতদেহ আমার জ্যান্ত শরীর নিয়ে
চলে গ্যাছে তার শাখাভাঙা
বিধবার ঋতুরক্ত ন্যাকড়ার কাছে
প্রজাপতির চিত্রল ডানা দেখে
বিরহ থেকে বিবাহের দিকে চলে যায় মানুষেরা
আমি এক সৌন্দর্য রাক্ষস ভেঙে
দিয়েছি প্রজাপতির গন্ধসন্ধানী শুঁড়
বেক্তিগত বিছানা
১। শুধুই
রাধিকা নয়-গণিকাও ঋতুমতী হয়
তিন সন্তানের পিতা-পরিবার
পরিকল্পনার আদর্শপুরুষ
কৈশোরে করে থাকে
আত্মমৈথুন-করে না কি
২। আমি
রবীন্দ্রনাথ হতে চাই না-হতে চাই না রঘু ডাকাত
আমি ফালগুনী রায় হতে
চাই-শুধুই ফালগুনী রায়
৩। আমি যে
রাস্তায় থাকি তার একপ্রান্তে প্রসূতিসদন অন্যপ্রান্তে শ্মশানঘাট
বিশ্বাস না হয় দেখে যেতে
পারেন-বাস রুট ৪, ৩২, ৩৪, ৪৩
৪। ম্যাগাজিন
শব্দটি আমি লক্ষ্য করেছি রাইফেল ও কবিতার সঙ্গে যুক্ত
আমরাই রেনেসাঁ ও রেজারেকশন?
শরীর বিনষ্ট হ’লে ব্যাধির
প্রকোপ কি ভাবে সম্ভব
সাড়ে বারোটার রোদ্দুরে ভোঁ
বাজলে কারো টিফিন হয়-হয় কারো
রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার
সময়-কালাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার
দরকার পড়ে না-অন্ধদের দরকার
পড়ে না ব্রাকপিকাসোর ছবি দ্যাখার
কাকমত না
মর্কটক্রম-পূর্বজন্মের সুকৃতি না বর্তমানের কর্ম-কোন
ফলে আমি সিদ্ধ হব-কে বলে
দেবে-হঠ ভক্তি জ্ঞান রাজ
কোন যোগী রয়েছে কোথায়
মন্বন্তর শেষে আবির্ভূত মনু
যাঁর জামাতা মহামুনি কর্দম
নিজের স্ত্রীর বক্ষোদেশ দেখে পেতেন
যৌন আকর্ষণ এবং তিনি রেচক
পুরক কুম্ভক করে কুণ্ডলিনী শক্তিকে
করতেন জাগ্রত-বীর্যমোক্ষণের
পর আমার জাগ্রত লিঙ্গ নেতিয়ে পড়ে খুব
তখন ভাবাই যায় না এটা অই
‘ভাবে’ দাঁড়াতে পারে-মেরুদণ্ডের
ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের
আত্মপ্রত্যয়-তবু মানুষ কুঁজো হয়ে যায়
শ্রীমদ্ভাগবৎ পড়ে কেউ পুণ্য
সঞ্চয় করে-কেউ ভাইবোনের
যৌন সংগমের সংবাদ পায় অই
ধর্মগ্রন্থ পড়ে-পোয়াতীর পেট থেকে
বেরিয়ে মেয়েরা ফের
পোয়াতী-লিঙ্গদ্বারে প্রকাশোন্মুখ
মানুষের ভ্রুণ-ভ্রুণ তুমি কি
কথা বলতে পারো-চিন্তা ক্ষমতা
আছে কি তোমার-হায় আমি আর
পাবো না ফিরে আমার
ভ্রুণের জীবন হায় আমি আর
পাবো না ফিরে আমার
হারানো জীবন হায় আমি আর
পাবো না ফিরে আমার
শহীদ ভায়ের জীবন হায় আমি
জীবনকে ভালোবেসে ভুলে যাই
মৃতদের-মৃতদের কথা ভাবতে
ভাবতে জীবিতদের ভুলে যাই
একটি মেয়ের প্রেম পেয়ে
ভুলে যাই আরেকটি মেয়ের প্রত্যাখান
এ ভাবেই বড় হই আমি বেড়ে
উঠি-আমার আঁতুড় ঘরের আয়তন
বাড়ে না একটুও-এর ফলে
ম্যালথাস থিওরী না জেনেই বুঝে যাই
আমি জমি বাড়ে না মানুষ
বেড়ে যায় সংখ্যায়-লুপ্ত হয়
একশৃঙ্গ গণ্ডারের
দল-ম্যামথের কথা আজ মীথ হয়ে গ্যাছে
মানুষের কথা দিয়ে তৈরী
হচ্ছে নতুন পুরাণ-
হে চন্দ্রজয়ী শুক্রকীট
মানুষ-শুক্রগ্রহের দিকে চলে গ্যাছে তোমার
নভোযান-একদিন সূর্যের দিকে
চলে যাবে কম্যুনিষ্ট ও ক্যাপিটালিস্ট
দেশের যুগ্ম-উদ্যোগ আর
ভারতবর্ষের মার্কসিষ্ট লেনিনিষ্টরা
গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থেকে মেহনতী
মানুষকে করে দেবে আরো
বেশি বুরজোয়া তখন চারশো
টাকা মাইনে পাওয়া
জুতোর দোকানের শ্রমিক দেড়শো
টাকা মাইনে পাওয়া ইস্কুলের
কেরানীকে করবে তাচ্ছিল্য ও তারপর
উত্তমকুমারের আত্মজীবনীসহ
কবিতাপত্রিকা বের করে করে
