নিবন্ধঃ১ // মহাভারতের বলরাম ও কিছু সম্ভাবনা // তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়


              মহাভারতের উদ্‌যোগপর্বে দেশ-বিদেশের রথী-মহারথীদের নিজের নিজের পক্ষে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানিয়ে যখন কুরু-পাণ্ডব দুই পক্ষই দেশে বিদেশে দূত পাঠাচ্ছেন বা দেশ দেশান্তর থেকে রাজারা নিজের ইচ্ছেয় কোনও কোনও পক্ষে যোগ দিচ্ছেন, তখন যে  অবধারিত ভাবে বৃষ্ণি বংশীয় রথীদের আপন শিবিরে দেখতে দুই পক্ষ উদগ্রীব হবে, তা অনুমান করা যাচ্ছিল বনপর্বে বারংবার পাণ্ডবদের সাথে মিলিত হওয়া বা তাদের সাথে সখ্যতা বশত, আত্মীয়তার কারণে পাণ্ডবপক্ষে শ্রীকৃষ্ণের যোগদান সম্পর্কে প্রায় সবাইই নিশ্চিত ছিলেন; যদিও, তাঁর আত্মীয়তা দুর্যোধনের সাথেও কম ছিল না, তাঁর ছেলে শাম্বের সাথে দুর্যোধনে মেয়ে লক্ষণার বিয়ে হয়েছিল  উদ্‌যোগপর্বের সেনোদ্‌যোগপর্বাধ্যায়ে (বিরাট রাজার কন্যা উত্তরা ও অর্জুন পুত্র অভিমন্যুর বিবাহের পর) বিরাটরাজার সভায় পাণ্ডবেরা আপন রাজ্যোদ্ধারের উপায় খুঁজতে বসলে শ্রীকৃষ্ণ দুই শিবিরের পক্ষে হিতকর কর্তব্য স্থির করতে বলেন এর সপক্ষে তাঁর অগ্রজ কৌরবপক্ষে শান্তিদূত পাঠানোর প্রস্তাব রাখামাত্র আমাদের চোখে তাঁর উদার চরিত্র ক্রমে শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে শুরু করেছিল

             কিন্তু পরক্ষনেই দুর্যোধনকে অমিত বিক্রম আখ্যা দিয়ে, তাঁর ক্রোধ উৎপাদনে বিরত থাকতে বলার সাথে সাথে ওই শ্রদ্ধা যেন কিছুটা ব্যাহত হয় আমরা দ্বিধা বোধ করতে থাকি, কেন বলরাম দুর্যোধনের এমন গুণগান করতে শুরু করলেন ! উপরন্তু যুধিষ্ঠিরকে অজ্ঞ, হঠকারী বলে কেন শকুনির দ্যূতক্রীড়ায় জয়লাভকে ন্যায়সম্মত বলে দুর্যোধনের কাছে মিষ্ট বাক্যে শান্তিপ্রস্তাবের উপদেশ দেন? তিনি কি মনে মনে কুরুপক্ষের সমর্থক ছিলেন? তিনি কি সত্যি সত্যি একজন ইম্‌পিরিয়ালিস্ট? এলিট? শঙ্কা জাগে এ শঙ্কার নিরসন মহাভারত করেনি 

             এমন আলো-আঁধারির মধ্যে বলরামের চরিত্রটি উদ্‌ভ্রান্ত, অসম্পূর্ন এক সৃজন তাঁর সমস্ত জীবন কেটেছে নীরবে, কংস বধের থেকে শুরু করে আমৃত্যু তিনি অনুজের সহগামী হলেও তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, ইছে- অনিচ্ছে ততটা প্রকট হয়নি, বা বলা ভালো,  কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস তা প্রকাশের সুযোগ পাননি কৃষ্ণ চরিত্রটি যত রহস্যময়, বহু কবির, সংকলকের হস্তক্ষেপে যতটা সঙ্গতি-অসঙ্গতি সাধন ঘটেছে তাঁর উত্তরণে, বলরামের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি তাঁর চরিত্রের এমন অপরিণত বিকাশ ঘটিয়ে কেন মহাভারতের কবি শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের উপর দেবত্ত্ব ও মহত্ত্ব আরোপ করেছেন, তা আবহমান কালের মহাভারত পাঠক- গবেষকের কাছে এক প্রশ্ন   

