ঠোঁটকাটা
সত্তরের দশকের শেষ দিক। তিনি এলেন, দেখলেন আর নিজেই নিজেকে জব্বর জেতালেন কিংবা গোহারা হারালেন। নাম সুবিমলমিশ্র। ইদানিং তিনি নাম ও পদবী একসাথে জুড়ে দিয়েছেন। অনেক কিছুই ইচ্ছেমতো জুড়েছেন, আবার অনেক কিছুই ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়েছেন। এই যেমন বাংলা সাহিত্যে গল্প বা উপন্যাসের ফর্ম। সাহিত্যের ব্যাবসায়িক দেওয়াল লিখনে মহানন্দে হিসি করে দিয়েছেন, আবার লিকলিকে হাফ বেওয়ারিশ লিটিল ম্যাগাজিনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন শিশুর মতো! সেই ১৯৬৯। এর মাঝে অনেক জল গড়িয়েছে। ভালো জল। পচা জল। অনেককে কাঁধে তুলে লাফানো হয়েছে, ‘বলো কালী মা-ই কী!’ অনেক তাসার তালে নিতম্বের মোচড়। তার পর যা হয় আর কী! কোমর ভেঙে কেতরে পড়ে আছে। কিন্তু যে লোকটি আজও দৃঢ় ভাবে দণ্ডায়মান তাঁকে একটু বেশি পরীক্ষা করে হোক না, কারণ ‘যাকে ধরে নেওয়া হয়েছে ঠিক বলে তাকেই বেশি পরীক্ষা করা দরকার’।
অমিতকুমার বিশ্বাস
সুবিমল মিশ্র
হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি
হারণ মাঝির বিধবা বৌটার আর কোন উপায় ছিল না,গলায় দড়ি দিয়ে মরল। বাইশবছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে। দুটো কাক অনেক্ষণ ধরে ডেকে আসছিল এখন ফিরে যাবে।
দেড় বছরের কালো রোগা পেটের পিলে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে-থাকা ছেলেটা কঁকিয়ে কঁকিয়ে এখন হাঁফিয়ে উঠেছে, ধুঁকছে। শ্যাওড়াবেড়ার ধারে একটা গরু ঘাস চিবোচ্ছে। দুজন বুড়ো দুঃখ করছে ছেলেটার দুর্ভাগ্যের জন্য, এরপর বৌটার চরিত্রহীনতা নিয়ে আলোচনা করবে। বৌটার বাইশ বছরী তাজা শরীর, অনেক সাদ-আহ্লাদ মনে ছিল গো, কিছুই পূর্ণ হয়নি। হারাণ মাঝি পশু ছিল একটা, বামুনপাড়া থেকে মুড়ি বেঁচে ফিরতে দেরি করলে পিটতো, পিটিয়ে আধমরা করে ফেলত মানুষটাকে। মড়াটা ভেসে ভেসে কালিঘাটের দিকে চলে যাচ্ছে। কাকেরা পিছু নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। খালের দুদিক বড় সুদৃশ্য, মানুষেরা পায়খানা করে রেখেছে জলের কাছাকাছি, দুনিয়ার আবর্জনা স্তূপাকার করে ফেলা, বস্তা ঘাড়ে করে একটা কাগজ-কুড়ুনি কাগজ কুড়োচ্ছে, তিনটে মোষ ঘোলা জলে শরীর ডুবিয়ে স্থির হয়ে আছে, একটা মরে যাওয়া গলে যাওয়া কুকুর বেড়াল বা ঐরকম কিছু ভেসে যাচ্ছে, তার ওপরেও একটা কাক। কালিঘাটে এসে লোকে এই জলে চান করে পাপ ধুয়ে ফ্যালে। হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের শব কত দূরে কে জানে, কালিঘাটের দিকে ভেসে আসছে। হারাণ মাঝি বৌটাকে অনাথ করে গিয়েছিল, বৌটা মরে বাচ্চাটাকে অনাথ করে গেল। শিশুর শরীরে পাপ নাই, শিশু ঈশ্বরের তুল্যি, তুলে নিয়ে যাও পুণ্যি হবে--কারা যেন কথাগুলো বলে ওঠে।
