সেনেটি ঘরামি যেবার প্রথম ভোট দিল/ নভলেট/ রূপাই পান্তি


ভোট মানেই যেন রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন দাঁড়ান, দাঁড়ান গল্পটা মোটেও  তেমন নয় সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে এসেছে মানুষের কাছাকাছি আজকের গল্পটা সেই কাছাকাছি আসার গল্প প্রেমের আর সেই প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে ভোট ব্যাস গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র কাল্পনিক, ঘটনাও, স্থান-কাল-পাত্রের কাকতলীয় মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাতড়াতে বসবেন না আপনার মনে পড়ে গেলে, সে আপনার স্মৃতির দোষ...  


সৌরদীপ্ত চৌধুরী 

পরিচ্ছদঃ


এবার একটা গোলমাল বাঁধবে শান্তিরাম বেশ বুঝতে পারছে পার্টি না করলেও ও বেশ বোঝে রাজনীতি এখন কোথায় চলে গেছে এই আবাদে চার দফায় ভোট হয়ে গেল সারা দেশে খবরের কাগজে যা বলছে, ও জানে, সত্যিটা তার চেয়ে কোথাও কোথাও যতটা কম, কোথাও কোথাও ততটাই বেশি
শীতলিয়া গ্রামে সবাই ওকে চেনে কেননা ও রাজনীতি করে না এত বছর ধরে সবাই তাই দেখে আসছে আদিবাসি এফ পি স্কুলের হেডমাস্টার শান্তিরাম হাঁসদা জ্ঞানত ভোতে কখনও গোলমাল দেখেনি আর এ তো দিল্লির ভোট যে যে পার্টিই করুক, দিল্লির ভোটের সময় সবাই কেমন খোশমেজাজে থাকে লাইনে দাঁড়িয়ে হয়ত এ ওর সাথে মশকরা করছে, ও খ্যাপাচ্ছে ওকে, এ বিড়ি এগিয়ে দিচ্ছে তো ও দেশলাই...
হ্যাঁ, পঞ্চায়েত ভোতে সবাই সক্কাল সক্কাল ভোট দেয় তবু কারোর হাসি মিলিয়ে যায় না কখনও সে যেই জিতুক না কেন... ভোটের খবর বেরোলে সবাই একসাথে গোল হয়ে বসে যাবে হাঁড়িয়া খেতে...
আগে তো পঞ্চায়েতে দাঁড়াতই দুজন জোর তিনজন সবাই জানত, কে জিতবে অবস্থা পালটেছে এখন চাপা একটা উদবেগ টের পায় শান্তিরাম গত কয়েকবছর ভোটের দিনগুলোতে কেমন একটা বদল টের পায় ও না, গোলমাল এ গ্রামে কখনও হয়নি কত ভয় ভাবনা নিয়ে কত দূর থেকে ভোটবাবুরা আসেন, শান্তি আশ্বাস দেয়, না, গোলমাল হবে না কত পালাবদল ঘটে গেছে, কত আনকোরা মুখ কোন অজানা শক্তির জোরে কবে কীভাবে মাতব্বর হয়ে গেছে আশেপাশের গ্রামগুলোতে, কিন্তু এ গ্রামে তার কোনও ছায়া পড়তে দেখেনি শান্তিরাম
দিল্লির ভোট বলে তবু যা নিশ্চিন্তি ছিল, তাও কেমন ভরসা দিচ্ছে না আজ
পার্টি বলতে তো এখন একটা দুটো না পেঁচাপার্টি বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াচ্ছে এবারে দিল্লির ভোট ওরাই ঠিক করে দেবে শোনা যাচ্ছে এখানে ওখানে নাকি বুথে বুথে ওরাই সবার ভোট দিয়ে বেড়াচ্ছে হরদম মেশিন ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে আশেপাশের গ্রামে গ্রামে দল পাকাচ্ছে ওরা  
কোকিল পার্টির অবস্থা এগ্রামে তেমন ভালো নয় আগে দাপট ছিল বটে, সে শান্তিরামের মনে আছে তারপর তো এল ময়না পার্টি তাদের দাপট এখন কমে এলেও ওরা সহজে ছাড়বে না পেঁচারা যদি গোলমাল বাধায়, ওরাও পালটা মজা দেখাতে তৈরি
আর এসবের ফাঁকে কখন যে অজান্তে শালিখ পার্টির দলে ভিড়ে গেছে গ্রামের কিছু মানুষ... কে যে ওদের বুঝিয়ে গেছে এবার দিল্লিতে শালিখ পার্টির দলের সরকার হবে... মানুষ বিশ্বাস করেছে মানুষ, যে মানুষ সহজে সাফল্য চায়, সহজে পেয়ে যেতে চায় স্বপ্নের দেখা পেরিয়ে যেতে চায় দিগন্তের সীমারেখা...
শান্তিরাম হাঁসদার ভয় হয় এই শান্ত গ্রামের কোন খালের ধারে, কোন কাঁটাঝোপের আড়ালে কে যে অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে আছে, কোন বহিরাগত, কবে কখন কার রক্তে ভেসে যাবে বেলেমাটির এই ক্ষেত, এই দূর-দূর খেজুর আর ইউক্যালিপটাসের সারি... আর কার সব সহজ হিসেব মেলাতে কঠিন হয়ে যেবে এই দিন আনা, দিন খাওয়া, হাড়িয়ার গন্ধে ম ম পড়শিঘরের অন্ধকার... শান্তির ভয় হয়...   
তার উপর নিজের  কানে শুনেছে... ভান্ডারখালি থেকে ফেরার পথে পেঁচাপার্টির গোপন অফিসের পাশে এক চালার নিচে বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাচ্ছিল শান্তি ওরা দল পাকাচ্ছে মেশিন দখলের সেক্টর অফিসারকে হাত করে ফেলেছে প্রায় শুনেছে, প্রিসাইডিং অফিসারটি নাকি নরম গোছের দেখতেও খুব সহজ বয়স কম
ওরা প্রথমে প্রিসাইডিং অফিসারকে হাত করে নেবে তারপর ভোটিং কম্পার্টমেন্টে ওদের লোক দাঁড়িয়ে থাকবে সব ভোট ওরাই দিয়ে দেবে প্রিসাইডিং অফিসার কিছু বলবে না  আর সেক্টর তো হাতের লোক... উপর থেকেও কেউ অবজেকশান করার মতো নেই ফলে এবারের ভোট জমে গেছে...
শান্তির ভয় হচ্ছে সত্যি প্রিসাইডিং অফিসারটি যদি তেমন হয়, যদি মেনে নেয় ওদের দাবি... এবার এই প্রথম তবে শীতলিয়াতে গোলমাল হবে... হাঁড়িয়া খাইয়ে ভোটের যে রেওয়াজ নিয়ে ও এতকাল প্রতিবাদ করে এসেছে, আজ যা শুনল, তা যদি ঘটে, তবে তো...
শান্তি দ্রুত পা চালায় শেষ ভটভটিটা ধরতেই হবে দেখতেই হবে ভোটবাবুদের...