              তবে কি এই বলরাম পুরাণোক্ত বিষ্ণুর দশাবতারের অষ্টম অবতার নন? তবে কি বলরামের শাক্ত-যাপন, তাঁর কম কূটনীতিক বিচক্ষণতার থেকে কৃষ্ণের মাহাত্ম-কথা, তাঁর মহাভারতের মহারণ্যে অস্ত্রহীন অথচ প্রবল প্রভাবশালী উপস্থিতি, বা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর তাঁর পঞ্চরাত্র বা ভাগবত ধর্ম প্রচারের মতো অনন্য কিছু অবদান (এই ধর্ম বলরামের কাছ থেকে শিখে শাণ্ডিল্য এক সংহিতা রচনা করেন, যা পরে কেবল নামে মাত্র ছিল, কেউ তা পাঠ করেননি বা পাঠ করতে পারেননি; বা হারিয়ে গেছিল) তাঁকে যতটা আলোকিত করেছে, বলরামের ক্ষেত্রে ততটা নয়? কৃষ্ণ শুধু যে কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন তা নয়, “ উত্তর ভারতে তিনি এক শক্তিশালী রাষ্ট্র স্থাপনের যে চেষ্টা করেছিলেন, তা প্রথমে যুধিষ্ঠিরের দ্যূতান্ধতার ও পরে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের লোভে ও ভীষ্ম দ্রোণের দুর্যোধনের দাবী অন্যায় জেনেও তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করায় ব্যর্থ হয় শেষ জীবনে নুতন নীতিমূলক ভক্তিবাদী প্রবৃত্তির লক্ষণ যে ধর্ম তিনি প্রচার করেছিলেন, তা দ্বৈপায়ন ঋষি ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের চেষ্টায় অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু তবু তাঁর থেকে ভারতবর্ষে ক্রমে ভক্তিবাদী ভাগবত ধর্মের বিকাশ হয়...”(‘মহাভারতের মূলকাহিনি ও বিবিধ প্রসঙ্গ’- শিশির কুমার সেন)

               অন্যদিকে বলরামের বীরত্ব বা কৃতিত্ব বলতে বল্বল, রোমহর্ষক বা প্রলম্বাসুর বধ আর তীর্থভ্রমণ ছাড়া তেমন কিছুই জানা যায় না উপরন্তু, মহাভারতের কবি তো এইসব অসুর বধের কথাও উল্লেখ করেননি!

                তাই বলে যে বলরামকে আমরা কম বলবান বা বীর ভাবব, তা নয় তিনি কেবল বড় যোদ্ধাই ছিলেন না, কুরু-পাণ্ডবদের গদাযুদ্ধও তিনিই শিখিয়েছিলেন আর মহাভারতের যুদ্ধে তাঁর এই নিঃস্পৃহ থাকার অন্যতম কারণ শিক্ষকতা নিজের ছাত্রদের যেহেতু তিনি কাউকেই সমর্থন করতে পারবেন না, তাই তিনি নিরপেক্ষ থাকলেন আর তাঁর কথায় কথায় ছড়িয়ে থাকল পক্ষপাত! তিনি তা প্রকাশ করতে পারছেন না, কিন্তু সব আলোচনার ঊর্দ্ধে থেকে যে সবার শ্রদ্ধা আদায় করে নেবেন, তেমন আচরণও করতে পারছেন না! তিনি যে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পিসতুতো ভাইদের প্রতি পক্ষপাত দেখাননি, তা অভিবাদনযোগ্য কিন্তু, একই সাথে তিনিই দুর্যোধনের অহংকার, নীচতা, শঠতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এ কেমন ধারার ধর্ম ! তিনিই না জগত রক্ষায় মানুষের বেশে জন্ম নিয়েছেন? প্রসঙ্গত, এই অবতারবাদের ধারণা মহাভারতের কবি একদম পাত্তা দেননি, এমনকি, শান্তিপর্বে ভীষ্ম কৃষ্ণকেই জগতকর্তা, বিধাতা বলে উল্লেখ করে, তাঁর বরাহ অবতারের বর্নণা দেন

