ভোট মানেই যেন রাজনীতির গন্ধ পেয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। গল্পটা মোটেও তেমন নয়। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার এসেছে ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে। ক্ষমতার সাধারণীকরণ এসেছে। এসেছে মানুষের কাছাকাছি। আজকের গল্পটা সেই কাছাকাছি আসার গল্প। প্রেমের। আর সেই প্রেমের অনুষঙ্গে এসেছে ভোট। ব্যস। গল্পটা এমন হতে পারত, কিন্তু... সেই... আমাদের ঘুরে ঘুরে ঘোলা জলে মাছ ধরার সেই অভ্যেস... বলছি, সব চরিত্র কাল্পনিক, ঘটনাও, স্থান-কাল-পাত্রের কাকতলীয় মিল খুঁজে কেউ আবার স্মৃতি হাতড়াতে বসবেন না। আপনার মনে পড়ে গেলে, সে আপনার স্মৃতির দোষ...
পরিচ্ছদঃ ১
“বাঁ-হাত।”
সেনেটি বাঁ-হাত বাড়িতে দিল।
ঠাণ্ডা। কালো। নির্জন
মসৃণ একটা বাঁ-হাত। সেনেটি ঘরামির। নতুন ভোটার। ১৮২
পশ্চিম শীতলিয়া আদিবাসী এফ পি স্কুল ভোটকেন্দ্রের ১০০১ নম্বর ভোটার।
সম্বর্ত্তক একটু দেরী করে। যতটা
দেরী করা যায়। ভরা
মরসুমে বেলা পড়ে আসছে। ভোত কেন্দ্রে ওরা মাত্র দুজন। ভোটার
সেনেটি আর প্রিসাইডিং অফিসার সম্বর্ত্তক। ওর তিন পোলিং অফিসার খেতে
গেলো এইমাত্র। তাই
সেনেটি। একা। পোলিং
এজেন্টরা ওর ভোটার নম্বর মিলিয়ে বাইরে গেছে। ব্যাপারটা কাকতলীয় কি না, সম্ব জানে না। যেভাবে
কেটেছে এই তিনটে দিন!
“কই ? হাত
নিয়ে কী করবেন?” সেনেটি
ঢেউএর মতো ভাসছে।
“কালি দিতে হবে।”
“নতুন করে আপনি আর কী কালি
দেবেন...”
“তোমার প্রথম ভোট সেনেটি...”
“তবু কালি লাগল। ভোট
না দিয়েই কালি লাগল বাবু। এ ভোট আমার মনে থাকবে। অনেক, অনেকদিন মনে থাকবে আমার...”
আর আমাকে? এই যার জন্য এত কালি
মাখলে, তাকে? সম্ব ভাবল একবার বলেই
ফেলে। কিন্তু
ঐ যে! নাহ! থাক কী ভাববে! সম্ব ইনডেলিবেল কালির
শিশি থেকে প্লাস্টিকের বাড বের করে। ভোটের কালি...
অবশ্য কালি মাখানো, ভোটার লিস্টে নাম মেলানো, সিরিয়াল নাম্বার লিখে
সেনেটির দিকে ১৭ এ মানে নির্বাচক নিবন্ধ বা ভোটার রেজিস্টার বাড়িয়ে দিয়ে সই নেওয়া, ই ভি এমের কন্ট্রোল
ইউনিটের বোতাম টিপে ভোট নেওয়া, কিছুই ওর কাজ নয়... তবু এই ভরা ভোটের দিন
দুপুরে, ১০৭০
ভোটারের ভোটকেন্দ্রে যেখানে ৮৪৬ ভোট পড়েছে, সেখানে ও একা। একাই
সামলাচ্ছে সব কাজ। সামলাচ্ছে
মানে ইচ্ছে করেই। সামনে
দাঁড়িয়ে সেনেটি ঘরামি ওর কালো চোখে দেখে চলেছে ভোটবাবুকে।
“কতটা দাগ দেব?”
শুনে হাসল সেনেটি। শান্ত
পুকুরে একটা ঢিল পড়ে যেন ভেঙে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা... “এতটা দাগ লেগে গেছে... তার
পরেও আপনি ভয় পাচ্ছেন বাবু? এ
দাগ তো কালই উঠে যাবে...”
