অনুবাদ গল্পঃ শয়তান লিসবনে থাকে// বের্টা ভিয়াস মাহোউ


অনুবাদঃ সোহবার সুমন

সোমবার গুলোতে মা সব সময় ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন বিছানা ছাড়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি সেখান থেকে গিয়ে, নাস্তার জন্য বাসন কোসন এক করতে শুরু করেন, এবং তারপর, আবারও আমাদের দিকে একটা হাসি দিয়ে, শনিবারের আগে তিনি আর বাড়ি ফিরে আসেন না যখন তিনি ফিরে আসেন সোমবারে যে পথ ধরে চলে গিয়ে ছিলেন সেই একই পথে ফিরে আসেন তখন নিয়েভের বয়স সবে সাত আমার ছয় এলিসার, মাত্র তিন বছর

মা এক স্কুল শিক্ষিকার কাজ করেন লা কোম্বাতে, পাহাড়ি ছোট্ট এক গ্রামে প্রতি সোমবারে ছোট্ট বাসটা তাকে নিতে পথের একেবারে শেষ প্রান্তে, বীচ বনের কাছটায়, চেস্টনাট গাছ গুলোর একটার কাছে এসে থামেসেখানে, লা কোম্বাতে, তার একটা কামরা রয়েছে, সেটা তিনি পুরো সপ্তাহের জন্য ভাড়া করেন আর সেখানে তারা তাকে দুপুরের এবং রাতের খাবার দেয় সকালের নাস্তাও সেই ঘরের মালিক আর তার বড় ছেলে খনিতে কাজ করে তার বউ ছোট বাচ্চা, তাদের গরু গুলোকে, এবং খেত খামার আর বাগান দেখাশোনা করে, একই সঙ্গে পরিবারের সবার এবং প্রতি সোমবার পোলা ডে সিয়েরো থেকে আসা স্কুল শিক্ষিকার খাবারের ব্যবস্থা করেন এবং এই সময় আমরা তিনজন আমাদের খালার তত্ত্বাবধায়নে থাকি তারপর থেকে আমরা বাবার মুখও খুব কমই দেখতে পাই

কোন কোন সপ্তাহে মা সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে যান, তবে কেবল আমাদের তিনজনের একজনকে কিন্তু সেটা ছিল শুরুর দিককার কথা, যখন আমরা স্কুলে যেতে শুরু করিনি, যদিও, আমরা নার্সারিতে যেতে শুরু করবার পর, চার বছর পার হবার পর থেকে, কখনও কখনও মা সেই নিয়মের ব্যতিক্রম করতে শুরু করেন এবং আমাদের তার সঙ্গে যেতে দিয়ে, ক্লাস ফসকানোর সুযোগ করে দেন সেই সপ্তাহ গুলো আমাদের কাছে মস্ত একটা পার্টির মতন যে পার্টিতে আমরা কেবল মায়ের সঙ্গ উপভোগ করি, আর অন্যসবাই পড়ে থাকে নীচের শহরে

এবং এলিসাকে আমাদের সবার কাছে খুব প্রিয় বলে মনে হয়, তবে এর সত্যিকার কারণ হলো আমরা যখন স্কুলে যাই তখন ও খুবই ছোট আর ও তখন নার্সারিতে পর্যন্ত যাওয়া শুরু করেনি মার সঙ্গে যখন ও সপ্তাহ কাটায় ও তখন খোলা মাঠে দৌড়ায়, গরুর দুধ দোয়ায়, ঝর্ণার জলে গোসল করে, আর চাইলেই পছন্দ মতো ফল খেতে পারে টক চেরি আপেল নাশপাতি এমন কি ডুমুরও আর এমন নয় যে শহরে আমরা সেসব খেতে পাই না, আসলে সেখানকার তরতাজা ফলের স্বাদই অন্যরকম

