প্রিয় পাঠঃ অমিতাভ দাস

      এই সংখ্যার 'প্রিয় পাঠ' বিভাগে পাঁচজন কবিকে রাখা হয়েছে। প্রথমজন কবি অমিতাভ দাস। অমিতাভ নব্বই দশকের শক্তিমান কবি। তাঁর শব্দ ভিন্ন মাত্রার শক্তি বহক করে। দ্বিতীয়জন তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তমাল বিশুদ্ধ কবি। সৌন্দর্যের কবি। বিষণ্ণতার কবি। শূন্য দশকের অন্যত্তম সেরা কবি তমাল। তৃতীয়জন  শূদ্রক উপাধ্যায়। শূদ্রক প্রথম দশকের প্রতিশ্রুতিমান কবি। চতুর্থজন দেবাশিস বিশ্বাস।  দেবাশিস বয়সে একদম তরুণ। মাত্র কুড়ি। কিন্তা তাঁর উচ্চারণ অত্যন্ত বলিষ্ঠ। পঞ্চম জন সৈকত ঘোষ। সৈকত প্রথম দশকের কবি। তাঁর উচ্চারণে মহানগরের ছায়া এসে পড়ে। সৈকত এক শক্তিমান কবি। 


ছবিঃ লিওনার্দো  দা ভিঞ্চি


অমিতাভ দাস 
বেশ্যাকথা~

একটা বেশ্যাকে ভালোবেসে
তুমি নরকগামী হয়েছো কুমার--

এই কথা বলে
তিনি চলে গেলেন ।

আমার গুরু চলে গেলেন ।
আমার সত্য বোধ চলে গেল ।
আমার চেতনা ও চৈতন্যও চলে গেল ।

আমি একটা বেশ্যার
গায়ের গন্ধ ,চুম্বনের
লালা নিয়ে
ভিখিরির মত
বসে আছি পথে...

এইসব অজ্ঞতা জনিত মোহ
এই সব অজ্ঞতা জনিত
ক্রোধের পাশে
নিজেকে জ্বালাই ,
নিজেকে চন্ডাল ভাবি...
নিজের মাংস-মজ্জা টেনে
ছিঁড়ে ফেলি ,বাতাসের গায়ে
লিখে রাখি
আমার প্রিয় সেই
বেশ্যার নাম--

যাবার আগে গুরু বলে গেলেন ,
বেশ্যার পাশে শুয়েছিলে বলে
ঈশ্বর ছেড়ে গেছেন তোমায়...
তোমার ইহকাল বা
পরকাল বলে আজ
কিছুই নেই...

তাঁর কাঠের খড়ম
শব্দ করতে করতে
দূরে মিলিয়ে গেল...

বেশ্যাকে ভালোবেসে
আমিও যে বেশ্যা হয়ে গেলাম...




      বেশ্যাকথা~

       বুকের বোতাম খোলা জ্যোত্স্নায় সেই বেশ্যাটা দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টে ঝুঁকে আছে তার প্রিয় সেই রোগা ফর্সা কবি যে তাকে আদিগন্ত হানিমুনের স্বপ্ন দেখিয়েছে... প্রতিবার রমণের পর এভাবেই তাকে বাতাসে ছুঁড়ে দেয় সেই চিকন গড়ন কবি... হা হা হা ,শেয়ালের ডাকে কাঁটাতার নেচে ওঠে-- ওগো বেশ্যাসুন্দরী যার কবিতা লিখেছো হাতের তালুতে তার বউ তুমি হবে না কখনো এই শেয়ালের দেশে তুমি ও এই রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট এক ই অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছো রমণের পর চলে গেছে তোমার রাতচষা কবি হায় হানিমুন... হায় বিদেশ ভ্রমণ...





ছবিঃ লিওনার্দো  দা ভিঞ্চি


বেশ্যাকথা~

যাকে আমি বেশ্যা বলেছি
সেই হলো আরাধ্যদেবী আমার...

সেই সব প্রেরণার মূল ,
সেই সব বাসনার হেতু...

সে সব নিয়তি লালিত পূজা--
সে সব আগুনে রিপুকে জ্বালিয়ে হোম...

