ইজ্জত আলীর কবর
- কালার মাইরা গল্প কইতাসোস গুরু!
সিগারেট ধোঁয়ার রিং বানাতে
বানাতে বলল তুর্য।
- রঙ চরাই নাই। ওইসব আমাকে
দিয়ে হয় না। গল্পটা এমন করে শুনেই তো বড় হলাম।
তুর্যের ঠেস লাগা কথা হজম না
করে পালটা বলি আমি।
- হুম!
সরু চোখে মিলিয়ে যাওয়া ধুম্রগোল্লাটার দিকে
তাকিয়ে আছে তুর্য। সিগারেট ক্ষয়ে গোড়া অব্দি চলে এসেছে। ওটাকে ঘাসে গুঁজে দিল। আমি স্বস্তি
পেলাম। সাথের কেউ
ধোঁয়া টানলে আমি বিব্রত হই। কপাল ঘেমে যায়। তালু ঘেমে ওঠে। এতদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েও ধোঁয়া হজমের কলা রপ্ত
হয়নি। বাকিরা একটু
সরেটরে খায়। তুর্যটা বেয়াড়া। মুখের উপর
ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। ইচ্ছে করেই করে, আমি বুঝি। ওর ধারণা এসব
আমার নিজেকে ভিন্ন দেখানোর ছক।
আমি আর তুর্য রমনার ভেতরে বসে আছি। বসে আমি। তুর্য আধশোয়া। এভাবে শুয়ে ধোঁয়ার
গোল গোল রিং বানিয়ে উপরে ছেড়ে দেওয়া আর
তার মধ্যে দিয়ে আকাশ দেখা, তুর্যের এই ভাসমান ধোঁয়াগোলক নাকি তাকে জীবন দর্শন পর্যবেক্ষণ
শেখায়।
- গুরু! আরেকবার কও দেখি
গল্পটা।
তুর্যের পাগলামিতে বিরক্ত
লাগে আমার। আমি মাত্রই গল্পটা বলে শেষ করলাম। আবার গোড়া থেকে
বলতে বলার মানে কী! আমি কি টেপ রেকর্ডার!
- আইচ্ছা খাড়াও! খালেদ আর
জামানরেও ডাকি। ওগো না আসার কথা মাঠে? এখনও খবর
নাই!
- এসে গেছে।
তুর্যের পেছনে দাঁড়ানো খালেদ
আর জামানকে দেখে বললাম আমি। খালেদ আর জামান
ধুপ করে হাতের ব্যাগটা ফেলল। গোল করে মুড়ানো পত্রিকাও ফেলল।
- এই দেশের মাটিতে মরার
রাজাকারের কবর হইল! থুহ!
জামান পত্রিকার ভাঁজ খুলে
সবে বিছিয়েছে ঘাসে, তাতে খালেদের
গোটা গোটা থু থু এসে পড়ল। জামান পত্রিকার দিকে তাকাল। তারপর ফোঁস ফোঁস করতে থাকা
খালেদের দিকে ফিরে পিঠ চাপড়ে দিল।
- মাম্মা! তোমার ছ্যাপের
নিশানা তো জব্বর! পুরা জালিম বুড়ার মুখের উপর পড়সে।
আমরা তিনজনে যতটা জোরে হাসা
যায় হেসে উঠি। খালেদ কেবল ফুঁসছে।
- তাইলে সকল রাজাকারদের কবর
দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখুক। আর ওইখানে একটা
থুথুস্তম্ভ হোক। সময় সময় গিয়ে থুথু দিয়ে আসব।
- এমন কি আসলেই করা সম্ভব!