কিন্তু কোন কোন শনিবারে মা আর ফিরে আসেন না সাধারণত মাসের প্রথম শনিবারে এমন হতে দেখা যেতো যদিও সব মাসেই নয় আর সোমবারের ব্যাপারটা আমাদের সবারইনায়েভস এবং আমি, সম্ভবত এলিসারওজানা, কেননা সেই সকাল গুলোতে মা কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে অন্য সময়ের চাইতে খানিকটা বেশীই হাসি মুখে থাকতেন, সেই হাসি এতটাই প্রশস্ত যে তাকে দেখে তখন একজন বিদেশি বলেই মনে হতো, একজন আত্মবিশ্বাসী পর্যটকের মতন, যেন সব কিছুর বিনিময়ে, তিনি এমন একটা জায়গাতে গিয়ে পৌঁছাতে যাচ্ছেন যার জন্য আজীবন তিনি স্বপ্নে বিভোর ছিলেন আমাদের অনেকেই সেখানে কখনই যেতে পারবে না

আর সেভাবেই এক সময় মা হেঁটে হেঁটে চলে যান চেস্টনাট গাছেদের ছায়া তার কাঁধের ওপর খেলতে থাকে হাঁটার সময়ও তিনি হাসেন কি বৃষ্টি কি রোদ সব সময় সেই একই রকম হাসি তিনি কব্যিকতার ঢঙ্গে হাঁটেন ধীর স্থির মন্ত্র মুগ্ধের মতো আরক্ত ভঙ্গীতে তিনি কি প্রেভার্ট ? বা এরাগন যাচ্ছিলেন ? ( স্পেনের জায়গার নাম )সম্ভবত নিয়েভস জানতে পারে অথবা মা, হ্যাঁ মায়ের অবশ্যই মনে থাকার কথা

আমরাও জানতাম কারণ সেই সপ্তাহ গুলোতে, তিনি যখন অদৃশ্য হয়ে যেতেন, তার সঙ্গে সেই হাতল ওয়ালা আয়নাটাও গায়েব হয়ে যেত, যেই আয়নাটা তিনি সব সময় সিন্দুকের উপরের ড্রয়ারে রাখতেন তার শোবার ঘরে সেটা ছিল বাড়ির একমাত্র দর্শনীয় বস্তু সাদা রঙ করা দেয়ালের একটা বাড়ি পুরাতন, প্রকাণ্ড, খুব সাধারণ আসবাব, যা অতি ব্যবহার আর কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে

সোমবারের সেই হাসি, মায়ের হাসি চেস্টনাট গাছের মাঝ দিয়ে তিনি হারিয়ে যাবার সময়, সেই হাসি ছিল এমন একজনের হাসি যিনি মিশনারির কাছ থেকে নির্দেশনা পেতেন, এমন একজন যিনি নিরাপদ বোধ করতেন, একটি মাত্র শব্দে দূরে চেলে যেতেন বাবা, যদিও তিনি এর কিছুই আদৌ টের পেতেন না অথবা মনে হতো, তিনি এর কিছুই টের পাচ্ছেন না অথবা এমন ভান করতেন যে তিনি এসবের কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না যেহেতু তিনি এব্যাপারেমোটেই আগ্রহী ছিলেন না সারাদিন তিনি কেবল ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অবিরাম তাস পেটাতে পেটাতে খেলার মাঝে বুদ হয়ে থাকতেন আর আমরা মা তার সেই ব্যাগ আর সেই হাসি নিয়ে চলে যাবার পর, টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে খালার সঙ্গেই থাকতাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য রান্নাঘরে দেখবার পর, যখন তিনি সোমবার সকালে লা কোম্বাতে আরোহণের জন্য রওনা হতেন তার পরের একটা সপ্তাহ থেকে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত তার আর দেখা পেতাম না