“এ দাগ দিনকয়েক থেকে যাবে... দেখ, ভুলে যেতে যতটা সময়...”
“আপনি যেন কেমন করে বলেন... শুনতে
ঠিক...” সেনেটি
কেন থেমে যায়... চোখে
কি জল আসে? আলোর
দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে মুখটা ভালো দেখতে পারে না সম্ব।
“সেই পরশু থেকেই বলে আসছ, কেমন, কিন্তু সত্যি কেমন... লুকিয়ে রাখছ...”
“নাহ... আপনি
ভালো কথা বলেন... এমন
কথা কেউ বলে না... এমন
করে বলে না...”
“কিন্তু...”
“যাতে মনে থাকে তেমন করেই
মাখিয়ে দিন...”
“মনে রাখবে? সত্যি?” সাহস করে বলে ফেলে সম্ব
নিজে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে চাইল... আর সেনেটি, হিঙ্গলগঞ্জের কোন দূর
গ্রামের এক কালো মেয়ে কবে কখন ওর নাম করে ফুঁপিয়ে উঠবে, ভাবতে ভাবতে ছোট্ট করে
কালির দাগ দিয়ে দিল বাঁ-হাতের তর্জনীর নখে। হাতটা কেঁপে উঠল। দাগের টান পড়ে গেল আরও
একটু। আঙ্গুলের
প্রথম করের গিঁট অবধি... আঁকাবাঁকা... সেনেটি চুপ করে কালি মেখে
যাচ্ছে... যেন
মনে মনে চাইছে যতটা কালি আছে, মাখাতে চায়, মাখাক, এই অকাল দোলের উৎসবে...
“দেরী হয়ে যাচ্ছে না?”
সেনেটির কথায় পাতাও নড়ে ওঠে। সম্ব
কালি মাখানোর বাড সরিয়ে নিচ্ছে। দেখছে, অনেকটা দাগ পড়ে গেছে। অথচ... ভেবেছিল একটা ছোট্ট কালির
ফোঁটা দেবে নখের উপর... এত
ছোটো, যে
রাতে যখন নেলপালিশ পরবে সেনেটি, তখন যেন ঢেকে যায়... কিন্তু... এই হচ্ছে ওর সাথে গত
তিনদিন ধরে... ও
ভাবছে এক, আর
হচ্ছে আর এক...
সম্ব কন্ট্রোল ইউনিটের
বোতাম টিপে দিল। “তোমার প্রথম ভোট, সেনেটি। বোতাম
টেপার পর শব্দটা থেমে যাবে। খেয়াল করবে কিন্তু...”
“সব শব্দ কি থেমে যায় বাবু?” বলতে
বলতে সেনেটি ভোটিং কম্পার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যায়।
সম্ব চেয়ারে বসে থাকে। মনে
হয়, এই
শব্দ যেন না থামে, এই
ব্যালট ইউনিটের বিপ্বিপ্শব্দ। একটানা, সারাদিন যা অসহ্য মনে
হচ্ছিল। সেনেটি কম্পার্টমেন্ট থেকে এদিকে তাকাচ্ছে না। সম্ব তাকিয়ে থাকে। সেনেটি
বেরিয়ে আসছে। ওর
হাত ধরে ডেকে নিচ্ছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে সামনের মাঠ পেরিয়ে, দিগন্ত জোড়া খেজুর আর
ইউক্যালিপটাস গাছের সারি পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নদী পেরিয়ে...
“এখন আসি, বাবু। সন্ধ্যায়
দেখে করব...” সেনেটি
যখন চলে গেছে, তখনও
সম্ব ওর হাত ধরে হেঁটে চলেছে... নেবুখালির ঘাট পেরিয়ে, সাহেবখালির ঘাট পেরিয়ে, সদরের দিকে এগিয়ে চলেছে, শহরের দিকে। সেনেটি ওকে চেনাচ্ছে, ঐ যে দূরে, দেখছেন, অদিকে শমশানখালি, তার পরেই বাংলাদেশ। ওদিকে
গেলে ভারতের মোবাইলের টাওয়ার পাবেন না। আর ঐ দিকে...