হারাণ মাঝি মরে যাওয়ার পর মুড়ি বেঁচে পেট চালতো তার বিধবা বৌ। বামুনপাড়ায় অনেক শিক্ষিত লোকের বাস। তারা বাড়ির সামনে রজনীগন্ধার বাগান বানায়, পুজোর সময় নতুন কাপড়-জামা পরে, বানরের খেলা দেখে বাজিকরের দিকে টাকাটা-সিকেটা ছুঁড়ে দেয়, হারাণ -বৌয়ের আঁটো শরীর দেখে তাঁকে ধানভানারি রাখতে চায়। কান্না দেখে যেন বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল মুখের লালা আর নাকের সিকনিতে তার বুক ভরে গেছে বলে চুপি চুপি তাঁকে মাটির ওপরে নামিয়ে রাখল। সীতা পাতাল প্রবেশের সময় বলেছিউলেন: হে ধরণী দ্বিধা হও, ঠাঁই দাও আমাকে তোমার কোলে। 'প্যাটের দায় বড় দায় বাছা-- ক্যান যে বৌটা বিপথে গেছলা তা তোমরা বুঝবা না।' -- কারা যেন ভিড়ের ভেতর থেকে বলাবলি করে।
হারাণ মাঝির বৌয়ের গায়ে অসুরের শক্তি, রাইটার্স বিল্ডিঙের দরজার গোড়ায় সে পুতনা রাক্ষসীর মতো জাঠাগাছ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে কেউ এগোতে পারছে না, অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবস্থা খারাপ দেখে মেট্রোতে ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট পাওয়া যায় কিনা ভাবতে শুরু করেছে। হারাণ মাঝির লাঙলটা শেষ পর্যন্ত ঘুণ ধরে যায়। অনেকে অবশ্য বলে ঘুণ নয় উইয়ে খেয়েছে। কারণ হারাণ মাঝির কোন জমি ছিল না। সে বামুনপাড়ায় জমিদারদের জমিতে বর্গাদার ছিল। ভাগরেকর্ড প্রথা চালু হওয়াতে তারা আর হারাণকে বিশ্বাস করে জমি দেয়নি। এইমাত্র অল ইন্ডিয়া রেডিও ঘোষণা করল ক্ষুধিত মানুষেরা মিছিল করে এগিয়ে আসছে সেকেনডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে। গলায় দড়ি দেওয়ার আগে হারাণ মাঝির বিধবা বৌ অন্ধকারের সমস্ত তলটাই দেখতে পেয়েছিল। কারা যেন ফাঁদ পেতে পাখি ধরছে। এক দংগল কাক কা-কা শব্দ করতে করতে উড়ে গেলে জায়গাটা শুকনো মরুভূমি হয়ে পড়ে থাকল। তাতাররা মরুভূমির ভেতর দিয়ে চলতে চলতে জলটল ফুরিয়ে গেলে যখন তৃষ্ণায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা তখন উটটাকেই মেরে ফেলে তার রক্তে তেষ্টা মেটাবার চেষ্টা করত। আলের ওপর চাষা ছেলেটা পান্তাভাত শুকোপোড়া দিয়ে দিব্যি খেয়ে চলেছে। তার সামনে সবুজ বেহেন রাখা, সে তলায় রুইবে। সেই তলার একটু দূর দিয়ে খাল, যার জলে হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের শবদেহ ভেসে যাচ্ছে। আর এই খাল অনেক দূরে গিয়ে টালিগঞ্জের ভেতর দিয়ে কালিঘাট ছুঁয়েছে।
আগামী নির্বাচন উপলক্ষে মনুমেনট ময়দানে যে মিটিং ডাকা হয়েছিল তাতে খুব হাঙগামা হয়, ট্রাম-বাস পোড়ে, পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে মহাত্মা গান্ধীর যে স্ট্যাচুটা ছিল কি করে সেটা ভেঙে যায়। সবাই যখন দুঃখ করছে, হায় রাম একি হল বলছে, তখন আমেরিকা ঘোষণা করল তারা টাকা দিয়ে ওখানে একটি সোনার গান্ধী বানিয়ে দেবে। বোউয়ের গলার হারটা, তার শেষ সম্বল, অত্যন্ত সাধের জিনিস বেচতে গিয়ে হারাণ কেঁদে ফেলেছিল, অবশ্য তার সেই কান্না পৃতিবীর কাকপক্ষীও টের পায়নি। বিধবা মেয়েমানুষের উপোষী পেট হচ্ছে বাচ্চা পাড়ার সবচেয়ে প্রশস্ত জায়গা...মিনসেগুলোর যখন তর সয়না কাপড় খুল্যা লিয়া তলপেটে গুঁতা মারে, তখন খ্যাল থাকে না সারাদিন প্যাটে কিছু পড়েনি, তলপেটটা খোঁদল হয়্যা আছে। এর থাইক্যা কুকুর হয়্যা জন্মালিও ভালো ছেল-- মেয়্যা মাইনসের জন্মরে ঘেন্না ধরি যায়...