তিনি চলে যাবার পরের সেই দুদিন গুলোকে আমার কাছে অসীম বলে মনে হতো, আজ তারা কোথায় ? যেই ঘণ্টা গুলোকে আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হতো ? সম্ভবত বাবারও এমনই মনে হতো সেই দিন গুলোতে আমি সারাদিন ধরে দৌড়ঝাঁপে ব্যস্ত থাকতাম, আমার বোন নায়েভেস এবং এলিসাও, তাদের শোবার ঘরে আয়নার কাছে ফাঁকা জায়গাটুকুতে দৌড়াদৌড়ি করতো সেই আয়নার ফ্রেমেস্বর্ণের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা ছিল, সেই সঙ্গে ছিল সরু আর লম্বা একটা হাতল, ফ্রেডিটাস ফ্রেডিভিন্ডা নামে এক বৃদ্ধ খালার কাছ থেকে মা সেটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে ছিলেন

তিনি কোথায় যেতেন ? আমার জানা নেই আমি জানি না মা কোথায় যেতেন এব্যাপারে নিশ্চিত করে আমি কিছু জানি না কেবল জানি প্রতিবার যখন তিনি ফিরে আসতেন, তিনি আমাদের বলতেন এবার তিনি অন্য একটা জায়গাতে গিয়ে ছিলেন, নতুন এক জায়গাতে, জায়গাটা খুব বেশী দূরে নয় কিন্তু শুধু শহরের বিরল শব্দে অভ্যস্ত আমাদের কানে তা বিদেশী বলে মনে হয় অন্যদিকে, আজ অনেক দিন পর, আমার মনে হচ্ছে সেটা বুঝি সেই একই জায়গা ছিল, একই শহর, যদিও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই সেটা আসলে কোথায় কেন যেন আমার এমন মনে হচ্ছে

আরো অনেক দিন পরের কথা, এক চমৎকার দিনে, মা সেই নির্দিষ্ট সময়ে বের হওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিলেন অথবা সেগুলো কি শুধু প্রমোদভ্রমণই ছিল, আর তাই, আমি যেমনটা ভেবে ছিলাম তিনি নিজেকে বাবার সাথের সেই ক্লান্তিকর, শহুরে ধূসর জীবন যাপন থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন ? আজকে, বারো বছরের কিছু বেশী সময় পর, তার মুখে আবারও সেদিনের সেই হাসি দেখতে পাচ্ছি, আমার মনে হয় তিনি কোথায় যেতেন সেটা আমি বের করতে সক্ষম

মা, তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো ? সেই বিকেলে এলিসা তাকে জিজ্ঞেস করে মা হাসে এবং এর জবাবে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তাকে আরেকটা প্রশ্ন করে বসে আর তাহলে শয়তানের ব্যাপারে কী বলবে ? তুমি কি শয়তানে বিশ্বাস করো ? আমার বোন অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় সম্ভবত আমার মতই, তার গায়েও কাঁটা দিয়ে উঠেছিল সম্ভবত আমার মতই, তার চুলের শেষ প্রান্ত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সম্ভবত নায়েভেস এরও এই একই ধরনের অনুভূতি হয়েছিল এমন কি হতে পারে যে আমরা এখনও সেই অশুভের অস্তিত্বে বিশ্বাস করছি ? অথবা মায়ের মুখভঙ্গি বুঝতে পারার কারণেই কি আমাদের এমন হয়েছিল ?
এবং মা তার বর্ণনা দেন জোসে মারিয়ে বলেওর কথা কি তোমাদের মনে আছে, সেই খনি গ্রামের আমার ছাত্রের কথা ?—যে কিনা সব সময় বলে বেড়াতো যে শয়তান অবশ্যই লিসবনে থাকে আমার জন্য লেখা চমৎকার এক রচনাতে সে একথা লিখেছিল স্বভাবত, সেবার সে খুব বেশী নম্বরও পেয়েছিল তবে সে ছিল আমার প্রিয় ছাত্র এবং যখন আমি ওদের যিশুর বারো জন শিষ্যদের মাঝ থেকে একজনের নাম লিখতে বলি, তোমরা কি ধারনা করতে পারো জোসে মারিয়ে তখন কার নাম লিখেছিল ? ফাদার পিও !