তখন ১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া
আদিবাসী এফ পি স্কুল ভোটকেন্দ্রের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দুটো নীলকণ্ঠ পাখি
এসে বসেছে জানালায়। ভোটকেন্দ্রের
ভেতর একা সম্ব জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালার ওপাশে ইট পাতানো
রাস্তার ধারে খাবার জলের টিউবওয়েল। সেখানে অবিরাম গ্রামের মেয়ে বউরা জল ভরে
নিয়ে যায়। সকাল
থেকে আজ অবশ্য জল নেবার ভীড় কম। সামনের মাঠের একদম শেষ প্রান্তে হাঁড়িয়া
নিয়ে বসে আছে কয়েকজন। বিনে পয়সায় হাঁড়িয়া খাওয়ানো চলছে সকাল থেকে।
সম্ব চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। তাহলে
ভোট ৮৫০র বেশি পড়ল না। আর এর জন্য দু দিনের এত নাটক, এত হইচই...
পরিচ্ছদঃ ২
“১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া
আদিবাসী এফ পি ইস্কুল। ভোটার কত জানেন? ১০৭০। মশায়, রাত কাবার হয়ে যাবে সার। বুইলেন? তারোপোর আদিবাসী
এলাকা মোশায়। কপালে যে কী আছে...” স্বপনবাবুর
ব্যাগটা যখন বেঞ্চের ওপর পড়ল, তখন সম্বর একটু হলেও
চিন্তা হয়েছিলই।
তো, যখন সাহেবখালি ঘাটের দিকে আসছে, সেক্টর অফিসার অভিজিৎ ওদের চেনাচ্ছে নানা অলি-গলি, নানা সমাধান, যা সম্বকেই বোঝাতে চাইছে বারবার, যে, আপনি তো একদম কমবয়সী, আপনি কী করে পারবেন, যখন ওর হয়ে দিব্যেন্দুদা জানাচ্ছে, গাঙ্গুলি এর আগে দুটো পঞ্চায়েত, একটা লোকসভা, একটা বিধানসভা ভোট করে এসেছে, ওকে বোঝাতে হবে না, যখন ওর বুথের দুই সশস্ত্র পুলিশ বাসের পেছনের সিটে বসে
একনাগাড়ে কেশেই যাচ্ছে, একজন ইনহেলার নিচ্ছে, আর ১৮১ না ১৮৩, নাকি ৮৪-৮৫ বুথের কেউ হবে, ও ঠিক চেনে না, হাসছে পুলিশের এই অবস্থা নিয়ে, এই আর্ম নিয়ে কী করে ভোট হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন সম্বর শুধু বাসের জানালা দিয়ে দূরে যতটা দেখা যায়, তাকিয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না। এই মাঠ-ঘাট, এই রোগা, ক্ষিদের ভারে বেঁকে যাওয়া মানুষগুলো রাস্তার পাশে সারি
সারি দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের এই গণতন্ত্রের বয়ে যাওয়া। সম্ব শুনতে পাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে হু হু বাতাসের ফিসফিসানি... কেমন এক
মনমরা বাতাস। গুমরে উঠছে যেন।
তারপর লঞ্চের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। মেঘ করে এল। বাতাস যেন পাগল হয়ে উঠেছে। স্বপনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি চলছেই। এবার কী হবে, এবার কী হবে?
নেবুখালি ঘাটে ওদের জন্য ইঞ্জিন ভ্যান অপেক্ষায় ছিল। প্রতি বুথের নাম্বার সাঁটা দুটো করে ভ্যান। সম্ব গুছিয়ে বসে। সামনে দিব্যেন্দুদা আর পুলিশকাকু, দত্ত। নিত্যদা, স্বপনবাবু আর সুধীরবাবু, সবচেয়ে বয়স্ক পুলিশ কনেস্টবল, যার আর মাত্র ৫ মাস চাকরী আছে, আর একটা ভ্যানে উঠে পড়েছে ততক্ষণে।
আর ভ্যান ছুটতেই হু হু বাতাস ভারী হয়ে আসে, গুমরে ওঠে। সম্বর মনে হয়, বাতাসের কী একটা বলার ছিল ওকে। এত লোকের মাঝে বলতে পারছে না। ভ্যানের পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে ও
আকাশের দিকে তাকায়। বুকে চেপে ধরা ই ভি এম। ঠোঁট ফুলিয়ে যেন তৈরী হচ্ছে সেও।
আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আটটা ইঞ্জিন ভ্যান প্রবল আক্রোশে
ছুটে চলেছে দিগন্ত পেরিয়ে, গণতন্ত্রের সিপাই আর
যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম নিয়ে। আর দূরে আবদার না মেটা শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে সম্ব বুঝতে
পারছে, এবার কান্না আসবে। ও ভ্যানের ড্রাইভারকে বলে, “বৃষ্টি আসছে তো, আমাদের পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“তা পিরায় মিনিট কুড়ি তো লেগি যাবে ছার...”