হারাণ মাঝি বলত, খানকির ব্যাটারা খেয়ে পরে কিচুতে বেঁচে থাকতি দিলে না। তার কয়েক মাস পরেই হারাণ মারা যায়। জমিতে লাঙল চষা নিয়ে জমিদারের সংগে বচসা এবং তা শেষ পর্যন্ত খুনোখুনিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। জলের চেয়ে রক্তের ঘনত্ব কম। মাথাটা দুখান হয়ে গল গল করে লাল রক্ত বেরোচ্ছে। বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল হারাণ, সেই জ্ঞান আর ফিরে আসে নি। হারাণ মাঝির বৌ বাচ্চাটাকে কাঁখে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখল এত বড় দশাসই মানুষটা কেমন নিশ্চল হয়ে গেছে। রাইটার্স বিল্ডিঙে হৈ হৈ চলছে। হারাণ মাঝির বিধবা বৌ কেন আত্মহত্যা করল তার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গভরমেনটের হিসেব অনুযায়ী এ বছর পশ্চিমবংগ খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত রাজ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক ভাষণে বলিয়াছেন, আমাদের দেশের একটি লোককেও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত হইয়্যা দ্যাট ইজ না খাইয়া মরিতে দিব না। কেহ কেহ বলেন আমাদের অধিকাংশ খাদ্যশস্য ইঁদুরে খাইয়া ফেলিতেছে। ইঁদুরের বংশ নির্বংশ করিতে পারিলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই। হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়াটা কয়েকটা শেয়ালে মিলে ডাঙায় টেনে এনেছে, পেট চিরে ফেলতে তারা তার ভেতর একটা জ্যান্ত বাচ্চা দেখতে পেল। বাচ্চাটা সরাৎ করে উপরে আকাশে উঠে গিয়ে চেঁচিয়ে বলছে:
তো মা রে ব ধি বে যে গো কু লে বা ড়ি ছে সে
সারা ভারতের লোক এই স্বর শুনেছে, কিন্তু 'তোমারে' বলতে কাকে বোঝাচ্ছে বুঝতে পারেনি। আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি খুব শিগগির এ দেশে আসছে খবরের কাগজে খুব বড় বড় হরফে ছাপা হয়ে বেরুল। পশ্চিমের সমাজবিজ্ঞানীরা এক বিপ্লবকারী গবেষণা করেছেন, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে আধুনিক যুগের মনুষ্যগণ অত্যধিক চরিত্রবান। হারাণ মাঝির বিধবা বৌ বলত: শালার বামুন বুড়ো চাট্টিখানি খাইতে দ্যায় আর সময় নাই অসময় নাই খালি ঠাপানোর ধান্দা। পরজন্মে শালারা নরকের কুত্তা হবি। চারদিক হৈ হৈ কাণ্ড ! বামুনপাড়ার জমিদারবুড়ো সন্ধ্যেবেলা পুকুরঘাটে হাত পা ধুয়ে খড়ম পায়ে বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছে এমন সময় তার পায়ের কাছে নরম মতো কি ঠেকে। লম্ফ নিয়ে এসে দ্যাখে হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া। রাম রাম! এর কাছে ওর কাছে শুয়ে মাগিটা পেট করেছিল শেষ কালে কিনা বামুনের বাড়ির বারান্দায়। শহরের মেয়র বাথরুমে যাওয়ার জন্যে উঠেছেন, রাত তখন দুটো, ঢুকতে গিয়ে দরজার কাছে বিশ্রি একটা পচা