আমরা তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠি নায়েভেস, ওর তখন এরই মধ্যে উনিশে পেরিয়ে গেছে আমি, প্রায় আঠারো ছুঁই ছুঁই আর এলিসা, মাত্র পনর ফাদার পিও লা কোম্বার বিভাগীয় পুরোহিত একজন সাদাসিধা ভালো মানুষ, কিন্তু মেজাজ মর্জিতে তিনি একসঙ্গে হাজারটা পিশাচের মতো এবার ভাবো দেখি ! আর আচার সংস্কারের গাড়ি নামের জিনিস গুলোর কথা ! কি তোমার মনে আছে ? তিনি ভাবতেন সেই গাড়ি গুলো কেবল পোপ, বিশপ আর বয়োজ্যেষ্ঠ পুরোহিতদের ব্যবহারের জন্য

জোসে মারিয়ে লিসবনকে অবশ্যই থাকার জন্য জাঁকজমকপূর্ণ একটা জায়গা হিসেবে ভেবে ছিল সে জন্যই সে সেখানে শয়তানের নিযুক্তির কথা ভেবেছিল যদিও শহরটা আসলে প্রকৃত পক্ষে কেমন সে সম্বন্ধে তার ভুল ধারনা হয়ে থাকতে পারে আর তাই আমিও, এমন একজনের সঙ্গে কথা বলার কথা ভাবি যিনি বিশ্বাস করেন এটা অবশ্যই বসবাসের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা সত্য বলতে কি, হতভাগ্য সেই ছেলেটা নিজে কখনও সেখানে যায়নি আমিও কখনও লিসবন যাইনি বেশীর ভাগ সময় প্রায়ই সেই এখানে আসতো লা পোলাতে আর শয়তান ? সে কি আসলে জানতো শয়তান আসলে কী জিনিস বা কে সেই শয়তান ?

আর সেই ছোট্ট জোসে মারিয়ে শেষে কি হয়েছিল ?, তখন নায়েভেস জিজ্ঞেস করে বসে এধরনের কল্পনাপ্রবণতার জন্য, তার একজন লেখক হওয়া উচিত ছিল লা কোম্বার কবি আর সবার মতই সে খনিতে যোগ দেয়, অস্বস্তিকর একটা হালছাড়া ভাব নিয়ে মা বলে
শুধু ভেবে দেখ, লিসবনের, জুয়ান, এর বেশ কিছুক্ষণ পরে সে আমার দিকে ফিরে আর আমার ঘাড়ে কাতুকুতু দিয়ে বলে তখনকার মতই, এখন আমি মনে করতে পারছি সেই সোমবার গুলোতে মা যখন তার কোন প্রমোদ যাত্রায় বেরবার সিদ্ধান্ত নিতেন, যখন আমরা দুধ আর রুটি দিয়ে সকালের নাস্তা সারছি, তিনি তখন আমাদের চুলে বিলি কাটতেন, আমাদের ঘাড়ের পেছনে আঙ্গুল ডুবিয়ে ধীরে ধীরে মাথার ওপর নিয়ে আসতেন আর আমাদের চুল ঠিক করে দিতেন আমরা বিশেষ ভাবে তার সেই মমতাময়ী কাজটা পছন্দ করতাম, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারতাম এটা ছিল তার চলে যাবার এবং এক তিক্ত অভ্যর্থনার মাধ্যমে তাকে আবারও গ্রহণ করার সেই পূর্ব লক্ষণ মাত্র
হাসতে হাসতে, মা হঠাৎ করেই বলে ওঠেন: শয়তান লিসবনে থাকে ঠিক বার বছর আগেকার সেই হাসি এক সোমবারে তিনি যখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছিলেন আরক্ত চেহারায় মগ্ন ভঙ্গীতে প্রশান্ত চেহারায় আমার তখন মনে হয়েছিল তার চোখে বুঝি আমি উড়ন্ত ফুলেদের পেরিয়ে যেতে দেখলাম, ওয়াইনের বোতলের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম সবুজ ওয়াইন,” পর্তুগালে যেভাবে বলা হয়, মা ? হ্যাঁ, তোমার চোখ আমার খুবই পছন্দ সেখানে আমি একটা স্বচ্ছ সবুজ দেখতে পাই ঠিক সেই বোতল গুলোর একটার কাচের মতো