ফেলবে কবিসম্মেলন
অগণন বাঙালী কিশোরের শহীদ
বেদীর পাশ দিয়ে চলে যায় কলকাতায়
মাড়োয়াড়ী যুবকের আলো
ব্যাণ্ড বাজীময় বিবাহ মিছিল আরো যাবে
বাংলাদেশের বাঙালীদের
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়তে পড়তে
পশ্চিমবাংলার হিন্দু
বাঙালীরা খুন করে ফেলবে হিন্দু বাঙালীদের
এই মন্বন্তরের
ভেতর-মনু-কোথায় তোমার আবির্ভাব আমরা
কেবলি কি আকূতি প্রসূতি
দেবাহূতির পিতা বলে জানবো তোমায়
দুর্জনের নিধন সুজনের
সংরক্ষণকারী কৃষ্ণ তুমি কোথায় আমরা
কেবলি কি বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে
যাবো পর্ণোগ্রাফীর বদলে
অথবা আমরাই
উত্থানশক্তি-আমরাই হবো রেনেসাঁ ও রেজারেকশন
আমরা যারা মহাযানী বৌদ্ধদের
মত প্রজ্ঞাপারমিতা ওরফে নিজস্ব
প্রেমিকাকে করতে চাই শয্যা ও
জ্ঞান সংগিনী আমরা যারা এম্প্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের
কার্ড করবার জন্যে যোগাড়
করতে পারি না বাস ভাড়া
আমরা যারা সিনেমায় ছাড়া আর
কোথাও সমুদ্রকে দেখিনি এখনো এবং শেলী ও হার্ট ক্রেন
সমুদ্রে ডুবে মারা গেছিলেন
জানবার পরেও আমরা যারা
সমুদ্রকে নিয়ে কবিতা লিখি
আমরা যারা মৃত্যুকে মৃত্যু না ভেবে
মনে করি ওটা জন্মান্তরের
পাশপোর্ট আমরা যারা জীবনকে একটা বিস্ময়কর ঘটনা
বলে অভিহিত করি ও
যৌন-জ্যামিতিক সূত্র আবিষ্কার করি
প্রজননে-সূত্রকারকে
আবিষ্কারকে করতে পারি না
আমরা যারা কলমকেই বাইবেল ও
রাইফেল হিসেবে ব্যবহার করি
এবং মৃত সন্তানের শোক ভুলে
যাই কামোত্তেজনায় স্বার্থপরদের
কুম্ভীরাশ্রুতে ভিজে যাওয়া
বিপ্লবীদের বারুদ আমরা যারা শুকিয়ে দিতে চাই
এবং কাউকে মারবেন না গাল
দেবেন না এই শিক্ষা গ্রহণ করি
মাও সে তুঙের বই পড়ে আমরা
যারা এবার ফিরাও মোরে পড়ে
কম্যুনিষ্ট হয়ে যাই পরোপকার
বৃত্তি থেকে স্বেচ্ছায় বিপ্লবী
সেই আমরাই হব কি রেজারেকশন
অথবা পাড়ার বাবলিদের
টিট্কিরি খেতে খেতে
গেন্জি লুংগী পরে রকে বসে
বিড়ি খেতে খেতে
আমরা শুনে যাবো নির্বিকার
রবীনঠাকুরের গান
কৃত্রিম সাপ
গাঁজা খেলে আমার খুব দাবা
খেলতে ইচ্ছে করে-ইচ্ছে করে
গ্রামার পড়তে আমি হতে চাই
না ফিশার বা ফাউলার
দাবা খেললে আমার খুব গাঁজা
খেতে ইচ্ছে করে-ব্যাকরণ
পড়ার সময় আমার চাই
গাঁজা-আমি পানিনি হতে কোনদিন চাইনি
আমি জানি ভাষাচার্য
সুনীতিকুমার আমার চেয়ে তিনহাজার গুণ শিক্ষিত
আমি জানি মহানায়ক
উত্তমকুমার আমার চেয়ে দুহাজার গুণ রূপবান
কিন্তু এর ফলে আমার ভেতর
কোনো হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়নি
জ্ঞানীগুণীরূপবানবিত্তবান
মানুষ-মানুষীর মিছিলে
মূর্খকুৎসিতদরিদ্র
মানুষ-মানুষীর মিছিলে
আমি ভেসে চলে ভুলে যাই সে
সময়ে আমি বেটাছেলে না মেয়েছেলে
কিন্তু নিজের প্যাণ্টের
বোতাম বা বুকপকেটে হাত দিলে
অর্ধনারীশ্বর চেতনা থেকে
পুরুষ অনুভূতির কাছে ফিরে আসি
ফিরে এসে লক্ষ করি অনেক
বাড়ির বৌ ও ঝিদের বুক কোমরের পাছার একই মাপ
লক্ষ করি কলকাতার কোনো এক
পোষাকের দোকানের শোকেসে রয়েছে সাজানো একটি
কৃত্রিম সাপ
এবং ব্যাপারটা আরো
ইন্টারেষ্টিং এই কারণে যে দোকানটার নাম অ্যারেষ্টোক্র্যাট
ঋণঃ মলয় রায়চৌধুরী,সুবিমল বসাক, সমীর রায়চৌধুরী, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
, গৌতম বসুমল্লিক,
ভারবি।
মন্তব্যসমূহ