উৎপলকুমার বসু’র ‘চতুর্দশী’: এক আশ্চর্য সম্মোহন


 তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

পছন্দের কবিতা সম্পর্কে চিরদিন কিছু মতবিরোধ থেকে যায়, থেকে যায় বহুল চিন্তামগ্নতার বিপুল প্রভেদ। সেসব কাটিয়ে বিস্তর অন্বেষণ শেষে যে উপলব্ধ প্রিয় নিমগ্নতা ছুটে আসে, নির্দিষ্ট করে তার সীমা পরিসীমা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আর  ঠিক এভাবেই সম্ভব-অসম্ভবের মধ্যে দুলতে শুরু হয় এক কবিতার নিমগ্ন পাঠোদ্ধার। এক-একটি কবিতার এক-একটি শব্দের মধ্যেকার যে দীর্ঘ যাত্রাপথ (অথচ ছাপার অক্ষরে কত কাছাকাছি!) তা অতিক্রম করার পর পাঠকের স্নায়ুজগতে যে প্রশান্তির ছায়া নামে, যে প্রবল আলোড়ন শুরু হয় চিন্তা জগতে, তা থেকে ঐ কবিতার প্রতি প্রবল এক আকর্ষণ বোধ হয়। এমন কবিতার সংখ্যা কম হতে নেই। আর নেই বলেই আমি প্রথম পছন্দের তালিকায় খুঁজে পাই বর্ষীয়ান কবি উৎপলকুমার বসুর ‘চতুর্দশী’ কবিতাটি।
তোমার বয়েস আমি ভালোবাসি।
তুমি কোন পাথরে দাঁড়াও মনে থাকে।
যত গান প্রিয় বলো আমি লিখে রাখি মলিন খাতায়।
প্রতিদিন পুরোনো সূর্যের রথ ভেঙে পড়ে সন্ধ্যেবেলা।
দূরে- উপকূলে-
ক্রীড়ারত তোমার বয়সী যারা – ওরা কেমন প্রেমিক? (‘চতুর্দশী’ ; চৈত্রে রচিত কবিতা)

একটা বয়েসে যখন আমরা সত্যিসত্যিই ঘুমের ভেতর আমাদের কান্নার শব্দ শুনতে পাই, সাধারণ বিচারে যাকে বয়ঃসন্ধি বলে, আমি সেই সময় হঠাৎ অতল সমুদ্রের  মাঝে, একঝাঁক শামুকের মধ্যে ঠুকে ঠুকে পেয়ে গেলাম মুক্তোগর্ভা এই কবিতাটি। আমি প্রতি দুপুরে আনমনা হয়ে পড়তাম এই মুক্তো-সম্মোহনে। জানালার দিকে মুখ, হঠাৎ হঠাৎ যেন প্রিয় নারীর দেখা পাওয়ার মতো ছলাৎ-ছলাৎ করে ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে... এমন বোধ হত।