সৌরদীপ্ত চৌধুরী 


পরিচ্ছদঃ


“আপনারা আজকেই চলি আইলেন যে!”
সম্ব ফিরে তাকাল বেশ সাজুগুজু করা একটা লোক পেছনে আরও দু-তিনজন সম্ব কিছু বলার আগেই স্বপনবাবু এগিয়ে গেলেন
“আমরা? এসেই গেলাম, বুইলেন... পাঠিয়ে দিল তো! তা আপনারা কী দরকারে যদি বলেন...”
“আমরা? হেঁ হেঁ... মানে রান্না করি দেব... আপনাদির...” সাজুগুজু আবার রান্না করে? দেখে তো মনে হয় না
“আরে, না, না, বুইলেন, আপনাদের অত কষ্ট করার কী দরকার... ইস্কুলের রান্নার লোক তো আচে, ওরাই করে দেবেখোন...”
“ইস্কুলির ঐ মেইছেলিরা? উরা আস্‌পেনা উরা আবার রানতি পারেনায়ি?” সাজুগুজু খ্যাঁকখ্যাঁক হাসে পেছনের একজন তাল দেয়
“আপনার বাড়িতেও কি আপনি রান্না করেন?” সম্ব না বলে পারল না
সাজুগুজু হঠাৎ সিরিয়াস “আমরা রেঁদি দোবো, পার হেড আমাদের দুশো ট্যাকা অ্যাক্‌বেলা” 
“আমাদের জন্য রান্নার গ্রুপের লোককে বলা আছে আপনারা আসুন” সম্ব সোজা দাঁড়াল সাজুগুজুর সামনে চোখের দিকে তাকাল সাজুগুজুর বিড়িখাওয়া কালো দাঁত আর্ধেক বেরিয়ে থাকতে থাকতে কেমন পালাই-পালাই করছে দেখে পেছনের কে যেন বলে ওঠে, “আমাদিরুপর এই গিরামের কেউ কতা কয় না
“বুইলেন, সার, এদের সাথে কথা বলে লাভ নেই  আপনি চলেন” স্বপনবাবু সম্বর পাশে এসেছে আর সাজুগুজুর তখনও অর্ধেক দাঁত, অর্ধেক জিভ... ও সুড়ুৎ করে নাল টেনে নেয়
রান্নার গ্রুপের মেয়েরা স্কুলবাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে ভোটবাবুদের সাথে দেখা করতে এসে সাজুগুজু আর সম্বর এই ফ্রিজ শট দেখছে দিব্যেন্দুদা নেমে এসেছে ওপর তলা থেকে পুলিশকাকু
আর সম্বকে ডাকছে একটা অনেক চেনা গলা সম্ব তাকিয়ে আছে সাজুগুজুর ঔদ্ধত্বের দিকে, সাজুগুজু তাকিয়ে আছে সম্বর সাহসের দিকে স্বপনবাবু তাকিয়ে আছে, দিব্যেন্দুদা, পুলিশকাকু, রান্নার দল, আর তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ একটা অদ্ভুত চেনা গন্ধ নিয়ে কাছে আসতে চাওয়ার মতো বিকেল...
মোটরবাইকের শব্দে ঘোর কাটে সকলের সাজুগুজু চলে যাচ্ছে স্কুলবাড়ির সামনের ইঁটপাতানো রাস্তা ধরে সঙ্গে ওর সাঙ্গোপাঙ্গো বাইক থেকে নেমে সেক্টর সম্বর দিকে এগিয়ে আসছে
সম্ব দেখছে সেক্টরের চোখে কেমন এক অবিশ্বাস কেমন অচেনা দৃষ্টিতে দেখছে ওকে কেমন অচেনা আর মাঠ পেরিয়ে, সামনের রাস্তার দুদিকের ছোটো ছোটো ডোবা পেরিয়ে তখন বিকেলের আলো এসে খেলা করবে বলে অপেক্ষায় দাঁড়ায় স্কুলবাড়ির সামনের মাঠে যেন ভয়ে ভয়ে ... সম্ব হাত নেড়ে ওদের ডাকে

সৌরদীপ্ত চৌধুরী 

মন্তব্যসমূহ