               এখন যদি অবতার, দেবত্বের সব আবরণ সরিয়ে রেখে আমরা কেবল সাধারণ এক কাব্যের চরিত্র-চিত্রণের দিকে দৃষ্টি দিই, যদি একজন সাধারণ অর্থে চেনা শিক্ষক হিসেবে বলরামকে দেখি, তবে এই সুরাপায়ী নীলাম্বর হলধরকে কোনভাবেই একজন আদর্শ শিক্ষক বলে মেনে নিতে পারি না

               তিনি তাঁর ছাত্রদের যুদ্ধের সব কৌশল শিখিয়েছিলেন ঠিকই, তা না হলে ভীম-দুর্যোধন কীভাবে এমন বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে আমাদের কল্পনাকে উদ্ভাসিত করবেন? কীভাবে ভীম বনপর্বে (যক্ষযুদ্ধপর্বাধ্যায়) বদরিকাশ্রমের কাছে কুবের-ভবন আক্রমণ করে যক্ষ-রাক্ষকাদি মনিমান ইত্যাদিদের গদাযুদ্ধে পরাভূত করবেন? (তবে, তর্কের খাতিরে বলেই রাখি, সারা মহাভারতে ভীমের যত পরাক্রমের কথা পাওয়া যায়, দুর্যোধনের ক্ষেত্রে তাঁর তেমন উল্লেখ নেই, এমনকি বনপর্বেই দ্বৈতবনে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের হাতে পরাজিত ও বন্দী দুর্যোধনের উদ্ধারে ভীমার্জুনের আগমন ও চিত্রসেনের পরাজয়ের পর ভিমের হাতে জীবন পাওয়ার অভিমানে দুর্যোধনের প্রায়োপবেশনে বসার ঘটনায় সন্দেহ হয়, সত্যি দুর্যোধনের বীরত্ব কি এত প্রশংসনীয় ছিল?) হয়ত গদাযুদ্ধের অনেক কৌশল তিনি ছাত্রদের শিখিয়েছিলেন, কিন্তু আদর্শ? চরিত্রগঠন?
             জীবনে হয়ত বলরাম তেমন কোনও অন্যায় করেননি, নৈমিষারণ্যে রোমহর্ষক বধের পর যজ্ঞস্থল অপবিত্র করার কারণে উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি ঋষিদের কাছে প্রার্থনা করেছেন, তবু, অনেক অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার দরুণ, প্রতিবাদ না করার দরুণ, এক প্রকারে ঐসব অন্যায় প্রশ্রয় দেবার দায়ভারও তাঁর উপর খানিকটা বর্তায়!