যেন মনে হচ্ছিল আমি তার হৃদকম্পন টেরপাচ্ছিলাম যেন তা খানিকটা দ্রুত চলছে তারপর সেখানে কেমন যেন একটা স্মৃতি কাতরতা ভর করে, তার চোখে সাগরের কুয়াশা যেমন করে শহরগুলোকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে, যে শহর গুলোকে সব সময়ই বহু দূরের বলে মনে হয়, এমন কি আপনি সেখানে যাবার পরও তেমনই মনে হবেবিষণ্ণতার আভা তার মুখে উদ্ভাসিত হয়েছিল এবং বেঞ্চিতে আমার পাশে বসে, মা কাঁপতে শুরু করেন, যেন তিনি শীত বোধ করছেন, ক্লান্তভাবে তিনি ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে আছেন, তার হেলান দিয়ে থাকা দেয়ালের পাথর গুলো থেকে তখনও সারা দিন সঞ্চিত করে রাখা সূর্যের তাপ বেরিয়ে আসছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মা কাঁপছে, এর কারণ সম্ভবত তিনি এই সত্য জানেন যে চলে যাওয়া সেই নিরালা দিন গুলো কখনই আর ফিরে আসবে না 

তিনি কি লিসবন গিয়েছেন ? এবং সেখানে গিয়ে কি মা শয়তান কে দেখেছে ? আমি একটা হোটেল কক্ষের দৃশ্য কল্পনা করি সব সময় একই ঘরের ছবি এবং কোন এক ক্যাফের একটা চেয়ার সম্ভবত সেটাও, সব সময় একই থাকে উঁচু নিচু ঢালু সরুপথ দিয়ে, অপরিচিত লোকেদের সাথে হাঁটা টাইলসে মোড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে চলা এবং সাগর পাড়ে দিবানিদ্রা যাওয়া তোমার পায়ের ওপর দিয়ে জল আর আগুন খেলে গিয়ে, শরীরের ওপর দিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে,তোমার তরতাজা ত্বক বালিতে ঢেকে যাচ্ছে একা ? প্রেমিকসহ ? অথবা সেই শয়তানের সঙ্গে ?
আর আমি তার প্রতি ঈর্ষা বোধ করি হ্যাঁ, সেই শয়তানের ওপর ঈর্ষাকাতর হই এবং তার প্রতি আমার মায়ের প্রতি এবং বাবার ওপর ক্ষিপ্ত হই সব সময় একটা কাঠের টেবিলের ওপর ঝুঁকে থাকতেন তিনি, টেবিলটার কাঠের ওপর অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিজের ছোট্ট ছুড়িটা দিয়ে তিনি সেটার ওপর প্রতিনিয়ত দাগ কাটতেন খুব মনোযোগ সহকারে অসীম এক ক্ষোভের সঙ্গে তিনি এই কাজটা করতেন এবং রঙ করতেন গ্রিজের রঙ আর আগুন দিয়ে রঙ করতেন, তপ্ত সসপ্যানের পীট দিয়ে, এমন ভাবে রঙ করতেন যাতে তা আর কোন ভাবেই তুলে ফেলা সম্ভব না হয় আর বাবার হাতে সব সময় তাসের প্যাকেট থাকতো উজ্জ্বল আর নোংরা, কোনা গুলো ছেড়া
আগে, এবং এখনও, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, দৃঢ়চেতা নারী কঠোর পরিশ্রমী ক্লান্তিহীন এবং একই সঙ্গে, তোমাকে দেখে মনে হয় যেন কোন গোলক ধাঁধার মাঝে রয়েছ, যেন সব সময় কোন পথের বাঁকে রয়েছ, ঠিক স্বপ্ন মন্দিরে প্রবেশ করার মতো অবস্থায় চির দিনের মতো ছেড়ে চলে যাচ্ছ একই সঙ্গে ঝরঝরে আর খোলামেলা কেন তুমি তাকে ছেড়ে চলে গেলে না, মা ? কেন তুমি এই নিয়তির বাঁধনে জড়িয়ে পড়ে রইলে, এমন একটা লোকের সঙ্গে যাকে তুমি কখনই ভালোবাসতে পারোনি, এবং সম্ভবত সেও তোমাকে কখনই ভালোবাসেনি ? যে কখনই তোমাকে ভালোবাসেনি যেভাবে তুমি সেটার উপযুক্ত ছিলে চিরন্তন ভালোবাসা কেবল চার মাসের মতোই টিকে থাকে, কথাটা সে প্রায় সব সময়ই বলতো আমাদের বাবা এবং অন্য ধরনের প্রেমগুলো, খুব বেশী হলে দুবছর, এর পরপরই সে বলতো তার রসিকতার ধরন সব সময়ই খুব ধ্বংসাত্মকছিল
সেটা কি আমাদের জন্যই, মা ? জানি, তোমাকে হারাবার ব্যথাটা খুবই ভয়াবহ হতে পারতো, কিন্তু আমি সব সময় তোমাকে সেই হাসি মুখেই দেখতে চাইতাম যাতে স্বপ্নের মাঝেই কেবল সেই দিন গুলোর তুমি হঠাৎ এসে আমাদের ঘাড়ে চাপড় না মারো এই সেই আত্মঘাতী স্বপ্ন যার মাঝে আমি তোমাকে হারাবার কথা কল্পনা করতাম, সেই ছেলেবেলা থেকে আমি এই স্বপ্নটা দেখে আসছি তুমি অন্য কোথাও হারিয়ে গেছ অন্য কাউকে জড়িয়ে রয়েছ তোমার সেই হাসিসহ এমন এক হাসি যা একটা পুরুষকে পাগল করে তুলতে পারে যে কোন পুরুষকে তাদের সবাইকে

