‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি’
দেবশ্রী
ভট্টাচার্য
কবিতা নিয়ে
লালন মন কী ভাবছে? কবিতা হল আদি সাহিত্য কর্ম। ভাষা ও লিপি আবিষ্কারের পর যখন মানুষ প্রথম নিজের মনের ভাবকে
সাহিত্যের আকারে প্রকাশ করা শুরু করল, তার মাধ্যম ছিল কাব্য বা কবিতা।এখনও যে কোন বড়, মেজো, ছোট সাহিত্যিকের সাহিত্যজগতে হাতে খড়ি হয় কবিতার মাধ্যমে। মানে ঐ ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি’, টাইপের কবিতা। যাকে
ছড়া বলা হয়-কবিতার বাল্যরূপ।বাংলা সাহিত্যজগতে আমার অবস্থান জীবাণুর চেয়েও নিচে।অনুবীক্ষন যন্ত্রের সাহায্যেও চোখে পড়ে না। তবু এই অধমেরও কাগজের ওপর আঁকিবুঁকি কাটা শুরু হয়েছিল ছড়ার
মাধ্যমে। শব্দের
সাথে শব্দ মিলিয়ে অন্তমিল রেখে, আপ্রাণ চেষ্টায় ছন্দ বজায় রেখে কিছু
একটা লেখা –এটাই ছিল আমার অবসরের সাহিত্য চর্চা।
তখন আমার
বয়স ছিল দশ। আমার বাবা সরোদ বাজাতেন
এবং সেই সুত্রে বাড়িতে গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী আসতো। আমি ছিলাম তাদের কড়া মনিটর। ওটাই ছিল আমার প্রিয় খেলা। সেইসব দাদা-দিদিদের আদরে প্রশ্রয়ে
খেলাটা বেশ ভালোই জমতো। একবার
গৌতমদা বলে বাবার এক ছাত্র বেশ কয়েক দিন ধরে কামাই করলো। প্রায় মাস খানেক পর সে যখন এল, তখন প্রথমেই তাকে আমার সামনে পড়তে হল। কড়া গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম – এতদিন কামাই কেন? চিঠি নিয়ে এসেছ? তখন স্কুলে একদিন দুদিন কামাই করলেই ক্লাস টিচার গার্জেনের চিঠি চাইতেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে গৌতম দা বলল , আর বোল না দিদিমণি, বইমেলায় স্টল দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন। বইমেলায় যারা স্টল দেয় ,তারা তো স্বপ্নের ফেরিওলা। কত নতুন নতুন বই। চকচকে
মলাট,
সুন্দর গন্ধ।সারাদিন বইয়ের মধ্যে
বসে থাকা!
পড়ার বই নয়, গল্পের বই।
গৌতম দা
নিজেই ছড়া লিখত, নিজেই ছাপাতো, নিজেই
বিক্রি করতো। নাম ছিল ‘ঝিলিমিল’। আমি ঝুলে
পড়লাম গৌতম দার পিছনে। আমিও ছড়া লিখবো।কী করে লিখতে হয়? গৌতম দা বলল লেগে পড় দিদিমণি,
সামনের বার তোমার আমার একসাথে ছড়ার বই বার করবো। আনন্দে উত্তেজনায় আমার তো মাটিতে আর পা-ই পরে না।নাই বা হল চকচকে
মলাট,
নাই বা থাকল সুন্দর গন্ধ। ফিনফিনে হলুদ কাগজের ওপর কালো কালো গোটা গোটা অক্ষরে ছাপা। কাগজের মধ্যে বোটকা গন্ধ। তাতে কী! তবু তো ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখবো!