গন্ধ পেলেন, আলো জ্বালিয়ে দেখেন হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া সেখানে পড়ে আছে। একজন বিখ্যাত জননেতা সারাদিন যিনি নানাধরনের সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকেন দুপুরের খাবার টেবিলে বসতে গিয়েই দুর্গন্ধ: টেবিলের ওপর হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া পড়ে আছে। ভোর রাতে ট্রাম চালাতে চালাতে ট্রাম-কনডাকটার হঠাৎ নাকে রুমাল চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে দ্যাখে চলার পথ বন্ধ, রাস্তার ওপর হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া শুয়ে আছে। সারা শহরময় খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভীত, মরা মাছের চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গণ্যমান্যদের ঘরের চৌকির নিচে, আলমারির পেছনে, খাবার ঘরের মেঝেতে, কলতলার অন্ধকারে হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া পাওয়া যাচ্ছে। দেড়-বছরের সর্বহারা বাচ্চাটা কোন এক অপরিচিত মেয়ের বুকে সমানে কেঁদে চলেছে। খবরে বলল আমেরিকা থেকে সোনার গান্ধীমূর্তি দমদমের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে অসংখ্য কাক-শকুনকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। নাগরিকেরা মুখে রুমাল চেপে সব সময় চলাফেরা করছেন। সারা শহর দুর্গন্ধে ভরে গেছে। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত । কখনও না জানি কাকে হারান মাঝির বৌয়ের মরার পাল্লায় পড়তে হয়।
লোকের মুখে এখন হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ছাড়া অন্য কোন কথা নেই। সকালবেলা আমেরিকান বিমানটি দমদমে নামছে, চারিদিকে গণ্যমান্য সবাই অপেক্ষা করে রয়েছেন, এক সভ্রমপূর্ণ মুহূর্ত, এই বিমানে গান্ধীজীর সোনারমূর্তি রয়েছে। ভিড়ের ভেতর থেকে শোনা গেল গান্ধী আমাদের আদর্শ গান্ধী আমাদের আরাধ্য। দেড় বছরের অনাথ বাচ্চাটি সমানে কেঁদে চলেছে। কে যেন হাত তুলে আকাশে কাক-শকুন উড়ছে দেখিয়ে দিল। এবার কাঠের বাক্স নামানো হচ্ছে, ডালাটা খোলা হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রধান তাঁর দস্তানাপরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন গান্ধীজীর সোনারমূর্তি স্পর্শ করার জন্য। সৈন্যবাহিনী রাজকীয় মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পতাকা, সিল্কের তৈরি পৎ পৎ উড়ছে। ড্রাম বাজছে তালে তালে। অনেক ফালতু লোক ব্যাপার কি দেখার জন্য দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাদের ঘেষতে দেওয়া হচ্ছে না। এক সময় বাক্সটার ডালা খোলা হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত উপস্থিত জনবর্গ সবিশ্ময়ে দেখলেন বাক্সটার উপরে হারাণ মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধীমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।
( জুন ১৯৬৯)
বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন
বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন। তল্লাটের ছেলেবুড়ো মেয়েমরদ তাঁকে চিনত কিন্তু কোত্থেকে এসেছেন কেউ বলতে পারত না। ফুলের মাসে সারা অঞ্চলটা নিমফুলের গন্ধে ম ম করত, দেখনঅচাচা মগডালে বসে পা দোলাতেন, বলতেন: বলত ছোঁড়ারা ফুলের গন্ধে গুয়ের গন্ধে তফাৎ কি? ছেলেরা কিছু বুঝতে পারত না, খুব একটা ইয়ার্কি ভেবে হি হি হেসে পালিয়ে যেত।
মানুষের ঐটেয় মানায়। বাঁশবাগানের সোনার জ্যোৎস্না উঠলে তিনি ঘোড়ানিম থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, জিভ দিয়ে চেটে সেই সোনার পাতের ঠাণ্ডা নিতেন। বাঁশবাগানের গায়ে একটা ডোবা ছিল, তাতে ব্যাঙেরা ভেসে থাকত। দু হাত -দুপা দিয়ে হেঁটে দেখনচাচা সেই জলে নেমে পড়তেন। তারপর যখন তিনি উঠে আসতেন–- জল–পাঁক-মাখা তাঁর শরীর বুকে ভর দিয়ে হাঁটতে থাকলে তাকে অতিকায় এক আদিম সরীসৃপের মত মনে হত।
দেখনচাচা বলতেন সব শালা রাই ফুটো-ফাটার ধান্দা। বলে থপ থপ করে উরত বাজালে লোকে হাসত। বলত: ফুটোটা বুজলুম ফুটোপয়সা কিন্তু ফাটাটা কি... হি –হি–হি। দেখনচাচা খেপে গিয়ে “বিশ্বাস করলিনা হতভাগারা” বলে বসতেন , তারপর একজনের গর্দান ধরে “ওঁ ক্লিং ক্লিং বৌটায় ফট্ সাহা” মন্ত্র পড়লে তার চোখে দিব্য- দৃষ্টি হয়ে যেত, সে দেখত নায়েব মশাই পা টিপে টিপে তার শালির ঘরে ঢুকছে, হাজার একর জমির মালিক চৌধুরী মশাইয়ের গোলায় বেওয়ারিশ ইঁদুরেরা ধান খেয়ে যাচ্ছে চুপি চুপি, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জলপানি–পাওয়া ছেলে আসন্ন পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে রামপ্রসাদী গাইছে, আমায় দে মা তবিলদারি... তারপর গর্দান ছেড়ে দিয়ে বলতেন: দে শালা দে, দুটো পয়সা দিয়ে যা...অনেক দেখেছিস ...
এই সব তন্ত্রমন্ত্রের জন্য সবাই দেখনচাচাকে ভয় করত, কেউ ঘাঁটতে সাহসী হত না। ক্ষেত থেকে কলাটা মুলোটা লোকে আদর করে দিয়ে যেত, দেখনচাচা ঘোড়ানিমের ডালে বসে সেগুলো কাঁচা চিবিয়ে খেতেন। তার পরনের কাপড়খানা অনেক সময় গাছের মগডালে থাকত । গ্রামের ঝি-বৌরা যাওয়ার সময় হঠাৎ ওইভাবে দেখনচাচাকে দেখে ফেললে মুখ ঘুরিয়ে বলত: মাগো... দেখনচাচা বলতেনঃ মুখে যাই বলুক মনে তারা আনন্দ পাচ্ছে।
একবার এই রকম ঘটনা ঘটল। চৌধুরী মশাইয়ের বড় জামাই সস্ত্রীক কলকাতা থেকে বেড়াতে এলেন। একদিন ভোরবেলা তিনি বৌ নিয়ে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ চাচাকে গাছের আগায় ল্যাংটো হয়ে বসে থাকতে দেখলেন। দেখনচাচা তাকে দেখে হি হি করে হাসলেন, ‘চমৎকার যুবতী বৌ তো তোমার’ বললেন। সেই নব্যযুবকের এই সব ইতরামির মতো ব্যাপার সহ্য হল না, লোকজন ডেকে চাচাকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে কী মার! হাড়গোড় বুঝি ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল মারের পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে 'আমি কিন্তু স্ত্যি কথাই বলেছিলাম' বলে হাসতে হাসতে দেখনচাচা ঘোড়ানিমের আগায় চলে গেলেন।