তারপর সত্যিই ‘আমরা’ বড় হয়ে উঠলাম পাশাপাশি। তরুণ বয়সের সেই উন্মাদনা কমতে থাকল, বাড়তে থাকল জীবন জীবিকার সংশয় – বাড়তে থাকল দূরত্ব। তবু  এর মধ্যে অবসর সময়ে মনে পড়ে তরুণ বয়সের সেই পাঠের অভিজ্ঞতা, সেই ঐন্দ্রজালিক অনুভব। এই পাঠ বিষয়ে আমার যা অনুভব কবি তাঁর ‘কবিতা সংগ্রহ’
( ১৯৯৬ দে’জ পাবলিশিং) এর ‘আরম্ভ’তে বোধহয় তেমনটাই বলেছেন, ঠিক যেমন তরুণ এক প্রেমিকের প্রশ্নময়তা কবিতাটিকে গ্রথিত করেছেন মনে মনে –
      ‘... যা আছে, তা হল স্মৃতি। ... কেননা সে শুধু প্রতিফলন মাত্র। আশা বা আকাঙ্খা ব’লে অন্য একধরণের মনোভাবের সঙ্গেও আমার মুখ চেনা আছে। এদের নিয়ে – এইসব অস্থাবর, অনিশ্চিত মেঘ ও বালুচরের খেলা নিয়ে – আমাদের ছুটোছুটি
আমিও সেই অনিশ্চতার মধ্যে, মেঘ ও বালুচরের মধ্যে ছুটতে ছুটতে  বারবার আবিষ্কার করছি আমার তরুণ বয়সের সেই আর্তিগুলো।
          একটি কবিতার সবচেয়ে বড় অঙ্গ যেটা, আমার সাধারণ বিচারবুদ্ধিতে যা মনে হয়, তা হল, মনকে আঘাত করা, মনকে নাড়িয়ে দেওয়া। কবির কবিতার প্রতি ঐ দায়বদ্ধতাটুকু অবশ্যই থাকে। পাঠক সেই আঘাতে কতটা বিচলিত হবেন, আদৌ হবেন কি না সেটা কবির বিচার্য নয় বা কবি তা বিচার করে কবিতা রচনা করেন না কবিতা পাঠের শেষে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, যে জারন-বিজারন পাঠকের মনে চলতে থাকে, তা থেকেই উদ্ধৃত হয় এক অপ্রতিরোধ্য সম্মোহন। ক্রমে পাঠকের ‘চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে...’ কবি উৎপলকুমার বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থের দুটি শীর্ণতনু কবিতার মধ্যে (অন্যটি ‘আশ্বিন,১৩৬৫’) এই ‘চতুর্দশী’ আমাকে যতটা বাঁড়া দিয়েছে, হাসতে ও কাঁদতে শিখিয়েছে, তাঁর কোন অংশ কবির চেতনার উদ্ভাসে রঞ্জিত, তা বলা কঠিন। কবিতার প্রতিটি চরণ, প্রতিটি শব্দ এক তরুণ প্রেমিকের বিফল প্রেমাকাঙ্খার বেদনায়  পরিপর্ণতা পেয়েছে। এই প্রেমিক তার চতুর্দশী প্রিয়ার দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন ( হয়তো    তার বয়স বা সৌন্দর্যের বিচারে)। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই চতুর্দশী, হয়তো বয়সের ব্যবধান জনিত কারণে  বা নারীসুলভ রহস্যময়তায় অতি পরিচিত বিস্ময়কর পছন্দের কারণে এই নিবেদিত-প্রাণ পুরুষের প্রতি মনোযোগ দেননি। প্রিয় নারীকে খুশি করতে ( বা আপন খেয়ালেই) প্রেমিক তার প্রতি পদক্ষেপ লক্ষ্য করে, সে কখন কোথায় দাঁড়ায়, অপেক্ষা করে, কোন পথে তার স্বচ্ছন্দ যাতায়াত, কী গান তার পছন্দের, কী তার অপছন্দ... সব, সব মনে থাকে। আর সেই নারীর পছন্দ বদলায়, সে এক প্রিয়সঙ্গ ছেড়ে অন্যত্র  যাত্রা করে। আবার অন্য পথ অন্য পছন্দ – তবু এতসবের মধ্যে প্রেমিক পুরুষটি (যাকে আমি প্রকৃত প্রেমিক বলি) কিন্তু একমনে নিরীক্ষণ করে চলে এই প্রাত্যহিক বিবর্তন (একে কি phenomenology বলব?)। মাঝেমাঝে প্রশ্ন জাগে, এই নিরীক্ষণ কি কোনও নীরব দর্শকের,যাকে আমরা গ্রিক নাটকে কোরাস বা সমবেত সংগীতশিল্পীর ভূমিকায় পাই, যে আবহমানকাল থেকে ঘটমান সব পরিবর্তনের উপর নজর রেখেছে, প্রশ্ন করেছে, কিন্তু সদুত্তর পায়নি...
 প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিটি কবিতাই এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রশ্নমালা। আর উৎপলকুমার বসু সেই আবহমান কবিতার ধারায় যে কোনও ব্যতিক্রম নন, তা বলাই বাহুল্য। শুধু  তাঁর প্রশ্নের ধরনটা একদম আলাদা, যেমন গভীর রাতের নীরবতার ভেতরে হঠাৎ  একটা ‘খুট’... এই নীরবতা-ভঙ্গকারী আপাত ক্ষণস্থায়ী শব্দটি যেমন নিদ্রার জাল ছিঁড়ে আমাদের বাধ্য করে ঐ শব্দের প্রকৃত উসানুসন্ধানে, তেমন করেই আলোচ্য কবিতাটি  আমাকে ব্যস্ত করেছিল। বয়ঃসন্ধির পর আমি সেই চতুর্দশী সঙ্গিনীর জন্য অপেক্ষা করি। মাঝেমধ্যে দেখা হয়তো হয়, কিন্তু তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারি না... একদিন প্রবল বর্ষণতাড়িত পথে আমি, সন্ধ্যা নামতে দেখে