তা, কুড়ি মিনিট তো অনেক সময়। ততক্ষণে মনের কথা বলতে না পেরে আকাশ-বাতাসের জোড়া মনখারাপ কান্না হয়ে ছুটে
আসছে। ঝমঝম করে নেমে আসছে ওদের ভ্যানের ওপর।
সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ওদের ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা
দোকান ঘরের সামনে। মালপত্তর নিয়ে বন্ধ দোকানের চালার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা
তিনজন।
সম্ব আকাশের দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ বৃষ্টি হবে না মনে হয়। তবু ভোগান্তি...
আর তখনই ছুটতে ছুটতে একটা মেয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে এসে
দাঁড়ায় ওর পাশে। ভিজে সপসপে। লম্বা
চুলের বেনী থেকে জল... সম্বর গা ঘেসে দাঁড়িয়ে মেয়েটা চুলের বেনী একপাশে সরিয়ে
ঘাড়ের কাছে জমা জল মোছে। কালো রঙেরও এত আলো থাকে, সম্ব আগে দেখেনি।
যেভাবে ধাক্কা দিয়ে এসে দাঁড়াল, তাতে যেটুকু রাগ হয়েছিল, ভেবেছিল, একবার ডেকে দুকথা শোনাবে কি না... সেসব কেমন ভুলে গেছে
বেমালুম। বরং মেয়েটাই এবার লজ্জায় ভেসে বলে দিল, “সরি। ধাক্কা লেগে গেল। দেখতে পাইনি।”
সম্ব কী বলল, তা নিজেই শুনতে পেল না। শুধু তাকাল। সিক্তবসনা। সাদা
সালোয়ার ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। ভিজে জামার নিচে জেগে ওঠা শালুকপাতার মতো অন্তর্বাসের বহর ঠিকরে বেরোচ্ছে। সম্ব দেখছে ভারতবর্ষ। টলটলে দিঘিরঢালু পার বেয়ে নেমে
গেছে কালো মাটির রাস্তা। দূর বলে মনে হয় না, তবু এত দূর... লোভ হয়। সম্ব চোখ ফেরাল...
“কুথায় গিচিলি র্যা?” ভ্যানোর
ড্রাইভার পাশ থেকে কথা বলছে ততক্ষণে।
“পড়াতে।”
“অ। তা ছাতা নিস নাই?”
“না গো। ভুলে গেছি। কে জানত যে বৃষ্টি হবে? এত রোদ ছিল সকালে...”
“ফিরবি কি কর্যে?”
“তাই তো ভাবছি। একটাও ভ্যান নেই। তাই হাঁটছিলাম।”
“তুই চিন্তা করিসনে। দাঁড়া, আমি বাবুর্যে বইলচি। আমাদের সাথ্যে যাইসখন।”
“এনারা ভোটবাবু নাকি?”
“তো? তুর কি মনে হইচ্ছ্যে?”
সম্ব জানে, ওর কী মনে হচ্ছে। কিন্তু
বলে না। ভ্যানোর ড্রাইভার সামনে এসে বলে, “বাবু, এ আমাগে গেরাম্যের
মেয়্যা। সেনেটি। আপনার যদি তেমুন অসুবিধা না হয়, আমাগ্যে সাথ্যে নিয়্যা যাব?”