মাঝরাত্তিরে দেখনচাচা কি করতেন কোথায় যেতেন কেউ জানে না। কেউ কেউ বলত তাঁকে দুহাতে দুপায়ে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় অন্ধকারে। কেউ কেউ বলত তিনি শব সাধনা করেন শ্মশানে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন: দেশের সমস্ত ধান ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে দেখতে যাই, জ্যোৎস্না রাতে আকাশের চাঁদ কেমন বিধবা যুবতীর মতো এলোমেলো হয়ে যায় দেখতে যাই। এ রকম দু-একটা কথা শুনে লোকের প্রবৃত্তি হত না চলে যেত। দেখনচাচা তাদের চলে যাওয়ার দিকে হি হি হাসি ছুঁড়ে মারতেন।
এই রকমের ছিলেন দেখনচাচা আর তাঁর শেষ কয়েকটা দিন বড় অদ্ভুত কাটল। গ্রামে কলেরা এসেছিল। এমন কলেরা বুড়োরাও জীবনে দেখেনি। প্রথমে এল জেলেপাড়ায়। জোয়ান বিশু জেলে দুপুরে ভাত খেয়ে মাছ ধরতে গেল, ফিরে এসে কয়েকবার ভেদবমি করল, তারপর সব ঠাণ্ডা। ঘন্টা দুয়েক পরে বিশুর বৌয়ের হড়হড়ে পায়খানা শুরু হল। ক্রমশ সমস্ত জেলেপাড়ায় ছড়িয়ে গেল অসুখ। একরাত্রে সেখান থেকে নটা মরার সংবাদ পাওয়া গেল। সকালে বামুনপাড়ার দিকে রোগ চলে এল। সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত, কে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুপুরের মধ্যেই বামুনপাড়া থেকে গোটা-পাঁচেক মড়া বেরোতে গ্রাম ছেড়ে লোক পালাতে সুরু করল। যে যেখানে পারছে চলে যাচ্ছে। বৌ- ছেলে মা-বাপের দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই। সবাই তখন নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। সন্ধের দিকে কায়েত পাড়ায়ও ভেদবমি সুরু হল। যে কজন সাহসী লোক পাড়ায় ছিল, সাহস দেখিয়ে যায়নি, নানা ছুতোয় তারাও সরে পড়তে লাগল। গৌর মণ্ডল যুবক, তার বৌ মনোরমা একবার পায়খানা করে এসেই বারান্দায় পড়ে গেল, চোখের তারা মরা মাছের মতো নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। গৌরের বাপ বলল: গৌর যদি প্রাণে বাঁচতে চাস ত এই বেলা চল পালাই। গৌর একবার বৌয়ের দিকে চেয়ে দেখল, বৌয়ের প্রতি তার বড় টান, ঐ শরীরে তখনও পরিপূর্ণ যুবতী। বাপ ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল: বৌ একটা গেলে আর একটা হবে কিন্তু জান্ একবার গেলে... বাপের বাক্য শিরোধার্য করল গৌর। বৌটা সম্ভবত কিছু আন্দাজ করে 'আমায় নিয়ে যাও আমায় ফেলে যেওনা দোহাই পায়ে পড়ি' এই রকম বলতে বলতে রাস্তার ধারে এসে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সে যেখানে পড়ল সেটা ঘোড়ানিমের গাছতলা, তার ওপরে দেখনচাচা বসেছিলেন। বৌটার অবস্থা দেখে নেমে এলেন, এসে টিপে টিপে হাত-পা দেখলেন চোখের তারা দেখলেন, বুঝলেন চিকিৎসা করলে এখনও বাঁচতে পারে। কয়েকজন লোক তখন এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তিনি তাদের ডাকলেন, বললেন, মেয়েটার একটু সেবা কর বেঁচে যেতে পারে, কিন্তু তারা পালিয়ে গেল দূর দিয়ে, গাছের ছায়াও মাড়াল না। দেখনচাচা