এই যে আমাকে দেখছো ,
আমাকে পড়ছো --এসব কি লিখেছি আমি ?
আমি কি পারি এই সব
শোকের অনুবাদ !
কামের যথার্থ সাধন !

এই সব নিশি আসলে সেই দেবী ,
তথা ঈশ্বরীর দেহ থেকে ,
চোখ থেকে ঝরে যাওয়া
ফুল ,মধু...তা কী
বুঝেছো কখনো ?






কর্কটলগ্নে স্থিতা

দেখলাম নক্ষত্রসুন্দরী উপাসনার ভঙ্গীতে
স্থির বসে গাম্ভীর্যে অথবা ক্লান্ত মনে
পিছনে রতিভারাতুর অনুরাধা দাঁড়িয়ে

এইভাবে শ্রাবণরজনী শেষ হ'লো আর
সেই মেয়ে ,কর্কটলগ্নে স্থিতা , নিরুত্তর...
অতঃপর দেবগনজাত গন্ধর্বকুমার...

দেখলাম নক্ষত্রসুন্দরী জানালার কাছে
মাথায় বেলফুল চন্দনচর্চিত ললাট--

আকন্ঠ কামনা-তীব্র ফুলমালা। আমি

স্বপ্নবৎ ; নীল-অরণ্য গভীরে ঘুমিয়ে পড়লাম...

ছবিঃ লিওনার্দো  দা ভিঞ্চি


মাধবীলতার লতার হাসি

এখন সকল প্রহর বুঝি অর্বাচীন ! বুঝি রোদ ক্রমশ ক্ষয়ে যায়...

তোমার জামার গন্ধ থেকে লাফিয়ে নেমেছে বকুল বকুল হাসির লিরিক--

আমরা কখনো কত কিছু ই বুঝে উঠতে পারিনি এত অহং জেনেছি ,এত আত্মতৃপ্ত উদাসীন কাটিয়েছি দিন...কেন এত ভালো লাগা ছিল বলো--এত এত মাধবীলতার ঘুম...

যেতে যেতে রেখে যাচ্ছি শেকড়ে জমে থাকা মাটি রেখে যাচ্ছি অঞ্জলিপুটে ধরে থাকা সেই সব স্নেহ-অশ্রুজল

বিরহ-বাতাস ঠিক ডাক দেবে তোমায় বিরহ-বাতাসে দেখো আবীর লেগে ছিল --হলুদ ,সবুজ...রাধা মাধবের হাসি...

এইসব তুচ্ছাতি তুচ্ছ জমে থাকা জীবনের পাশে কে যে এসে বসে !কেউ কি বসেছিল নাকি ?কেউ কি খুঁজে পেয়েছিল সেই সব ঔদাসীন্যের মানে ?




ভোর

মুখর হয়েছে সময়
আর মৌন হয়েছে
বেদনার কথাগুলি ।
দ্যাখো একটা নিবিড়
ভোর নেমে আসে ,
অসম্ভব প্রশান্তি মাখা...
চলো তার কাছে গিয়ে বসি ।
মধু লিখি আমাদের
যাবতীয় ক্ষতে...
দ্যাখো ,শিউলি ফুটে উঠছে
একটা দুটো ।চলো
ওদিকেই যাই ,গিয়ে বসি
চায়ের দোকান--ধোঁয়া...

ভোর তোমাকে সুন্দর হতে বলে ,
আরো মগ্নতা দিতে চায়
ওই দুই চোখে...এসো
আমরা নিজেদের মতো বাঁচি...

ছবিঃ মনোজিৎ ভঞ্জদাস 





অমিতাভ উবাচ-১

না , আমি কোনো বানিজ্যিক কাগজে লিখি নি
আমি কোনো বড়ো কবির বাড়ির বাজার করে দিই নি
আমি কোনো কবির সঙ্গে বসে মদটাও খেতে পারি নি
আমি আজো কোনো কবিকে নিয়ে
সংখ্যা করিনি
আমি টিভিতেও কবিতা পড়িনি
পড়িনি রেডিওতেও ,জানিনা
কাকে কতটা তেল
দিলে রেডিও কিংবা টিভিতে কবিতা
পড়া যায় ,বড়ো কাগজে
লেখা যায়...
শুধু এটুকু জানি কেউ কেউ
আমার কবিতা
আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিল...
শুধু এটুকু জানি এক জন্মান্ধ মেয়ে
আমার কবিতার গায়ে
হাত বুলিয়েছিল ,চুম্বন
করেছিল অক্ষরের ওপর
তাই আমার কবিতা অমর হয়ে গেছে...