               বিরাটরাজার গৃহে বলরাম বলেছিলেন, “শত্রুগণ যথানিয়মে কার্য্যানুষ্ঠান করিলে পাণ্ডবেরা অর্দ্ধরাজ্যলাভেও প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিবেন, তাহা হইলে প্রজাগণের আর কোনপ্রকার অনিষ্ঠঘটনার সম্ভাবনা থাকিবে না 
( ‘বলদেবকর্তৃক সন্ধির সমর্থন’, সেনোদ্‌যোগপর্বাধ্যায়, উদ্‌যোগপর্ব, অনুবাদ, কালীপ্রসন্ন সিংহ) সামনীতিতে যা পাওয়া যায়, তাই অর্থকর, যুদ্ধ অন্যায় ও অনর্থকর যে মানুষ যুদ্ধবিরোধী, তাকে তো সম্মান করতেই হয় সভ্যতার আদিকাল থেকে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই যুদ্ধের বিপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন কিন্তু, বলদেবের এই কথা আসলে এক সাবধানবাণী! যে দুর্য্যোধন এক পরাক্রমি বীর, তাকে না ঘাঁটানোই ভালো! যদি তা না হবে, তবে কেন তিনিই কোনও উদ্যোগ নিলেন না? নিলেন না যখন, তবে কেন আবার  দুর্য্যোধন যখন দ্বারকায় এলেন, তাঁকে আগ বাড়িয়ে বলতে গেলেন, “হে নররাজ! আমি বিরাটরাজভবনে বৈবাহিক সভায় তোমার নিমিত্ত হৃষীকেশকে নিগ্রহপূর্বক পুনঃ পুনঃ কহিয়াছিলাম যে, আমাদিগের সহিত ধার্তরাষ্ট্র ও পাণ্ডবগণের সম্বন্ধগত কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য নাই; তথাপি হৃষীকেশ আমার ঐ সকল বাক্য গ্রহণ করিলেন না কিন্তু হৃষীকেশ বিনা ক্ষণমাত্রও অবস্থান করিতে আমার সামর্থ্য নাই আমি তাঁহার অনুরোধে এই স্থির করিয়াছি যে, কি পাণ্ডবের, কি তোমার  কাহারও সাহায্য করিব না অতয়েব প্রস্থান কর; তুমি সকলপার্থিবপূজিত ভরতবংশে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছ, অবশ্যই ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারে সংরামে প্রবৃত্ত হইবে”( কৃষ্ণকে সপক্ষে আনায়নের জন্য দুর্য্যোধন-অর্জুনের তৎসমীপে গমন’, সেনোদ্‌যোগপর্বাধ্যায়, উদ্‌যোগপর্ব, অনুবাদ, কালীপ্রসন্ন সিংহ)? অতি অল্প সময়ের ব্যাবধানে এই মানুষটির পরিবর্তন আমাদের মনে ঐ চরিত্রটির প্রতি যেমন কৌতূহলী করে তোলে, ঠিক তেমনি, আমাদের সন্দেহ আরও ঘনিয়ে ওঠে!

            এর পরেই তিনি মহাভারতের মহারণ্য থেকে বহুদুরে চলে গেলেন শল্যপর্বে বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের কৌতূহল নিবারণার্থে বলরামের তীর্থযাত্রার বিবরণ দেন দেখা গেল, তিনি দ্বারকা থেকে বেশ রেগেমেগেই বের হয়েছিলেন সমুদ্র থেকে সরস্বতী নদীর বিপরীত স্রোতমুখে যাত্রা করে দেশে দেশে বহু দান-ধ্যানকরেন, তাঁর প্রথম তীর্থ হল প্রভাস, তারপর উপদান তীর্থ, সপ্তসারস্বত কপালমোচন, আদিত্য,
 সোমতীর্থ, সারস্বর মুনির ক্ষেত্র, বৃদ্ধকন্যাশ্রম তীর্থ ভ্রমন করে সমন্তপঞ্চকে  এসে কুরুক্ষেত্র সম্পর্কে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস শ্রবণ করেন সেখান থেকে হিমালয়ের  কাছে যত তীর্থ আছে, সব দর্শন করে মিত্রাবরুণের আশ্রমে এলে দেবর্ষি নারদের সাথে সাক্ষাৎ হয় তাঁর কাছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গতিবিধি ও ভীম-দুর্য্যোধনের আসন্ন গদাযুদ্ধের সংবাদ পেলে দ্রুত দ্বৈপায়ন হ্রদের কাছে প্রিয় দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখতে উপস্থিত হন অবশ্য এই যুদ্ধ দেখার থেকে সরস্বতী নদীর অনুপম রূপদর্শনে তার বেশি আগ্রহ ছিল বলেই মনে হয় নয়ত বারবার ঐ নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে ফিরে ফিরে তাকানোর আর কী কারণ হতে পারে? বলরামের এই সৌন্দর্য্যপ্রীতির ছবিখানি মহাকবি কালীদাস বড় যত্নে এঁকেছেন তার কাব্যে। 