দেখলেন, দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর মিনিট-দুই কি ভেবে 'ব্যোম তারা' বলে হাঁটুগেড়ে বসলেন মেয়েটার কাছে, তার কোমরের কাপড় আলগা করে দিলেন। কাপড়টা গুয়ে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, মুখের গাঁজলা বমি মুছিয়ে দিলেন। জল এনে ধুয়ে মুছে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টায় মেয়েটার জ্ঞান ফিরল, দেখনচাচা তখন তার হাতে পায়ে সেঁক দিচ্ছিলেন। একজন পুরুষমানুষের সামনে উলংগ হয়ে শুয়ে আছে বুঝতে পেরে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল মেয়েটা, দেখনচাচা বললেন: লজ্জা কি মা, আমি তোমার ছেলের মত, সেবা করছি।
তারপর মেয়েটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে দেখনচাচা এক কাণ্ড করে বসলেন। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললেন: তোমায় আমি ইচ্ছা করি।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল: কি?
দেখনচাচা বললেন: রতি যাঞ্ছা চাহি।
মেয়েটা লজ্জায় মরে গেল।
দেখনচাচা বললেন:
উপকার করি যদি দাম নাহি চায়,
হয় মিথ্যা কথা বলে না হয় ভাঁড়ায়।
মেয়েটা কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
দেখনচাচা সযত্নে তার হাত ধরলেন, বললেন:
জননী জায়ার মাঝে ভেদাভেদ নাই,
একজন স্তন্যদাত্রী অন্য জন মাই।
বলে, অত্যন্ত সহজ- ভংগিতে তার বুকের কাপড় খসিয়ে নিলেন।
গ্রামের লোকেরা যখন জানল ব্যাপারটা তখন তারা দেখনচাচার ওপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগল এরকম চরিত্রহীনতা তারা সহ্য করবে না। প্রথমে একজন চরিত্রবান লোক একটা খোলামকুচি ছুঁড়ে মারল দেখনচাচার দিকে । দ্বিতীয় চরিত্রবান মারল একটা ঢিল। তৃতীয় চরিত্রবান একটা শক্ত মাটির টুকরো। আর চতুর্থ চরিত্রবান একটা আস্ত থান-ইট। ঠিক মাথার মাঝখানে ইটটা লাগতে দেখনচাচা ঘোড়ানিমের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। এখন সমবেত চরিত্রবানেরা তাঁকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। কিন্তু তখনো তিনি হাসছিলেন, তাঁর কপালের রক্ত গড়িয়ে এসে ঠোঁটের হাসিটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। সমবেত সেইসব চরিত্রবানেরা দেখনচাচাকে মারতে মারতে এক সময় অজ্ঞান করে ফেলল, পা দিয়ে বলের মত লুফতে থাকল, তারপর গ্রামের বাইরে নদীর ধারে জলে ফেলে দিয়ে এল। শেষ মুহূর্তেও দেখনচাচার ঠোঁটে সেই রক্তাক্ত হাসিটা লেগে ছিল।
পরের দিন গ্রামের সমস্ত চরিত্রবান লোক দেখল যেখানে দেখনচাচার রক্ত পড়েছিল সেখানে সেখানে এক-একটা ঘোড়ানিমের গাছ জন্মে গেছে। সকাল বেলার সতেজ আলোবাতাসে সেই সব নিমগাছের কচি পাতায় কাঁপ ধরেছে।
(নভেম্বর ১৯৬৯)
(গল্পদুটির বানান অপরিবর্তিত। কোথাও ‘মতো’ কোথাও-বা ‘মত’; ‘সুরু’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার মূল গল্প দুটিতে রয়েছে। সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গল্পদুটি প্রকাশ করা হয়েছে। )

মন্তব্যসমূহ