মা, তুমি কি তোমার মদিরতায় কখনও পুরুষদের পাগল করেছ ? আমি নিশ্চিত তুমি এমন কিছু একটা করেছিলে, যেটা তুমি এখনও করতে সক্ষম এমন কি কোন রকম মনঃসংযোগ না করেই সম্ভবত, হতে পারে তুমি নিজেও সেই মদিরতায় আচ্ছন্ন ছিলে তাই কী তুমি তোমার মদিরতায় মজিয়ে পুরুষ গুলোকে একে একে মাতাল করে তুলতে ? অথবা তুমি কি এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছিলে যে তোমার ভালোবাসার জন্য উন্মাদ ছিল, যাকে কাছে পাবার জন্য তুমি খুবই মরিয়া ছিলে ? আর যদি এর সবই আমার মামুলি কল্পনানা হয়ে থাকে তাহলে কী হবে ? আর বাস্তবে তুমি কি কখনই লিসবন যাওনি ? এমনকি শয়তানের বাহুডোরেও কি ধরা দাওনি ? আর সেই শয়তানের যদি কখনও অস্তিত্বই না থাকতো, তাহলে কী হতো ?

না তুমি তাকে সামনা সামনি দেখেছিলে আমি তা জানি আর একারণেই আয়নাটা এখন ভাঙ্গা তোমার শোবার ঘরের, উপরের ড্রয়ারে, ওই খানটায় বছরের পর বছর ধরে সেটা ওখানেই রয়ে গেছে কখনই আর নেড়ে চেড়ে দেখা হয়নি সম্ভবত সেটাতে তুমি আর কখনই মুখও দেখোনি সম্ভবত অতীতের কোন কোনা-কাঞ্চিতে হারিয়ে যাওয়া একটা পরিচিত মুখ দেখার ভয়ে সেই শয়তানটার প্রতিবিম্ব, এর শূন্যতার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছিল সেটা কি এখনও সেখানেই রয়েছে ? আয়নাটার ভেতরে ? আর আমি যখন প্রতিবার সেই শয়তানটাকে কাচের ভেতরে একপাশ থেকে অন্যপাশে ভেঙ্গে পড়তে দেখি, তখন আমার অন্তরাত্মা কুঁকড়ে ওঠে সেই আত্মা যেটা বিক্রয় করার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত ছিলাম, যদি তোমার কাছে তার মানে চিরদিনের মতো এখান থেকে চলে যাবার সক্ষমতা হয়