 হিত্বা হালামভিমতরসাং রেবতীলোচনাঙ্কাং, বন্ধুপ্রীত্যা সমরবিমুখো লাঙ্গলী যাঃ সিষবে    
 কৃত্বা তাসামভিগমমপাং সৌম্য ! সারস্বতীনা-মন্তঃশুদ্ধস্ত্বমপি ভবিতা বর্ণমাত্রেণ কৃষ্ণঃ।।
                                                                      (‘মেঘদূতম্‌' ; পূর্বমেঘ ; ৫২)


( ‘ হে সৌম্য, আত্মীয়প্রীতিবশত সমরবিমুখ বলরাম নয়নপ্রতিবিম্বযুক্ত সুস্বাদু সুরা ত্যাগ করে যা পান করতেন সেই সরস্বতী নদীর জল  সেবন করলে তোমার অন্তর শুদ্ধ হবে, কেবল বর্ণেই কৃষ্ণ থাকিবে  অনুবাদ- রাজশেখর বসু )


সারস্বত মুনির তীর্থে নদিতীরে বসে বলরাম হয়ত বা কুরুক্ষেত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণামের কথা ভেবেছেন, কেননা, তাঁর প্রত্যয় ছিল, কৃষ্ণ সবসময় ধর্মের পক্ষে, এবং যেহেতু দুর্য্যোধনেরা কৃষ্ণের ভাগবতধর্মের সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছেন, ফলে, কৃষ্ণ একটা মরিয়া কূটনৈতিক চাল চালবেনই ! আর প্রবাদে আছে, ‘ যথা ধর্ম, তথা কৃষ্ণ যথা কৃষ্ণ, তথা জয় তবু মনঃকষ্টে ভুগেছেন একজন শিক্ষক হিসেবে আর তাঁর এলিটিস্ট মনোভাব, তাঁর একান্ত আপন বিশ্বাস, তাঁর ইম্‌পিরিয়ালিজম্‌তাঁকে চুপ থাকতে দেয়নি তিনি আক্রমণ করেছেন ভীমকে, দুর্য্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর, ঠিক যেন গ্রীক কবি ঈস্কিলাসের ওরেস্তিয়া ট্রিলজির আগামেমনন নাটকের কোরাস, আর্গোসের বৃদ্ধদের মতো তারাও এভাবেই রাজা আগামেমননের হত্যার পর আক্রমণ করতে যান রানী ক্লাইতেইমেস্ত্রাকে

               এখন প্রশ্ন, মহাভারতে বলরামের গুরুত্ব কতটা? কৃষ্ণ তো এই বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রায় নির্দেশক হয়ে উঠেছেন ক্রমশ তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, প্রতিবাদ, উপদেশ, শান্তিস্থাপনের জন্য দূত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি মহাভারতের মূল  ঘটনার গতিবিধিকে যতটা প্রভিত করেছে, বলরামের উপস্থিতি সেখানে প্রায় নগণ্য এমনকি বনপর্বেও কৃষ্ণকে যতবার পাণ্ডবদের সাথে দেখা গেছে, বলরামকে ততটা নয় সন্দেহ জাগে, তিনি কি কর্তব্যবোধহীন মানুষ? নাকি পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর কোনও গোপন ক্ষোভ ছিল? অর্জুনের উপর তাঁর রাগের একটা কারণ ছিল, তা প্রকাশ পায় সুভদ্রাহরণের সময় অর্জুন নিজের মামার মেয়ে সুভদ্রাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে শুনে বনমালাধারী- নীলাম্বর- সুরাপানে মত্ত বলরাম কৃষ্ণকে দায়ী করে তাঁকে দোষারোপ করেছিলেন এমন অপরাধে তাঁকে সাহায্য করার জন্য এমনকি বীরবিক্রমে একাই কুরুবংশ ধ্বংস করার জন্য ছুটেছিলেন তাছাড়া, আর একটা কারণ প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকেই সেটা হল, তাঁর প্রানের ভাই কৃষ্ণ এই সময় থেকেই ক্রমে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে জাচ্ছিলেন, আর অর্জুনই তাঁর একমাত্র কারণ