দিব্যেন্দুদা বিড়ি ধরিয়েছে। সম্বর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সম্ব বলার আগে বলে ওঠে, “আরে বাবা, অসুবিধার কী আছে? যাবে তো নিয়ে চলো না! ভারি তো একটা মেয়ে যাবে... আগে
বৃষ্টিটা তো থামুক...”
সম্ব তখন
এক অদ্ভূত গন্ধ পাচ্ছে। সেনেটির গা থেকে। ভিজে সালোয়ার শুকোচ্ছে হাওয়াতে। শিরশির কাপছে সেনেটি। আর ঘামেভেজা কালো শরীর থেকে ভেসে আসছে কী এক অজানা রহস্যের মতো ঘ্রাণ।
তো, একসময় বৃষ্টি থামে। ভ্যানে স্টার্ট দেয় ড্রাইভার। পেছনে সম্বর পাশে সেনেটি। তখন আকাশের মুখে কী এক হাসি লেগে আছে। বাতাসের মেজাজটাও কেমন ফুরফুরে। ভ্যানের ভট্ভট্ছাপিয়ে সেনেটির
গলা পায় সম্ব।
“আপনি ভোটবাবু?”
“ভোট নিতে এসেছি বটে তবে আমি বাবু-টাবু নই। আমার একটা নাম অবশ্য আছে...”
“তবুও... আসলে আমরা ভোটবাবু বলেই ডেকে আসি। প্রত্যেক ভোটে এক এক দল ভোটবাবু...”
“তুমি পড়াও শুনলাম। কী নিয়ে পড়? না কি শুধু পড়াও?”
“আমি? আমি ভূগোলে এম এ করছি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের
ছেলে-মেয়েদের ভূগোল পড়াই একটু। হাতখরচটাও উঠে আসে, চর্চাটাও হয়... আপনি কী করেন?”
“আমি? আমি এই ভোট নিয়ে
বেড়াই...” রহস্য করে বলে ওঠে সম্ব।
“তাই কখনও হয়? চাকরী তো একটা করেনই... অবশ্য যদি না বলতে চান...”
“আরে, না না, সেরকম কিছু না। আমিও পড়াই। একটা স্কুলে। বাংলা পড়াই আমি।”
তারপর সারাপথ এটা-ওটা। আঁকাবাঁকা পথে দামাল ভ্যানের অবিরাম গর্জন তুলে ছুটে
চলার ঝাঁকুনি আর বাকবদলের কল্যাণে সেনেটি টাল সামলাতে না পেরে বারবার গা ঘেঁসে
হেলে পড়ছে। আর বারবার সেই অদ্ভূত গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে সম্বকে।
পরিচ্ছদঃ ২
“১৮২ পশ্চিম শীতলিয়া
আদিবাসী এফ পি ইস্কুল। ভোটার কত জানেন? ১০৭০। মশায়, রাত কাবার হয়ে যাবে সার। বুইলেন? তারোপোর আদিবাসী
এলাকা মোশায়। কপালে যে কী আছে...” স্বপনবাবুর
ব্যাগটা যখন বেঞ্চের ওপর পড়ল, তখন সম্বর একটু হলেও
চিন্তা হয়েছিলই।
তো, যখন সাহেবখালি ঘাটের দিকে আসছে, সেক্টর অফিসার অভিজিৎ ওদের চেনাচ্ছে নানা অলি-গলি, নানা সমাধান, যা সম্বকেই বোঝাতে চাইছে বারবার, যে, আপনি তো একদম কমবয়সী, আপনি কী করে পারবেন, যখন ওর হয়ে দিব্যেন্দুদা জানাচ্ছে, গাঙ্গুলি এর আগে দুটো পঞ্চায়েত, একটা লোকসভা, একটা বিধানসভা ভোট করে এসেছে, ওকে বোঝাতে হবে না, যখন ওর বুথের দুই সশস্ত্র পুলিশ বাসের পেছনের সিটে বসে
একনাগাড়ে কেশেই যাচ্ছে, একজন ইনহেলার নিচ্ছে, আর ১৮১ না ১৮৩, নাকি ৮৪-৮৫ বুথের কেউ হবে, ও ঠিক চেনে না, হাসছে পুলিশের এই অবস্থা নিয়ে, এই আর্ম নিয়ে কী করে ভোট হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন সম্বর শুধু বাসের জানালা দিয়ে দূরে যতটা দেখা যায়, তাকিয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না। এই মাঠ-ঘাট, এই রোগা, ক্ষিদের ভারে বেঁকে যাওয়া মানুষগুলো রাস্তার পাশে সারি
সারি দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের এই গণতন্ত্রের বয়ে যাওয়া। সম্ব শুনতে পাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে হু হু বাতাসের ফিসফিসানি... কেমন এক
মনমরা বাতাস। গুমরে উঠছে যেন।
তারপর লঞ্চের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। মেঘ করে এল। বাতাস যেন পাগল হয়ে উঠেছে। স্বপনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি চলছেই। এবার কী হবে, এবার কী হবে?