অমিতাভ উবাচ-২

তোমার সিঁদুরের পাশে
তোমার সিঁদুরের পাশে
রেখে গেলাম
একটা কুকুরের ঝুলে থাকা জিভ ,
একটা সাদা থান আর
একমুঠো কালো ছাই …


তুমি অনন্তকাল
বেঁচে থেকো
কুসুম আমার



ছবিঃ মনোজিৎ ভঞ্জদাস 





অমিতাভ উবাচ-৩

কঠিন সব ঘুমের কথারা
আজ অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
হয়ে উঠেছে...
তুমি যার নাগাল পাবে না ,
তুমি যার চির শত্রু ছিলে...
মায়াবী চন্দন গাছের কাছে
আসেনি তো কেউ প্রতিশ্রুতি মত
কেবল সাপ ,বিষ ঝেরেছিল--
উদ্ধত উদ্বিঘ্ন ফনা...
আজ ঘুম আসতে চাইছে
হে মায়াবী বৃক্ষদেবতা
আমাকে আশ্রয় দেবে কি কখনো ?



অমিতাভ উবাচ-৪

বান্ধবী বললে ,
আপনার ভেতরে
যে ঈশ্বরটা আছে ,
তাকে একটু বাইরে
বের করুন ।একটু
ঘুরে আসুক ।বলুন
জগিং করে আসতে ।
বসে বসে হাতে-পায়ে
খিল ধরে গেছে...
ঠিক ই বলেছে সে ।
চৈতন্যপ্রদেশে এখন
মেঘ ডেকেছে ।বৃষ্টি
নামতে পারে ।এই
জীবনে শুদ্ধ উচ্চারণ
জেগে উঠছে ।জেগে
উঠছে আফিমের
নেশায় আসক্ত আমার
দুর্বল ,ভ্রান্ত ঈশ্বর--
যাঁর হাতে কোনো
ক্ষমতা নেই ।ক্ষমতা
ছিল না কখনো...
সে একটা হিপোক্রেট
লিবিডো তাড়িত
অহং-পূর্ণ ঈশ্বর...

অমিতাভ উবাচ-৫

সেই সব তুচ্ছতা...
সেই সব মুগ্ধতা...
সেই সব দাহ...
সেই সব হিম...
তুমি তো এখন
সুন্দর হয়েছো
শ্মশানের মত
চুপ হয়ে গেছ...


অমিতাভ উবাচ-৬

আজো ভিজতে ভিজতে
সেই মরু শহরের দিকে গেলাম--
আজো কুকুর ডেকে চলেছে
আজো আকাশে ছিন্ন ছিন্ন কালো মেঘ...
যদি একটাও ঠিকঠাক
অনুবাদ করতে পারতাম--
সেই সব কথামেঘ ,বৃষ্টিবিন্দু
ল্যাপটপে লেগে থাকা ঘাম...
স্মৃতি তাহলে কাব্য হতে চায় ,
ক্ষণজন্মা শোক ।আমার
এইসব বিলাসী মেদুর যাপন
কবে লিখেছিলাম পতঙ্গ-কথা--
লিরিকের এলোমেলো ছায়া...
স্পর্শ-বাতাস থেকে
কেবলই রূপ জেগে ওঠে...
কেবলই অহং-এর জন্ম হয়...



ছবিঃ মনোজিৎ ভঞ্জদাস 




মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
ধন্যবাদ অপূর্ব বাবু। আপনার কাছ থেকে আরো মন্তব্য প্রত্যাশা করি। ভালো থাকুন। অমিতাভ দাসের কবিতাগুলি সত্যিই অনবদ্য।