সেটাই বা কম কিসে!সেদিন পাড়ার মোড়ে মিষ্টির
দোকানে দাঁড়িয়ে আমার প্রথম সাহিত্য কীর্তি রচিত হল –
“রসগোল্লা রসগোল্লা তুমি কী মিষ্টি ,
ছানা আর চিনি দিয়ে
তোমার যে সৃষ্টি”।
তারপর দিন গড়াতে থাকে। উঠতে বসতে শুতে জাগতে তখন ছড়া লেখা হছে। সাতদিনে একটা দিস্তা খাতা শেষ।তবে আমার দুর্ভাগ্য আমার সেসব ছড়া আর বইমেলার মুখ দেখল না। মাস খানেক পর কী এক সাঙ্ঘাতিক জন্ডিসে গৌতম দা মারা গেল।
কিন্তু ছড়ার
ভূত তো তখন মাথায় গেঁড়ে বসেছে। স্কুলের
টিচার,
বন্ধুরা, আকা্শ,
বাতা্স, গাছপালা-
কেউ আমার ছড়ার আক্রমণ থেকে রেহাই পেল না। ছড়া লেখার আদর্শ সময় হল অঙ্কের ক্লাস। শিক্ষিকা যা বোঝাতেন আমার মাথার ওপর দিয়ে সাঁ করে এরোপ্লেনের
মতো চলে যেত।ধরেই নিয়েছিলাম ঐ বিষয়ে আমার লাল কালি বাঁধা, সুতরাং ওটি নিয়ে আমি বিশেষ চর্চা করতাম না। শুকনো মুখে অঙ্ক করার চেয়ে ছড়া লেখা অনেক ভালো ছিল বলে আমার
মনে হয়েছিল। ছোট ছিলাম তো বুঝতে
পারি নি এর পরিণাম কী হতে পারে! বুঝলাম যেদিন ধরা পড়লাম।গার্জেন কল করা হল। আমার
বাবাকে সবার সামনে অপমান করা হল। শিক্ষিকা
বললেন,
অঙ্কের খাতায় ছড়া লিখছে –এই মেয়ের জীবন তো
অন্ধকার!ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। তবে যে ছড়াটা লেখায় এত বকুনি জুটল, সেই ছড়াটা মাস দুয়েক পর আনন্দ বাজারের রবিবারের পাতায় বেরোল -
“কুচুর মুচুর ভেলপুরি,
কপিল দেবের সেঞ্চুরি।
তেড়ে মেড়ে তক্কা,
তেন্দুলকারের ছক্কা”।
বড় হতে
লাগলাম, আমার সাথে আমার ছড়াগুলোও বড় হতে হতে কবিতার আকার নিল। তবে সেই কবিতা প্রথম ধাক্কা খেল যেদিন কলেজে প্রথম দিন পি এস
বি-র অনার্সের ক্লাস করলাম। ছন্দ, অলঙ্কার , তাদের কত নাম, কত গতি প্রকৃতি – আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কবিতার পেলব চামড়ার নিচে যে ছন্দ অলঙ্কারের এমন শক্ত কঙ্কাল
ছিল তা জানা ছিল না।আমার সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কবিতা এসব নিয়মের
বেড়াজালে পথ হারিয়ে ফেলল।তার ওপর এক কবি বন্ধুর কাছে শুনলাম প্রেমে
না পড়লে নাকি কবিতা লেখা যায় না।এখন কবিতা লেখার
জন্য প্রেমিক জোটাই কোত্থেকে?
তা প্রেমিক
আমার জুটল, বিয়ের পর। কিন্তু দুঃখের বিষয় কবিতা আর এল না। কবিতা লেখার খাতাটা বারবার শূন্যই থেকে গেল। তারপর ছেলে হল। আমার
কবিতা লেখার খতায় তার অপটু হাতের এ বি সি ডি লেখা শুরু হল। কবিতা আমার একেবারেই সমাধিস্থ লাভ হল। তবে ভাবনা গুলো মরল না। ডালপালা মেলে গদ্যের আকার নিল। ব্যস্তারপর থেকে ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি’। আমার জীবন শুধুই গদ্যময়।
![]() |
ছবিঃ মনোজিৎ ভঞ্জসাহা |
মন্তব্যসমূহ