নেবুখালি ঘাটে ওদের জন্য ইঞ্জিন ভ্যান অপেক্ষায় ছিল। প্রতি বুথের নাম্বার সাঁটা দুটো করে ভ্যান। সম্ব গুছিয়ে বসে। সামনে দিব্যেন্দুদা আর পুলিশকাকু, দত্ত। নিত্যদা, স্বপনবাবু আর সুধীরবাবু, সবচেয়ে বয়স্ক পুলিশ কনেস্টবল, যার আর মাত্র ৫ মাস চাকরী আছে, আর একটা ভ্যানে উঠে পড়েছে ততক্ষণে।
আর ভ্যান ছুটতেই হু হু বাতাস ভারী হয়ে আসে, গুমরে ওঠে। সম্বর মনে হয়, বাতাসের কী একটা বলার ছিল ওকে। এত লোকের মাঝে বলতে পারছে না। ভ্যানের পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে ও
আকাশের দিকে তাকায়। বুকে চেপে ধরা ই ভি এম। ঠোঁট ফুলিয়ে যেন তৈরী হচ্ছে সেও।
আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আটটা ইঞ্জিন ভ্যান প্রবল আক্রোশে
ছুটে চলেছে দিগন্ত পেরিয়ে, গণতন্ত্রের সিপাই আর
যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম নিয়ে। আর দূরে আবদার না মেটা শিশুমুখের দিকে তাকিয়ে সম্ব বুঝতে
পারছে, এবার কান্না আসবে। ও ভ্যানের ড্রাইভারকে বলে, “বৃষ্টি আসছে তো, আমাদের পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“তা পিরায় মিনিট কুড়ি তো লেগি যাবে ছার...”
তা, কুড়ি মিনিট তো অনেক সময়। ততক্ষণে মনের কথা বলতে না পেরে আকাশ-বাতাসের জোড়া মনখারাপ কান্না হয়ে ছুটে
আসছে। ঝমঝম করে নেমে আসছে ওদের ভ্যানের ওপর।
সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ওদের ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়েছে একটা
দোকান ঘরের সামনে। মালপত্তর নিয়ে বন্ধ দোকানের চালার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা
তিনজন।
সম্ব আকাশের দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ বৃষ্টি হবে না মনে হয়। তবু ভোগান্তি...
আর তখনই ছুটতে ছুটতে একটা মেয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে এসে
দাঁড়ায় ওর পাশে। ভিজে সপসপে। লম্বা
চুলের বেনী থেকে জল... সম্বর গা ঘেসে দাঁড়িয়ে মেয়েটা চুলের বেনী একপাশে সরিয়ে
ঘাড়ের কাছে জমা জল মোছে। কালো রঙেরও এত আলো থাকে, সম্ব আগে দেখেনি।
যেভাবে ধাক্কা দিয়ে এসে দাঁড়াল, তাতে যেটুকু রাগ হয়েছিল, ভেবেছিল, একবার ডেকে দুকথা শোনাবে কি না... সেসব কেমন ভুলে গেছে
বেমালুম। বরং মেয়েটাই এবার লজ্জায় ভেসে বলে দিল, “সরি। ধাক্কা লেগে গেল। দেখতে পাইনি।”
সম্ব কী বলল, তা নিজেই শুনতে পেল না। শুধু তাকাল। সিক্তবসনা। সাদা
সালোয়ার ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। ভিজে জামার নিচে জেগে ওঠা শালুকপাতার মতো অন্তর্বাসের বহর ঠিকরে বেরোচ্ছে। সম্ব দেখছে ভারতবর্ষ। টলটলে দিঘিরঢালু পার বেয়ে নেমে
গেছে কালো মাটির রাস্তা। দূর বলে মনে হয় না, তবু এত দূর... লোভ হয়। সম্ব চোখ ফেরাল...