              মহাভারতে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের আগে কৃষ্ণ-বলরামের উপস্থিতি কোথাও ছিল না তবে, সুভদ্রাহরণের পর থেকে কৃষ্ণ-অর্জুনের সখ্য প্রবল হতে থাকে, যা শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল এমনকি, মৌষলপর্বেও বলরামের ভূমিকা তেমন ভাবে লক্ষ্য করা যায় না কৃষ্ণপুত্র শাম্বের গর্ভজাত মুষলের কারণে দ্বারকায় ঘোর বিপদের দিনেও তিনি অবিচল! বৃষ্ণি ও অন্ধকেরা নিজেদের মধ্যে প্রচুর সুরাপান করে মত্ত অবস্থায় তাঁরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে কৃষ্ণ বলরামের খোঁজে এসে দেখলেন, তিনি গাছের তলায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন পরিবারের প্রতি তাঁর কোনও উদ্বেগ নেই! এমনকি যাদব মেয়েদের রক্ষা করতে কৃষ্ণের তৎপরতা দেখেও তিনি ভাইকে অনুসরন করেননি  

              এরপরের ইতিহাস সবার জানা যাদবকুলের রক্ষায় অর্জুন আসছে, এই সংবাদ দিয়ে কৃষ্ণ বলরামের কাছে এসে দেখলেন বলরাম নিথর দেহে বসে আছেন, তাঁর মুখ থেকে একটা সাদা রঙের সহস্রশীর্ষ রক্তমুখ মহানাগ নির্গত হয়ে সাগরে প্রবেশ করছে এই নাগই তাঁর প্রাণস্বরূপ (অবশ্য, দেহত্যাগের এই বর্ণনা ভাগবতে নেই, মহাভারত ও বিষ্ণুপুরাণেই কেবল আছে!) আমরা কীভাবে এই মানুষটির এত নির্বিকার, ‘দুখেষ্ণ্ব নুদ্বিগ্নমনা ভাব সমর্থন করি? 