বের হই। এবং দূরে ধোয়াচ্ছন্ন পথে দেখতে পাই তাকে... তাদেরকে... কচি বয়সের দুর্দমনীয় উচ্ছ্বাসে ভীষণ বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ওরা – ক্রীড়ারত – অসম্ভব ডুবতে ডুবতে যখন আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আমার নিচুকণ্ঠে একদা তার প্রিয় গানটি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তার কান এড়াতে পারিনি। এবং সেই সন্ধ্যায় আমি ভীষণভাবে বুঝেছি, মানুষের পছন্দ কত দ্রুত বদলায় (এতে অবশ্য দোষ ঐ ব্যাক্তির একার নয়, মনে হয় কিছুটা বস্তু বা বিষয়ের...)।
কিছু ঘটনা প্রত্যহ ঘটে। কিছু কখনও সখনও। আবার কিছু ঘটনা ঘটেই না। এমন তিনটি বিভাগ যদি মেনে নেওয়া যায়, তবে আলোচ্য কবিতাটির চতুর্থ চরণে যেভাবে ‘প্রতিদিন পুরনো সূর্যের রথ ভেঙে পড়ে সন্ধবেলা’, তা প্রাত্যহিক ঘটনা, এবং এই ঘটন-প্রাত্যহিকতার মধ্যে বিস্ময় না থাকলেও মনে হয়, কবিতার সমস্ত সম্ভব-অসম্ভব, অনিত্য ঘটনাগুলির মধ্যে একমাত্র এই মহাজাগতিক ঘটনাটিই সত্য, আর সেই সত্য বাকি সব অসম্ভবগলোকে কী ভীষণভাবে সমুজ্জ্বল করেছে। শুধু এই সন্ধ্যাকালে ভেঙে পড়া সূর্যের মতোই বিষণ্ন প্রেমিকের চোখে পড়ে এক অপরূপ দৃশ্য  (যাকে কখনও সখনও ঘটতে দেখা যায়) – ‘দূরে- উপকূলে’ – চোখে পড়ে প্রিয় চতুর্দশী তার সমবয়সীদের সাথে ক্রীড়ারতা। এই ক্রীড়া একার্থে মহাজাগতিক। আবহমান কাল ধরে তা কেউ খেলে চলে, কেউ কখনও খেলে না, খেলতে পারে না, যেমন আমি, যেমন কবিতার প্রেমিক, যেমন আরও অনেকে...
   মহাজাগতিক সেই ক্রীড়ার প্রকরণ আমরা অনেকেই জানি না। জানি না ঐ রহস্যময় খেলার নিয়ম-কানুন। শুধু হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে যায় সেই খেলার টুকরো  দৃশ্যসকল। আমরা দৃষ্টি মেলে সেই খেলা দেখি- দেখি সেই খেলোয়াড়দের- প্রাচীন মহাকাব্যে বহুবর্ণিত এই অপার্থিব দৃশ্য দু-চোখ মেলে দেখি। দেখি কী অসম্ভব সাছ্যন্দে  আমাদের প্রিয় নারী ঐ রহস্যময় খেলায় মেতেছে- যে খেলা আমরা চিরদিন খেলতে চেয়েছি। যে খেলা আমাদের চির-স্বপ্ন-প্রার্থিত। যার না-পারার বেদনায় শুধু প্রশ্নচিহ্ন জাগে। এই কখনও না-ঘটা ঘটনার ক্রম বিষণ্ন করে আমাদের... আর অনিবার্য ভাবে  বেজে ওঠে কবির শেষ চরণটি-  
‘... তোমার বয়সী... ওরা কেমন প্রেমিক?’
  বয়সের পার্থক্য তো বটেই, সেই সঙ্গে মিশে আছে প্রিয়ার চিরঅভ্যেসমতো  বদলে যাওয়া পছন্দের তালিকাও- একদা ক্রীড়াসঙ্গিনীর বর্তমান পছন্দের সঙ্গে বেমানান কবির প্রশ্ন যেন চিরপ্রেমিকের অসীম-অসহ সেই আর্তি –জেনে নেওয়া তার কৃপণা ( যে নারি পক্ষপাতদুষ্টভাবে অকাতরে ‘অপাত্রে’ প্রেম বিলাবে, অথচ আমার মতো দীর্ঘ অপেক্ষমা মানুষটিকে দেখবেও না, তাকে কৃপণা বলব না!) প্রেমের  অকস্মাৎ এই অপাত্রে ধারাবর্ষণের রহস্য। এখানে কবির সমর্পণ আছে, অন্বেষণ আছে, আছে উত্তরণের বাসনাও – শুধু জানা নেই পথ, শুধু জানা নেই ভবিষ্যৎ; তাই না জেনেই যে বয়সকে ভালোবেসেছেন, সেই বয়সের প্রেমিক কেমন হতে পারে, তার প্রশ্ন সরাসরি ছুটে গেছে তার প্রিয়াকে লক্ষ্য করে। কবি সমর্পণ করেছেন নিজেকে, যে সমর্পণ ভীষন মানবিক বা তর্কাতীত ভাবেই শারীরিক... যা পড়তে পড়তে আমি ভিজতে থাকি, ভিজতে থাকি এমন এক বৃষ্টিতে যেখানে ‘শুধু শব্দের সম্মোহন। এই সম্মোহন কাটিয়ে ওঠা যায় না। এই সম্মোহন আমাকে অতলস্পর্শী আবিষ্কারের ক্ষুধায় কাতর করে তোলে। আর কাতরাতে কাতরাতে আমি একটু একটু করে এগিয়ে চলি কবিতার অভিজ্ঞতা থেকে নিজস্ব – একান্ত এক জগতে, যেখানে নিভৃতে কবি উৎপলকুমার বসু আমার জন্য বুনে চলেছেন একের পর এক সম্মোহনী জাল – আর আবিষ্কারের নেশায় আমিও কবির নিকটবর্তী হতে থাকি – প্রেমের এই রূপ-রূপান্তর বিষয়ে... অথবা এর উলটোটাও হতে পারে। কে জানে, কবিতার আলো কোন রাত্রির  দিকে পথ নির্দেশ করে।
                                                                                                                  ফেব্রুয়ারি ৭, ২০০৬



মন্তব্যসমূহ