“কুথায় গিচিলি র্যা?” ভ্যানোর
ড্রাইভার পাশ থেকে কথা বলছে ততক্ষণে।
“পড়াতে।”
“অ। তা ছাতা নিস নাই?”
“না গো। ভুলে গেছি। কে জানত যে বৃষ্টি হবে? এত রোদ ছিল সকালে...”
“ফিরবি কি কর্যে?”
“তাই তো ভাবছি। একটাও ভ্যান নেই। তাই হাঁটছিলাম।”
“তুই চিন্তা করিসনে। দাঁড়া, আমি বাবুর্যে বইলচি। আমাদের সাথ্যে যাইসখন।”
“এনারা ভোটবাবু নাকি?”
“তো? তুর কি মনে হইচ্ছ্যে?”
সম্ব জানে, ওর কী মনে হচ্ছে। কিন্তু
বলে না। ভ্যানোর ড্রাইভার সামনে এসে বলে, “বাবু, এ আমাগে গেরাম্যের
মেয়্যা। সেনেটি। আপনার যদি তেমুন অসুবিধা না হয়, আমাগ্যে সাথ্যে নিয়্যা যাব?”
দিব্যেন্দুদা বিড়ি ধরিয়েছে। সম্বর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সম্ব বলার আগে বলে ওঠে, “আরে বাবা, অসুবিধার কী আছে? যাবে তো নিয়ে চলো না! ভারি তো একটা মেয়ে যাবে... আগে
বৃষ্টিটা তো থামুক...”
সম্ব তখন
এক অদ্ভূত গন্ধ পাচ্ছে। সেনেটির গা থেকে। ভিজে সালোয়ার শুকোচ্ছে হাওয়াতে। শিরশির কাপছে সেনেটি। আর ঘামেভেজা কালো শরীর থেকে ভেসে আসছে কী এক অজানা রহস্যের মতো ঘ্রাণ।
তো, একসময় বৃষ্টি থামে। ভ্যানে স্টার্ট দেয় ড্রাইভার। পেছনে সম্বর পাশে সেনেটি। তখন আকাশের মুখে কী এক হাসি লেগে আছে। বাতাসের মেজাজটাও কেমন ফুরফুরে। ভ্যানের ভট্ভট্ছাপিয়ে সেনেটির
গলা পায় সম্ব।
“আপনি ভোটবাবু?”
“ভোট নিতে এসেছি বটে তবে আমি বাবু-টাবু নই। আমার একটা নাম অবশ্য আছে...”
“তবুও... আসলে আমরা ভোটবাবু বলেই ডেকে আসি। প্রত্যেক ভোটে এক এক দল ভোটবাবু...”
“তুমি পড়াও শুনলাম। কী নিয়ে পড়? না কি শুধু পড়াও?”
“আমি? আমি ভূগোলে এম এ করছি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের
ছেলে-মেয়েদের ভূগোল পড়াই একটু। হাতখরচটাও উঠে আসে, চর্চাটাও হয়... আপনি কী করেন?”
“আমি? আমি এই ভোট নিয়ে
বেড়াই...” রহস্য করে বলে ওঠে সম্ব।
“তাই কখনও হয়? চাকরী তো একটা করেনই... অবশ্য যদি না বলতে চান...”
“আরে, না না, সেরকম কিছু না। আমিও পড়াই। একটা স্কুলে। বাংলা পড়াই আমি।”
তারপর সারাপথ এটা-ওটা। আঁকাবাঁকা পথে দামাল ভ্যানের অবিরাম গর্জন তুলে ছুটে
চলার ঝাঁকুনি আর বাকবদলের কল্যাণে সেনেটি টাল সামলাতে না পেরে বারবার গা ঘেঁসে
হেলে পড়ছে। আর বারবার সেই অদ্ভূত গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে সম্বকে।
মন্তব্যসমূহ