               তাঁর এই সব আচরণের সমর্থনে যুক্তি অবশ্য আছে! তিনি জানতেন,  যে যাদবকুল দেব-দানব-মানুষের অবধ্য, দুর্বাশা ও গান্ধারীর অভিশাপে কৃষ্ণই তা ধ্বংসের কারণ হবেন, হয়ত তাই তিনি আর অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্যকে প্রতিরোধ করতে চাননি, যেমন চাননি কৃষ্ণ
                তবে বলরামের চরিত্রের এই অসম্পুর্ণ চিত্রণ বা এইসব অসঙ্গতির জন্য যে পরিবর্তিত সাহিত্যের ক্রমরুপান্তরিত অবস্থানের কিছুটা ভূমিকা আছে, তা বলাই বাহুল্য মহাভারত যে সময় লেখা শুরু হয়, তখনও অবতারবাদের ধারণা তেমন ভাবে জনমানসে প্রকট হয়নি তখন সময়টা ঋক বেদের যুগ, সমাজের প্রধান দেবতা ইন্দ্র, নারায়ণ নন  আর যে সময়  তা সংকলিত হয়, তাঁর মধ্যে যে অবতারবাদের ধারণা এসে গেছে, তা প্রকট হয় মহাভারতের নানা উপকাহিনির মধ্যে দিয়ে আরও অবাক করার মতো বিষয় যেতা তা হল, নারায়াণের অবতার হিসেবে মহাভারত কখনও বলরামকে স্বীকার করেনি তাঁর জন্ম সম্পর্কে যে উপাখ্যানটি পাওয়া যায়, তা দ্রৌপদীর বিয়ের সময় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের মুখে জানা যায় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর জন্মকথা শোনানোর পর তিনি বললেন, “... এই সময় নারায়ণ তাঁর একটি কৃষ্ণ এবং একটি শুক্ল কেশ উৎপাটন করলেন সেই দুটি কেশ যদুকুলে গিয়ে  দেবকী ও রোহিণীর গর্ভে প্রবিষ্ট হয়; কৃষ্ণকেশ কৃষ্ণ এবং শুক্লকেশ বলরাম” (অনুবাদ  রাজশেখর বসু)  নারায়ণ বা বিষ্ণুর অবতার বলরামের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে মহাভারতের কবি এর বেশী আর কিছু বলেননি

              এখন কেবল মহাকাব্যের আর পাঁচটা চরিত্রেরে মতো বলরামকে সমীক্ষা করা যায়, তবে দেখব, সারা মহাভারতে তাঁর উপস্থিতি তেমন গুরুত্বপূর্ন নয় তাঁর চরিত্রটি যেন কথা প্রসঙ্গে একবার ঘটনা প্রবাহের জালে একবার জরিয়েছে, আর পরক্ষণেই হারিয়ে  গেছে পক্ষপাতের দোষে কালিমালিপ্ত হয়েছেন, অপরাধ তা নয় আসলে, মহাভারতের প্রায় সব চরিত্রই এত জ্যান্ত তাদের মানুষ-সুলভ দোষগুণের হিসেব করতে করতে, যেন হয়, আসলে এরা আমাদের সবারই খুব চেনা, আর মজাটা হল, প্রত্যেকেই তাদের এইসব দোষগুলিকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর, এখনকার মানুষের মতো! পক্ষপাতের চরম নিদর্শন হিসেবে আজও জেগে আছেন দ্রৌণাচার্য, তাঁর পথ ধরে আজও প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকই এইরকম প্রিয় ছাত্র বা ছাত্রীর প্রতি পক্ষপাত দেখান গুরুতর অপরাধ তা নয়, বরং,  justificationএর চেষ্টাটুকু, নিজেকে, নিজের ভুলগুলোকে আর, কথা যখন তাঁর  দেবত্বের, অবতারবাদের, তখন...সারাজীবন কোনও ন্যায়-অন্যায়ের বিতর্কে না জড়িয়ে, সংসারে সং না সেজে আপন খেয়েলে তিনি জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন এমন মানুষ সবার কাছে সম্ভ্রম আদায় না করতে পারলেও বিতর্কের জন্ম অন্তত কমই দেন অথচ, বলরাম সেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন দিয়েছেন এই কারণে, যে তিনি সবক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টি, বিচার-বিবেচণা এই পার্থিব জগতের ঊর্ধে উঠে করতে পারেননি পারেননি বলেই সুভদ্রাহরণের খবরে অর্জুনের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন, আর যাদবকুলের মেয়েদের যখন দস্যুরা হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন নিঃষ্ক্রিয় থেকেছেন ; বিরাটরাজসভায় কথাপ্রসঙ্গে দুর্য্যোধনের শক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন; দ্বৈপায়নের তীরে আক্রমণ করেছেন দুর্য্যোধন-ঘাতী ভীমকে আর ভালোমন্দের সংসারে এই সামান্য কয়েক মুহুর্তের জন্য তিনি তৈরী করে গেছেন এক অসীম অন্ধকার