এখন, যখন আবারও শীত আসবে আর চেস্টনাট গাছেরা তাদের পাতা হারাতে থাকবে, চারপাশের বাড়িগুলো যখন একেবারে নীরব আর নিশ্চুপ হয়ে পড়বে এবং তাদের জানালাগুলো বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে আসবে, আমাদের তখনও বেঁচেবর্তে থাকতে হবে আর আমাদের সবার ছোট এলিসাও, আর সবার মতই চুপচাপ বসে থাকবে তার অকপট আর সদাসতর্ক, সবুজাভ চোখ জোড়া, দীর্ঘ সময় জুড়ে তোমার দিকেই তাকিয়ে থাকবে যদিও তোমার সেটা কখনই জানা হবে না সম্ভবত সেই প্রথম শয়তানের কাছে ছুটবে ঈশ্বরের কাছে যথোচিত ভাবেবিশ্বস্ত একজন শয়তানের কাছে আর তারপর সেও দূরে চলে যাবে তোমার মতো, হাসতে হাসতে নির্মল, মন্ত্র মুগ্ধের মতো, সপ্রভ চোখে কথাটা মনে রেখ, মা

 --------------------------------------------------------------------------------------------
 * ড্যানিয়েল হাহন এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে সোহরাব সুমন। 
গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডারস-এ ছাপা হয়


 বের্টা ভিয়াস মাহোউ
বের্টা ভিয়াস মাহোউ ১৯৬১ সালে মাদ্রিদে জন্ম গ্রহণ করেন, এবং ভূগোল এবং ইতিহাস বিষয়ে পড়ালেখা করেন ( প্রাচীন ইতিহাসের ওপরে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ ) তিনি একাধারে একজন লেখক এবং সাহিত্য অনুবাদক এপর্যন্ত তিনি তিনটা উপন্যাস লিখেছেনলিও এন লা কামা ( “লিও ইন বেড,” এসপাসা নেরাটিভা, ১৯৯৯ ), লোস পোজোস ডে লা নিয়েভে ( “দ্যা ওয়ালস অব স্নো,” একান্টিলাডো, ২০০৮ ) এবং ভেনিয়ান আ বুসকারলো আ এল ( “দে ওয়ার  কামিং ফর হিম,” একান্টিলাডো, ২০১০, উপন্যাসটি ২০১১ সালে প্রেমিও ডুলেস চাকোন ডে নেরেটিভা পদক জিতে )—সেই সঙ্গে একটি গল্প সংগ্রহ (লাডেরা নরটে—“দ্যা নর্থ ফেইস,” একান্টিলাডো,২০১১ ), যেখানে দ্যা ডেভিলস লিভস ইন লিসবন গল্পটা ঠাঁই পায়, তার প্রবন্ধ সংগ্রহ লা ইমাজেন ডে লা মুজের এন লা লিটেরাচুরা ( “দ্যা ইমেজ অব দি ওমেন ইন লিটারেচার,” এনায়া, ২০০০ ) এবং এছাড়াও তার আরো তিনটা শিশুতোষ উপন্যাস রয়েছে তিনি গোথি, জুয়েগ, শনিটসলার, জোসেফ রুথ, গেরট্রুড কোলমার এবং ওডোন ভন হরভেথ এর লেখা অনুবাদ করেছেন 


ছবিঃ  সৌরদীপ্ত চৌধুরী 

মন্তব্যসমূহ