খালেদের রাগ সামাল দেয়ার
চেষ্টা করি আমি।
- সম্ভব না–ই বা কেন? ঘৃণা প্রকাশের অধিকার তো আছে আমার। রেওয়াজও আছে। মিনায় গিয়ে
কঙ্কর ছুঁড়ে মারে না লাখ লাখ মানুষ? প্রত্যেক রাজাকারের জন্য একটা কালো জামারাত হোক। আমি সাত বার
করে ছ্যাপ ছুঁড়ব প্রত্যেক শয়তান রাজাকারের স্তম্ভে।
- কথা কিন্তু ঠিকই কইসো তুমি
দোস্ত! বিষয়টাকে কাঠামোগত ভাবে প্রস্তাব ও নির্মাণ করতে পারে রাষ্ট্র। যতজনের বিচার হল, তাদের তালিকা, ছবি, রায়ের দিন, তারিখ, অপরাধের
তালিকা, রায়ের কপি, সব একখানে
সংরক্ষণ করে রাখা দরকার। একটা ডিজিটাল
আর্কাইভ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকতে পারে
একটা রাজাকার কক্ষ। কক্ষটা হবে কালো রঙের। আরে ভাই, আগামি প্রজন্মের তো জানা দরকার দেশের মানচিত্রে আঁচড় দেয়া শকুনদের কী
পরিনতি করেছিল এই জাতি!
খালেদ কথা বলতে বলতে রাগে কাঁপছিল, আর জামান কথার শেষে আবেগে। আমরা চারজনে একই সাথে অদ্ভুত শির
শির বোধ টের পাই মেরুদণ্ডে। হাতের তালুতে। আমাদের চোখের চাহনিতে এখন ভাসা ভাসা বোধ নেই। গাছের পাতার
ফাঁক গলে আসা বিকেলের সূর্যের আলোর ঝিলিকে
আমাদের চোখ চকচকে আর দীপ্ত।
- ভাই, চা দিমু আপনেগো?
ফ্ল্যাক্সটা ঠকাস করে ঘাসের উপর এলিয়ে পড়ে থাকা
ভাঙা ইটের উপর রাখল মোকলেস। আমাদের নিয়মিত
বৈকালিক আড্ডাকে চাঙ্গা রাখতে মোকলেসের চায়ের ভূমিকা ইতিহাসে লেখা থাকবে
তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের জন্য মোকলেস স্পেশাল চা বানায়। এটাকে চাফি বলে। আজকাল চাফির
জমজমাট পসার। চায়ের সাথে একটু কফি গুলে দেয়। ফ্ল্যাক্সের আধা ঠাণ্ডা চায়ের মাঝে কফির তিতকুটে স্বাদ
রমনার বিকেলটা পালটে দেয় নিমিষে। তারপরই কারো
গিটারটা তারছেঁড়া সুরে বাজে। কোনো নতুন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের আনকোরা মলাট
উন্মোচনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। বাক্স ভরা সস্তা
প্যাটিস নিয়ে প্যাটিসওয়ালা ছুটে আসে, চায়ের সাথে মচমচে ভাজা প্যাটিস চলবো?
-দে! চারটা চাফি দে। ঠাণ্ডা হইলে
পয়সা পাবি না কইলাম।
তুর্য গলা ভারি করে বলে। অবশ্য তাতে ভয়
পায় না মোকলেস। বরাবরের মতো কালো মাড়িতে সাদা দাঁত কেলিয়ে হাসে। চারটা সাদা প্লাস্টিক কাপে আধা
ঠাণ্ডা চাফি ঢালে একে একে। আরেকদিক থেকে মোকলেসের প্রতিদ্বন্দি আসে।
- স্যার, আমার চা গরম বেশি। মাত্র ক্যান্টিন থেকে নিয়া আসছি।
মোকলেস চা বেড়ে টাকা নিতে
নিতে চোখ গরম করে উঠে দাঁড়ায়। প্রতিদ্বন্দি ফ্ল্যাক্স হাতে ছুট দেয়। মোকলেসও পিছে
পিছে। রোজকার ঘটনা। আমরা তাও ঘাড়
ফিরিয়ে দেখি। আধা গরম চাফিতে সুরুৎ করে চুমুক দেই। আর হাসি। এ-এক অনবদ্য মুহূর্ত।
- গল্পটা কও আবার। জামান আর খালেদ
তো শুনে নাই।
তুর্য ভোলেনি। আমি অসহায় বোধ
করি। জামান আর খালেদ