              এসব কিছুই হতনা, যদি না বলরাম আজীবন নিজের মনে নিমগ্ন থেকে যেতেন, যদি যুদ্ধে যজ্ঞ না দেওয়ার কোনও কারণ না দেখিয়ে কেবল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তীর্থক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতেন, যদি হঠাৎ করে তীর্থক্ষেত্র থেকে সোজা দ্বৈপায়নের তীরে এসে ভীমকে আক্রমণ না করে বস্তেন তাঁর নীরব উপস্থিতি হয়ত আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত আমাদের কাছে সারা মহাকাব্যে তাঁর উপস্থিতি যতই কম হোক, অন্তত এই প্রশ্নচিহ্ন থাকে যেত না তাঁর চরিত্রের উপর হয়ত তাঁর এই নীরব উপস্থিতি বিদুরের মতোই আরও সুশোভিত হত, শিক্ষক হিসেবে তাঁর  অবদান যাই হোক না কেন, অন্তত এই কালির ছিটেটুকু তো থাকত না! তাঁর নীরবতার প্রসঙ্গে কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা মনে পড়ে

 না, অন্যায় গদাযুদ্ধে হারানো হয়েছে শিষ্যকে

শতাব্দী শিক্ষক আস্তে এগলেন, ঊরুভাঙা ছেলে

তুই দুর্য্যোধন হতে পারিস কিন্তু যে বলরাম

তোরই হাতে দিয়ে গেছে শুদ্ধ রণজয়ের বিশ্বকে” 
( দশাবতার ; বলরাম’, “জলেহস্মিন্‌সন্নিধিং কুরু)


                না, এই শুদ্ধ রণজয়ের বিশ্ব কিন্তু দুর্য্যোধনের নয় যুদ্ধে আদৌ শুদ্ধতা থাকে না, একথা বলরাম জানতেন না, তা বিশ্বাস করা যায় না তিনি মেনে নিতে পারেননি হতে পারে, পাণ্ডববিরোধী কথা বলে পক্ষান্তরে তিনি তাদের মনে কৌরবদের প্রতি প্রতিশোধের বাসনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছেন; হতে পারে, ভীমকে ভুল ভাবে যুদ্ধ করার জন্য তিরস্কার করেছেন, কারণ তিনি চাননি, তাঁর ছাত্রেরা কোনও ভুল করুক; হতে পারে, তিনি যাদবকুলের ক্রমবর্ধমান পাপের বহর দেখে মনে মনে তাঁর ধ্বংস কামনা করেছিলেনএসব সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না  আর এসব রহস্য লুকিয়ে আছে মহাভারতের মূল কাব্যের নানা পাঠান্তর, উপকথা, লৌকিক রূপান্তর, সঙ্কলণ, নানান গ্রহণ-বর্জন, যুগে যুগে পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়জীবন ও বিশ্বাস ইত্যাদির মধ্যে সেকথা আজ আর নয়




যেসব উৎস আলো ছড়িয়েছে :-

 মহাভারত ; অনুবাদ- কালীপ্রসন্ন সিংহ, তুলি ও কলম,৭ম সংস্করণ, ২০০৬

 কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কৃত মহাভারত, সারানুবাদ- রাজশেখর বসু, এম. সি. সরকার, ১১শ মুদ্রণ, ১৪১০

 কালীদাসের মেঘদূত, মূল অনুবাদ, অন্বয়সহ ব্যাখ্যা ও টীকা - রাজশেখর বসু, এম. সি. সরকার,পঞ্চম সংস্করণ, ১৪১১    

 মহাভারতে মূলকাহিনী ও বিবিধ প্রসঙ্গ, শ্রী শিশির কুমার সেন, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ১৩৯০ 

 জলেহস্মিন্‌সন্নিধি কুরু, গীতা চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৯               

        


ছবিঃ  সৌরদীপ্ত চৌধুরী 

মন্তব্যসমূহ