যেহেতু পরে এসেছে তাই ওদের চোখে আগ্রহ দেখতে পাই। আমি শ্রাগ করি আপনমনে। গলাটা ভারী করে
শুরু করি।
- গ্রামের সবাই বলাবলি করে
ইজ্জত আলী পাক সেনাদেরকে গ্রামের মেয়েদের খোঁজ-খবর দিত লুকিয়েচুরিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা
জোবায়ের-এর বাড়িও নাকি চিনিয়ে দিয়েছিল সেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস পার হলেও মুক্তিযোদ্ধা
জোবায়ের আর ফেরেনি। বাড়ির লোকেরাও সেই সময় ভয়ে পালিয়ে কে কোথায় গেছে, মরেছে না বেঁচে আছে জানে না কেউ। বাড়িতে লুটপাট
হয়েছিল, সেও নাকি ইজ্জত আলীর ইশারায়। এরপর ভিটে খাঁ
খাঁ। শীতের কুয়াশা
বাড়ির ভেতরের অন্ধকারের সাথে মিশে জমাট বাঁধে। ফাগুন মাসের শুকনো বাতাসে
বাড়িটার দরজা-জানালার কপাট যেন খসে পড়বে। ইজ্জত আলী ওই
সময় হা-রে-রে করে ছুটে আসে। কপাট সামাল দেয়। কুকুর খেদায়। উঠানে বেড়া দেয়। তারপর মরাকান্না তুলে বলে,
যুদ্ধে যাবার আগে জোবায়ের তাকে বলে গিয়েছিল, এই বাড়ি আজীবন দেখে রাখতে। গ্রামবাসীর কাছে কোনোকিছুরই
প্রমাণ নেই। তারা কিছু বলে না। খালি খেদিয়ে দেয়া কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করলে ইজ্জত
আলী লুঙ্গি উঁচিয়ে ছুট লাগায়।
- হা হা হা। আমার চোখের
সামনে ইজ্জত আলীর লুঙ্গি উঁচানো ছুট দেখতে পাচ্ছি যেন।
জামান বেশ একচোট হেসে নিল। তুর্য ক্রিটিকস
এ্যাওয়ার্ডের জুরির মতো ভাব মেরে বলল, গল্পটা তো আলাদা কিছু না। এই টাইপ চরিত্রগুলো সাধারণত পরের
দৃশ্যে ভিটেবাড়িই দখল করে।
আমি হালকা কেশে নিলাম। তুর্যের কথার
উত্তর করলাম না। গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করলাম।
- নেড়ি কুকুরটা ছাড়া আসলে আর
কোনো বাধা ছিল না। তাই জোবায়ের পরিবারের শূন্য ভিটেটা ইজ্জত আলীর দখলে চলে এল। বাড়ির চারপাশে
ঘেড়াবেড়া হল। তারপর ইজ্জত আলীর শানশওকত বাড়তে
থাকে। ঢাকায় যোগাযোগ রাখে। গ্রামের মানুষদের শুনিয়ে শুনিয়ে
পার্টির লোকজনদের ফোন দেয়। একবার তো ইজ্জত আলী গ্রামের মেম্বার ইলেকশনে জিতেও গেল। ইজ্জত আলী বুঝাতে চাইল তার অনেক প্রভাব। গ্রামের লোকে সেটা বুঝেও নেয়। গ্রামের লোকেরা
আগে ইজ্জত আলীকে ডাকত ইজ্জত বুইড়া বলে। ছেলেছোকরারা আগে ডাকত ইজ্জত নানা। এরপর থেকে ইজ্জত আলীর নামডাক
চালু হল ইজ্জত মেম্বর।
আমি থেমে সবার মুখে চোখ বুলিয়ে নেই। আসলে ইজ্জত
আলীর জীবনবৃত্তান্ত আমার এত বিষদ জানা নেই। আমি কেবল শেষটাই ছোটবেলায় শুনেছিলাম।
- ক্ষমতা, প্রভাব এসব ইজ্জত আলীর বয়সকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। পাঁচ বছরের
মাথায় শয্যাশায়ী হয় সে। এরও ছয় মাসের মাথায় তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, এলোপ্যাথ ডাক্তার এসে দেখে ঘুরে যেত। তাদের ওষুধে কোনো
ফল হত না। গ্রামের বুড়ো কবিরাজ একদিন এসে বলল, ইজ্জত আলী, তোর মরণ ঘনায় আইসে। তুই তওবা কর। ইজ্জত আলী কথার
জবাব দিতে পারে না। গো গো আওয়াজ করে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। কবিরাজের কথার পর, অনেকেই ইজ্জত আলীকে দেখতে আসে। ইমাম সাহেবকে ধরে নিয়ে আসা হয়। তওবা পড়লেই
ইজ্জত আলীর জীবনমুক্তি। কিন্তু ইজ্জত আলী তওবা বলে না। ইমাম সাহেব টানা সাত দিন এসে ঘণ্টা খানেক বসে থেকে ফিরে
যান। ইজ্জত আলীকে
তওবা করানো যায় না।
- যেমনটা এই শালার পুতেরা
করে। ক্ষমা চায় না, তারা আপিল করতে চায়। রিভিউ চায়।
খালেদ খেদোক্তি করে। আমি আর সবাই চুপ থাকি কিছুক্ষন। তারপর আমি আবার শুরু করি।
- কিন্তু ইজ্জত আলী তওবা না করেই গোঙাতে গোঙাতে
মারা গেল। মধ্য রাতের দিকে। ওইদিন সন্ধ্যা থেকেই নাকি একটা কুকুর ইজ্জত আলীর উঠানে বসে টানা ঘেউ ঘেউ
করছিল। শুধু তাই না
কুকুরটা নাকি ঘরের দরজায় গিয়ে আঁচড়ও কেটে এসেছিল। কুকুরের ডাকে ইজ্জত আলীর হাঁশফাঁশ বেড়ে গেল। গ্রামের লোকেরা একে ডাকে। ওকে ডাকে। এই করতে করতে উঠোনে
সব লোক জড়ো। এমনকি ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখে বাচ্চারাও।
পুরুষ লোকেরা দাওয়ায় বসে আছে। বউরা ঘোমটা দিয়ে বাচ্চা কোলে গোল জটলা করে আছে। মুরুব্বীদের
কেউ কেউ ঘরের ভেতর যাচ্ছে, আর কিছুক্ষণ
পর বার হয়ে আসছে। কেউ যদিও বলছে না মুখ ফুটে, কিন্তু ইজ্জত আলীর মৃত্যুতেই যেন সবার ঘুম মাথায় তুলে উঠোনে দাঁড়িয়ে
থাকাটা স্বার্থক হয়। হলও তাই। ইজ্জত আলী মরে গেল। ইজ্জত আলী মৃত।
- খাল্লাস!
জামান শরীর এলিয়ে বসতে বসতে
বলে। আমি ডানে-বামে
মাথা নাড়ি। গল্পের শেষাংশ বলা শুরু করি।
- সমস্যা বাঁধল ইজ্জত আলীর
জানাজা পড়াবে কে? ইমাম সাহেব
জানালেন, ইজ্জত আলী তওবা করেনি, তার
জানাজা কীভাবে পড়াবেন!
আমাকে এখানটায় থামতে হল। জামান আবার বলা
শুরু করেছে।
- ঠিক! আর এদিকের জানাজা
রাজনীতিটা ধরতে পেরেছিস তো? রাজাকারের উইল
উঁচিয়ে দেখাল সবার নাকের ডগার উপর! আরে! এর তো কোন ধর্মের রীতিতেই দাফন হওয়ার কথা
না। একটা ধর্ষক, একটা লুটেরা,
একটা খুনির তো কোন ধর্ম থাকার কথা না। এই
বদমাইশরে ধর্মমতে দাফন করতে হইবো ক্যান!
এইটাতো আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। করে কিনা বল?
- হু!
- হু!
খালেদ আর তুর্য সম্মতি দেয়
জামানের সাথে। আমি চুপ থাকি। বিষয়টায় অবাক হয় খালেদ।
- তোর মত কী?
- হা হা হা! ওর মত নাই
মাম্মা! অয় পুরাদস্তুর মিডিয়া বাক্সের মত আমাগোর সামনে বইসা আছে। দেখস নাই? মিনশা বুইড়ার মরার খবর
মিডিয়া কেমন ফরমালিটিস কইরা প্রচার করল। বেশ একখান সৌজন্যতা দেখায়া তার
মৃত্যু সংবাদ স্ক্রল করল। অথচ এই সৌজন্যতা না দেখাইলেও কেউ মিডিয়ার ভুল ধরতে আইতো না! আবার এইটা
কইরাও মিডিয়ার খায়েশ মিটে নাই, শেষকৃত্য
তো লাইভ টেলিকাস্ট দিল!
তুর্য কথা বলছিল। ও যা বলছে তা
ঠিক। আমিও লক্ষ্য
করেছিলাম পেশাদারিত্বের নামের মিডিয়ার এই দৈন্যতা।
কিন্তু তা বলে মিডিয়ার মিডিয়াবাজির সাথে আমার তুলনা করার হেতু কী বুঝে আসল
না আমার। আজ তুর্য কথায় কথায় আমাকে
খোঁচাচ্ছে।
- এই খাসলতই তো আমাদের খাইলো! ক্যান! ইতালির ঘটনা
মনে নাই? নাৎসি এরিখ প্রিবক এর মরা শরীর
বহনকারী গাড়ির গায়ে ক্যামনে পাবলিকেরা লাত্থি-গুতা মারল!
পাবলিকের স্পষ্ট কথা ছিল, কশাইয়ের জায়গা এই শহরে হইবো না!
কথা বলতে বলতে হাতের তালু দিয়ে ঘাসের উপর
জোরসে থাবা দিল খালেদ। জামান আমার দিকে ফিরে গল্পের বাকি অংশ বলার ইশারা করল।
- লাশের যেহেতু একটা
ব্যবস্থা করতেই হবে, অন্য কোনো
পন্থা গ্রামের কেউ নিতে পারছিল না,
চার গ্রাম পরের একজন ইমামকে ডেকে আনা হল ভোর ভোর কালে। তড়িঘড়ি করে
কবরে নেওয়া হল ইজ্জত আলীকে। সবাই এই বোঝা থেকে মুক্ত হতে চায়। লাশ কবর দিয়ে হাত ঝেড়ে ফিরে চলল
সবাই। মোটে চল্লিশ
কদম গিয়ে ঠেকেছে, আচমকা হুড়মুড়
আওয়াজ। কী যেন ভেঙ্গে গেল! সবাই ঘাবড়ে গিয়ে পেছন ফিরে দেখে ইজ্জত আলীর সদ্য মাটি
চাপা দেওয়া কবরটা ধ্বসে গেল। বলতে গেলে সকলের চোখের সামনেই। দেবে গেল মাটি। মট করে আওয়াজও
হল।
- কী বলছিস!
জামানের কণ্ঠে বিষ্ময়।
- শেষটা আবার কও তো!
আমাকে টেপ রেকর্ডার ভাবার মতো
এখানে কেবল তুর্যই আছে। আমিও অবিকল শেষ কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করি।
- ইজ্জত আলীর সদ্য মাটি চাপা
দেয়া কবরটা ধ্বসে গেল। বলতে গেলে সকলের চোখের সামনেই। দেবে গেল মাটি। মট করে আওয়াজও হল।
সবাই চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে, পরের অংশটুকু শুনতে চায়। আমি নড়েচড়ে বসি। গল্পটা আসলে আর
নেই। মানে আমি এর পরেরটুকু
কখনই শুনিনি। ঠিক এখান পর্যন্তই জানি। আমি এবার প্রশ্ন ছুঁড়ি সবার দিকে।
- গল্পটার পরের আর কিছু নেই
ধর। এটুকু থেকে কী
বুঝলি তোরা? মানে এই যে, গল্পটা আমাদের গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে আমি পর্যন্ত পৌঁছল,
এর কী কারণ হতে পারে?
- গুরু! ওস্তাদের মাইর শেষ
রাইতে! এই মাটি, হইবো না যুদ্ধাপরাধীদের
ঘাঁটি!
শেষটা টেনে দিল তুর্যই। আমি সবার মুখের
দিকে তাকালাম। তুর্যের পিঠে জোরসে থাবা দিলাম। তুর্য দিল জামানের পিঠে। জামান খালেদের। আর খালেদ আমার
পিঠে। আমরা একটা
দুর্ভেদ্য চক্রব্যুহ গড়ে তুলি। আমাদের মাঝে একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো স্তম্ভের মতো পড়ে আছে
রাজাকারের মুখচ্ছবিওয়ালা পত্রিকাটা। আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে ওটার দিকে ফিরি। ঘৃণায় আমাদের
মুখ ভরে ওঠে ছ্যাপে। আমরা এক সাথে ওটার দিকে ছ্যাপ ছুঁড়ে মারি – থুহ!
৩০ নভেম্বর ২০১৪
মন্তব্যসমূহ